#রূপবানের_শ্যামবতী
#২১তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে আছে ঘরটি। জানালা গলে আলো আসারও সুযোগ নেই। চারপাশ আরো বেশি নিকষ আঁধারে ছেয়ে রয়েছে। বিশাল ঘরটিতে একটি বেড, একটি চেয়ার ও টেবিল ছাড়া কিছুই নেই। হাত-পা ছড়িয়ে বেডের ওপর নিথর ভঙ্গিতে শুয়ে আছে কেউ একজন। দৃষ্টি সামনে বরাবর থাকা জানালার বাইরে। গভীর ভাবনায় মগ্ন এই মানুষটি কে? খান বাড়ির বড় ছেলে – আয়মান খান।
ঠকঠক করে দরজায় টোকা পড়ে। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া না যাওয়ায় ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে আসিফ। অন্ধকারে চোখে ধাঁধাঁ লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা তার। দেয়াল হাতড়ে সুইচবোর্ড খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করতেই পেয়ে গেলো। আলো জ্বালাতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে আয়মান। “চো” করে শব্দ করে উঠে বসে সে। আসিফকে দেখে খানিকটা গলা চড়িয়ে বলে ওঠে,
–কি সমস্যা তোর? আলো জ্বালালি কেন?
ভড়কে গিয়ে আসিফ তোতলানো স্বরে জবাব দেয়,
–ইয়ে.. না.. মানে.. বস, আপনিই তো আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।
চোখ সরিয়ে পুনরায় সামনের দিকে তাকায় আয়মান। চোখ বুজে আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বলে,
–যে কাজের জন্য তোকে দেখা করতে বলেছিলাম তার আর প্রয়োজন নেই।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আসিফ বলে ওঠে,
–কি বলছেন বস? আপনি কি তবে শত্রুতা শেষ করতে চাইছেন?
ঝট করে চোখ খুলে আসিফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আয়মান। আসিফ ভয় পেয়ে মিইয়ে গেলো। গুরুগম্ভীর স্বরে আয়মান জবাব দেয়,
–শত্রুতা শেষ করার হলে এতোকিছু করতাম না।
বলতে বলতে ঠাস করে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো আয়মান। পুনরায় বলে ওঠে,
–যার জন্য নিজের প্রিয় মানুষ হারিয়েছি তাকে এতো সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আপাতত চুপ থাকতে চাইছি। ওরা একটু সুখে কাটাক কিছুদিন। তবেই না দুঃখের আসল মজা টের পাবে।
আসিফ বাধ্য মানুষের মতো জবাব দেয়,
–ওকে বস।
–আলো নিভিয়ে দিয়ে যা।
আসিফ আলো নিভিয়ে চলে যায়। আয়মান হাত-পা মেলে দেয় আবার। চোখ বুজে মানসপটে ভাসিয়ে তোলে মায়াবী এক মুখশ্রী। বুকের চিনচিনে ব্যথা নিয়ে মনে মনে আওড়াতে থাকে, “ভালোবাসি, ভালোবাসি।”
~~~
আহরারের ঘরে চলছে আজ তুমুল হট্টগোল। কারণ তার টিম এসেছে আজ। বন্ধুদের এই দল এক জায়গায় হওয়া মানে সেই জায়গায় কোনো বড়সড় সাইক্লোন বয়ে যাওয়া।
রান্নাঘরে তাদের জন্য নাস্তার আয়োজন করছে তাসফিয়া। অরুনিকা সাহায্য করছে শ্বাশুড়িকে। ফলের প্লেটে ফল সাজাতে গিয়ে ভুলবশত কিছু ফল ছিটকে মেঝেতে পড়ে যায়। তাসফিয়া বিরক্তির স্বরে বলে ওঠেন,
–একটু মনোযোগ দিয়ে কাজ করবে তো নাকি?
