#চোরাবালি_মন (পর্ব ৫)
৪র্থ পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1474152476433108/
নীলার মনটা ছুটে গেছে বাসায় ফেরার জন্য।এয়ারপোর্টে নেমেই আবিরকে ফোন করেছিল কিন্তু ও ধরেনি। শাশুড়ি মাকে ফোন করতেই বলল, গাড়ি এয়ারপোর্টে পাঠিয়েছিল উনি। টুকুন তো মায়ের গলা পেয়ে চিৎকার করে ওঠে, নীলার বুকটা যেন জুড়িয়ে যায়। শেষের ক’টা দিন আবিরের সাথে ঠিকমতো কথাই হয়নি। এমন না যে ও ফোনের কাছে ছিল না, কিন্তু কেন জানি ওকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। মনের ভেতর একটা অযাচিত দুশ্চিন্তা ঘিরে ছিল। কিন্তু আজ টুকুনের উচ্ছ্বাসে ওর দুশ্চিন্তার সব মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর ওঠে।
বাসায় এসে পৌঁছাতেই টুকুন মাকে জড়িয়ে ধরে, নীলাও শক্ত করে টুকুনকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের চুলে ঘ্রাণ নিতে থাকে। টুকুন ভালো আছে, এবার আর কিছু হয়নি। টুকুন ঠিক থাকলেই ওর পৃথিবী ঠিক। কিন্তু আবির ওর ফোন ধরল না, আবার ফিরতি কলও করল না! ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে।
নীলা ব্যাগ থেকে মায়ের জন্য, টুকুনের জন্য আনা গিফটগুলো বের করে দেয়। আবিরের জন্য দুটো শার্টও এনেছে। সবকিছু গুছিয়ে গোসল করে খেতে খেতে বিকেল হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে নীলা ঘুমিয়ে পড়ে, আবির এখনও ফোন দেয়নি।
টানা কয়েক ঘন্টা ঘুমোয় নীলা। ভীষণ ক্ষুধা নিয়ে ঘুমটা যখন ভাঙে, এত ক্লান্ত লাগছে, উঠতে ইচ্ছে করছে না। নীলা ঘুম ঘুম চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ক’টা বাজে। রাত আটটা পঁয়ত্রিশ! এতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও! আচ্ছা, আবির কি এখনও আসেন? নাকি এসে ওকে ঘুমাতে দেখে আর ডাকেনি?
নীলা সব আলসেমি ঝেড়ে এবার উঠে পড়ে, হাত মুখ ধুয়ে বের হতেই দেখে আবির ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। সেই পরিচিত দৃশ্য, লুঙ্গি পরা, ভুঁড়িটা উঁচু হয়ে আছে। কিন্তু মুখটা এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেন?
নীলা কাছে গিয়ে একটু উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘এই তুমি কখন এসেছ, আমি প্লেন থেকে নেমেই ফোন দিলাম, কিন্তু তোমার কোনো খবরই নেই।’
আবির একবার তাকায়, মুখটা কেমন কঠিন, হাসি নেই। শীতল গলায় বলে, ‘ব্যস্ত ছিলাম।’
নীলা একটা ধাক্কা খায়, এবার ব্যাপারটা তো আর স্বাভাবিক নেই। এতদিন পর ও এসেছে, আবিরের মাঝে বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই। এমন কি ওর দিকে ঠিকমতো তাকালও না! কোথাও নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়েছে। অফিসে কোনো ঝামেলা না তো? কিন্তু তাই বলে ওর সাথে কথাটুকু বলবে না?
নীলার ভীষণ মন খারাপ হয়। টুকুনের রুমের দিকে যেতেই টুকুন বের হয়ে আসে। আনন্দিত গলায় বলে, ‘আম্মু, তোমার আনা ঘড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে।’
নীলা সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’বাবাকে দেখিয়েছ?’
টুকুন মাথা নাড়ে, তারপর আগ্রহ নিয়ে বাবার কাছে যেয়ে ডান হাতের কবজি উলটে বলে, ‘বাবা দেখো, আম্মু এনেছে। সুন্দর না?’
