#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” এই সময়ে ফোন দিলি যে? সবঠিক আছে তো? তোর শাশুড়ী আবার কিছু করলো না তো?”
” না আমি অন্য একটা জিনিস জানার জন্য তোকে ফোন দিয়েছি।”
” কি হয়েছে তৃধা? তোকে এতো চিন্তিত লাগছে কেন?”
” অফিস থেকে ফিরে এসে দেখলাম তেজবীন শুয়ে আছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই একপ্রকার ধা’ক্কা দিলো। তন্বী কেঁদে উঠতে এমনভাবে তাকালো যেন খে’য়ে ফেলবে। পরে চিৎকার করে বললো তার নাকি মাথাব্যথা করছে।”
মোহনা বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,
” এতো কিছুর পরেও তুই কেন দরদ দেখাতে যাস বলতো? মাথাব্যথা করছে তো একটা প্যারাসিটামল দিয়ে দে, চলে যাবে। বুঝি না বাপু তোর এতো দয়ার শরীর কেন।”
” আমার কেন যেন কিছু ঠিক লাগছেনা মোহনা। ওর চোখগুলো কিরকম যেন লাল হয়ে গিয়েছে। শুয়ে আছে কিন্তু চটপট করছে, মাঝেমাঝে বিরবির করছে। ওর আচরণ কেন যেন আমার অদ্ভুত ধরণের লাগছে।”
তৃধার কথা শুনে মোহনা বিরক্তি ভাব একপাশে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
” তুই কিছু দিয়েছিস ওকে? মানে ওষুধ বা অন্যকিছু?”
” আমি এসে রং চা, প্যারাসিটামল খাইয়ে দিয়েছি। কপালে বাম দিয়ে ম্যাসাজ করে দিয়েছি কিন্তু তাও চটপট করছে। এখন তুই বল কি করবো? এতোরাতে তো কোন ডাক্তারও নেই।”
” আচ্ছা তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি হসপিটালের কোন বড় ডাক্তারকে ফোন করছি।”
” আচ্ছা তাড়াতাড়ি জানাস।”
ফোন কেটে তৃধা আরেকবার রুমে উঁকি দিয়ে তেজবীনকে দেখে নিলো এবং অপেক্ষা করতে লাগলো মোহনার ফোনের। মোহনা একটা সরকারি হসপিটালে নার্স হিসেবে চাকরি করছে। চাকরি সূত্রে সে তার ছেলেকে নিজে কোয়ার্টারে থাকে এবং তৃধার ভাই এখানে তার বাবা-মায়ের সাথে থাকে।
কিছুসময় পর মোহনা ফোন করে তাকে কিছু ওষুধের নাম বললো, সাথে বেশি ব্যথা করলে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিতে বললো। আপাতত রাতটা এগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে বলেছেন ডাক্তার। অতিরিক্ত হয়ে গেলে বাকিটা সকালে হসপিটালে নিয়ে দেখা যাবে।
ঘড়ির দিকে তাকালো তৃধা। ঘন্টার কাঁটা দশটার ঘরে যাই যাই করছে। সে কিছুক্ষণ কাগজের দিকে তাকিয়ে নন্দিনীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
” কি চাই?”
” আপনার স্বামী আছে?” ইতস্তত হয়ে জিজ্ঞেস করলো তৃধা। তৃধা রুদ্রকে খুঁজছে এটা নন্দিনীর ঠিক হজম হলো না।
” কেন? এই রাতের বেলা ওকে কেন দরকার? কোন মতলবে তুমি রুদ্রকে খুঁজছো?”
” দেখুন কিছু না জেনে উল্টোপাল্টা কথা মাথায় আনবেন না। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকেন, একটু আশেপাশের খোঁজখবর রাখুন৷ আপনার ভাই যে মাথাব্যথায় ছটফট করছে সেটা জানেন? সারাদিন তো ভাইয়ের কান ভাঙান, বাড়ি ফিরলেই তার আশেপাশে ঘুরতে থাকেন। তাহলে আজ কেন আপনাকে দেখলাম না? যাক সেসব কথা, আপনাকে বলে লাভ নেই। নিজের খাবার বেড়ে খেয়ে নিন, আমি বেড়ে দিতে পারবো না। আমার দশটা হাত নেই যে আপনাদের সবার কাজ আমি একা করতে পারবো।”
রুমে এসে টাকার ব্যাগ নিয়ে ওষুধ কিনতে বেরিয়ে পড়লো তৃধা। কপাল ভালো বিদায় কাছাকাছি একটা দোকান খোলা পেয়ে গেলো সে। ওষুধ নিয়ে এসে তেজবীনকে জোড় করে একটু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো৷ কিছুসময় পর জোড়ে ফ্যান ছেড়ে, মাথায় একটু তেল দিয়ে দিলো। তেজবীন ঘুমিয়ে যেতে তৃধা দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজ রাতটা সে এবং তন্বী তিথির রুমেই থাকবে।
পরেরদিন সকালে অফিসের জন্য তৈরি হতে গেলে তৃধা দেখলো তেজবীন অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে।
” আজ এতো তাড়াতাড়ি তৈরি হচ্ছো যে? মাথাব্যথা কমেছে? না হলে ডাক্তার দেখিয়ে এসো।”
” দরকার নেই আমি ঠিক আছি।”
তেজবীনের চোখের দিকে তাকালো তৃধা। না লালভাবটা আর নেই, আগের মতোই স্বাভাবিক আছে। যা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।
.
.
