হাতটা রেখো বাড়িয়ে -Part 11+12

0
250

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-11+12
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
রাত গভীর। আশেপাশে সবকয়টা বাড়ির বাতি নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। বাইরের ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ধারার ভীষণ অস্থির বোধ হচ্ছে। বিকেলে সেই যে শুদ্ধ ধারাকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে এনে রেখে গেছে আর তার কোন পাত্তা নেই। এমনকি ফেরার সময় পুরো রাস্তায় ধারার সাথে কোন ধরণের কোন কথাও বলেনি সে। সারাটা পথ গম্ভীর হয়েই থেকেছে। এত রাত হয়ে গেল, মানুষটা এখনো বাড়ি ফিরে এলো না যে! খোদেজা আর চুমকিও রুমের বাতি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা একবার ভাবলো শ্বাশুড়িকে ডেকে তুলেই না হয় বলা যাক কথাটা। ভাবা মতো কাজ করবার জন্য অগ্রসর হতেই ধারা কাঠের সিঁড়িতে ঠকঠক পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। দ্রুত গতিতে রুমে প্রবেশ করেই শুদ্ধ ধারার কাছে এসে কোন ভালো মন্দ না বলেই সরাসরি বলে উঠলো, ‘ধারা, আপনি কোথায় ভর্তি হবেন না হবেন কিছু ঠিক করেছেন?’
ধারা সংকুচিত হয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘বাবা তো কিছু বলেনি আমি আর পড়বো কিনা?’
‘এখানে আপনার বাবার বলার কি আছে? আপনি পড়তে চান কি চান না সেটা বলুন।’
ধারা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। শুদ্ধ আশাহত হয়ে বিরক্তি মাখা গলায় বলল,
‘ধারা, এইসব কি আমাকে একটু বোঝাতে পারেন। আপনার কোন ধারণা আছে আপনি নিজের সাথে কি করছেন! আপনার কান্ডকারখানা দেখে আমি জাস্ট শকড হয়ে থাকি। আপনাকে যে যা বলে আপনি তাই করেন। আপনার নিজের কোন আলাদা চিন্তা ভাবনা নেই, নিজের কোন ইচ্ছা নেই, নিজের কোন সিদ্ধান্তও নেই। সামনের জন উঠতে বললে উঠেন আর বসতে বললে বসেন। আপনি একটা পসেসড বডির মতো হয়ে আছেন। শরীরটা তো আপনারই। কিন্তু এর ভেতরকার ইচ্ছা, ভাবনা, চালনাশক্তি সব অন্যদের হাতে। আপনি সবাইকে এতো কেন ভয় পান ধারা? তারা তো আপনার আপনজনই। কোন ভুল হলে হয়তো আপনার উপর রাগ করবে, বকা দিবে। মেরে তো আর ফেলবে না! আপনি কেন এতো আতংকিত হয়ে নিজের সবকিছু অন্যদের উপর ছেড়ে দেন!’
ধারা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে শুদ্ধ’র এই প্রশ্নবিদ্ধ নজর থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। যেই প্রশ্নের আদৌও কোন সুস্পষ্ট উত্তর ধারার কাছে নেই। নিজের নজরকে লুকাতেই আশেপাশে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ধারা বারবার ডান হাত দিয়ে কপালের কার্ণিশটা ঘষতে লাগলো। শুদ্ধ এই ব্যাপারটা আগেও অনেকবার লক্ষ করেছে। ধারা যখনই অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে যায় সে তার হাত দিয়ে কপালের কার্ণিশ ঘষতে থাকে। শুদ্ধ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম স্বরে বলল,
‘ধারা, এভাবে নিচে তাকিয়ে থাকবেন না। তাকান আমার দিকে। তাকান বলছি!’
ধারা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে তাকালো শুদ্ধ’র দিকে। শুদ্ধ দু হাত দিয়ে ধারার বাহু ধরে বলতে লাগলো, ‘আপনার কোন ধারণাও নেই ধারা, আপনি নিজেই নিজের সাথে কত বড় অন্যায় করছেন! এভাবে শুধু সবার কথা মেনে চললে আপনার নিজের বলে কোন ব্যক্তিত্ব থাকবে না। আপনি জানেন, আপনার যে নিজের বলে কোন সত্তা নেই! কোন অস্তিত্ব নেই! আপনার দিকে তাকালে শুধু অনেকগুলো মানুষের ছায়া দেখতে পাই। পাই না শুধু একটা ‘আমি’কে দেখতে, একটা ধারাকে দেখতে। আপনি কোথায় ধারা? কোথায় আপনি? আমি আপনাকে দেখতে চাই। একটা ধারাকে দেখতে চাই।’
ধারার চোখ থেকে টপ করে একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো। শুদ্ধ সেই জল হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, ‘কাঁদবেন না ধারা। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি পাশ করুন বা ফেল করুন, ভালো করুন, খারাপ করুন আমি সবসময় আপনার সাথে আছি। সবসময়!’