আবির একবার তাকায়, তারপর শুষ্ক গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, সুন্দর হয়েছে।’
কথাটা বলেই আবার টিভিতে মনোযোগ দেয়।
টুকুন একটু তাকিয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে, তারপর অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নিজের রুমে চলে যায়। নীলা দূর থেকে পুরো ঘটনাটা দেখে। মেয়ের সাথেও এমন গম্ভীর? নাহ, এবার তো জানতেই হয় ঘটনা কি। মানুষটা কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।
নীলা পায়ে পায়ে আবিরের কাছে এসে বসে, তারপর নরম গলায় বলে, ‘আচ্ছা, তোমার কী হয়েছে? এতদিন পর আসলাম, আমি কেমন আছি সেটা জিজ্ঞেস করা তো দুরের কথা, একবার ভালো করে তাকালেও না। মেয়েটা এত আগ্রহ করে ঘড়িটা দেখাল আর তুমি শুকনো মুখে শুধু বললে সুন্দর হয়েছে। মেয়েটা মন খারাপ করে চলে গেল। কি হয়েছে বলো তো? অফিসে ঝামেলা?’
আবির এবার উঠে বসে, টিভিটা বন্ধ করে বেডরুমে চলে আসে। নীলা অবাক চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর বেডরুমে আসে, অধৈর্য গলায় বলে, ‘কি হলো, বললে না কি হয়েছে? আমি বিদেশ গিয়েছি সেজন্যই রাগ করেছ?’
আবির স্থির দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ঠান্ডা গলায় বলে, ‘তাহসান সাহেবকে কবে বিয়ে করছ?’
নীলার মাথায় যেন বাজ পড়ে, মুখটা মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে যায়, বুকের ভেতর একটা অস্বস্তিকর চাপ অনুভব করে। তাহসানের নাম আবির জানল কি করে! আর বিয়ের কথাই আসছে কী করে? তাহসানের সাথে তো ওর সব চুকেবুকেই গেছে। তাহলে আবির জানল কি করে? আবির জানেই বা কতটুকু?
নীলা ঢোক গিলে তোতলানো গলায় বলে, ‘কিসব আজেবাজে কথা বলছ, কে তাহসান? আর আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি মানে, এসব কী বলছ?’
আবিরের ভীষণ রাগ উঠে যায়, নীলা কী অবলীলায় মিথ্যেটা বলল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘যাকে তুমি ভালোবাসো, যার সাথে তুমি সিংগাপুর ঘুরে এসেছে সেই তাহসান। স্বামী স্ত্রীর মতো থেকেছ, সেই তাহসান।’
নীলার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে, আবির এসব কি বলছে। আর তাহসান যে ওর সাথে সিংগাপুর গিয়েছিল এটা ও জানল কী করে? তারমানে কেউ আবিরকে সব বলে দিয়েছে। কিন্তু যা কখনও হয়নি আবির তাও কেমন কুৎসিত করে বলছে, তাও চিৎকার করে।
নীলা দ্রুত বেডরুমের দরজাটা বন্ধ করে, টুকুন না শুনুক, আমার টুকুন না শুনুক। মাথার ভেতর শুধু একটা কথাই এখন ঘুরছে। ও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ছোট হতে পারে, কিন্তু টুকুনের কাছে যে ছোট হতে পারবে না!
চোখ ফেটে কান্না চলে আসে, হাতজোড় করে ভাঙা গলায় বলে, ‘দোহাই তোমার, যা বলার আমাকে বলো। বাসায় আম্মা আছে, টুকুন আছে, ওদের শুনিয়ে কিছু বলো না। আমি ভুল করেছি, আর সেটা বুঝতে পেরে সে পথ থেকে ফিরেও এসেছি। আর তুমি যে ইংগিত করে কথা বলছ তার কিছুই হয়নি। শুধুই বন্ধুর মতো ছিল তাহসান।’
আবির এবার নিচু গলায় হিসহিস করে বলে, ‘মিথ্যেবাদী, তুমি একটা আস্ত মিথ্যেবাদী। এই ছবিগুলা কি তাহলে? মানুষ বন্ধুর সাথে এমন হাত ধরে ছবি তোলে?’