অরুনিকা তাড়াহুড়ো করে মেঝেতে বসে পড়ে যাওয়া ফলগুলো তুলতে লাগলে তাসফিয়া ধমকে ওঠেন,
–কি আশ্চর্য! আবার ওগুলো তুলতে যাচ্ছো কেন? যাও আরেকটা নিয়ে এসে কেটে সাজাও। আমেনা তুই এই জায়গাটা পরিষ্কার করে দে।
–জে, ছোডো ছাছী।
তাসফিয়ার আদেশে আমেনা জায়গাটা পরিষ্কার করার কাজে নেমে পড়ে। এদিকে অরুনিকা ভয়ে ভয়ে আরো একটি ফল নিয়ে এসে কাটতে শুরু করলো। শ্বাশুড়িকে ভিষণ ভয় পায় সে। হয়তো গম্ভীরমুখে থাকেন তাই। তবে অকারণে খারাপ ব্যবহার করেন না কখনোই। তারপরও যেন কত দ্বিধা। অন্যমনষ্ক হয়ে ফল কাটতে গিয়ে নিজের আঙুল কেটে ফেলে অরুনিকা। “আহ!” করে আর্তনাদ করে উঠতেই ছুটে আসেন তাসফিয়া।
–কি হলো? দেখি।
আঙুলে রক্ত দেখে অস্থির হয়ে বকতে বকতে বলেন,
–আজব মেয়ে, একটু খেয়াল রেখে কাজকর্ম করতে পারেনা। কিভাবে আঙুলটা কেটেছে দেখেছো। আমেনা এন্টিসেফটিক আর তুলা নিয়ে আয়।
আমেনা দৌড়ে নিয়ে এসে তাসফিয়ার হাতে ধরিয়ে দিতেই তিনি পরম যত্নে জায়গাটা পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। সঙ্গে বকাবকি তো চলছিলোই,
–নিজের ব্যথা নিজেকেই সইতে হবে। তাই নিজের খেয়ালটাও নিজেরই রাখা উচিত। এমন অন্যমনষ্ক হয়ে কাজ করলে আজ আঙুলে কেটেছে কাল আঙুলই কেটে যাবে। তখন কি হবে?
অরুনিকা মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাসফিয়াকে। অবিকল তার মায়ের মতো। সেই একইরকম শাসন, একই ভঙ্গিমা। এ তো তার মা-ই।
ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষে অরুনিকার দিকে ফিরতেই তাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কড়াস্বরে বলে ওঠেন,
–কি হয়েছে? তাকিয়ে আছো কেন এভাবে?
–দেখছি কিভাবে আমার কেটে যাওয়া দেখে মায়ের মতো স্নেহময় শাসন করছেন।
তাসফিয়া বিব্রত হলেন। সরে গিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়ান। হাত ধুতে ধুতে বলেন,
–হয়েছে যাও। এখন আর কাজে হাত লাগাতে হবেনা। আমি রেডি করে দিচ্ছি। তুমি গিয়ে দিয়ে এসো।
–আচ্ছা।
এদিকে আহরারের ঘরে শোরগোল বাড়ছে। দাইয়ান, রাদিফ আর ঈশান জোর করে আহরারকে বিছানার মাঝখানে চেপে বসিয়ে রেখেছে। উদ্দেশ্য আহরারকে রোমান্টিক বানানো। তাদের ধারণা বন্ধু তাদের রসকষহীন। রোমান্টিকতা বলতে কিছুই নেয়। কিভাবে বউকে পটাতে হয় জানেনা। তাই আজ বন্ধুরা হাতে ধরে শিখিয়ে দেবে। আহরারের সামনে একটি রোমান্টিক মুভি চালিয়ে রেখেছে বন্ধুগণ। দুপাশে দাইয়ান, রাদিফ, আর মাথার ওপর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে ঈশান। মাঝেমাঝে আহরারের মাথায় ভর দেওয়ায় মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আহরার রেগেমেগে বারবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার পরও ঘুরেফিরে এসে সে একই কাজ করছে। বাধ্য হয়ে আহরার হাল ছেড়ে দেয়। মুভির দিকে মনোযোগ দেয়। একটি দৃশ্য আসে যেখানে নায়ক সবার সামনেই নায়িকাকে কোলে তুলে নেয়। দৃশ্যটি দেখামাত্র দাইয়ান লাফিয়ে বলে ওঠে,
–এই দেখ, ঠিক এভাবেই বউকে কোলে তুলে নেওয়া উচিত বুঝলি? তুই এভাবেই প্র্যাক্টিস করবি।
আহরার তারাহুরো করে বলে ওঠে,
–অসম্ভব এই কাজ আমি জীবনেও করতে পারবোনা। বউ পটানো তো দূর, কষ্ট করে পাওয়া বউটারেই হারায় ফেলবো।
ঈশান পেছন থেকে পিঠে ঠাস করে মেরে বলে,
–কি কস! এমনে না করলে জীবনেও বউ পটাইতে পারবিনা।