ধারা কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন ভাবে কখনো তো কেউ বলেনি তাকে! সবাই শুধু তার থেকে তার সেরাটাই চেয়েছে। এর থেকে কম সব অগ্রহণযোগ্য।
কিছুক্ষণ পর ধারা একটু স্বাভাবিক হলে শুদ্ধ বলল,
‘আচ্ছা ধারা, আপনার রেজাল্ট তো মোটামুটি ভালোই ছিল। একটুর জন্যই এ প্লাস মিস হয়েছে। সাইন্সের সাবজেক্টগুলোতেই কম মার্ক পেয়েছেন আপনি। আপনি বেশি ভালো পারেন কোন সাবজেক্টগুলো?’
‘আমি বেশি ভালো পারি বাংলা। বাংলার গল্প, কবিতাগুলো আমার খুব ভালো লাগে। ইংরেজিও ভালো পারি। সাইন্সের সাবজেক্টগুলোও মোটামুটি পারি কিন্তু ওগুলো আমার পড়তে ভালো লাগে না।’
‘হুম বুঝেছি। ধারা, আমার কথাটা এবার মনোযোগ দিয়ে শুনুন, আমি এতক্ষণ আপনাকে নিয়েই ভেবেছি। সব খোঁজ খবর নিয়েছি। আপনি একটা কাজ কেন করেন না! আপনি এডমিশন টেস্ট দিন।’
ধারা ঝট করে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এডমিশন টেস্ট মানে? ইউনিভার্সিটিতে?’
‘হুম।’
ধারার কথাটা হজম হলো না। ধারা গ্রামের মেয়ে। ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞানও নেই তার। শুধু জানে এটা খুব একটা বড় কিছু। অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন সেখানে পড়তে হলে। দেশের সেরাদের সাথে লড়াই করতে হয়। ধারা সাধারণ মেয়ে হয়ে এতো কিভাবে পারবে? সম্ভবই না!
ধারা ভড়কে যাওয়া গলায় বলল,
‘কি বলেন! আমি কি পারবো নাকি!’
‘অসম্ভবের মতো তো কিছু বলিনি। আর আমি তো বলছি না আপনি দিলেই পারবেন। কিন্তু একটা চেষ্টা তো করা যেতে পারে। আমি এ নিয়ে অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কুলার বের হয়ে ফরম ফিল আপও হয়ে গেছে। শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এটারও এতো দিনে হয়ে যাবার কথাই ছিল কিন্তু এই বছর এমন রাজনৈতিক গোলযোগের জন্য ঢাকায় ঝামেলা হওয়ায় এটার ফরম ফিল আপ স্থগিত করে রাখা হয়েছিল। আর মাত্র কয়দিনই এখন বাকি আছে এটার লাস্ট ডেটের। আপনি এখানেই দিবেন। এখানে অনেকগুলো ইউনিট। পরবর্তীতে যেন বাংলা সাবজেক্টটা পাওয়া যায় এরকম একটা ইউনিটে দিবেন।’
‘বাংলা সাবজেক্ট! সাইন্সের কোন সাবজেক্ট নেই?’