নীলা বিমূঢ় হয়ে আবিরের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে, তাহসানের সাথে ওর কিছু ছবি ছিল, সেল্ফি সব। একটা ছবি ছিল হাত ধরে। কিন্তু তাহসান এগুলো পাঠিয়েছে আবিরকে!! বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় নীলার। লোকটা কী পাগল হয়ে গেল!? নিজের মান সম্মানের কথা ভাবল না একবারও? এতটাই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে যায় মানুষ?
নীলা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। মাথাটা ভীষণ ঘুরছে, বুকের ভেতর কেমন ধড়ফড় করছে। নিশ্বাসটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে মেঝেতে শুয়ে পড়ে এখনই।
আবির এখনও বলে যাচ্ছে, ‘বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে ডিভোর্স দিয়ে আলাদা হয়ে তারপর যা ইচ্ছা করো।’
একটাই বাঁচোয়া, আবির এখন কথাগুলো অন্তত চিৎকার করে বলছে না। নীলা এবার মুখ তুলে শুন্য চোখে কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর একটা জোর নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘আবির, তাহসানের সাথে আমার একটা ভালো লাগার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। কিন্তু সেটা কখনোই সীমা লংঘন করেনি। আজকের পর তুমি যদি আমার সাথে না থাকতে চাও আমি টুকুনকে নিয়ে চলে যাব।’
আবির এবার এক লাফ দিয়ে কাছে আসে, নিচু হয়ে মেঝেতে বসে হিংস্রভাবে নীলার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে, ‘টুকুনকে তুমি কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না। এই ছবিগুলো দেখালে কোনো আদালত টুকুনকে তোমার কাছে দেবে না। আর টুকুনও যাবে না তোমার সাথে।’
নীলা স্তম্ভিত হয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে, আবির ঠিক কথা বলছে। তাহসানের সাথে ওর সম্পর্কটা প্রমাণ হলে ও কোনোদিন টুকুনকে পাবে না। কথাটা ভাবতেই বুকটা মুচড়ে ওঠে, কান্নায় ভেঙে পড়ে। টুকুনকে যে ও হারাতে পারবে না। পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়ে ও টুকুনকে চায়।
নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘প্লিজ আমাকে তুমি এবারের মতো ক্ষমা করো। এমন আর হবে না।’
ঠিক এ সময় ওদের বদ্ধ দরজায় ঠকঠক শোনা যায়, সাথে টুকুনের ক্ষীণ কণ্ঠ শোনা যায়, ‘আম্মু, দরজা খোল।’
নীলা দ্রুত চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়, দরজা খোলার আগে আবিরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাতজোড় করে একবার চুপ থাকতে অনুরোধ জানায়। তারপর আরেকবার চোখটা মুছে দরজা খুলে, যতটা পারে স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘কী, ক্ষুধা পেয়েছে? তোর দাদুকে ডাক, চল খাবি।’
টুকুন মায়ের মুখের দিকে তাকায়, বেডরুমে বাবা এখন চুপ করে বসে আছে। একটু আগে বাবা কেমন বিশ্রীভাবে চিৎকার করছিল। বাবা তো কোনোদিন এমন করে না।
টুকুনের কেমন ভয় লাগতে থাকে। জড়োসড়ো হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোয়। দাদু এর মধ্যেই টেবিলে এসে বসেছে।
নীলা টেবিলে খাবার বাড়তে থাকে। আড়চোখে খেয়াল করে ওর শাশুড়ি দিলারা বেগম মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। তারমানে সবাই আবিরের প্রথম দিককার কথাগুলো শুনেছে। নীলা ঠোঁটটা জোরে কামড়ে ধরে, ভাত বাড়তে গিয়ে হাতটা কাঁপছে। এমন দিন আসবে ও ভাবেনি কখনও।
এই প্রথবার রাতে খাবার টেবিলে তিন প্রজন্মের চারজন মানুষ কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেতে থাকে। দিলারা আড়চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পান, মুখটাতে রাজ্যের বিষন্নতা। ছেলের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যায়, এটা এমন একটা বিষয় যেখানে মা হয়ে ছেলেকে উনি সান্ত্বনাটুকু দিতে পারছেন না। সান্ত্বনা না দিতে পারার অক্ষমতা পোড়ায় দিলারা বেগমকে।
এদিকে আবির ভাবছিল ও কোনো ভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। টুকুন কি ওর চিৎকার করে কথাগুলো শুনতে পেয়েছ?