–দেখ ভাই, অরু এসব পছন্দ করবে না। ও অন্যরকম। যখন তখন যেখানে সেখানে হাত ধরাধরি, গা ঘেঁষাঘেঁষিও পছন্দ করেনা আর সবার সামনে কোলে তুলতে গেলে দেখা যাবে পরেরদিনই বাক্সপেটরা হাতে নিয়ে বাপের বাড়ি হাঁটবে।
রাদিফ বিজ্ঞের ন্যায় বলে ওঠে,
–শোন, মেয়েদের মন বোঝা এতো সহজ নয় বুঝলি। তোর হয়তো মনে হচ্ছে তোর বউ এসব পছন্দ করবেনা। কিন্তু এমনটা ঘটলে মনে মনে ঠিকই খুশিতে গদগদ হয়ে যাবে।
আহরার ছিটকে পেছনে সরে গিয়ে হাত দুটো সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে ওপরে তুলে বলে,
–না ভাই, তোরা যে যাই বল এই কাজ আমার দ্বারা হবেনা। আমি পারবো না।
ঈশান হাত উঠিয়ে বলে,
–আচ্ছা, বেশ বেশ এই পরিকল্পনা বাতিল। আহরার তুই বল তুই কখনো বউকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিস?
আহরার মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলে ওঠে,
–না, এখনো সেই সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
দাইয়ান এসে আহরারের কাঁধ গলিয়ে গলায় হাত চেপে বলে,
–সা লা, পছন্দ কইরা এতো যে ঘুরঘুর কইরা যে বিয়া করছো, এখনো বউরে ঘুরতেই নিয়া গ্যালেনা। তোমার দ্বারা বউএর লগে প্রেম হইতোনা।
রাদিফ বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে বলে,
–শোন, শোন.. বউকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার বাহানায় অনেক কিছু করতে পারবি। একসাথে রিকশায় ঘোরা তারপর..
বাকি কথাটুকু ঈশান শেষ করে,
–মেয়েরা বাইরে গেলে প্রিয় মানুষের সাথে ফুচকা, আইসক্রিম খেতে পছন্দ করে। তুইও খাওয়াবি। পার্কে নিয়ে গিয়ে হাত ধরে হাঁটবি আর রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলবি। দেখবি বউ পটে গলে আলুবালু হয়ে যাবে।
দাইয়ান ঈশানের দিকে তেরছাভাবে তাকিয়ে বলে,
–অভিজ্ঞতা তো ভালোই বন্ধু।
শার্টের কলারটা পেছনে টেনে ভাব নিয়ে জবাব দেয় ঈশান,
–হাহ! ঈশানের অভিজ্ঞতা ১০০ তে ১০০।
রাদিফ বলে,
–তাহলে আপাতত প্ল্যান এটাই। যদি বউ পটে তো ভালো আর না পটলে নেক্সট প্ল্যান।
আহরার ইতস্তত করতে করতে বলে,
–এসব করার কি খুব দরকার? না মানে..
–শোন বউ পটানো আগে বাকি সব দুনিয়াবি পরে
ঈশানের গুরুগম্ভীর স্বরে অভিনয় করে বলা কথা শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। আহরার ঈশানের পেট বরাবর ঘুষি মেরে বললো, “শুধরালিনা।”
দরজায় নক পড়তেই হাসি বন্ধ হয়ে গেলো চার বন্ধুর। চুপচাপ স্থির নয়নে চেয়ে রইলো দরজার দিকে। দরজা ঠেলে খাবারের ট্রে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো অরুনিকা। তিন বন্ধুই হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঈশান একটা ডিগবাজি দিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো। দাইয়ান কোনোরকমে তাকে ধরে দাঁড় করালো। অকস্মাৎ এমন ঘটনায় তাজ্জব বনে গেলো অরুনিকা। আশ্চর্য! এরা এতো অস্থির হচ্ছে কেন? তিনজনই সোজা সটসট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অরুনিকার চোখে চোখ পড়তেই তিনজনই দাঁত বের করে হি হি করে হাসছে। সামনের দিকে আহরার দাঁড়িয়ে আছে কাচুমাচু ভঙ্গিতে। সবকটার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কেউ এদের মাথায় ব ন্দু ক ঠেকিয়ে রেখেছে। সেই ভয়ে সব নড়াচড়া ভুলে স্থির হয়ে আছে। অরুনিকা বুঝে উঠতে পারলো না তাকে দেখে ওদের এমন কান্ড করার কারণ কী?