‘আছে। কিন্তু আপনিই তো বললেন আপনার সাইন্সের সাবজেক্ট ভালো লাগে না। আর যেটা ভালো লাগে না সেটা পড়ে কখনোই ভালো কিছু করতে পারবেন না। বাংলা আপনার ভালো লাগে যেহেতু বাংলা নিয়ে পড়বেন, ভালো রেজাল্টও করতে পারবেন।’
‘বাবা আর কাকা কখনোই রাজী হবে না। তারা তো সাইন্স ছাড়া অন্য কিছু শুনতেই পারে না। আর্টসের কিছু শুনলেই নাক সিটকায়।’
‘ধারা, সাইন্স, কমার্স, আর্টস কোনটাই কোন থেকে ফেলনা কিছু না। কিছু মানুষ জাস্ট এগুলোর মধ্যে একটা সস্তা, দামীর মাত্রা টেনে রেখেছে। পৃথিবীর সবাইকেই তো আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না। সবকিছুরই প্রয়োজন সমাজের আছে। পৃথিবীর অন্য দেশ গুলোতে গিয়ে দেখুন সাবজেক্ট নিয়ে ওখানে এমন বদ্ধ ধারণা নেই। বাড়াবাড়িও নেই। যার যেটায় ইন্টারেস্ট, পছন্দ, সে সেটা নিচ্ছে। আমাদের দেশেই শুধু কিছু মূর্খ জাতির দল এইভাবে কমার্স, আর্টসকে তাদের চিন্তা দিয়ে নগন্য বানিয়ে রেখেছে। আপনি বাংলা অথবা যদি মানবিক বিভাগের অন্য কোন সাবজেক্ট পান সেটা পড়েও ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবেন। শুধু সেটাই করুন যেটা আপনার ভালো লাগে।’
ধারা কিছুই বললো না। বিভ্রান্ত বোধ করতে লাগলো। ধারাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুদ্ধ ধারার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ধারা, এতো ভয় পাবেন না। আপনার বাবা আর কাকা নাকি আপনার এ প্লাসই নিশ্চিত করবার জন্য এক বছর গ্যাপ দিয়ে আপনাকে ফার্সট ইয়ারেরই দুই বছর রেখেছিল? একটা স্টুডেন্ট হিসেবেও কি আপনি বুঝেননি এক একটা বছরের কতটা গুরুত্ব! তখনও কি আপনার কিছু বেঠিক মনে হয়নি ধারা।
একবার তো একটু নিজের মনের মতো করে দেখুন, সব ভালোই হবে। নিজেকে এতো ছোট মনে করবেন না ধারা। চেষ্টা করতে তো কোন অসুবিধা নেই। হয়তো আপনিও পারবেন। এতো বড় ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারবেন। তখন দেখবেন আপনার বাবাও আপনার উপর প্রাউড ফিল করবে। আমার একটা বন্ধু আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইউনিভার্সিটিতে থার্ড, ফোর্থ ইয়ারে থাকাকালীন ও এডমিশন কোচিংয়ের কিছু ক্লাস করাতো। এখন অবশ্য একটা অনলাইন বিজনেসের পাশাপাশি একটা জবের প্রিপারেশন নিচ্ছে। এখন আমাদের শহরেরই আছে। ওকে আমি বলবো আপনাকে পড়াতে। আর তাছাড়া আমি তো আছিই। আপনার যা সাহায্য লাগে আমি করবো। আমি পাশে আছি। শুধু নিজের উপর আপনি একটু বিশ্বাস রাখুন ধারা।’
ধারার কাঁধে হাত রেখে শুদ্ধ পরম ভরসা মাখা গলায় বলল, ‘আমরা একটা চেষ্টা করি ধারা? বলুন ধারা, করবেন তো!’
ধারা দ্বিধান্বিত চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো।
__________________________________________
ভোর হতে না হতেই শুদ্ধ ধারাকে ডেকে তুললো। বাইরে তখনও অন্ধকার। ভোরের আলোও ঠিকমতো ফুটেনি। ধারাকে বেশ কয়েকবার ডাকতে হলো শুদ্ধকে। পিটপিট করে হালকা চোখের পাপড়ি খুলতেই ধারা দেখলো শুদ্ধ তাকে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। ধারাকে চোখ মেলতে দেখেই শুদ্ধ প্রসন্ন মুখে বলে উঠলো,
‘ধারা উঠুন, পড়তে বসবেন না?’
ধারা চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে বলল,
‘এতো সকালে! এখনও তো দেখি সকালও হয়নি ঠিক মতো।’
‘আমাদের হাতে তো খুব বেশি সময় নেই। মাত্র দুই মাসের মতন আছে। আমরা এমনিতেও পিছিয়ে আছি।’
শুদ্ধ এমন ভাবে ‘আমরা’ ‘আমরা’ বলতে লাগলো যেন শুধু ধারা না ধারার সাথে সেও পরীক্ষা দেবে। তারই প্রস্তুতি শুরু করবে এখন দুজন। ধারা নিচে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসলো। তার ঘুম এখনও কাটেনি। বারবার হাই তুলে তারই জানান দিচ্ছে সে। ধারা ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলল,
‘আজকে না হয় থাক! গতকালই তো মাত্র ঠিক করলাম এডমিশন দেবো। কালকে থেকে একদম ধুমছে পড়বো। আজকে এখন একটু ঘুমিয়ে থাকি।’
‘জ্বি না। আজকে থেকেই আমরা পড়া শুরু করবো। এখন থেকেই করবো। এভাবে কালকে কালকে করতে থাকলে সেই ‘কাল’ আর কোনদিনও আসবে না।’
‘আমি পড়বো যে, কি দেখে পড়বো? বই কি এখনও কেনা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’
‘আপনি বই কিনলেন কখন? এতো সকালেই দোকান খুলে ফেলেছিল?’