টুকুনের খুব কষ্ট হচ্ছে। সারা দিন শেষে এই একটা সময় ও আব্বু আম্মুকে একসাথে কাছে পায়। স্কুলের গল্প করে, সারাদিন কি কি হলো দাদু তার ফিরিস্তি দেন। কিন্তু আজ যেন সবাই বোবা, কেউ কথা বলছে না। টুকুন ভেবেছিল ওর স্কুলের একটা জরুরি ব্যাপার আজ বলবে, কিন্তু সবাই যেমন গম্ভীর, তাতে আজ আর বলার দরকার নেই। আচ্ছা, এরা কি এখন থেকে সব সময় মুখ গম্ভীর করেই রাখবে? তাহলে ও ওর জরুরি কথাগুলো কাকে বলবে?
সেদিন রাতে সব কাজ গুছিয়ে এসে দেখে আবির তখনও ঘুমাতে আসেনি। ড্রয়িং রুমে টিভি ছেড়ে ভলিউম একদম মিউট করে একটা চ্যানেল দেখছে। মুখটা অন্ধকার। নীলার আজ আর ওকে ডাকার সাহস হয় না, যদি আবার চিৎকার করে আজেবাজে কিছু বলে।
আবির মনোযোগ দিয়ে টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখছিল। একটা হরিণের পাল মনের আনন্দে ঘুরে ঘুরে কচি ঘাস, পাতা খাচ্ছিল। দূর থেকে একটা বাঘ নিঃশব্দে হরিণের পালটার দিকে এগিয়ে আসছিল। আবিরের নিশ্বাসটা দ্রুত বয়, এত সুন্দর হরিণটাকে বাঘটা এখনই নিষ্ঠুরভাবে শিকার করবে। আবিরের হঠাৎ করেই নীলার মুখটা মনে পড়ে যায়। আচ্ছা, নীলার সাথে সত্যিই কী ওই লোকের কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল? কথাটা ভাবতেই মাথায় আগুন ধরে যায়। টিভিতে ততক্ষণে বাঘটা হরিণের টুঁটি চেপে ধরেছে। আবির পাগলাটে দৃষ্টিতে বাঘটার তীক্ষ্ণ দাঁতের দিকে তাকিয়ে আছে যেটা এখন হরিণের নরম গলায় বসে গেছে। আবিরের ইচ্ছে হচ্ছে এই বাঘটার মতো নীলার গলাটা নিষ্ঠুরের মতো চেপে ধরে। মাথাটা কাজ করছে না এখন।
চ্যানেলটা চেঞ্জ করে ফেলে। একটা বাংলা সিনেমা হচ্ছে। ইদানীং রাত বাড়লেই পুরান পুরান সব বাংলা সিনেমা চলে চ্যানেলগুলোতে। রাজ্জাক আর শাবানার বাসর ঘরের দৃশ্য দেখাচ্ছে। শাবানার মুখটা কুমকুমের সাদা সাদা ফোঁটা দিয়ে সাজানো, মাথায় ঘোমটা। লাল শাড়িতে লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে আছে। আবিরের হঠাৎ করেই নীলার কথা মনে পড়ে যায়। নীলাও ঠিক এমন করেই বসে ছিল সেদিন, লাজুক মুখে। সবাই খুব মজা করছিল, নীলার রূপের প্রশংসা করছিল। এর মাঝে একজন দূর সম্পর্কের ভাবি ঠেস দিয়ে বলেছিল, ‘দেইখো, নীলা কিন্তু সবার সয় না।’
সেদিন আবিরের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আজকে কেউ এমন কুকথা বলে? আড়চোখে খেয়াল করেছিল নীলার উজ্জ্বল মুখটা সেদিন দপ করে নিভে গিয়েছিল। পরে অবশ্য আবির নীলাকে আদর করে বলেছিল, ‘নীলা অবশ্যই আমার সইবে। আসলে ওনার ঈর্ষা হয়েছে, তোমাকে দেখে ওনার চোখ ট্যারা হয়ে গেছে।’
