বৈধ_দৃষ্টি #পর্বঃ৩২

0
261

#বৈধ_দৃষ্টি
#পর্বঃ৩২
#ফাতেমা_জান্নাত

—“দুই স্বামীর সাথে-ই তো সংসার করেছো। তা একটা ঘর থেকে ও তো সন্তান এর মুখ দেখাতে পারলে না”।

সোফায় বসে চম্পার সাথে কথা বল ছিলো রাফিয়া। পাশে-ই সাবিনা বসে ছিলো। নাজমা বেগম পান চেঁচে খাচ্ছিলো।মুখ এর মধ্যে পান পুরে রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে কথা টা বলে উঠে।নাজমা বেগম এর কথায় পরিবেশ গুমোট ধরে যায়।রাফিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।আর যাই হোক শাশুড়ি এর সামনে তাকে এই কথা বলায় লজ্জায় এখন শাশুড়ি এর দিকে তাকাতে পাচ্ছে না।সাবিনা নিজে ও লজ্জা পেয়েছে খালা শাশুড়ি র কথায়।বউ শাশুড়ি কে সামনা সামনি রেখে এমন কথা বলা অবশ্য-ই লজ্জা জনক।রাফিয়া কে চুপ করে থাকতে দেখে সাবিনা সাহস জুগিয়ে স্বগতোক্তি করে নাজমা বেগম কে বলে উঠে,

—খালাম্মা,আপনি রাফিয়া কে এসব কি ধরন এর কথা বলছেন?তাছাড়া এখানে আমি ও উপস্থিত আছি।শাশুড়ি এর সামনে বউ কে এমন করে কিসের কথা বলেন?

সাবিনার কথা শুনে নাজমা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকায় সাবিনার দিকে।এত দিনে সাবিনা কে ধমকে ধামকে তাকে ভয় পাইয়ে চুপ করিয়ে রেখে ছিলো। যাতে কখনো তার কথার প্রত্যুত্তর দিতে না পারে।আর আজ সেই সাবিনা কি না তার কথার উত্তর দিচ্ছে?এই জন্য নাজমা বেগম তেঁতে উঠে তিক্ত গলায় সাবিনা কে কিছু বলতে যাবে তার আগে-ই সাবিনা এক হাত উঁচু করে নাজমা বেগম কে থামতে বলে।নিজ এর কণ্ঠ স্বর আরো কঠিন করে সাবিনার উদ্দেশ্যে বলে,

—-আর না খালাম্মা। অনেক সহ্য করেছি।আপনি আমাকে এত দিন যা নয় তা বলে ছিলেন। আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু আমার বউ মা কে আপনি সব সময় একটা না একটা কথা নিয়ে যা ইচ্ছে তা বলে যাবেন।এটা এখন আর আমি সহ্য করতে পারবো না।তাছাড়া আপনি সন্তান এর কথা বললেন না?সন্তান কি হাত এর মোড়া নাকি? যে,নিজ এর মন মতো সন্তান এর জন্ম দেওয়া বা সন্তান কে দুনিয়া তে নিয়ে আসবে?সন্তান হচ্ছে আল্লাহর দান।আল্লাহর রহমত।আল্লাহ যা কে খুশি সন্তান দেন আবার যা কে খুশি দেন না।কাউ কে তাড়াতাড়ি সন্তান দেয় আবার কাউ কে দেরি করে সন্তান দেয়।ধৈর্য্য ধরে থাকতে হয় আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য।আর রাফিয়া সাফওয়ান এর তো বিয়ের এখনো এক বছর ও হয় নি।এত তাড়া কিসের আপনার?আল্লাহ যখন খুশি তখন সন্তান দিবে।আমার লজ্জা করছে শাশুড়ি হয়ে বউ মা সম্পৃক্ত কথা আমি আমার খালা শাশুড়ি কে এভাবে বলতে হচ্ছে।কিন্তু আজ তো আমি বলতে বাধ্য হয়ে ছি।বলা যায় আমি বলতে চাই নি।আপনি আমাকে বলতে বাধ্য করেছেন।শাশুড়ির সামনে ছেলে বউ কে আপনি প্রতি নিয়ত এসব কথা শুনালে কোনো শাশুড়ি সহ্য করতে পারবে কিনা জানি না। তবে আমি আর সহ্য করতে পারবো না।সব সময় যে কোনো বিষয়ে ধৈর্য্য ধরে থাকতে হয় খালাম্মা।হাদিসে ধৈর্য্য সম্পর্কে বলা আছে যে,

“যে ব্যক্তি ধৈর্য্য ধারণ এর চেষ্টা করে,আল্লাহ তাকে ধৈর্য্য এর শক্তি দান করেন।কোনো ব্যক্তি কে কল্যাণকর যা দেওয়া হয়,তন্মধ্যে ধৈর্য্য-ই সব চেয়ে উত্তম ও প্রশস্ত”(মুসলিম:১৭৪৫)।

