#নিভৃত_কুহক (পর্ব ৪)
নভেম্বর, ২০০২
১.
আরিফ মনোযোগ দিয়ে মাসের হিসেব করছিল। মেস ভাড়া (এক সিট)-৫০০টাকা, দুই বেলা (সকাল আর রাতের খাবার) মিল খরচ – ১৪০০টাকা, দুপুরের খাবার-৯০০ টাকা (এটা কমবে, মাঝে মাঝেই ক্লায়েন্ট খাওয়ায়), যাতায়াত-৫০০টাকা, বাড়িতে-৩০০০ টাকা, হাতখরচ-৫০০ টাকা।
লেখা শেষে আরিফ ওর নতুন মোবাইলটা বের করে। এটাতে ক্যালকুলেটর আছে। জিনিসটা খুব মজার, মোবাইলে ক্যালকুলেটর। আরিফ এবার বাটন চেপে চেপে সংখ্যাগুলো যোগ করে, ৬৮০০টাকা মোট। যাক, তারপরও হাতে সাতশ টাকার মতো থাকবে। একটা পাঁচশ টাকার ডিপিএস খুলে ফেলতে হবে। ছোট ভাইটা পলিটেকনিকের শেষ বর্ষে আছে, ও বের হয়ে গেলেই চাপটা কমবে। তখন দুই ভাই মিলে ঢাকায় বাসা নিয়ে বাবা মাকে নিয়ে আসতে হবে।
নাখালপাড়ার এই মেসে গাদাগাদি করে থাকতে খুব কষ্ট হয়। এক রুমে চারজন করে, ফ্লোরেই বিছানা, আলাদা আলাদা। ইচ্ছে করলে এক রুমে দু’জনও থাকা যায়, চকি পেতে। তাতে খুব আরাম হয়। কিন্তু এতে করে মাসে ভাড়াটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। জীবনে আরামের সাথে টাকার অংক সমানুপাতিক হারে জড়িত।
আরিফ মোবাইলটা একবার চেক করে, এক দু’টো মেসেজ এসেছে ফোন কোম্পানি থেকে। যদিও অর্থহীন তবুও আরিফ মনোযোগ দিয়ে মেসেজগুলো পড়ে। ওর চাকরির সাথে ফোনটা বিলাসিতা। কিন্তু তারপরও ও টাকা ধার করে ফোন কিনেছে। কেন জানি মনে হয়েছে এতে ও আরও বেশি বেশি ক্লায়েন্ট পাবে। আর সেটা সত্যিও। যারা ইন্স্যুরেন্স করে এরা একটু আর্থিকভাবে সচ্ছল। এবং অনেকেই এখন মোবাইল ব্যবহার করেন। তাতে যোগাযোগে সুবিধে হয়। বড় বড় ক্লায়েন্ট খুব খুশি হয় হাতে মোবাইল দেখলে। কিস্তির টাকা দেওয়া, অথবা কোনো ক্লেইম থাকলে চট করেই ওকে পেয়ে যায়। তাই কষ্ট হলেও ও মোবাইল নিয়েছে। আর এর ফল হাতেনাতেই পাচ্ছে। এই যে মিতা আপা, অত বড় সরকারি অফিসার, উনি পর্যন্ত ওকে ডেকে ইন্স্যুরেন্স করলেন। মিতা আপার কথা মনে হতেই হঠাৎ করেই রেহনুমা নামের মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়। সাথে সাথে শার্টের ছেঁড়া বোতামের কথাও মনে পড়ে। কী কেলেংকারী! মেয়ে দেখতে যেয়ে এমন বোকা হয়ে গেল! সেদিন আবার স্যান্ডো গেঞ্জিও পরেনি। কেলেংকারীর একশেষ।
আরিফ আলনা থেকে সেদিনের বেগুনি রঙের শার্টটা নামায়, বোতাম লাগাতে হবে এটাতে৷ একটু ভাবে, তারপর মনে মনেই হাসে। মেয়েটা বলেছিল ওর সেলাইয়ের দোকানে নিয়ে যেতে, সেলাই করে দেবে। যাবে নাকি আজ?