নীলা ওর কথা শুনে খুব হেসেছিল। আহা, কী আনন্দের দিন ছিল! প্রথম দিকে প্রতি সপ্তাহেই ওরা ঘুরতে যেত, সিনেমা দেখত। মাসে একবার তো ঢাকার বাইরে যাওয়া চাইই চাই। ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়ল, সংসার, চাকরি ওদের সব সময়গুলো গিলে খেতে থাকল। হঠাৎ করেই আবিরের মনে হয়, শুধু নীলাকে নিয়ে ও বহুদিন কোথাও যায়নি, এমনকি ঢাকাতে একটা সিনেমা দেখতেও! দু’জনেই এত ব্যস্ত থাকা হয় যে ছুটির দিন শুধু পড়ে পড়ে ঘুমানো।
কথাটা ভাবতেই আবিরের মনে হয়, ও কী নীলাকে সময় কম দিয়েছে তাই ও এমন করে আরেকজনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল? আচ্ছা, এই যে লোকটা আজবাজে কথা লিখেছে, ছবি পাঠিয়েছে সেটা নীলা সহ্য করছে কী করে? অন্তত আবিরের কাছে যে ও অনেক ছোট হয়ে গেল। আর টুকুনও তো কিছুটা শুনেছে। এই মানসিক চাপটা কী ও নিতে পারবে? হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ওর বুকটা ধক করে ওঠে, নীলা যদি সুইসাইড করে ফেলে! ভাবনাটা ভাবতেই ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। এক লাফে ওঠে দাঁড়ায় আবির, তারপর দ্রুত পায়ে বেডরুমে আসে।
নীলা চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে, আধো অন্ধকারে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে আবির, সেই সাথে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আগে হলে অন্তত জিজ্ঞেস করত, মন খারাপ কিনা। আজ সে কথাটাও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মেজাজটা আবার তিরিক্ষে হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে নীলা আকাশ পাতাল ভাবছিল। তাহসান এত নিচু কাজ করল! একটা সময় যে ওকে ভালোবাসার কথা বলেছিল সে আজ ওকে এত বড় একটা বাজে পরিস্থিতিতে ফেলে দিল? ওর বেঁচে থাকার সুখী গৃহকোণে সারাজীবনের জন্য দুঃখের আগুন জ্বেলে দিল? আবির কি ওকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে? আর ওর টুকুন? ও যদি সবটা জানে, তখন? ভাবনাটা ও ভাবতেই পারে না। ও চাকরি ছাড়তে পারে, আবিরকেও। কিন্তু টুকুনকে যে ছাড়তে পারবে না, টুকুনের কাছে যে ও ছোট হতে পারবে না। কষ্টে বুকটা ফেটে আসে, বুক হাহাকার করা আফসোস ওকে গিলে খায়। কেন ও জড়িয়ে পড়েছিল ওই শয়তান লোকটার সাথে?
পরদিন সকালে আবির না খেয়েই অফিস চলে যায়। নীলা যে জোর করে কিছু বলবে সেটা বলতে পারে না। শাশুড়ি মা শুধু গম্ভীরমুখে চেয়ে থাকেন। নীলাও সেদিন কিছু না খেয়েই অফিস চলে আসে।
সেদিন অফিসের কলিগরা যেই ওকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, একদম এলোমেলো, বিষন্ন একটা মুখ। অথচ নীলা সবসময় পরিপাটি থাকত। নীলা অফিসে ওর রুম থেকে আজ বেরই হয় না। লাঞ্চটা আজ রুমে এনেই করে। মাথায় একটা ভাবনা, আচ্ছা তাহসান কেন এমন করল? কী হলো নতুন করে?
