ফুলকৌড়ি (২৭) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
1149

#ফুলকৌড়ি
(২৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

দীর্ঘ সময় ধরে জমা আকাশের ঘনোকালো মেঘ সরে গিয়ে সেখানে যেনো ঝলমলে রোদ্দুরের দেখা মিলেছে।তন্ময়ীর সম্মতি এমনই প্রভাব ফেললো ইভানের মনে।সাথে বাড়ির বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর মনেও।মান্যতা আর মৌনতা-তো ভিষন খুশি।তন্ময়ীকে তাদের ভিষন পছন্দ।ছোটো বউমনি হিসাবে মোটেই মন্দ হবে-না মেয়েটা।একেবারে তাদের মনমতোন,খুব মিষ্টি।পুনরায় আবার আংটিবদল হলো।আগের পাত্রপক্ষের আংটি খুলে ফেলে,যত্রতত্র নীহারিকা বেগমের হাতের আঙটি দিয়ে আপতত আংটিবদল সারা হলো।ইভান যখন আঙটি পরাতে গেলো তন্ময়ীর হাতে।সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো তন্ময়ী।ইভানের হাত থেকে আঙটি কেড়ে নিয়ে নিজেই নিজের আঙুলে পরে নিল।
পাশেবসা ইভানকে দাঁতে দাঁত চেপে মৃদুস্বরে বললো।

‘বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি মানে,আমাকে ছোঁয়ার অধিকার দেইনি।সো ভুলেও অধিকার তো দেখাবেনই না।দ্বিতীয়ত যখন তখন ছোঁয়ার বাহানা-ও খুঁজবেন না।

দূর্বল চোখে,তন্ময়ীর কঠিন করে রাখা মুখাবয়বের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ইভান।ফের আশেপাশে নজর ফেলে আর কথা বাড়ালোনা।চুপচাপ উঠে চলে গেলো।পূর্বে যে উৎফুল্লতা সবার মনে বিরাজ করছিলো সেই উৎফুল্লের সহিত হলুদ অনুষ্ঠান নাহলেও,মোটামুটি ভাবেই সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠান শেষ করা হলো।বিয়ের মতো একটা সেনসেটিভ ইস্যু ঘোলাটে হয়েও,পুনরায় যেভাবে হোক মিটে যাওয়ায় সবার মনেমনে সাচ্ছন্দ্যতা অনুভব করলেও,তৃনয়ের মনটা ছোটো হয়ে গেলো।তন্ময়ীর বিয়ের পর সে চেয়েছিলো,সাহস করে হলে-ও একবার নিভানের সামনে প্রস্তাব রাখবে মান্যতার জন্য।তাতে যদি নিভান অসম্মতি জানায় বা তাদের বন্ধত্ব একটু নড়চড় হয়।তবু-ও রাখবে।আগে মনে হতো,চোখের ভালো লাগা একটু একটু করে মনে বাসা বেঁধেছে।বন্ধুত্বের কারনে সেটা একটু কষ্ট করে হলেও, চোখের আড়ালে থাকলে ভুলে যেতে পারবে।কিন্তু না।যখন পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ চলে গেলো,মেয়েটা জেনো সেই মনে বাঁধা বাসাটা আর-ও শক্তপোক্তভাবে বাঁধলো।তারপর সেই বাসা ভেঙে দেওয়ার কথা ভাবলেই বুকে পাহাড়সম ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হয় তার।মনে এমন অনুভূতি জাগে,বাসা বাঁধা জায়গা থেকে মেয়েটাকে একটু নড়চড় করলেই নিজেকেই শেষ হয়ে যেতে হবে।অথচ মেয়েটাকে বলার ক্ষমতা নেই।নেই বললে ভুল হবে।তবে মান্যতার সামনে নিজের অনুভূতি কখনো প্রেমিক রূপে প্রকাশ করতে চায়নি সে।চেয়েছে,সবার সম্মতিতে তাকে নিজের স্ত্রী রূপে আপন করে নিতে।তাকে চেয়েছে প্রনয় নয় পরিনয় রূপে।তবে এখন বোনের জন্য এখন সম্পর্ক তৈরী হতে যাচ্ছে, সেই পরিনয় রূপে চাওয়া সম্পর্ক কি গড়া সহজ হবে!সম্পর্ক হওয়া ঘরে কি আর দ্বিতীয়বার সম্পর্ক তৈরীর প্রস্তাব রাখা যাবে!সেটা কি সবাই ঠিকঠাক চোখে দেখবে?যদিও তন্ময়ী ভালো থাকলে, সুখে থাকলে সেই ভালো।তৃনয়ের পরম শান্তির। তবুও কোথাও যেনো তার কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে, এমনটা অনুভব হচ্ছে।সব কেমন হঠাৎই গড়মিল হয়ে গেলো কেনো!ভাগ্য বরাবরই সে যা চেয়েছে তার বিপরীত দিয়ে এসেছে। এবার চাওয়াটা যদি সেরকমই হয়।তবে তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে।আজ মেয়েটাকে দেখার পর যেমন তাকে পাওয়ার প্রবলতা দ্বিগুনভাবে অনুভাবিত হয়েছে,সেখানে এই ঘটনার পর তাকে না পাওয়ার আকাঙ্খা, ভয়, দ্বিধা, শতগুণরূপে ব্যাথার অনুভূতি রূপে বাসা বেঁধেছে।