সে ধীরভঙ্গিতে টেবিলে খাবারগুলো সাজিয়ে রাখলো। তারপর নম্রস্বরে বলে ওঠে,
–আপনারা খেয়ে নিন। আর হ্যা দুপুরের খাওয়া দাওয়া কিন্তু এখানেই করতে হবে, আম্মা বলেছেন।
ঈশান ছটফট করে বলে উঠলো,
–হ্যা হ্যা ভাবি অবশ্যই। আপনি না বললে আমি নিজে গিয়েই বলে আসতাম, দুপুরে না খেয়ে আমি কিছুতেই যেতাম না।
সঙ্গে সঙ্গে মাথায় চটাস করে বারি পড়তেই “উফ” করে আর্তনাদ করে ওঠে সে। পাশে তাকাতেই দেখতে পায় দাইয়ান কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে,
–সা লা, কোথায় কি বলতে হয় ভুলে গেছস।
রাদিফও চাপাস্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে ওঠে,
–একটা দিলি ক্যান আরো দুইটা দে। ওর পেটে একটা গুঁতা দে। খালি খাওন খাওন করে। ওর পেটে এতো জায়গা কেমনে?
ঈশান দাইয়ানকে টপকে রাদিফের দিকে দৃষ্টি ফেলে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলে,
–আরে ব্যাটা ব ল দ, খাবারগুলো তো পেটে থাকেনা। পশ্চাৎদেশের সুড়ঙ্গ হতে শৌচাগারের সুড়ঙ্গে পতিত হয়ে পরবর্তী খাবার ঢোকানোর জায়গা করে দেয়।
ঈশানের ঢং করে বলা কথায় দাইয়ানের মাথায় রাগ চড়ে যায়। সে ঈশানকে ঠেলে সামনে এনে তার পেছন বরাবর কষে এক লা ত্থি মেরে বলে ওঠে,
–নে শা লা, তোর পশ্চাৎদেশের সুড়ঙ্গ বরাবর উপহার মেরে দিলাম।
অরুনিকার সামনে এদের এসব কান্ডকারখানা আহরারকে বেশ বিব্রত করছে। এদিকে অরুনিকা ঠোঁট চেপে হাসছে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
–মারামারি শেষ হলে খেয়ে নিয়েন।
এই বলে সে মুখে ওড়না চেপে হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়ে। অরুনিকা বেরোতেই সকলেই ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে তাকায়। ঈশান ভড়কে গিয়ে তোতলানো স্বরে বলে,
–এ..এভাবে দেখছিস কেন? আম…আমি কি করলাম আবার?
আহরার রেগেমেগে বলে ওঠে,
–এই ধর শা লা রে..
তিনবন্ধুই “হারেরেরে” করে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঈশানের ওপর।
~~~~~
সকাল সকাল বারান্দার টবে পানি দিচ্ছে অরু। আহরারকে কফি দিতে এসেছিলো। ভাবলো একেবারে পানি দেওয়ার কাজটা সেরেই যায়। পানি দিতে দিতে জানালা দিয়ে একবার ভেতরে উঁকি দিতেই দেখতে পায়, আহরার গভীর মনোযোগী হয়ে অফিসিয়াল কাজ করছে। মাঝে মাঝে কফি কাপে চুমুক দিচ্ছে। হুট করে অরুনিকার হাত থেমে যায়। সে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে দৃশ্যটুকু। তার কাছে মনে হচ্ছে সে ভিষণ সুন্দর একটি দৃশ্য দেখছে। কারো কফি খেতে খেতে কাজ করার দৃশ্যও এতো সুন্দর হতে পারে? আনমনে হাসলো অরুনিকা। পানি দেওয়ার কাজ শেষ করে ভেতরে আসতেই দেখতে পেলো আহরারের কফি খাওয়া শেষ। সে খালি কাপটা নিয়ে বেরোতে গেলেই আহরারের ডাকে থেমে যায়।
–অরু..
অরুনিকা পিছু ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আহরার না তাকিয়েই প্রশ্ন করে,
–তোমার পড়াশোনা কি বাদ দিয়ে দিলে চিরতরে?