অফিস ছুটি হয়ে যায়, সবাই চলে গেছে। নীলার কেন জানি বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত চোখটা একটু বন্ধ করে চেয়ারটায় আধাশোয়া হয়ে বসে। হঠাৎ করেই মনে হয় ওর তাহসানকে শক্ত করে কিছু কথা বলার দরকার। ওর সাথে যা হয়নি তাও ও আবিরকে বলেছে। ভবিষ্যতে আরও কত কী যে বলবে!
চোখটা খুলে ফোনটা হাতে নেয়, লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বহুদিন পর তাহসানকে ফোন দেয়। একটা রিং হতেই সাথে সাথেই ধরে, নাটকীয় গলায় বলে, ‘আমি জানতাম তুমি ফোন দেবেই। আবির সাহেব তোমাকে কবে ছাড়ছে? আমি বিয়ে তোমাকে করবই।’
নীলার মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তুমি একটা নোংরা মানুষ, আমাকে তুমি কখনই ভালোবাসনি। শরীরটা চেয়েছ। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তুমি যদি আর বাড়াবাড়ি করো, আমি কিন্তু বসে থাকব না।’
ওপাশ থেকে তাহসানের ক্রুদ্ধ গলা পাওয়া যায়, ‘তুমি আমাকে চেনো নাই। তুমি সুমনের সাথে প্রেম করে বেড়াবা আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব? কখনোই না, আমি তোমার সব শান্তি শেষ করে দেব। এখনও তো ছবিগুলা তোমার মেয়েকে পাঠাইনি। ওর ফেসবুক একাউন্টটা তো টুকুন নামেই। আমি এখনই ছবিগুলা পাঠাব।’
কথাটা বলেই তাহসান ফোনটা কেটে দেয়।
নীলা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে, ওর কেমন শীত শীত করছে। মাথাটা কাজ করছে না। তাহসান এটা কী বলল! টুকুনকে ছবিগুলা পাঠাবে? নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। টুকুন কি এখন মোবাইল হাতে?
দ্রুত ভাবে, তারপর মোবাইলটা তুলে নিয়ে শাশুড়ি মাকে ফোন দেয়। ফোনটা বন্ধ, উফ। আবার ফোন দেয়, এবারও বন্ধ। নীলার নিশ্বাসটা দ্রুত পড়তে থাকে। বাসায় তো এখন আর কেউ নেই। তাহলে? টুকুনকে ফোন দিয়ে বলবে ফোনটা না খুলতে? কিন্তু তাতে ও কী ভাববে??? নীলা দিশেহারার মতো ভাবে যা ইচ্ছে ভাবুক, টুকুনকে ছবিগুলো দেখতে দেওয়া যাবে না।
দ্রুত ও অফিস থেকে বের হয়, তারপর টুকুনকে ফোন দেয়, রিং হচ্ছে। আহ, বাঁচা গেল। রিংটা বেজে বেজে থেমে যায়। আবার ফোন দেয়, এবারও কেউ ফোন ধরে না। নীলা অস্থির হয়ে বার বার ফোন দিতেই থাকে। এক সময় আর ফোন যায় না, ফোনটা বন্ধ। নীলা দামী গাড়ির এসির ঠান্ডার ভেতর থেকেও ঘামতে থাকে। হৃৎপিণ্ডটা মনে হচ্ছে গলায় আটকে যাবে। টুকুন কী এর মধ্যেই ছবিটা দেখে ফেলেছে? ও কী, ও কী…ভাবনাটা ভাবতে পারে না। কেমন পাগল পাগল লাগছে। টুকুন, মাগো, আমি আসছি। একটু সময় আমাকে দে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৮/০৭/২০২২