বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২) #পর্বঃ০৩

0
270

#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

দেখতে দেখতে চোখের নিমেষে দু’দিন পার হয়ে গেলো৷ আজ তৃধা এবং তার বাচ্চাকে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। চুপচাপ বাচ্চাকে জামা কাপড় পড়াচ্ছে তৃধা, তার ভাবী মোহনা থমথমে মুখ করে সব জামা কাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখছে। বেডে বসে মোহনাকে ব’কে চলেছেন শায়লা খাতুন।

” তোমাকে দিয়েও না কোন কাজ হয়না। আরেকটু ধীরেসুস্থে বুঝিয়ে বলতে পারলেনা বাপু? দেখছো একটা ঝা’মেলা হয়েছে, আরেকটু নরম স্বরে কথা বলতে পারলে না তুমি?”

” মা আপনি এবার চুপ করবেন? আমি আর নরম স্বরে কথা বলতে পারবোনা। বেশি প্রয়োজন হলে নিজেই ফোন করুন, আমি তে বারণ করিনি আপনাকে। বারবার অপ’মান হতে আপনার ভালো লাগলেও আমার এসব অ’সহ্য লাগে।”

বউয়ের কথা শুনে শায়লা বেগম থমথমে মুখ করে বললেন, ” অ’সহ্য তো তোমার লাগবে। মেয়েটাতো তোমার না। আমি তো মা, তাই লাজলজ্জা বির্স’জন দিয়ে আমাকেই আপোষ করে নিতে হবে।”

এসবের মধ্যে তৃধা একদম নির্বিকার হয়ে বসে রয়েছে। শাশুড়ী-বউয়ের মধ্যে শীতল মনোমালিন্য হওয়ার মূল কারণ ফাতেমা বেগম। শায়লা খাতুন সকাল হতেই জোরপূর্বক মোহনাকে দিয়ে তৃধার শাশুড়ীর কাছে ফোন করিয়েছেন যেন তিনি এসে তৃধাকে নিয়ে যান। এটা শুনে ফাতেমা বেগম সরাসরি বলে দিয়েছেন,

” এখন তাদের এ বাড়িতে আনার দরকার নেই। মহারাণীকে ওনার বাপের বাড়িতেই নিয়ে যান। সেখানে থাকুন কয়েকদিন, বাকিটা আমরা পরে চিন্তা করে দেখবো৷ তোমাদের তো আবার এতো টাকা পয়সাও নেই, যদি দরকার পড়ে তাও বলোনা। কোন ফা’লতু কাজে আমি আমার ছেলের টাকা গুলো খরচ করতে চাইনা।”

ওনার এধরনের কথা শুনে মোহনা ভীষণ অপমা’নিতবোধ করে। স্বভাবগতভাবে মোহনা চুপ থাকতে না পেরে মুখের উপর বলে ফেললো,

” আমাদের টাকা-পয়সা কম থাকলেও বিবেক আছে। কিছু মানুষের মতো অন্তত অমা’নুষ না। আর আমার এতোটাও অভাবী নয় যে আপনাদের মতো মানুষদের কাছে টাকা চাইতে হবে। রাখছি, ভালো থাকবেন।”

শায়লা খাতুন সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মোহনার কথাগুলো ওনার একটুও পছন্দ হয়নি, যার কারণে তিনি তার উপর কিছুটা বিরক্ত।

” মা তোমাদের যদি আমার আর আমার মেয়ে নিয়ে এতোটাই অসুবিধে থাকে তাহলে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তোমরা চলে যেতে পারো, আমি নিজের ব্যবস্থা করে নেবো। আর যাইহোক কারোর বিরক্তির কারণ হতে চাইনা।”

” ঠাটিয়ে একটা চ’ড় মারবো। বাচ্চা জন্ম দিয়ে নিজে বড় ভাবছো না? তুমি তোমার নিজের বাড়ি যাবে। এতে কে কি ভাবলো তা তোমার দেখার প্রয়োজন নেই। ও বাড়িতে কারো যদি বেশি স’মস্যা হয় তাহলে তোমাকে আমি আমার সাথে কক্সবাজার নিয়ে যাবো। আমার সাথে কোয়াটারে থাকবে তোমরা। এবার যাও তৈরি হয়ে নাও, বাবুকে আমার কাছে দাও। আমি ডাক্তারের সাথে শেষবার আরেকটু কথা বলে আসছি।”

মেয়েকে ভাবীর কাছে রেখে তৃধা জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। ব্যাগপত্র সব বেডের উপর রেখে মোহনাও বাবুকে নিয়ে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেলো। শায়লা খাতুন নির্বিকার হয়ে সেখানেই বসে রইলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে তিনি নিজের মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে ভীষণ রকম চিন্তিত।

” তোরা ভাবছিস আমি বোধহয় নি’ষ্টুর মা, যে কিনা সব বুঝেও নিজের মেয়েকে সেই সংসারে ফিরে যাওয়ার জন্য বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছি। শত অপমান মেনে বারবার তাদের দোরগোড়ায় ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু তোরা কি বুঝবি মা এই সমাজের নিয়ম। সমাজ কিছু না বললেই তো আর হয়না। শত চেষ্টা করলেও আমরা সমাজের অলিখিত নিয়মকানুনের বেড়াজালেই আবদ্ধ হয়ে থাকবো। একদিন, দুইদিন এরপর আমাদের ঠিকই আবারো সমাজের নিয়মে চলতে হবে৷ ইচ্ছে না থাকলেও সমাজের সাথে আপোষ করে থাকতে হবে, না হলে এই নি’ষ্টুর সমাজ যে কাউকে বাঁ’চতে দেয়নারে।”
.
.