‘আমি কালকে রাতেই বই কিনে এনেছিলাম। তারপরই আপনার সাথে কথা বলেছি।’
‘তার মানে আপনি আগে থেকেই বুঝেছিলেন আমি রাজী হয়ে যাবো।’
ঠোঁট চেঁপে হেসে শুদ্ধ ধারার গাল টেনে বলল,
‘হ্যাঁ, বুঝেছিলাম। কারণ আপনি যে আমার লক্ষ্মী বউ।’
এভাবে বাচ্চাদের মতো গাল টেনে দেওয়ায় ধারা হতবাক হয়ে গেলো। শুদ্ধ তাড়া দিয়ে বলল,
‘নিন, পড়া শুরু করুন। আমি আমার বন্ধুর থেকে কিছু ইম্পর্টেন্ট টপিক দাগিয়ে এনেছি। সেখান থেকেই শুরু করুন।’
ধারা সাধারণ জ্ঞানের একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করলো। আর শুদ্ধ আরেকটা বই নিয়ে পড়া কম করার জন্য শুধু ইম্পর্টেন্টগুলো দাগিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কিছু একটা ধারাকে বোঝানোর জন্য সামনে তাকাতেই দেখে ধারা বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমে বেহুঁশ। আবারও তাকে ডেকে তুলে পড়তে বসালো শুদ্ধ। কিছুক্ষণ পড়ার পর আবারও একটু পরপরই ঘুমে ঝিমাতে লাগলো ধারা। আর তাকে ডেকে তুলতে তুলতে ক্লান্ত হলো শুদ্ধ। তবুও সেই একই অবস্থা। পরীক্ষার পর রেজাল্ট অব্দি দীর্ঘসময় আর কিছু পড়া হয়নি বলে সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস এমনিতেই পেয়ে বসেছে ধারাকে। তার উপর তার যেই গাঢ় ঘুম! রাতে একবার ঘুমালে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেও বোধহয় টের পাবে না। এই মেয়েকে কিভাবে শুদ্ধ সকালে উঠিয়ে পড়াবে তা ভেবেই মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো শুদ্ধ। ধারা তখন আবারও মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। কিছুসময় এভাবেই পার হবার পর হঠাৎ শুদ্ধ চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ধারা, আপনার বাবা এসেছে।’
ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়লো ধারা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যখন বুঝলো এটা শুদ্ধ’র মজা ছাড়া আর কিছু না তখন সরু চোখে তাকালো শুদ্ধ’র দিকে। শুদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আমার শ্বশুর মশাইটাকে আমি এই মুহুর্তে অনেক মিস করছি। এই মুহুর্তে একমাত্র তিনি থাকলেই হয়তো আপনার ঘুম তাড়াতে পারতো।’
ধারা সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে হাই তুলতে লাগলো। শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর সদ্য কল থেকে আনা এক জগ ঠান্ডা পানি নিয়ে ফিরে এলো সে। বিছানার পাশে টেবিলে রেখে আবারও ধারার একটা বই নিয়ে বসলো। জগের দিকে তাকিয়ে ধারা বলল,
‘শুধু শুধু এক জগ পানি আনতে গেলেন কেন? এতো সকাল সকাল কি আর এতো পানির পিপাসা পাবে!’
শুদ্ধ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘পানি খাবার জন্য আনিনি?’
‘তাহলে?’
‘এরপর থেকে আপনি যতবার ঝিমাবেন ততবার আপনার মাথায় পানি ঢালা হবে, সেই জন্য এনেছি।’
শুদ্ধ’র কথা শুনে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো ধারার। কি বলে লোকটা!
চলবে,#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়লো বাইরের তুমুল বর্ষণ। টিনের চালের বৃষ্টির অপূর্ব ঝমঝম শব্দ কানে শ্রুতিমধুর আবেশ সৃষ্টি করে। ঘুমু ঘুমু চোখে বারান্দার বৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ধারা একবার চোখ বুলালো ফাঁকা রুমটিতে। শুদ্ধকে দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে তো আজকাল পড়া শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই ধারাকে উঠিয়ে দেয়। আজ হঠাৎ ব্যতিক্রম হলো কেন? ধারা একটা হাই তুলে উঠে বসলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো আসলেই অনেক বেলা হয়ে গেছে। বাইরে বৃষ্টি বলে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। দেরি হয়ে গেছে বুঝতে পেরেও ধারার মধ্যে তাড়াহুড়োর কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি দেখা প্রকৃতির একটা সুন্দর সারপ্রাইজ। চারপাশটা কেমন যেন হিমেল আবরণে জড়িয়ে আছে। ধারা গায়ের পাতলা কাঁথাটা টেনে পা থেকে গলা পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়িয়ে রাখলো। এভাবে ঘুমু ঘুমু ভাবটা নিয়ে হালকা উষ্ণতাটা ধারার ভালো লাগছে। এভাবেই আপাদমস্তক কাঁথায় পেঁচিয়ে ধারা হাঁটুতে মুখ ভার দিয়ে রেখে বারান্দায় তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ পৃথিবীর সেরা শ্রুতিমধুর শব্দগুলোর একটি। এতদিন নিজেদের পাকা দালানে বসে বসে এই শ্রুতিমধুর ধ্বনি থেকে ধারা বঞ্চিত ছিল। আহ! কি সুন্দর!