ভাবনাটা ভাবতেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। দেখাই যাক, এমনি এমনি বলেছে নাকি ওকে মায়া করে কথাটা বলেছে। আরিফ এবার মোবাইলটা বের করে মিতা আপাকে একটা মিস কল দেয়। মিতা আপার সাথে একটা বোঝাপড়া হয়ে রয়েছে, ও মিসকল দিলেই উনি ব্যাক করেন। এক মিনিট কথা বললে অনেক টাকা কেটে নেয়। প্রতি মিনিটে সাত টাকা করে।
আরিফ অপেক্ষা করে। একটু পরেই মিতা আপা ঠিক ফোন করেন। ওপাশ থেকে মিতা আপার উচ্ছ্বসিত গলা পাওয়া যায়, ‘কী খবর আরিফ, আর তো কিছু বললে না সেদিনের পরে।’
আরিফ একটু সংকুচিত হয়ে যায়। আসলে কী বলবে? ওর নিজেরই তো ঠিকমতো চলে না। এখন কী করে বিয়ের কথা বলে।
আরিফ একটু দ্বিধা নিয়ে বলে, ‘আপা, ওই যে সেদিনের মেয়েটা, মানে রেহনুমার দোকানের ঠিকানা মেসেজ করতে পারবেন? বলেছিল একটা ইন্স্যুরেন্স করবে।’
ওপাশ থেকে মিতা আপার জোর হাসি শোনা যায়, বলেন, ‘একেবারে সারাজীবনের জন্য ইনস্যুরেন্স করে নাও। আচ্ছা দিচ্ছি ঠিকানা।’
একটু পরেই মেসেজ আসে মিতা আপার। আরিফ ভালো করে ঠিকানা দেখে নেই। দোকানের নামটা তো দারুণ সুন্দর, ‘সুঁই-সুতা’।
আরিফ ব্যাগে শার্টটা নেয়। কী মনে করে এক সেট ইন্স্যুরেন্সের ফরমও নিয়ে নেয়। শুধু শার্ট নিয়ে গেলে আবার না ভাবে ছেলেটা কেমন হ্যাংলা। এমনি এমনি বলেছি আর চলে এসেছে।
২.
নভেম্বরের মাঝামাঝি। এখন মিষ্টি হেমন্তকাল, বাতাসে শীতের হালকা আমেজ। বিকেলের রোদে দারুণ মায়া। রেহনুমার খুব ভালো লাগে হেমন্তকাল। ওর দোকানটা একদম এক কোণে। তাতে করে একটা পাশ খালি, বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা না। এই পাশটা বড় গ্রিল দিয়ে ঘেরা। তার ফাঁক দিয়ে রোদ আসে, বৃষ্টি আসে, হু হু করে বাতাস এসে ঝুপ করে ওর এই ছোট্ট সুঁই সুতার দোকানে ঢুকে পড়ে। ওর কপালের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় দুষ্ট ছেলের মতো।
রেহনুমা মন দিয়ে একটা জামায় হাতের কাজ করছিল। হঠাৎ খেয়াল করে দোকানে সামনের বারান্দায় একটা ছায়া পড়েছে। পশ্চিমের সূর্যের আলো কেউ আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। রেহনুমা মুখ তোলে, তাকিয়ে থাকে। একটু সময় লাগে, তারপর ঠোঁটের কোণে, মুখের ভাঁজে হাসি বিস্তৃত হয়। সেই বোকা ছেলেটা!
আরিফ সত্যিই একটা বোকার মতো হাসি দেয়। এখানে পৌঁছে এখন কেন জানি খুব সংকোচ লাগছে। কাজটা কি বেশি বোকার মতো হয়ে গেল?
জড়তা কাটিয়ে আরিফ এবার সামনে এগিয়ে যায়, তারপর হাসিমুখে বলে, ‘আসতে বলেছিলেন, চলে এলাম। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, একজন ক্লায়েন্টের একটা ক্লেইমের চেক দিতে। ভাবলাম আপনার এখানে ঢুঁ মেরে যাই। যদি একটা ইন্স্যুরেন্স করেই ফেলেন।’
রেহনুমা মুচকি হাসে, মাথা নেড়ে বলে, ‘তাই বুঝি? কিন্তু আপনি আমার দোকান চিনলেন কী করে? যতদূর মনে পড়ে আমি তো আপনাকে কোনো ঠিকানা দেইনি।’
আরিফের এবার সব গোলমাল হয়ে যায়। ইশ, মিথ্যেটাও ও ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারে না। ঠিক ধরে ফেলেছে, এই মেয়ে তো দারুণ বুদ্ধিমান।
আমতাআমতা করে বলে, ‘ওই মিতার আপার অফিসে গিয়েছিলাম কিস্তির টাকা আনতে, তখন কথায় কথায় আপনার ঠিকানা নিলাম। যদি একটা ইন্স্যুরেন্স খুলেই ফেলেন।’
রেহনুমা আর ঘাটায় না, বেচারার চোখমুখ কেমন লাল হয়ে গেছে। ও এবার আন্তরিক গলায় বলে, ‘খুব ভালো করেছেন এসে। এই টুলটায় বসতে পারেন। দোকানটা ছোট, একটা মেয়ে কাজ করে আমার সাথে। ভেতরে বসার ব্যবস্থা নেই।’
আরিফ একটা টুল টেনে বসতে বসতে বলে, ‘কোনো সমস্যা নেই। এখানেই বসছি।’
রেহনুমা নরম গলায় বলে, ‘পাঁচটা মিনিট একটু বসুন। মেয়েটাকে একটা কামিজর কাটিং একটু দেখিয়ে দেই।’
আরিফ আগ্রহ নিয়ে দেখে রেহেনুমা কেমন যত্ন নিয়ে মেয়েটাকে কামিজের ভি শেপ গলা কী করে কাটতে হয় তাই দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, গোলমাল করে ফেলছিল।
আরিফ এবার টুল থেকে উঠে পড়ে, বলে, ‘আমি দেখিয়ে দেই?’
