বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৩.
এজাজুল ইসলামের বুকে চিন চিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। উনি বুকের বা পাশটা চেপে ধরে বৈঠকখানার জানালাটা খুলে দিলেন। মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে বাতাস কম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পুরনো দিনের কাঠের পাল্লা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করলো খুলতে। জানালার কপাটের একটা পাশ ভেঙ্গে গেছে, সারানো হয়নি। এই বাড়ি বহুদিনের পুরনো। ওনার বাবা করেছিলেন। বাবার কাঠের ব্যবসা ছিল। মনে পড়ে, তখন ওরা খুব ছোট। দুই ভাই আর মা-বাবা এই বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। একটা মাত্র টিনের ঘর ছিল। দাওয়ার একপাশে এক চিলতে রান্না ঘর, অনেকখানি দূরে যেতে হতো প্রাকৃতিক কার্য সারতে। ছোটবেলায় ভয় করত ভীষণ। দুই ভাই একসঙ্গে যেত। সে সময় টাকা পয়সার খুব টানাটানি ছিল। বাবা দুই ভাইকে মক্তবে ভর্তি করেছিলেন। সেখান থেকেই স্কুল শেষ করেছেন এজাজ সাহেব। তার ধর্মচর্চার শুরু সেই ছেলেবেলা থেকেই। ওনার সঙ্গে যারা পড়তো সকলেই খুব বিরক্তি নিয়ে, পরীক্ষা পাশ করার জন্য পড়তো; কিন্তু কেন যেন ধর্মের প্রতি তার একটা অগাধ টান ছিল ছেলে বেলা থেকেই। কলেজে ওঠার পর তিনি আরো গভীরে গেলেন; পাঠ্য বইয়ের বাইরেও আরো অনেক ধর্মীয় বই পড়তে আরম্ভ করলেন। খুব ইচ্ছা ছিল কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করবেন, কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কলেজ পাশ করার পরপরই বাবা মারা গেলেন। সে সময় আর্থিক অবস্থা আগের থেকে ভালো হলেও ব্যবসার অবস্থা খুব ভালো ছিল না। বাবা মারা যাবার পর তাকে ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। তবে তিনি পড়তে ভালোবাসেন। বিশেষত ধর্মীয় বই। এই বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান; তবু প্রতিদিন মনে হয় কিছুই শিখে উঠতে পারেননি এবং জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর যতটুকু বা শিখেছেন তার ক্ণামাত্র এই জীবনে আমল করতে পারেননি। এই আফসোস তার আমৃত্যু থাকবে। এজাজ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভোরের নরম বাতাসে তার বুকের ব্যথা স্তিমিত হয়ে আসছে। আজ নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ অনুভব করছেন। আশেপাশের লোকজন বিভিন্ন সমস্যায় তার কাছে আসে, পরামর্শ চায় কিন্তু তিনি নিজের সমস্যা নিয়ে কারো কাছে যেতে পারেন না। কেমন সংকোচ লাগে। ছোট ভাইয়ের অভাবটা আজ বড় বেশি করে অনুভব করছেন। মফিজ বেঁচে থাকলে আজ তার সঙ্গে একটু পরামর্শ করা যেত।
এজাজ সাহেব বরাবরই শেষ রাতের দিকে ঘুম থেকে ওঠেন। তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন অনেকক্ষণ। তারপর ফজরের আযান দিলে নামাজ পড়তে বের হন। নামাজ শেষ করে প্রাতভ্রমণে যান। দিনের এই সময়টা ওনার সবচাইতে প্রিয়। সে সময়ে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করে। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত বিভিন্ন লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কুশল বিনিময় হয়। ওনারা নানান কথা জিজ্ঞেস করেন। অনেকে পাশাপাশি হাঁটেনও। গল্প করতে করতে সময় কেটে যায়। তারপর বাড়ি ফিরে সবার সঙ্গে প্রাতরাশ সেরে দোকানের উদ্দেশে রওনা দেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি; হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ভদ্রলোক আফসোসের স্বরে বললেন,
– আপনার ভাতিজিকে ঢাকায় পাঠায় বোধহয় ঠিক করেন নাই এজাজ ভাই।
– কেন কি হয়েছে?
– আমার ছেলেও তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, বলতেছিল ফেসবুকে নাকি কি সব দেখছে।
– কি দেখেছে?
– সে আমি আপনাকে বলতে চাইনা। আপনি সম্মানিত মানুষ, মনে হইল আপনাকে জানানো দরকার..
– আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি।
এজাজ সাহেবে চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরে এলেন। এবং তার পরপরই টেলিফোনটা এলো। যে টেলিফোন করেছে সে তার নিজের নাম বলেনি। কিন্তু ঘটনা যা বলেছে তাতে এজাজ সাহেবের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। মীরাকে নাকি একটা অফিস রুমে কিছু লোক একটা ছেলের সঙ্গে উদ্ধার করেছে। জানা গেছে সেই অফিসে মীরা প্রায়ই রাত্রি যাপন করে। এখানে কোন আর্থিক ব্যাপার জড়িত আছে কিনা তার জানা নেই, তবে সম্পর্কটা বহুদিন ধরেই চলছে।
এজাজ সাহেবের স্ত্রী চা নিয়ে এসেছেন। স্বামীকে এভাবে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলেন। সাধারণত এই সময় উনি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে তৈরি হতে থাকেন। চা পান করেন আরো আগেই। আজ নিয়ে আসতে দেরি হয়ে গেছে। উনি সৌরভের ব্যাপারে কিছু কথা বলবেন বলে তৈরি হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু স্বামীকে দেখে থমকে গেলেন। এজাজ সাহেবে চা নিলেন না, স্ত্রীকে বললেন উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, সৌরভকে পরে পাঠিয়ে দিতে। ওনার মুখভঙ্গি দেখে নাসিমা আর কোন প্রশ্ন করার সাহস পেলেন না।
এজাজ সাহেব দোকানে ঢুকেই মীরাকে ফোন করলেন। ভাতিজিকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করেন। তার নিজের কোন মেয়ে নেই। বিয়ের বহু বছর পর্যন্ত সন্তান হয়নি, শেষ বয়সে এসে সৌরভের জন্ম হয়। তবে আল্লাহ পাক তার সেই অভাব রাখেননি। ভাইয়ের তিন মেয়েকে তিনি নিজ সন্তানের অধিক স্নেহ করেন। তারাও বড় চাচা বলতে অন্তপ্রাণ। তবে সবার মধ্যে ওনার সবচেয়ে প্রিয় মীরা। আজ মীরার ব্যাপারে এমন একটা কথা শুনে উনি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন। তবে উনি নিশ্চিত কোথাও একটা ভুল হয়েছে। মীরা এমন কিছু করতেই পারেনা। মীরাকে উনি যতটা ভালোবাসেন তার থেকেও বেশি বিশ্বাস করেন।
সকাল থেকেই মীরার মন অসম্ভব খারাপ ছিল। সেদিন আশিক ওকে পৌঁছে দেবার পর সারাদিন ঝিম মেরে পড়েছিল। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়েছিল প্রায় পুরো দিন। মোবাইলে চার্জ দিতেও মনে ছিল না। রাতে মোবাইলে চার্জ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল আবার। পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস বাকি, তাই ক্লাস মিস না করে পরদিন চলে গেল ক্যাম্পাসে। ক্লাসে ঢোকার পর থেকেই বুঝতে পারছিল কিছু একটা যেন স্বাভাবিক নেই। পরবর্তীতে সেই অস্বাভাবিকত্ব ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। ক্লাসমেট, সিনিয়র এমনকি জুনিয়ররা পর্যন্ত কথা শোনাতে ছাড়ল না। মীরার যখন প্রায় নাজেহাল অবস্থা, তখন টুম্পা ওকে হাত ধরে নিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। গাড়ি চলতে শুরু করলে মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। টুম্পা ওকে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। অনেকটা সময় লেগেছে ওর স্বাভাবিক হতে। সবটা শুনে টুম্পা বলেছিল নিশ্চয়ই এতে কোন ঝামেলা আছে। বিকেল নাগাদ টুম্পা ওকে হলে পৌঁছে দেয়। মীরার খুব অসহায় লাগছিল। টুম্পাকে অনুরোধ করেছিল ওর গয়নার অর্ডারগুলো যেন পৌঁছে দেয়। ওর হাতে সব গয়নার সেটগুলো বুঝিয়েও দিয়েছে সেদিন। তারপর থেকেই খুব ইচ্ছা করছিল বাড়ি যেতে। পরদিন চাচার ফোনটা পেয়ে তাই খুব খুশি হয়েছিল ও। তবে বড় চাচার কণ্ঠস্বর শুনে কেমন একটু লাগলো মীরার। চাচা বিশেষ কিছু বলেননি শুধু বলেছেন যেন আজই চলে আসে।