তার এই সুন্দর মুহুর্তে ব্যাঘাত ঘটালো ফোনের কর্কশ রিংটোন। তার ছোট কাকী রুনা ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে অনেক কথাই হলো তার সাথে। ধারার বিয়েতে উপস্থিত না থাকতে পারায় রুনা ভীষণ দুঃখ প্রকাশ করলো। কাকীর সাথে কথা শেষ হলে ধারা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কুঁচকানো জামা কাপড় হাত দিয়ে ঠিক করে এলোমেলো চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে নিল সে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধারা নিচে নেমে দেখলো খোদেজা বারান্দায় টিনের ফুটো দিয়ে টুপটুপ করে পড়া বৃষ্টির পানির জায়গায় জায়গায় মগ, পাতিল, ছোট ছোট বাটি পেতে রাখছে। বড় বড় বালতিগুলো সব বাইরে পাতা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য। মাঝের চৌকিতে চুমকি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শুদ্ধ একটা মোড়ার উপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছে। খোদেজা মগ, বাটিগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় রাখতে রাখতে বলল,
‘সেই রাইত থিকা বৃষ্টি নামছে। তবুও এতক্ষণে একটু জোরও কমে নাই। আজকে মনে হয় সারাদিনই বৃষ্টি থাকবো রে মাহতাব। ঘর দুয়ার বৃষ্টিতে সব ভাইসা যাইবো মনে হইতাছে।’
শুদ্ধ ল্যাপটপের থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল,
‘ভেসে গেলে যাবে আম্মা। আমরা একটা কলা গাছের ভেলা বানিয়ে ভাসতে ভাসতে ঘুরবো।’
খোদেজা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ফাইজলামো করিস না তো!’
মায়ের দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ হাসতে লাগলো। স্বভাবতই তার গাল ডেবে গেলো। প্রতিবারের মতোই একটা ধাক্কা খেলো ধারা। ছেলেদের গালের টোলও যে এতো সুন্দর হয় তা শুদ্ধকে না দেখলে বোঝা সম্ভব না। কাঁঠের সিঁড়িতে ধারাকে ওমন থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খোদেজা বলল, ‘বউ, ওইখানে দাঁড়ায় আছো কেন? আসো, নিচে আসো।’
ধারা নিচে নেমে এলে খোদেজা বলল,
‘তুমি তো মনে হয় এখনও মুখ ধোও নাই না? এই বৃষ্টির ভিতরে আর কলপাড়ে যাবা কেমনে! একটা কাজ করো দরজার সামনে পাতা বালতি থিকাই বৃষ্টির পানি দিয়া মুখ ধুইয়া ফেলো। খোদেজার কথা মতোই করলো ধারা। টুথ ব্রাশ নিয়ে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করে ধারা মগ দিয়ে বালতি থেকে পানি তুলে মুখ ধুয়ে নিল। বাইরে বৃষ্টির যা তেজ! পায়ের কাছটায় বৃষ্টির ছাটে ভিজে আসলো ধারার। ফিরে এসে দেখলো শুদ্ধ’র নজর এখনো ল্যাপটপেই। আজ ইচ্ছে করেই ধারাকে এতো বেলা করে ঘুমাতে দিয়েছে শুদ্ধ। গতকাল অনেক রাত পর্যন্তই পড়েছে ধারা। তাই আজ এই বৃষ্টির দিনে একটু ছাড় না হয় দেওয়াই যাক! খোদেজা চৌকির কাছ দিয়ে যাবার সময় চুমকির গায়ের কাঁথা টেনে বলল,
‘ঐ মাইয়া, উঠ! আর কত ঘুমাবি? তাড়াতাড়ি উঠ।’