রেহনুমা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, কিছুক্ষণ মুখে কথা জোগায় না। তারপর বিস্মিত গলায় বলে, ‘আপনি এসব কাটাকুটি পারেন!’
আরিফ একটা নির্মল হাসি হাসে, কিছু বলে না। ও মেয়েটাকে বলে, ‘শোনো এটা তো ভি-শেপ গলা। প্রথমেই ঠিক করে মাপটা দিয়ে নাও। কামিজের উপরের আর নিচের পার্ট একসাথে এভাবে রাখো। এবার এখান থেকে সাড়ে সাত বা আট ইঞ্চি মাপ নিয়ে দাগ দাও। আর কলারের মাপটা সাধারণত সবাই তিন ইঞ্চি দেয়। ভি-শেপ গলার কলারের ক্ষেত্রে দুই সুতা বেশি দিবে। একদম কিনার থেকে এই মাপটা নিয়ে দাগ দাও। তারপর একপাশ থেকে নিচ পর্যন্ত দশ বা এগারো ইঞ্চি মাপ দিয়ে একটা দাগ দাও। এবার নিচের দাগটা আধা ইঞ্চি সামনে থেকে আর উপরে দাগের সাথে কোনাকুনি দাগিয়ে নাও। ব্যাস হয়ে গেল। এবার দাগ বরাবর কেটে ফেললেই হলো।’
রেহনুমা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল ওর কাজকর্ম। শেষ হতেই বলে, ‘বাহ, আপনি তো দেখি পাকা দর্জি। কোথায় শিখলেন?’
আরিফ হেসে বলে, ‘জানেন তো, আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের কত কিছু করতে হয়। যখন চাকরি পাচ্ছিলাম না তখন একবার ভাবলাম জামা বানানো শিখব। কিছুদিন প্রশিক্ষণও নিলাম, হাত বেশ ভালই পেকেছিল। তারপর হুট করে এই ইন্স্যুরেন্সের পচা চাকরিটা হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে আপনার মতো স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতাম, খুব ভালো হতো।’
রেহনুমা আলতো করে বলে, ‘কখনও ইচ্ছে হলে সংকোচ করবেন না, আমার এখানে চলে আসবেন।’
আরিফ তাকিয়ে থাকে, বোঝার চেষ্টা করে কথাটা কি দুষ্টুমি করে বলল নাকি সত্যি সত্যিই?
ওকে আনমনে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেহনুমা এবার হেসে বলে, ‘কই, আপনার ইন্স্যুরেন্সের ফরম কই, দিন পূরণ করে দেই।’
আরিফ ঠিক বিশ্বাস করে না, সন্দিহান গলায় বলে, ‘আপনি সত্যিই করবেন?’
রেহনুমা বাচ্চাদের মতো বলে, ‘হ্যাঁ তো।’
আরিফ মাথা নাড়ে, তারপর তাড়াহুড়ো করে ফর্মটা বের করতে যেতেই ভেতরের শার্টটা বের হয়ে আসে।
ব্যাপারটা খেয়াল করে রেহনুমা, চোখ বড় করে বলে, ‘এটা সেই শার্ট না যেটার বোতাম ছেঁড়া ছিল? আপনি বুঝি সেজন্যই এসেছিলেন? তাহলে যে বললেন এদিকেই একটা কাজে এসেছিলেন?’