যদি-ও হঠাৎ করে বিয়ে।তবুও আত্মীয় স্বজন কাওকে বলতে বাদ রাখলেন না নীহারিকা বেগম আর জাহিদ সাহেব।বড় ছেলে বাদে যদিও ছোটোছেলের বিয়ে,তবুও দ্বিধাদন্ড রাখলেন না কাওকে নিমন্ত্রণ করতে।এবাড়ির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিয়ে।তাও আবার হঠাৎই করেই। তবুও আয়োজন ধুমধামভাবে করার চেষ্টা করলেন।কোথাও কমতি রাখতে চাইলেন না।বিশেষ করে নিভান।ভাইবোনদের মধ্যে ইভানের জায়গাটা তার জীবনে অন্যরকম একটা দূর্বলতার স্থান।মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পরে এই পরিবারের প্রথম আপন বলে কেউ নিজের জীবনে স্থান করে নিতে পেরেছিলো।তার ছোট্ট নিঃসঙ্গ জীবনের একাকিত্ব দূর করে কথা বলার সঙ্গী হয়েছিলো।ভাগ্যের পরিহাসে বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর যে হাসিখুশি জীবটা বিসর্জন দিতে হয়েছিলো সেটাও যেনো কিছুটা হলেও তার জীবনে ফিরে এসেছিলো ইভানের পৃথিবীতে আসার আগমনে।তার মুখে এক টুকরো হাসি ফোঁটাতো বাচ্চার ছেলেটার সুদর্শন মুখ,নরম স্পর্শ।একটু বড় হলে তার কাছে থাকার আবদার।আদূরে কন্ঠ দাদাভাই ডাকটা।তাকে ছাড়া একটা সময় ওই ছেলেটা কিচ্ছু বুঝতে চাইতো না।এরকম একটু একটু করে একটা সময় এমন দূর্বলতা তৈরী হলো ছেলেটার প্রতি।তার অন্যায় আবদারও পর্যন্ত নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে নিভান।যদিও একটা সময় গিয়ে কিছু কারনে সম্পর্কে দূরত্ব এসেছে।তবুও ছেলেটার প্রতি সেই স্নেহ ভালোবাসাময় দুর্বলতা একতিল পরিমানও কমেনি।বরং বেড়েছে।যা হয়তো ইভানও জানে।আবার হয়তো বা জানে না।

নিমন্ত্রণ পেতেই নিকট আত্নীয়দের ভীড় লেগে গেলো বাড়িতে।বাড়ির ভিতরের দিকটা নীহারিকা বেগম আর স্বান্তনা রহমান নিপুণহাতে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।এরমধ্যে বড়ছেলের আগে ছোটোছেলে কেনো বিয়ে করছে?এবিষয়েও কথা উঠলো।কথা উঠলো কি,কথাটা সবার মুখেমুখে।সেসব কথার উত্তরও তিনি অমায়িক হেসে সুন্দরভাবে বলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।যদিও ছেলের এমন হুটকরে বিয়ের সিদ্ধান্তে মনে- মনে তিনি-ও একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন।তবে নিভান বুঝিয়ে বলায় সেই অসন্তুষ্টটা কিছুটা হলেও গলে বরফ হয়েছে।তবু্ও কাল থেকে ইভানের সাথে এবিষয়ে ভুলেও তিনি কথা বলেন-নি।কথাই বলেননি রাগে।তবে তন্ময়ী মেয়েটাকে উনার বেশ পছন্দ।মায়াবী চেহারার একটা মিষ্টি মেয়ে।হাসলে মেয়েটাকে কি সুন্দর দেখায়।আর সেই মেয়েটা উনার বাদর ছেলের বউ হবে।উনার ছোটো ছেলের বউ!একারনেই ছেলের প্রতি নারাজি তিনি উগ্রভাবে দেখাতে পারছেন না।রান্বাঘরে ব্যস্ত হাতে কাজ করছিলেন,আর মনেমনে ভাবছিলেন তিনি।হঠাৎ গলায় একজোড়া হাত পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরতেই বুঝতে পারলেন হাতজোড়া কার।তবু-ও বিশেষ পাত্তা দিলেন-না।দৃঢ়চিত্তে কাজেই মনোযোগ দিলেন।পাশ থেকে স্বান্তনা বেগম দেখলেন।মৃদু হেসে তিনিও নিজের কাজে মনোবেশিত হলেন।