চুমকি একবার চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে খোদেজা চলে যাবার পর আবারো কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে পড়লো। শুদ্ধ বলল,
‘আম্মা কিছু খেতে দাও। খিদে লাগছে তো! গরম গরম ভাত দাও।’
খোদেজা বলল, ‘এই বৃষ্টির মধ্যে আমি গরম গরম ভাত পাবো কই? গতাকালের দোকান থেকে আনা পাউরুটি আর কলা আছে। তোমরা সবাই তা দিয়াই কাজ সাইরা নাও বাপু। আমার পান্তা ভাতেই হবে।’
এই বলে খোদেজা পাউরুটি আর কলা বের করে ধারা আর শুদ্ধকে দিলো। চুমকিরটা রেখে দিলো পরে উঠে খাবে বলে। শুদ্ধ পাউরুটিতে কামড় বসাতে বসাতে তার মাকে বলল, ‘আম্মা, তুমিও একটা পাউরুটি খেয়ে নাও। পান্তা ভাত খাওয়া লাগবে না।’
‘তা না হয় খাইলাম একটা। দুপুরে কি খাবি? আজকে তো চুলায় রান্না করা যাইবো না কোনমতেই। রসুইঘরের চালা একদিকে কাইত হইয়া বৃষ্টির পানি সব ঢুকতাছে। মাটির চুলা ভিজ্জা রইছে। আগুন ধরবো না। তোরে কয়বার বলছিলাম রসুইঘরের চালটা আগে ঠিক কইরা নে। কবে বৃষ্টিতে ভাইঙ্গা পড়ে! দেখলি তো, আমার কথাই সত্যি হইলো। এদিকে সিলিন্ডারের গ্যাসও শেষ। ঘরের মধ্যে যে রান্না করবো তারও উপায় নাই। এখন বল, কি হইবো?’
শুদ্ধ মোড়া থেকে পা নামিয়ে বলল, ‘আচ্ছা বেশ! দোষটা যেহেতু আমারই। আজকের রান্নাটাও আমিই করবো।’
‘করবি টা কেমনে?’
‘তোমার না একটা আলগা ছোট মাটির চুলা আছে আম্মা! গতবছর চুমকি বায়না ধরায় বানিয়ে দিয়েছিলে। ঐটা তো চুমকি ঘরের মধ্যেই রেখে দিয়েছিল। ঐটা বের করো।’
‘কি জানি বাপু! আমি বুঝি না তোর কাজ কারবার।’
‘আহা আম্মা! তুমি বের করো তো। তারপর দেখো আমি কি করি। শর্টকাটে আজকে আমি খিচুড়ি রান্না করবো। সাথে ডিমভাজা। বৃষ্টির মধ্যে খিচুড়ি ডিম ভাজা দারুণ হবে।’
খোদেজা চৌকির তলা থেকে মাটির আলগা চুলাটা বের করে আনতে গেলো। ধারা এতক্ষণে জিজ্ঞাসা করলো,
‘আপনি রান্নাও করতে পারেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি বলেন!’
‘এতো অবাক হবার কি আছে?খাওয়াটা কি শুধু মেয়েদের কাজ? ছেলেরা কি খায় না? তাহলে তারা রান্না করতে পারবে না কেন? মেসে থাকতে তো আমার রান্না আমিই করে খেতাম। আজকে আমার রান্না খেয়ে দেখবেন। মনে হয় না অতোটাও খারাপ রান্না করি।’
ধারা সত্যিই অবাক হয়েছিল। গ্রামে তো সে এতদিন এই দেখে এসেছে। ছেলেরা রান্না করা তো দূর! রান্নাঘরের নাম থেকেও একশ মাইল দূরে থাকে। নিজেদের বাড়িতেও তো এতদিন এমনটাই দেখে এসেছে ধারা। মেয়েলি কাজে হাত লাগানো নাকি পুরুষদের জন্য শোভা পায় না। আজকে শুদ্ধ’র মুখে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী কথা শুনে অবাক না হয়ে ধারা কিভাবে পারে!
ততক্ষণে খোদেজা চুলা নিয়ে চলে এসেছে। শুদ্ধ’র সামনে রেখে বলল, ‘শুধু এই চুলা দিয়েই কি হবে আমি কিছু বুঝতাছি না কিন্তু। রান্নাঘর থিকা লাকড়ি আনবি কেমনে? এই বৃষ্টির মধ্যে আনতে গেলে তো সবই ভিজা যাবো। আর এই ঘরের মধ্যে তুই চুলা ধরাবিই কেমনে?’