তাছাড়া কোরআনুল কারীমে ও বলা আছে যে,

“নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্য্যশীল দের সাথে আছেন”(সূরা-বাকারা;আয়াত :১৫৩)

আবার ও বলা আছে,

“কেবল মাত্র ধৈর্য্যশীল দের কে-ই তাদের পুরষ্কার পূর্ণ মাত্রায় বেহিসাবি দেয়া হবে”।(সূরা -যুমার:আয়াত:১০)

তাই বলছি কোনো কিছু দেখতে এবং পেতে হলে ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে।যেখানে সাফওয়ান আর রাফিয়া ধৈর্য্য ধরে আছে।সেখানে আপনি কেন এত কথা বলছেন? তাদের সংসার নিয়ে?তাদের চিন্তা ভাবনা।তারা কি করবে না কি করবে না।আমার আপনার কেন এত মাথা ব্য”থা থাকতে হবে তাদের সংসার নিয়ে?দিন না তাদের কে তাদের মতো করে সংসার টা করতে।

কথা গুলো বলে-ই সাবিনা থামে।চার দিকে নিরবতা বিরাজমান। একটু টু শব্দ টুকু ও নেই।রাফিয়া এখনো মাথা নিচু করে আছে।চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে।নাজমা বেগম আর যাই বলুক কিন্তু উনার এসব কথা গুলো রাফিয়া সহ্য করতে পারে না।কষ্ট হয় ওর।কথায় কথায় তাকে লোভী, দুই বিয়ে করেছে, দুই স্বামীর সাথে থেকেছে বলে কথা শুনায় নাজমা বেগম।উনি এটা কেন বুঝতে পাচ্ছে না।এসব কিছু আল্লাহ রাফিয়ার ভাগ্যে লিখে রেখে ছিলো তাই এমন হয়েছে।

নাজমা বেগম এখনো চুপ করে সাবিনার দিকে তাকিয়ে আছে।তিনি বোধহয় এখনো বিশ্বাস করতে পাচ্ছে না সাবিনা তার মুখ এর উপর তাকে এত গুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছে।সাবিনা নাজমা বেগম এর এই দৃষ্টি কে উপেক্ষা করলো। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাফিয়ার কাছে গিয়ে রাফিয়ার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলে,

—ঘরে চল মা।এখানে আর বেশিক্ষণ বসে থাকার দরকার নেই।শরীর খারাপ লাগবে তোর আবার।চল আমার সাথে ঘরে চল।

রাফিয়া কে জোর করে টেনে উঠিয়ে নিয়ে তিনি ঘর এর দিকে পা চালালো। রাফিয়া ও আর কোনো বাক্য ব্যয় করেনি।সাবিনা যাওয়ার আগে চম্পা কে বলে দিয়েছে রাফিয়ার জন্য ঘরে কিছু ফল কে’টে পাঠিয়ে দিতে।

রাফিয়া কে নিয়ে নিজে দের রুমে-ই আসলেন সাবিনা।চম্পা ফল এনে দিতে-ই রাফিয়া কে ফল খাইয়ে দেয়।নিজে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে রাফিয়া কে তার কোলে মাথা দিয়ে শুতে বলে।রাফিয়া ও আর কোনো প্রকার দ্বিরুক্তি প্রকাশ না করে শুইয়ে পড়ে।সাবিনা কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে।সাবিনা রাফিয়ার মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়।পরম মমতা পেয়ে রাফিয়া চোখ বুঝে।নিঃশব্দে চোখ এর পানি ফেলে।নাজমা বেগম এর কথা গুলো মনে পড়লে-ই মনে হয় কেউ বুকে বি”ষাক্ত ধনুক গেঁথে দিয়েছে।রাফিয়া ও ভাবে-ই ঘুমিয়ে পড়ে সাবিনার কোলে। সাবিনা ও আর রাফিয়া কে সরিয়ে দেন নি কোল থেকে।আগের ন্যায় বসে থাকে।রাফিয়ার মুখ এর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।মেয়ে টা কালো তবু ও মুখ টা আস্ত মায়ায় ভরা।


আজ দুপুর এই সাফওয়ান বাসায় ফিরে এসেছে।একটা মিটিং ছিলো অফিসে। সেটা শেষ হতে-ই সবাই কে আজ বস ছুটি দিয়েছে।মূলত অন্য কম্পানির সাথে ডিল ফাইনাল হয়েছে।সেই খুশি তে আজ এমপ্লয় দের তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়েছে।

বাসায় ফিরে দেখে চম্পা রান্না ঘরে কাজ করছে।ড্রয়িংরুম কেউ নেই।সাফওয়ান নিজে দের ঘর এর দিকে পা বাড়ায়। ঘরে ঢুকে দেখে রাফিয়া ঘরে নেয়।সাফওয়ান কিছু টা অ’বাক হয়।কারণ এই সময় রাফিয়া হয়তো বেলকনি তে থাকে নয়তো নামাজে থাকে।সাফওয়ান ফ্রেশ হয়ে সাবিনার রুমে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়।সাবিনার রুমে গিয়ে দেখে সাবিনা আস্তে আস্তে রাফিয়ার মাথা টা বিছানায় রাখার চেষ্টা করছে নিজ এর কোল থেকে।সাফওয়ান এগিয়ে গিয়ে বলে,

—কি হয়েছে মা?রাফিয়া এখানে ঘুমাচ্ছে কেন?

