#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।৬।।
প্রথমে ঠিকই ছিল সবকিছু। কিন্তু প্রথম দেখায় নাহিদ তার গাল টিপে দেওয়ার চেষ্টা করতেই কেমন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল জিনিয়ার।
এই প্রথম মনে হলো যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে তো? কোথাও কোনো ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো?
এমনকি মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখতেও ইচ্ছে হলো উদয়টা কি চলে গেছে নাকি দাঁড়িয়ে আছে এখনো!
কিন্তু চিন্তাটা মাথায় আসতেই মাথা থেকে আবার বেরও করে দিলো জিনিয়া। বড় মুখ করে উদয়কে বলেছে, “তুই চলে যা, কিছু হবে না আমার!”
এখন আবার মাথা ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে প্রেস্টিজে লাগছে। আর যদি বাই চান্স দাঁড়িয়ে থাকেও উদয়, জিনিয়া কি আর তাকে ডাকতে পারবে?
ডাকলে তো ঠিকই খোঁচা দিয়ে বলবে, “কী, খুব তো বলেছিলি, তুই চলে যা, কিছু হবে না আমার! কেমন হলো এখন?”
“দেখাই যাক কী হয়” এই ভেবে নাহিদের পিছু পিছুই এগিয়ে চলল জিনিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় বার বিরক্ত লাগল যখন রিকশায় উঠে জিনিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরল নাহিদ।
অবশ্য “গরম লাগছে” বলে হাতটা ছাড়িয়ে দিতেই সরে গেল নাহিদ। চাপাচাপি করল না আর।
কিন্তু রয়েই গেল চাপা অস্বস্তিটুকু। সেই অস্বস্তি দ্বিগুণ বাড়ল যখন পরীবাগের বাসাটায় এসে দেখল বাসায় কেউ নেই নাহিদ আর তার দুই বন্ধু ছাড়া।
“আপু কোথায়? তুমি তো বলেছিলে এটা তোমার আপুর বাসা!” অবাক হয়ে জানতে চাইল জিনিয়া।
“আপুর শাশুড়ি অসুস্থ, আপু ওর শাশুড়ীকে দেখতে গিয়েছে!”
“আপু আসবে না?”
“না আটকা পড়ে গেছে, আসতে পারবে না আজকে রাতে। আমরা আমরাই!”
“এরা কারা?”
“আহ, এভাবে বলছ কেন? আস্তে বল, ওরা শুনতে পারলে কী ভাববে! বলবে, নাহিদের বউটা কি আনসোশ্যাল!”
“কারা ওরা?”
“ওরা আমার ফ্রেণ্ড, আমাদের বিয়েতে সাক্ষী দিতে এসেছে!”
“কিন্তু এভাবে কেন? আমাদের দুই ফ্যামিলির বড়রা কেউ থাকবে না, আপুও নেই…”
“উফ জিনি, খুব বেশি বোরিং তুমি! কাল তো বিয়ে হতোই, তাহলে আজ হলেই বা সমস্যা কী?”
ঢোক গিলল জিনিয়া। ঠিক কী হয়েছে নিজেও বুঝতে পারছে না, কিন্তু যে অন্ধ বিশ্বাস আর ভরসায় বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, উদয়ের সাথে এতক্ষণ সময় কাটানোর প্রভাবেই কিনা কে জানে, একটু যেন ফিকে হয়ে এসেছে সেটা।
তেমন কিছুই করেনি উদয়, শুধু একবার বুঝি বলেছিল আস্তে করে, “যা করছিস ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে করছিস তো?”
তখন উদয়কে ঝাড়ি দিয়েছে জিনিয়া। ঝাড়ী খেয়ে তখনকার মতো উদয় চুপ করে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু একটা বুঝি পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে জিনিয়ার মাথায়।
কোথায় যেন সামান্য হলেও দ্বিধা কাজ করছে জিনিয়ার ভেতরে। নাহিদকে সে ব্যবহার করতে চাইছে মুক্তির আশ্রয় হিসেবে।
নিজের বাসার শাসন বারণ অসহ্য লাগছে বলেই নাহিদকে বিয়ে করে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওই বাসা থেকে। হয়ত এ বাসায় এসে নাহিদের বড় বোনকে দেখতে পেলে এত কিছু মাথায় আসত না জিনিয়ার।
কিন্তু যখনই নাহিদের কথার সাথে বাস্তবতার মিল দেখতে পাচ্ছে না, তখনই মাথার জমিতে উদয়ের ছড়িয়ে দিয়ে যাওয়া সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মাথা তুলেছে।
“ওহ জিনি, ফাইনালি আই হ্যাভ গট ইউ!” জিনিয়ার কোমর ধরে উঁচু করে তুলল নাহিদ, তারপর আবার নামিয়ে দিয়ে চকাস করে চুমু খেয়ে নিল একটা।
জিনিয়ার এই প্রথম চুমু, এর আগে দুবার দেখা করেছে কিন্তু বসুন্ধরা সিটির জনসমাগমে চুমু খাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়ে ওঠেনি। ভালো লাগা উচিত ছিল হয়ত কিন্তু ভালো লাগার বদলে কেমন একটা ভয় ভয় অনুভূতি ঝটকা দিয়ে গেল সারা শরীরে।
“আমার একটু ফ্রেশ হতে হবে!” মরিয়া হয়ে বলে উঠল জিনিয়া।
“ফ্রেশ?”