মীরা বাস থেকে নামল দুপুর নাগাদ; তারপর রিক্সা নিয়ে যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন বেলা তিনটার বেশি বাজে। বাড়ি ঢুকে কাউকে দেখতে পেল না। ওদের এই বাড়িটা দোতালা। একতলায় বৈঠকখানা, খাবার ঘর, রান্নাঘর নামাজের ঘর। উপর তলায় দুই পাশে শোবার ঘর। সাধারণত একপাশে মীরারা থাকত আর অন্য পাশে বড় চাচারা। মীরা রান্নাঘরে উঁকি দিল। মা ওকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন। মায়ের খুশি দেখে মীরা একটু নিশ্চিন্ত হল। তার মানে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে; কিন্তু যখন স্নান সেরে খেতে বসলো, খাবার আর ওর গলা দিয়ে নামলো না। হালিমা জানাল সৌরভের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং আজকে সন্ধ্যের পরেই বিয়ে পড়ানো হবে। মীরা জানতে চেয়েছিল কেন, হঠাৎ করে কি এমন হয়ে গেল। হালিমা জবাব দেননি, শুধু জানিয়েছেন এটা বড় চাচার সিদ্ধান্ত।
মীরা ঠিক করল বড়চাচার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু আসরের পরেও বড় চাচা ফিরলেন না। বরং মীরাকে বলা হলো বাইরের কিছু লোকজন আসবে, ও যেন উপরের ঘরে চলে যায়। মীরার একবার মনে হল বড় চাচীর সঙ্গে কথা বললে হয়। মীরা গুটিগুটি পায়ে বড়চাচীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ভেজানো দরজায় হাত রাখার আগেই টের পেল ভেতরে কথোপকথন চলছে। মীরা আশ্চর্য হয়ে গেল। সৌরভ ভাই ভিতরেই আছে। কি অদ্ভুত, এতক্ষন টের পায়নি যে সৌরভ ভাই বাড়িতে। মীরা সাহস করে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। বড় চাচী ওকে দেখে বাঁকা গলায় বললেন,
এই যে, এসে গেছে নবাবজাদি। নিজে নষ্টামি কইরা আসে, আর আমার ছেলের ঘাড়ে চাপে।
সৌরভ হালকা প্রতিবাদ করে বলল,
-আহ মা, থামতো। মীরা আয়।
মীরা একটু থমকালো, তবে এবার ও গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারল। নিশ্চয়ই ওর সমস্ত খবর এখানেও চলে এসেছে। তাই বাড়ির মান সম্মান বাঁচাতে বড় চাচা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মীরা নির্বিকার গলায় বলল,
-সৌরভ ভাই তুমি পালিয়ে যাও। আমার জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করোনা।
-তুই এটা কি বলছিস মীরা? বাবার কি অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখেছিস?
বড় চাচী খেকিয়ে উঠে বলল,
– কেন ভুল কি বলেছে? ওর নষ্টামির জন্য তুই কেন মাসুল দিতে যাবি? তুই তোর নিজেরটা বোঝ।
মীরা একটু ম্লান হাসলো। ও উপকার করার চেষ্টা করছে, অথচ বড় চাচি কথা শোনাতে ছাড়ছে না। মীরা বলল,
– এদিকটা আমি সামলে নেব। তুমি যাও আজকেই রত্নাকে বিয়ে করে ফেলো।
– আর তোর কি হবে?
– কিছুই হবে না। আমি এখানেই থাকবো। আমরা সবাই মিলে চাচাকে ম্যানেজ করে নেব। বড় চাচি আপনি ওর ব্যাগটা একটু গুছিয়ে দিন।
নাসিমা এক মুহূর্ত সময় নিলেন না। ঝটপট সৌরভকে একটা ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। জামাকাপড়, কিছু টাকা-পয়সা, বিয়ের জন্য কেনা কয়েকটা নতুন শাড়ি সবই দিলেন ব্যাগে। তারপর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– আমি তো থাকতে পারতেছি না। বিয়ের পর ছবি পাঠাইস।
সৌরভ পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার বলে গেল,
-থ্যাঙ্ক ইউ মীরা।
নাসিমা ছেলেকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে আবার স্বরূপ ধারণ করলেন। খেকিয়ে উঠে বললেন,
-তুই এখানে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নিজের ঘরে যা।
মীরা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো লাগতো। চায়ের সঙ্গে মুড়ি মাখানো। ঠিকমতো ভাত খেতে পারেনি তখন। খিদেটা আবার পেটের মধ্যে জানান দিচ্ছে। নিচে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ বোধহয় এসেছে। দেখতে ইচ্ছা করছে না। মীরা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
চলবে……….