#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ১৮
কুয়াশা জমেছে আম গাছের পাতায় পাতায়।
ঘরের চালের উপরে থাকা ডাল থেকে টুপটুপ করে কুয়াশা পড়ছে টিনের চালে।
ফজরের আজান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তবে বাহিরে আলো তেমন ভাবে ফোটেনি। ডিম লাইটের আলো জ্বলছে, সে আলোয় আয়েত্রীর মুখ পানে তাকিয়ে রয়েছে সদ্য বিবাহিত স্বামী।
কে বলবে মাত্র ঘন্টা দুয়েক পূর্বে কবুল বলে এক হয়েছে দুটো ভিন্ন মানুষ।
কখনো ভেবেছিলো না ইশরাক যে সাধারণ টি-শার্ট, জ্যাকেট পরেই বিয়ে করবে সে।
আয়েত্রী এখন গভীর ঘুমে। সিডাক্টিভ দেওয়া হয়েছে। বৈধতা প্রাপ্ত স্ত্রীর পাশে বা কাত হয়ে শুয়ে আছে ইশরাক।
আলাদা কম্বলের নিচে ছিলো সে। মাঝেমধ্যে দৃষ্টি আয়েত্রীর পেটে নামিয়ে আনতো কারণ শ্বাস নিলে পেট উঁচু নিচু হয়, এবার তো শান্তির ঘুম তার চোখেও নেমে আসছে।
দুদন্ড না ভেবে চুপচাপ আয়েত্রীর কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লো সে।
আয়েত্রীর পেটের উপর ডান হাত রেখে সবে চোখ বন্ধ করেছে৷
এই দুইদিন যা গিয়েছে তা আর বলার নয়। কারণ আয়েত্রীকে যখন নদীর পাড়ে পেয়েছিলো তখন আয়েত্রীর শক্তির সাথে কেউ পেরে উঠছিলো না।
চারজন! আয়াত,ইশরাক,সামিউল, শ্রাবণ চারজন মিলে কোন প্রকার টেনে হিচড়ে নদীর পাড়ের থেকে পাকা রাস্তায় নিয়ে আসতেই জ্ঞান হারায় আয়েত্রী।
দুইদিন আয়েত্রীর ঘর থেকে আগরবাতির গন্ধ সরেনি৷ সব সময় তেলাওয়াত হয়েছে কোর-আন শরীফ। ডক্টর এসেছিলো। শিফট করার কথা বললেও কেউ রাজি হয়নি।
ইশরাকের শুধু মনে হচ্ছিলো
কোথাও তেলহীন একটা ছোট্ট প্রদীপ দিপদিপ করে জ্বলছে।
যে কোন সময় নিভে যাবে।
যখন আয়েত্রীর জ্ঞান ফিরলো তার মিনিট দশেকের মধ্যে বিয়ে হলো।
কারো নড়েচড়ে উঠায় চোখ মেলে তাকায় ইশরাক।
আবছা আলোয় অনুভব করলো
শরীরের উষ্ণতায় আয়েত্রী ধীরেধীরে সানিধ্য নিচ্ছে তার বাহুডোরে।
ইশরাক অনুভব করে মুচকি হেসে বেড সুইচ টিপে লাইট অফ করে দেয়।
দুহাতের শক্ত বন্ধনে জড়িয়ে নেয় আয়েত্রীকে।
পুরো নদীর পাড় পুলিসের বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীর কিছু লোক দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। ইস্তিয়াকের বিশেষ অনুরোধে এসেছে এক স্পেশাল ফরেনসিক টিম এসেছে।
রাস্তার ধার থেকে নদীর পাড়ের পানি অবধি খনন কাজ চলছে। আয়েত্রী তখন প্রতীর কাঁধে মাথা রেখে সামনে তাকিয়ে আছে।
মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে উঁচুনিচু অংশগুলোকে পার করে আয়েত্রী এগিয়ে যাচ্ছে নদীর পাড়ের দিকে।