“বাস জার্নি করে এসেছি, একটু হাত মুখ ধুতে হবে!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও না! ওই তো ওয়াশ রুম! স্টার থেকে খাবার আনিয়েছি, আমি টেবিলে সার্ভ করে দিচ্ছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে একেবারে রেডি হয়ে আসো, কাজি সাহেবের চলে আসার কথা যে কোনো সময়!”
রুমে ঢুকে দরজা লক করল জিনিয়া। কী করবে এখন?
আব্বুকে ফোন করবে? মেরেই ফেলবে আব্বু তাকে।
তাছাড়া, নাহিদকে কী বলবে? সে একা মার খেলে তো সমস্যা ছিল না।
তার জন্য যে নাহিদও মার খাবে বিনা দোষে? এমন তো নয় যে নাহিদ চাপাচাপি করছিল তাকে বেরিয়ে আসার জন্য।
নাহিদ বার বার করেই বলছিল সে প্রস্তুত নয় এখনো। জিনিয়াই বরং জোর করে চলে এসেছে।
রুমের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল জিনিয়া। খোলা বাতাসে শ্বাস নিল বুক ভরে।
বারান্দায় কয়েকটা নাইলনের দড়ি টানানো। দড়িতে কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে।
কাপড়গুলো এক পাশে সরিয়ে বারান্দার রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল জিনিয়া। কী একটা বিপদে পড়া গেল!
আচমকাই নিচে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠল জিনিয়ার হৃদপিণ্ড। ওটা কে?
উদয় না? গায়ের লাল টি শার্ট দেখে তো তাই মনে হচ্ছে!
এখনো যায়নি বাসায়? কি আশ্চর্য!
উদয়কে দেখে মনে হলো সেও বুঝি দেখেছে তাকে। প্রাণপণে হাত নেড়ে উদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করতে লাগল জিনিয়া।
কাছে এগিয়ে এল উদয়। আচ্ছা এখন কী করবে জিনিয়া?
এই বারান্দা দিয়ে নেমে যাওয়া যায় না?
সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তের বেশি দেরি করল না জিনিয়া। ছুটে গেল রুমের ভেতরে।
রুমের টেবিলের ড্রয়ার খুলতেই পেয়ে গেল কাঁচিটা। কাপড় শুকানোর দড়িটা কেটে ফেলল কাঁচি দিয়ে।
দড়িটা কি পারবে তার ভর নিতে? এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জিনিয়া দড়িটা বারান্দার রেলিং এর গায়ে বেঁধে টেনে টুনে দেখতে লাগল যথেষ্ট টাইট হয়েছে কিনা।
একদম মাটি পর্যন্ত পৌঁছাবে না দড়িটা, কিছুটা বাকি থাকবে। থাকুক, ওইটুকু লাফিয়ে নামতে পারবে জিনিয়া।
রুমের ভেতর থেকে চেয়ার এনে বারান্দার রেলিং এর পাশে লাগাল জিনিয়া। ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে চেয়ারে পা রেখে উঠে বসল রেলিং এর ওপরে।
দড়িটা হাতের মুঠোয় নিয়ে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করছিল জিনিয়া। ঠিক সেই সময় টোকা পড়ল দরজায়।
“এখনো হয়নি, জিনি?”
আর সময় নেই। দড়িটা ধরে ঝুলে পড়ল জিনিয়া।
জিনিয়া যখন লাফ দিয়ে মাটিতে নেমেছে তখন ছুটে এলো দারোয়ান, “এই কে আপনি? কোন বাসার?”
প্রস্তুত ছিল উদয়, জিনিয়ার হাত ধরে টেনে বলল, “দৌড়া!”
দারোয়ান ওদের পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলল, “এই চোর! চোর!”
চায়ের দোকানদার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এর লাইগ্যাই তো অতক্ষণ ধইরা দোকানে বইয়া আছিল!”
উদয়ের হাত ধরে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল জিনিয়া। পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই, দারোয়ানের সাথে সাথে আরো কয়েকজন জুটে গেছে ওদের পিছু ধাওয়া করার জন্য।
কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না ওরা, শুধু বুঝতে পারছে ধরতে পারলে কোনো কথা না শুনেই আগে এক চোট হাতের সুখ করে নেবে এই উন্মত্ত জনতা। পেছন থেকে শুধু “ধর! ধর! চোর! চোর!” শব্দই শোনা যাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে একটা গলিতে একটা অন্ধকার কোণা আবিষ্কার করে সেখানে বসে পড়ল উদয়। টান দিয়ে বসিয়ে দিলো জিনিয়াকেও।
হাঁপাতে হাঁপাতে ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল বেশ জোরেই, তাই উদয় সজোরে মুখ চেপে ধরল জিনিয়ার। প্রবল ভয়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে ওর হৃদস্পন্দন, হৃদপিণ্ডটা এমনভাবে ধড়াস ধড়াস করছে যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে এখুনি।
দূরে কোথাও থেকে এসে পৌঁছানো কোনো এক ল্যাম্প পোস্টের এক চিলতে আলোক রশ্মিতে দেখা যাচ্ছে আশে পাশে পচা সবজি, ডিমের খোসা, মুরগির পালক ছড়িয়ে আছে, নাকে ভেসে আসছে একটা অদ্ভুত বোটকা গন্ধ। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মুখ থেকে উদয়ের হাত সরিয়ে গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে প্রশ্ন করল জিনিয়া, “আমরা কোথায়?”
(প্রিয় পাঠক, গল্পটি পড়তে ভালো লাগলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার নতুন বই। লিংক কমেন্ট সেকশনে।)