সাফওয়ান এর কথা শুনে সাবিনা “শাহাদাত “আঙ্গুল উঁচু করে নিজ এর ঠোঁটের উপর রেখে সাফওয়ান কে চুপ করতে বলে।সাফওয়ান ও চুপ করে যায়।তিনি এবার ফিসফিস করে বলে উঠে,

—রাফিয়া ঘুমিয়েছে এখানে আমার কাছে।আজান দিয়েছে তো।তাই ওকে শুইয়ে দিয়ে নামাজ পড়তে যেতে চাইছি।

সাফওয়ান এগিয়ে এসে সাবিনার কোল থেকে আলগোছে রাফিয়ার মাথা টা তুলে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,

—আমি উনাকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি মা।তুমি নামাজ পড়ে নাও।

সাফওয়ান রাফিয়া কে কোলে নেওয়ার জন্য রাফিয়ার মুখের দিকে তাকাতে-ই দেখে চোখের কার্ণিস বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি শুকিয়ে আছে।সাফওয়ান ভ্রু কুঁচকে সাবিনা কে বলে,

—রাফিয়া কেঁদেছে কেন মা?

সাবিনা সাফওয়ান কে সব কিছু আর বলেনি। শুধু বলেছে,

—তোর দাদু আজ আবার ওকে কথা শুনিয়েছে।হয়ত বেশি কষ্ট পেয়ে ছিলো। তাই কান্না করেছে।

সাফওয়ান কিছু বলে না বিপরীতে। রাফিয়া কে কোলে তুলে নিয়ে নিজে দের ঘরে চলে যায়।সাবিনা অবাক হয়।কারণ তার ছেলে এত টা ঠান্ডা থাকার মতো না।পরোক্ষণেই বুঝতে পারে রাফিয়া তাকে হয়তো ঠান্ডা মেজাজে থাকতে বলেছে।তাই এমন ঠান্ডা থাকা।


সাফওয়ান রাফিয়া কে ঘরে এনে শুইয়ে দিতে-ই রাফিয়া জেগে যায়।সাফওয়ান এর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।পরোক্ষণে-ই মুখের হাসি মিলিয়ে ফেলে।সাফওয়ান রাফিয়া কে জড়িয়ে নেয়।নিজ এর প্রশস্ত বক্ষে রাফিয়ার মাথা রেখে বলে,

—আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদবেন না রাফিয়া?আপনার চোখ এর পানিতে ভিজানোর জন্য-ই তো সাদা শার্ট টা পরেছি।নিন শুরু করুন।কেঁদে সব ভাসিয়ে দিন।আমি মানা করবো না।

সাফওয়ান কথায় রাফিয়া সত্যি সত্যি-ই কেঁদে দেয়।সাফওয়ান এর শার্ট দুই হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কাঁদে। সাফওয়ান এর গায়ের সাদা শার্ট রাফিয়ার চোখ এর পানিতে ভিজে যাচ্ছে।যা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।সাফওয়ান রাফিয়ার মাথায় হাত ভুলায়।রাফিয়ার মাথায় কপালে,মুখশ্রী তে ভালোবাসার পরশ দেয়।

🌸🌸

দুই মাস পর এক দিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সাফওয়ান।হঠাৎ ওয়াশরুম থেকে কিছু পড়ার শব্দ হতে-ই সাফওয়ান দ্রুত সেই দিকে যায়।মাত্রই রাফিয়া নিজের কিছু ড্রেস ধোঁয়ার জন্য ওয়াশরুমে গিয়ে ছিলো।

সাফওয়ান ওয়াশরুম এর দরজা সামনে গিয়ে দাড়াতে-ই সাফওয়ান এর চক্ষু চড়কগাছ। রাফিয়া সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে ওয়াশরুম এর মেজেতে। গায়ের জামা কাপড় পানি তে ভিজে গেছে।সাফওয়ান দ্রুত গিয়ে রাফিয়ার মাথা ফ্লোর থেকে তুলে চোখে মুখে পানি ছিটা দেয়।কিন্তু রাফিয়ার সেন্স আসার কোনো খবর নেয়।সাফওয়ান রাফিয়া কে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে।তার মা কে চি’ৎকার করে ডাক দেয়।রাফিয়া কে নিয়ে হসপিটাল এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।সাফওয়ান এর মনে ভয় এসে দানা বাধছে।দুই মাস আগে-ই তো এপেন্ডিসাইটিস এর অপারেশন হলো।আজ আবার কোনো ক্রমে এপেন্ডিসাইটিস এর ব্য’থা উঠে সেন্সলেস হয়ে যায়নি তো রাফিয়া? চিন্তাই সাফওয়ান এর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন।আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here