আয়াত বাধা দিলে নানাভাই ছেড়ে দিতে বলে। কারণ আয়েত্রীই নিজেই খুঁজে বের করবে তার কাংখিত সেই রহস্য।
আয়েত্রী একজন কনস্টেবল কে ইশারা করে ঠিক সেখানে খনন করতে বললো যেখানে শাওন আয়েত্রী বসে থাকতো।
পনেরো হাত জায়গা গভীর করে খনন করার পরেও কিছু পাওয়া যায় না।
উৎসুক সবার দৃষ্টি গর্তের দিকে। এবার আয়েত্রী নিজে নেমে এলো গর্তে। হাত দিয়ে মাটি উছলিয়ে উছলিয়ে তুলছিলো সে।
কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে কিছু একটার স্পর্শ পেলো সে। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে লেগে গেলো আয়েত্রী। নদীর নিচ থেকে পানি উঠা শুরু করেছে। কাঁদাময় হয়ে যাচ্ছে আয়েত্রীর জামা কাপড়। ঠিক সে মুহূর্তে আবছা হয়ে ভেসে উঠলো সুদর্শন এক বালকের মুখশ্রী।
আয়েত্রী হাতের আজলে উঠিয়ে নিলো।
মুখ স্পষ্ট হতেই শ্রাবণ চিৎকার করে গর্তে নেমে পড়লো। এ আর কেউ না।শাওন যেনো ঘুমিয়ে আছে। পনেরো বছর আগে যে কাপড়ে শাওন বেরিয়েছিলো বাড়ি থেকে, যে অবস্থায় ছিলো! ঠিক সে অবস্থায় শাওন শুয়ে আছে আয়েত্রীর কোলে মাথা রেখে।
শ্রাবণ নেমে যেই না শাওন কে স্পর্শ করলো ঠিক ওমনি আয়েত্রী ঢলে পড়লো শাওনের পাশে কাদাস্তুপে।
শাওন কে ফরেনসিক টিম নিয়ে যায়। আশ্চর্য বিষয় শাওনের বয়স যেনো বাইশ বছরে থেমে আছে। লাশ নিয়ে যাওয়ার পর আয়েত্রীকে নিয়ে ইশরাক মুখোমুখি হয় দুজন মানুষের। যারা এসব করেছেন আয়েত্রীর সাথে নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য। সেরাতে সবাই বাড়ি থেকে বের হতে পারলেও এই দুজন বলয় পার করে আসতে পারেনি। সাথে সাথে তাদের বন্দী করেন আয়েত্রীর নানা এবং মৌলবীসাহেব।
হ্যাঁ তারা আর কেউ না। আয়েত্রীর ফুপু উপমা এবং আয়েত্রী বাবা এহমাদ খান।
উপমার সাথে শাওনের ছিলো প্রণয়ের সম্পর্ক। তবে ছিলো দুগ্রামে বিরোধ।তখনকার প্রেমগুলো এসময়ের মতন ছিলো না। ভালোবাসা ছিলো গভীর। এপাড়ের ছেলে ও পাড়ের মেয়ের প্রেমে পড়লো। একসময় কিছুটা কানাকানি হলো এলাকার বড়ভাইদের মাঝে। মেয়ের ভাই সিদ্ধান্ত নিলো বোনের বিয়ে দেবে।কিন্তু উপমা ছাড়বে না শাওনের হাত। পরিবারের মায়া ছেড়ে সেরাতে উপমা চলে আসতে চেয়েছিলো নদীর এ পাড়ে। কারণ একবার এপাড়ে এলে আর কোন বিপদ নেই। গভীর রাত বারোটা তেতাল্লিশ মিনিটে শাওন নৌকা দিয়ে পার তো করে আনলো উপমাকে কিন্তু বাড়ি পৌঁছাতে পারলো না। উপমার ভাইয়েরা আগে থেকেই নদী সাতরে আশ্রয় নিয়েছিলো এপাড়ের ঝোপে।
যখন ওরা পার করে এলো তখন ওরা বেরিয়ে এলো ঝোপের আড়াল থেকে।
তারা ছিলো সংখ্যায় অনেক কিন্তু শাওন একা। শীতের রাতের সবাই তখন গভীর ঘুমে। কে শুনবে উপমার আর্তনাদ?