মেয়েকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে চলে এলো তৃধা। সারারাস্তা মায়ের সাথে একটা কথাও বলেনি সে। মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে নিজে বসলো দুপুরের খাবারের জন্য৷ মোহনা তাড়াহুড়ো করে ডাল, বেগুন ভাজি, আলু ভর্তা আর ভাত টেবিলে রাখলো।

” তৃধা এখন একটু ক’ষ্ট করে খেয়ে নে। এই কম সময়ে আর কিছু রান্না করার সময় পাইনি। এখন এগুলো খেয়ে নে, রাতে ভালো কিছু রান্না করবো।”

” মোহনা তুমি এসব কি রান্নার করেছো? কোথায় একটু ভারী খাবার রান্না করবে, মাছ-মাংস করবে তা না কিসব ডাল, ভর্তা দিচ্ছো ওকে। তৃধা তুই বস আমিই রান্না করে আনছি। আমারই ভু’ল হয়েছে তোমাকে রান্না করতে বলা।” বেশ চড়া গলায় বললেন শায়লা খাতুন। শাশুড়ীর কথায় মোহনা কিছুটা বিব্রত হলো। মায়ের এধরণের কথা শুনে তৃধা একপ্রকার চেঁ’চিয়ে বললো,

” মা তুমি মোহনাকে এসব কি বলছো? সে তো বলেছে রাতে আরো ভালো রান্না করবে। আর মোহনার উপর দিয়ে এ কয়েকদিন কতটা ধকল গিয়েছে তুমি বেশ ভালো করেই জানো। আমার জন্য সে ছুটি নিয়ে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম ছুটে এসেছে। এখানে এসে নিজের ছেলের খেয়ালও ঠিকমতো রাখতে পারেনি আমাকে দেখাশোনার জন্য। দু’দন্ড বিশ্রাম যে নেবে তারও সুযোগ পাইনি। সেও তো মানুষ মা। যা রান্না করেছে তাই বা কম কিসে? এতো কিছুর পর আমারো ভারী খাবার খেতে ইচ্ছে করছিলো না, এগুলোই আমি আরামসে খেয়ে নিতে পারবো। তোমার যদি এতোই খাওয়ানো ইচ্ছে ছিলো তাহলে মোহনাকে না পাঠিয়ে নিজে রান্না করতে। তাহলে মেয়েটাও একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেতো।”

প্লেটে ভাত আর ডাল নিতে নিতে তৃধা বললো,

” আমি জানি মা আমার কথা শুনে তোমার খা’রাপ লাগবে কিন্তু মা তুমি হয়তো জানো না তুমি না জেনে মাঝে মাঝে মোহনাকে এটা সেটা নিয়ে কথা শোনাও, নিজের কিছু সিদ্ধান্ত তার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো।”

চামচটা বাটিতে রেখে শায়লা খাতুনের চোখে চোখ রেখে পুনরায় বললো,

” আমি আমার মাকে চিনি। তিনি কত কিছু স’হ্য করে এই পর্যন্ত এসেছেন তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। মা তুমি এমন কোন কাজ করোনা যেন কারো দীর্ঘশ্বাস তোমার উপর পড়ে। সে তোমার সামনে না হোক অন্তত মনে মনে হলেও কখনো যেন তোমার বিরুদ্ধে কিছু না বলে, এমন কোন কাজ করোনা যেন সে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নিয়ে তোমার সাথে চলাফেরা করে।”

মেয়ের কথায় শায়লা খাতুন চুপসে গেলেন। ভাতের থালাটা নিয়ে মায়ের পাশে বসলো তৃধা।

” মা আমাকে আজকে খাইয়ে দেবে? কতগুলো মাস পেরিয়ে গেলো তোমার হাতে খাইনি। আজকে খাইয়ে দেবে? কাল যদি আমি না থাকি তখন?”

” বউমা ঠিকই বলেছে। তোকে ঠাটিয়ে দু’টো চ’ড় মা’রা উচিত তাহলে যদি তুই বা’জে কথা বন্ধ করিস। নে এবার হা কর। খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর, আমার হয়েছে যত জ্বা’লা। এই তোর লজ্জা করেনা এতো বড় মেয়ে হয়েও অর্ক’মার মতো মায়ের হাতে খাচ্ছিস?”

” না করেনা৷ আমি সবার কাছে বড় হলেও আমার মায়ের কাছে সবসময় ছোট তৃধা হয়েই থাকতে চাই।” মাকে একপাশে জরিয়ে ধরে বললো তৃধা। মেয়ের আবদারমাখা আবেগ মিশ্রিত কথা শুনে শায়লা খাতুনের চোখে পানি জমে গেলো। মা-মেয়ের এই সুন্দর দৃশ্য দেখে মোহনাও বেশ খুশি হলো। সে তাদের একা ছেড়ে দিয়ে নিজের ছেলের কাছে চলে গেলো।
.
.

অনবরত বেলের শব্দে নন্দিনী ভীষণ বি’রক্ত হলো।

” বাড়ির মানুষগুলো ম’রে গিয়েছে নাকি? তৃ…. ধুর ওই হত’চ্ছাড়ি তো নেই। এই মা আর তিথিও কোন কাজের না। সারাদিন খালি শুয়ে বসে কাটাবে। আরে বাবা আসছি তো। কেউ ম’রে’ছে নাকি?”

বিরবির করতে করতে নিজেই দরজা খুলে দিলো। এমনিতেই সে বি’রক্ত ছিলো, দরজা ওপারের মানুষটাকে দেখে যেন তার বিরক্তির সীমা আরো কয়েকধাপ বেড়ে গিয়েছে।

” তাই তো বলি এভাবে অশিক্ষিত, অভদ্রের মতো অনবরত বেল বাজাচ্ছে কে?”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here