অরুনিকা ইতিউতি করতে থাকে। পড়াশোনা তো সে বাদ দিতে চায় না। তবে সে শুনেছে এবং অনেক দেখেওছে যে মেয়েরা বিয়ের পর আর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিয়ের পর বাড়ির বউএর পড়াশোনা করা পছন্দ করে না। তাই সে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কাওকে কিছু বলেওনি।
অরুনিকাকে নিশ্চুপ দেখে আহরার চোখ তুলে তাকায়।
–কি ব্যাপার? চুপ করে আছো যে?
অরুনিকা কি বলবে ভেবে পায়না। আহরার আবারো বলে ওঠে,
–অরু, এদিকে এসো। এখানে এসে বসো।
অরুনিকা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বসলো বিছানার এককোণে। আহরার সুপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,
–অনার্স ৩য় বর্ষে উঠেছিলে, তারপরই বিয়ে হয়ে চলে এলে। আমি চাই পড়াশোনা বাকিটুকুও শেষ করো।
চকিতে ফিরে তাকায় অরু। সে কি সত্যি শুনছে। তারমানে সে পড়াশোনা চালাতে পারবে। বাকিদের মতো বিয়ের পর তারও পড়াশোনা থেমে যাবেনা।
আহরার পুনরায় বলে ওঠে,
–যেহেতু এখান থেকে তোমার কলেজে যাতায়াত সম্ভব নয় আবার কলেজ চেঞ্জ করারও উপায় নেই তাই আমি ঠিক করেছি তোমাকে ভালো একটা কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিবো। কোচিং করো, বাসায় পড়াশোনা করো। পরীক্ষার সময় আমি রেখে আসবো তোমার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে পরীক্ষাটা দিয়ে আবার ব্যাক করবে। এছাড়া অন্যান্য যা করা লাগে আমি ব্যবস্থা করবো। তুমি জাস্ট মন দিয়ে পড়াশোনাটা করো।
অরুনিকা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহরারের দিকে। তার চোখে একরাশ মুগ্ধতা। এই মানুষটাকে যত দেখে তত সম্মান বেড়ে যায়। এমন একটা মানুষকে স্বামী হিসেবে পাওয়ায় এখন নিজেকে বড় সৌভাগ্যবতী মনে হয় তার। আহরার আবারো তার কাজের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে বলে,
–তৈরি থেকো, আজ বিকেলে বেরোবো। কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবো।
বিকেল বেলা অরুনিকাকে নিয়ে আহরার বেরিয়ে পড়লো। গেট পেরিয়ে মেইন রোডে আসতেই অরুনিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
–গাড়ি নিবেন না?
আহরার অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসে। কিছুক্ষণ পর একটা রিকশা ডেকে অরুনিকাকে ঈশারা করে উঠতে। অরুনিকা আরো একদফা অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলেনা। চুপচাপ রিকশায় উঠে পড়ে। আহরার উঠে বসতেই রিকশা চলতে শুরু করে। রিকশায় অভ্যস্ত নয় আহরার। অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে সে। বন্ধুদের পরামর্শে এমন একটা কাজ করলো তাও আবার রোমান্টিকতা দেখাতে। এখন রোমান্টিকতা তো দূর অস্থিরতায় নিজের নামটাও ভুলে যাচ্ছে। কারণ রাস্তায় ঝাঁকুনি খাওয়া মাত্রই তার বারবার মনে হচ্ছে সে পড়ে যাবে। অরুনিকা অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করছে বিষয়টা। আচমকা সে এমন একটা কাজ করে বসলো যে আহরারের মনে হলো সে রিকশার সাথে একেবারে সেঁটে গিয়েছে আর পড়বেনা। অরুনিকা তার কাছাকাছি আরেকটু চেপে বসে শক্ত করে বাহু জড়িয়ে ধরেছে। নিজের দিকে এমনভাবে টেনে রেখেছে আহরারকে যেন কিছুতেই তাকে পড়ে যেতে দেবেনা। কিছু সময় কাঠকাঠ হয়ে বসে রইলো আহরার। অতঃপর ঠোঁটজুড়ে খেলে গেলো মৃদু হাসির ঢেউ কারণ অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা অরুনিকার চোখেমুখে একরাশ লজ্জার ভিড়।
চলবে…..
(ইনশাআল্লাহ এখন থেকে একদিন পর পর গল্প পাবেন নিয়মিত।)
Plz upload porbo 22 and next after