বিগত সময় গুলোতে প্রাণ নেওয়া খুব একটা কঠিন বিষয় ছিলো না। যত্রতত্র হতো খুন খারাবী।
শাওন হয়ে গেলো সে মানুষরুপি পিশাচদের স্বীকার। উপমার চিৎকার মন গলায়নি কারো। মেরে নদীর পাড়েই বালিচাপা দেয় শাওন কে।
নিয়ে যায় উপমাকে।
ঘটনা সবার অগোচরে হলেও সবটা দেখে আয়েত্রীর বাবা। কারণ সে তখন শহর থেকে ফিরছিল।সম্পর্কে উপমা তার ফুপাতো বোন। ফুপাতো বোনের বদনাম হবে তাই সে সব চেপে গেলো।
এহমাদ সাহেব, উপমা মাথা নিচু করে বসে আছে। উপমার জিহ্বা বাধা। সে যেনো কোন কিছুই আওড়াতে না পারে সেজন্য এমন ব্যবস্থা। তবে তার কথা শোনার জন্য মুখের বাধন খুলে দিলো সামিউল।
“আমি শাওন কে ভালোবাসি। ভালোবাসা কখনো কমে না সে থাকুক না থাকুক।সেরাতে আমি অনেক ডেকেছি আল্লাহ্ কে। কিন্তু ওরা শাওন কে আমার সামনে মেরে পুতে দিল।তাই আমি শয়তান কে বেছে নিলাম। বদ জ্বীন বন্দী করা শুরু করলাম। পিশাচ বলতে কিছু নেই। সব জ্বীনের খেল।জ্বীনের সাধনা করায় প্রথম বলি দিয়েছি আমার সতীত্ব। কুফরি করে ফিরিয়ে আনবো আমার শাওন কে। কিন্তু আমার এমন এক কুমারী শরীর প্রয়োজন ছিলো যা শাওনের কাছাকাছি ছিলো। যখন পাগলের মতন কাউকে খুঁজেছি তখন ভাই আমাকে আয়েত্রীর সন্ধান দেয়।
আয়েত্রী শাওনের অনেকটা কাছাকাছি থাকতো।
অদ্ভুতভাবে শাওনের হাতে সে বিকেল বেলায় আয়েত্রী কামর বসিয়েছিলো।
আয়েত্রীকে নিয়ে যেতাম কিন্তু সামিউল বাঁচিয়ে নিলো। এদিকে শাওনের শরীর সজীব রাখার জন্য আমার লাশের প্রয়োজন ছিলো তাই আমি আয়েত্রী শরীর নিয়ে কুফরি শুরু করি।
খাবার,কাপড়,চুল, প্রথম মান্থলির রক্ত সব নিয়ে দিয়েছিল ভাই আমাকে। ধীরে ধীরে আয়েত্রী বড় হচ্ছিলো। আমার আশা আলো দেখেছিলো।
পনেরো বছরে পনেরোটা খুনের জন্য সাহায্য করেছে এহমাদ ভাই। নির্দিষ্ট সময়ে সে আয়েত্রীর মুখ থেকে কথা বের করেই নিতো।তবে মাঝে ভাই কেমন কেমন করছিলো। সে আমাকে বাধা দিচ্ছিলো। তাই উপায় বদলাতে হলো। আমি সফল হয়ে যেতাম।
আয়েত্রীর রুহ্ জ্বীন, এবং কুমারী শরীর দিলেই আমার শাওন বেঁচে উঠতো। কিন্তু আয়াতের জন্য আমি পারলাম না।
সব যখন কেটে গেলো তখন উপনীতার হাতে আচার,চাদর পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আয়েত্রী অবধি পৌঁছাতে পারেনি। তাই নিজে এলাম। যখন আয়েত্রীকে রেখে প্রতী বের হলো ঠিক তখন আমি রুমে যাই। আয়েত্রীর খোঁপায় হাত রাখতেই আয়েত্রী আমার বশে চলে আসে।
উপমার কথা শুনে আয়াত চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি না বাবা? বাবা হয়ে এমন করলে কেনো? ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে এহমাদ সাহেব বললেন,
“আমি তখন মনে করতাম আয়েত্রী আমার মেয়ে না। কারণ বিয়ের একমাস পরেই আয়েত্রী হওয়ার খবর পেলাম আমি। ডক্টর বললো দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা তোর মা।
বিয়ে করেছি একমাস, বউ আমার দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা? এটা কিভাবে মেনে নিবো?