‘ওটা আমি ব্যবস্থা করে নেবো।’
এই বলে শুদ্ধ উঠে বারান্দায় গেলো। একটা বহু পুরনো ভাঙা চেয়ার পড়ে ছিল অনেক আগে থেকেই। সেটাকেই একটা দা দিয়ে কয়েক টুকরো করলো। নিজের রুমে গিয়ে একটা ব্যাগে ভরে পুরনো কাগজপত্র নিয়ে এলো সাথে করে। সেগুলো সহ চুলোটাকে বাতাসের প্রবাহের বিপরীতের বারান্দায় নিয়ে এমনভাবে রাখলো যাতে ধোয়া সব বাইরে চলে যায়। এর জন্য ঘরের দরজাও সম্পূর্ণ খুলে দিল। বাইরে তখন একনাগাড়ে বৃষ্টি ঝড়েই যাচ্ছে। খোদেজা দরজার ধারে গিয়ে বৃষ্টির পানি দিয়েই চাল ডাল ধুয়ে আনলো। ধারা বসে বসে বটি দিয়ে পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিলো। চুমকি ততক্ষণে এমন শোরগোলের আওয়াজ পেয়ে ঘুম ছেড়ে উঠে বসলো। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই উৎফুল্ল হয়ে বিছানা থেকে নেমে আসলো সে। শুদ্ধ’র সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল, ‘মাহতাব ভাই, আজকে কি আমরা চড়ুইভাতি করতাছি?’
শুদ্ধ হেসে বলল, ‘হ্যাঁ রে চুমকি। এটাকে একটা ছোট খাটো চড়ুইভাতি বলাই যায়। কি বলেন ধারা?’
ধারা থতমত খেয়ে উঠলো। শুদ্ধ যে হঠাৎ করে তার নাম উচ্চারণ করবে এটা সে ভাবতে পারেনি। শুদ্ধ বলল, ‘আপনি তো এমনভাবে চমকে গেলেন যেন আমি ভূত দেখার কথা বললাম। বাই দা ওয়ে, আপনি না একদিন বাঁশ ঝাড়ের নিচে কি দেখেছিলেন! আপনার ঐ ভূত বন্ধু এসে আবার দেখা দিয়েছিল?’
খানিক শাসনের চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো ধারা। চুমকি ভূতের কথা শুনে ভয় পেয়ে বলল,
‘বাবা গো! তুমি কি দেখছিলা ভাবী? আমি হইলে তো সেইখানেই অজ্ঞান হইয়া যাইতাম।’
খোদেজা পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘ঐ ছেমড়ি, তুই পরে অজ্ঞান হইস। এখন যাইয়া আগে মুখ ধুইয়া আয়। বইসা বইসা সবার কাছে মুখের গন্ধ ছড়াইতাছে।’
গাল ফুলিয়ে মুখ ধুতে গেল চুমকি। শুদ্ধ মাটির চুলায় কয়েকটা লাকড়ি ঢুকিয়ে কাগজের টুকরো দিয়ে আগুন ধরালো। মুহুর্তের মধ্যে ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলো ঘর। সবাই কাশতে আরম্ভ করে দিলো। খোদেজা কাশতে কাশতে বলল, ‘ঐ মাহতাব, তুই ওঠ। কি যে করতাছোস!’
শুদ্ধ বলল, ‘আম্মা, আমি বলছি না আজকে আমি একা রান্না করবো। কোন লেডিস হাত দিবে না। তোমরা চৌকির উপর পা তুলে বসো তো।’
শুদ্ধ চুলায় সব মশলাপাতি কষিয়ে চাল ডাল দিয়ে দিলো। ধারা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে শুদ্ধ’র রান্না দেখতে লাগলো। মহা আনন্দে চুলার সামনে বসে রইলো চুমকি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার এখনই খেতে ইচ্ছে করছে। বাইরে তখনও ঝড়ছে অবিরাম শ্রাবণ ধারা। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ। ভেজা মাটির গা বেঁয়ে পুকুরের দিকে নেমে যাচ্ছে বৃষ্টির জল। আর ঘরের ভেতর চলছে চারটে মানুষের একটুপর পর হাসি ঠাট্টা। এভাবেই গল্প, হাসি, মজায় একসময় ওদের খিচুড়ি রান্না শেষ হলো। রান্না শেষ হতেই খোদেজা বলল, ‘নে এবার তোরা হাত মুখ ধুয়ে নে। আর যে গোসল করবি কর।’
খোদেজার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই চুমকি এক দৌড়ে বাইরে চলে গেলো। খোদেজা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘কি করতাছোস চুমকি? এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজিস না। ঠান্ডা লাইগা যাইবো। পুকুর থিকা তাড়াতাড়ি কয়টা ডুব দিয়া আইয়া পড়। বৃষ্টিতে ভিজিস না বেশি।’
খোদেজার কথাগুলো বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে গিয়ে তেমনভাবে চুমকির কানে পৌঁছালো না। আর যদিওবা পৌছালো সে তেমন গা করলো না। চুমকি তো তখন মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজছে। শুদ্ধ তার মাকে বলছে, ‘থাক আম্মা। ভিজুক। প্রতিদিন তো আর ভিজে না। মাঝে মাঝে একটু আধটু ভিজলে সমস্যা হয় না।’
খোদেজা তাই চুপ হয়ে গেলো। চুমকি বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় হঠাৎ দৌঁড়ে গিয়ে দরজায় দাঁড়ানো ধারাকে টেনে আনলো বৃষ্টিতে। ধারার সামনে শুদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিল। ধাক্কা লাগায় ধারার সাথে সেও চলে এলো বাইরে। বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ধারার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে!’