তন্বীকে গোসল করিয়ে জামা পড়াচ্ছিলেন শায়লা খাতুন। অনাঙ্ক্ষিত বেলের শব্দে চমকে উঠলেন তিনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন বারোটা তেরো, এই ভরদুপুরে কে আসবে তাই চিন্তা করতে লাগলেন তিনি। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তন্বীকে কোলে নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে এলেন শায়লা খাতুন। ডোর হোল দিয়ে বাইরে দেখলেন, দরজার অপরপ্রান্তে থাকা মানুষ দু’টোকে দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। দ্রুত পায়ে দরজা পাশ থেকে সরে তৃধাকে ফোন করতে লাগলেন। কিন্তু তৃধা ফোন ধরছেনা, এদিকে অনবরত বেলও বেজে চলেছে। উপায় না পেয়ে একপ্রকার মনে ভয় নিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
” কেমন আছেন চাচী?” একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো নন্দিনী।
” ভালো। বেয়াইন আপনারা আসবেন আগে তো বলেননি। তৃধাও তো আমাকে এই বিষয়ে কিছু বলেনি।”
” কেন? আগে থেকে বলে রাখলে ঘরে তালা মেরে অন্যের বাসায় বসে থাকতেন নাকি?”
” না না, সেরকমটা নয়। আপনারা আসবেন জানলে ভালে কিছু রান্না করতাম।”
” থাক এসবের দরকার নেই। এমনিতেও আপনাদের বাড়ির খাবার আমি মুখে তুলতাম না।”
” বাড়িতে আর কেউ নেই?” সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো নন্দিনী।
শায়লা খাতুন চারিপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মিনমিন করে জবাব দিলেন, ” না আমি আর তন্বীই আছি। আপনারা বসুন আমি কিছু নিয়ে আসছি।”
” ওই বাচ্চা নিয়ে কাজ করতে পারবেন তো? সমস্যা হলে এখানেই রেখে যান।”
” না মা তার দরকার নেই৷ তোমরা বসো আমি আসছি।”
তন্বীকে সহ নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন তিনি। তৃধাকে আরো কয়েকবার ফোন দিয়েও পেলেন না শায়লা খাতুন৷ এক হাতে বাচ্চা নিয়ে অন্যহাতে অনেক কষ্ট করে নাস্তা রেডি করলেন। নাস্তার প্লেট টেবিলে রেখে তিনি খেয়াল করলেন ফাতেমা বেগম একাই বসে আছেন।
” বেয়াইন, আপনার বড় মেয়ে কোথায়?”
” বাথরুমে গিয়েছে একটু, চলে আসবে। আপনি একটু লেবুর শরবত বানিয়ে আনুন তো, আমার মেয়ে এইসব ট্যাং খাই না।”
বাড়িতে যেহেতু একা, যেন কোন ঝামেলা না হয় তাই তিনি চুপচাপ লেবুর শরবত বানাতে চলে গেলেন।
শরবত নিয়ে ফিরে এসে দেখলেন নন্দিনী ফিরে এসেছে। গ্লাসটা তার সামনে রেখলেন তিনি।
” এই নাও মা, তোমার লেবুর শরবত।”
নন্দিনী গ্লাসটা দূরে সরিয়ে দিলো। নাক-মুখ কুচকে বললো,
” আপনারা এতো অপরিষ্কার কেন? বাথরুম যেতেই গা ঘিনঘিন করে উঠেছে।”
নন্দিনীর কথায় শায়লা খাতুন বেশ অবাক হলেন কারণ বাথরুম আজ সকালেই তিনি নিজ হাতে পরিষ্কার করেছেন। সেইসাথে নন্দিনীর কথা শুনে ভীষণ বিব্রত হলেন এবং লজ্জা পেলেন।
” কিন্তু আমি…..”
” থাক থাক আর সাফাই গাইতে হবেনা। মা চলো এখানে আসাই উচিত হয়নি।”
কথা শেষ করে একমুহূর্তও দাঁড়ালেন না দুজনে। ওদের কাজে আবারো অবাক হলেন শায়লা খাতুন। টেবিলে থাকা নাস্তার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আবারো দরজার দিকে তাকালেন তিনি। এসে ওনারা দশ মিনিটও বসেননি, তারপর কতগুলো খাবার নষ্ট হলো। দরজা বন্ধ করে তিনি ঘরের দু’টো বাথরুম চেক করলেন, না দু’টোই একদম পরিষ্কার।
” বাথরুম পরিষ্কার আছে তা তো আমি জানতাম। তাহলে নন্দিনী কেন এরকমটা বললো?”
সন্ধ্যায় তৃধা বাড়ি ফিরে মায়ের সুখে এসব শুনে অনেক ক্ষেপে গেলো।
” মা তোমাকে না বারণ করেছিলাম ওরা এলে দরজা খুলবে না আর তুমি কিনা ওদের ঘরে এনে আপ্যায়ন করেছো।”
” আরে ঘরে আসা আত্নীয়কে কি করে ফিরিয়ে দি? দরজার সামনে থেকে কি কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়?”
” আরে রাখো তোমার আত্নীয়, ভালো করেই জানো ওরা হচ্ছে একেকটা গিরগিটি। তুমি আমাকে ফোন করে জানাবে না।”
” করেছি তো, তুই তো ধরলি না। তো আমি কি করতাম বল?”
তৃধার মনে পড়লো সে তো আজ ফোন বাড়িতে রেখেই অফিসে চলে গিয়েছে৷ তার এখন নিজের কপাল চাপড়াতে মন চাইছে।
” তুমি কি তন্বীকে ওদের কাছে দিয়েছিলে?”
” আরে আমি পা’গল নাকি যে দিভাইকে ওদের কাছে রেখে যাবো?”
” আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি সাবধানে থেকো। আমরা কালকে আসবো।”
তন্বীকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলো তৃধা। তার মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে,
” আচমকা আজকেই কেন তারা এই বাড়িতে এলো?”
চলবে……