আমিও পারিনি। কিন্তু কাউকে বলতে পারিনি। লোকসমাজের সামনে আমি অনেক ভালো বাবা হয়ে উঠেছিলাম কারণ আমার প্ল্যান ছিলো আয়েত্রীকে মেরে ফেলা।মেয়ে খুনের দায় অবশ্যই ভালো বাবার উপর আসবে না।চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।
তাইতো তোদের বয়সের ব্যবধান মাত্র ১৮ মাসের।
তাই উপমাকে সাহায্য করি। কিন্তু বছর তিনেক আগে আমার সব ভুল ধারণা বদলে যায়। যখন ডক্টর বন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম দুজনের ডি-এন-এ টেস্ট করাতে। রিপোর্ট আসে পজেটিভ৷ তখন সব খুলে বললে সে আমকে সবটা বুঝিয়ে বলেছিলো।
মায়ের ভিতর বাচ্চাটার জন্য ডিম্বাণু আগে থেকেই তৈরী হতে থাকে। আর তাছাড়া মেডিকেল প্রফেশনে কন্সিভ করার ডেট ধরে যেদিন মান্থলি শেষ হয় সেদিন থেকে।
এসব শুনে আমি পাগলের মতন হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আয়েত্রীকে বাঁচানো আমার জীবনের থেকেও বেশি কিছু। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি। আয়েত্রী আঠারো পেরিয়েছে। উপমা আমাকে বলেছিলো সে ছেড়ে দেবে আমার মেয়েকে আমিও বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু ও ছাড়েনি। আয়েত্রীর ইদানীং অবস্থা দেখে আমার ভয় হচ্ছিলো তাই নানা ভাবে তোদের এসব ইশারা করেছি। পারলে আমায় মাফ করে দিস। ”
কথা শেষ করেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এহমাদ খান। সেদিন আর কি হয়েছিলো আয়েত্রী জানে না।ইশরাক তৎক্ষনাৎ নিয়ে চলে আসে তাকে।
শাওনের লাশ পরীক্ষা করে দেখা যায় ১৫ বছর আগে হয়েছিলো তার মৃত্যু। নিয়মনীতি অনুসারে হয় দাফন কাজ।
মাঝে কেটে যায় উনিশ বছর। উনিশ বছরে আয়েত্রী ফেরেনি মামার বাড়ি।সবাইকে দেখলেও বাবার লাশ অবধি চোখে দেখতে পারেনি। সাত দিন পর এহমাদ সাহেব আত্নহত্যা করে। সেসময় উন্নত চিকিৎসার জন্য আয়েত্রীকে নিয়ে ইশরাক পারি জমিয়েছে সিংগাপুরে।উপমার মৃত্যু হয়েছে আরো নৃশংস।কে যেনো তার পুরো শরীর চিড়ে ফেলেছিলো।
নানাজানের অসুস্থতার জন্য আজ এসেছে। ছোট্ট আয়েত্রীর এক ছেলে এক মেয়েও আছে। পাক্কা গিন্নী সে। প্রতী ইস্তিয়াকের তিন ছেলে। চার ভাইয়ের প্রাণ ইয়াশা।
হ্যাঁ ইয়াশা, আয়েত্রী -ইশরাকের মেয়ে।
মেয়েটাও হয়েছে মায়ের মতন। গ্রাম আগে কখনো দেখেনি। তবে জ্যোৎস্না ভিষণ ভালোবাসে। রাত জেগে ভাইদের নিয়ে করে জ্যোৎস্না বিলাশ।
পথে আসার সময় দেখে এক ছোট্ট নদী। রাতে মায়ের কাছে শুয়ে চিন্তা করছিলো
” আচ্ছা নদীর পাড় রাতের বেলা জ্যোৎস্নায় কেমন লাগে? ”
যেই ভাবা সেই কাজ। মায়ের পাশ থেকে উঠে চুপচাপ সু পরে বেরিয়ে পড়লো। জ্যাকেটের হুডি উঠিয়ে হেটে চলেছে নদীর পাড়ের দিকে।
নদীর পাড়ের কিছুটা কাছাকাছি যেতেই পিছনে থেকে কারো কন্ঠস্বর তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ডেকে উঠলো,
“এই চন্দ্রাবতী! দাঁড়ান। চন্দ্রাবতী!”
(সমাপ্ত)
#ছবিয়ালঃঅর্নিশা