ধারা পুরো ভিজে গিয়ে জবুথবু হয়ে বলল, ‘আমি কি ইচ্ছে করে আপনাকে এনেছি নাকি! ধাক্কা লেগেছে। আর আপনিই তো এই মাত্র বললেন, একটু আধটু ভিজলে কিছু হয় না। তাহলে সমস্যা কি?’
শুদ্ধ ভিজে যাওয়া মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ধারা, আপনি কিন্তু চালাক হয়ে যাচ্ছেন।’
ধারা আর চুমকি একে অপরের দিকে তাকিয়ে খানিক ঠোঁট চেঁপে হাসলো। ওরা তিনজন উঠোনে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের ঝরিয়ে দেওয়া আনন্দের উল্লাসে মেতে উঠলো। দৌড়াতে গিয়ে চুমকি কাঁদায় পিছলে পড়ে গেলো। তা দেখে হাসিতে ফেটে পড়লো ধারা শুদ্ধ। খানিকবাদে দরজার কাছে দাঁড়ানো খোদেজাকেও টেনে নিয়ে এলো শুদ্ধ। খোদেজা মিথ্যা রাগের ভাণ ধরে বলল,
‘আরে আরে কি করোস কি? তোরা ভিজ। আমার কি আর সেই সময় আছে!’
শুদ্ধ শুনলো না। মাকে টেনে নিয়ে এলো নিজেদের কাছে বাইরে। পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে আজ মাকেও নিজেদের সাথে বাচ্চা বানিয়ে দিল তারা।
গোসল শেষে দুপুর হলে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে একসাথে খেতে বসলো সবাই। খোদেজা সবার প্লেটেই খিচুড়ি বেড়ে দিল। গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি। তার সাথে ডিম ভাজা। দেখেই যেন সবার পেটে খিদে মোচড় দিয়ে উঠলো। চুমকি হঠাৎ বাঁধ সাধলো। সে হাত দিয়ে খাবে না। তার ভালো লাগছে না। তাকে খাইয়ে দিতে হবে। বিরক্ত হবার ভাণ ধরেও খোদেজা শেষমেশ চুমকির আর্জিতে ধরা দিলো। নিজের প্লেট থেকে খাইয়ে দিতে লাগলো চুমকিকে। চুমকি তো ভীষণ খুশি। শুদ্ধ বলে উঠলো, ‘আম্মা, শুধু কি চুমকিকেই খাইয়ে দিবা? আমাকেও একটু দেখো।’
এই বলে শুদ্ধ মায়ের কাছে গিয়ে মুখ হা করে রইলো। আনন্দের সাথে খাইয়ে দিতে লাগলো খোদেজা। ধারা হাসিমুখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। দৃশ্যটা এতোটাই সুন্দর! ধারাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খোদেজা বলল, ‘বউ, তুমিও হা করো তো! তুমি বাদ যাবা কেন? শ্বাশুড়ি হইছি তাতে কি হইছে! ওরা যেমন তুমিও আমার কাছে ওমনই। নাও হা করো।’
খোদেজা এক নলা ধারার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ধারাও মুখ হা করে খোদেজার হাত দিয়ে খেলো। সবকিছু ভীষণ ভালো লাগতে লাগলো তার। এমন মুহুর্ত সে খুব কমই দেখেছে। তাদের বাড়িতে তো সবাই সবসময় একপ্রকার গম্ভীর হয়েই থাকে। সবকিছু চলে কড়া নিয়মের সাথে। তাদের কাছে ডাইনিং টেবিল আছে। দুপুরে খাবার জন্য দশ আইটেম থাকে। থাকে না শুধু এতো আনন্দ। এতো হাসি ঠাট্টা। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। ঠিক তখনই তার মনে পড়লো তার ছোট কাকী তার বিয়ের ছবি দেখতে চেয়েছিল। সকালেই চেয়েছিল। খাওয়া শেষ করেই সে তার কাছে যেই ছবিগুলো ছিল সেই সব ইমুতে পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু সে কি আর জানতো এই ছবিগুলোই একদিন তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে!
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here