রেহনুমা শেষ কথাটা বলে মিটিমিটি হাসতে থাকে। আর আরিফের মনে হয় ‘হে ধরণী দ্বিধা হও’।
ওকে লজ্জা পেতে দেখে রেহনুমা এবার নরম গলায় বলে, ‘ঠিক আছে দিন, আমি বোতামটা লাগিয়ে দিচ্ছি।’
রেহনুমা যত্ন করে বোতামটা লাগিয়ে দেয়। ওর কাছে সাদা, লাল, নীল নানা রঙের বোতাম থাকেই। তাই অসুবিধা হয় না৷ এরপর উপরে নিচে অন্যান্য বোতামগুলোও একবার পরখ করে দেখে। বুকের কাছের আরেকটা বোতামের সুতা আলগা হয়ে আছে। রেহনুমা সেটাও সেলাই করে দেয়।
বোতাম লাগানো শেষে রেহনুমা শার্ট ফেরত দিতে দিতে বলে, ‘এরপর বোতাম ছিঁড়ে গেলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন, লাগিয়ে দেব। আর কই ফর্মটা দিন, কোথায় কোথায় সিগনেচার করতে হবে দেখিয়ে দিন।’
আরিফ এবার ফর্মটা বের করে ওকে বুঝিয়ে দেয় কোথায় কী লিখতে হবে।
সবকিছু যখন শেষ হয়ে যায় তখন আরিফ কৃতজ্ঞতার সুরে বলে, ‘আপনি আমার অনেক উপকার করলেন। একটা ইন্স্যুরেন্সে খুলতে একজনের পেছনে কত মাস বছর ঘুরতে হয়। আপনি এক কথাতেই খুলে ফেললেন। আবার আমার ছিঁড়ে যাওয়া বোতামটাই শুধু লাগিয়ে দিলেন না অন্য নড়বড়ে বোতামগুলোও ঠিক করে দিলেন। কী করে এর শোধ দেই বলুন তো?’
রেহনুমা তাকিয়ে থাকে, তারপর বিষণ্ণ গলায় বলে, ‘সবকিছুর বুঝি শোধ দিতে হয়? যদি দিতেই চান তাহলে মাঝে মাঝে আমার সাথে পুকুর পাড়ে একটু বসে থাকবেন। তাতেই আমি আমারটুকু পেয়ে যাব।’
আরিফ মাথা নাড়ে, বুঝতে পারে একটা দুঃখবোধ আছে মেয়েটার। তার কিছুটা আঁচ গলায়। ওকে স্বাভাবিক করতেই বলে, ‘কিন্তু আপনার তো ফোন নেই, আমি জানব কি করে আপনি পুকুর পাড়ে যাচ্ছেন? একটা ফোন নিয়ে নিন না। তাতে কিন্তু আপনার এই বিজনেসটাও বাড়বে। কাজও সহজ হবে।’
রেহনুমা নিজেও ভাবছিল একটা ফোন কেনা দরকার। আরিফের কথায় উৎসাহ পায়, আবদারে গলায় বলে, ‘আমাকে একটু কিনে দেবেন? মানে আমার সাথে যাবেন? আমি তো ঠিকঠাক বুঝি না কোনটা ভালো।’
আরিফও এবার উৎসাহিত গলায় বলে, ‘সামনের শুক্রবারেই আসেন, এলিফ্যান্ট রোডের মোতালেব প্লাজায়। দেখে শুনে একটা সুন্দর মোবাইল কিনে দেব। মানে পছন্দ করে দেব।’
শেষ কথাটা বলে ও হাসে, শুদ্ধ একটা হাসি। রেহনুমা একটা ভালো লাগা টের পায়। ছেলেটার হাসি খুব সুন্দর, নির্মল। এই পৃথিবীতে অন্তত একজন বন্ধু বুঝি ও পেল, যে ওর ছোট ছোট সুখগুলো বুঝবে।
আর আরিফ ভাবছিল, এই মেয়েটার ভেতর একটা মায়া লুকিয়ে আছে, নিভৃত কুহক। আর সেটা ওর জন্যই।
সেদিন আরিফ বাসায় ফিরে আসে, ব্যাগের ভেতর রেহনুমার ঠিক করে দেওয়া শার্ট। কেন যেন মনে হয় এই মেয়েটা ওর জীবনের সব ছেঁড়া ফাঁটা দুঃখগুলো সুখের সুঁই সুতো দিয়ে বুনে সারাজীবনের জন্য ঠিক করে দেবে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৮/০৪/২০২৩