‘ও আম্মু।খুব রাগ হয়েছো আমার উপর?

রাগ মনে না থাকলেও,গলায় কঠোরতা বজায় রেখে নীহারিকা বেগম বললেন।—ইভান আমার প্রচুর কাজ।এখান থেকে যা।তোর উল্টো পাল্টা বকবক শোনার সময় আপতত আমার নেই।যা…

টুপ করে মায়ের গালে একটা চুমু বসিয়ে দিলো ইভান।নীহারিকা বেগম বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ইভানকে পিছন দিক থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন।ফের পরিহাসের স্বরে বললেন—আমার নাবালক ছেলে হঠাৎ সাবালক হয়ে গেলো কবে?এটাই তো বুঝতে পারছি না!আর সেই ছেলে আমার সাবালক ছেলের আগে বিয়ের প্রস্তাব রাখছে,ব্যাপারটা একটু ধাক্কা খাওয়ার না?

নিজের কথার ফাঁদে নিজে আঁটকে যাওয়া!ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।মনেমনে নিজেকে বেশ প্রবোধন করলো ইভান।ফের মা’কে ভুলাতে বললো–তোমার নাবালক ছেলে নাবলকই আছে।শুধু বিয়ে করতে চাইছে।আর বিয়ে করতে গেলে ছেলে আবার নাবালক সাবালক হতে হবে কোথায় লেখা আছে?দাদুমা গল্প করেন শোনোনা,আগের মানুষের নাকি একদম ছোট্রো বেলায় বিয়ে হয়ে যেতো।এমনকি পেটে পেটেও নাকি বিয়ে হয়ে যেতো।তাদের কি কিছুতে আঁটকে আছে নাকি?নাকি….

নীহারিকা বেগম ইভানের কথা শেষ করতে দিলেন না।এই ছেলের মুখের কোনো লাগাম নেই।কোথায় কি বলে বসে,তার ঠিক নেই।তিনি চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাত চেপে বললেন।—আমি তোর মা,বান্ধবী নই।কথা হিসাব করে বল,বেয়াদব।আর এখান থেকে যা নাহলে কিন্তু মোটেই ভালো হবেনা ইভান।

মুখ বেজার করার অভিনয় করলো ইভান।ফের স্বান্তনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে অভিযোগের স্বরে বললো–দেখেছো ছোটোমা,এবার বলো মা কাকে বেশি ভালোবাসে। দাদাভাই নাকি আমাকে।দাদাভাই হলে তো ঠিকই তার কথা শুনতো।তাও আবার আদরে আহ্লাদে মনোযোগ দিয়ে শুনতো।শুধু আমার বেলায় তার যতো জ্বালা।আমার কথাই শুনতে ভালো লাগেনা উনার।

‘ইভান।

এই ছেলে নাকি বিয়ে করবে!ছেলের ইতুড়েপনায় তন্ময়ী এসে দুদিনও টিকবে কিনা উনার ঘোর সন্দেহ আছে। মায়ের চড়া গলার ডাক পড়তেই দমে গেলো
ইভান।বুঝলো উল্টো পাল্টা যাই বলুক না কেনো কাজই হবেনা।মা সত্যিি বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন তার উপর।পাশে দাড়ানো ছোটো চাচির দিকে একবার অসহায় নজরে তাকালো।সেটা দেখে স্বান্তনা রহমান চোখের পলক ফেলে আস্বস্ত করলেন।বুঝালেন সব ঠিক হয়ে যাবে।হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে নিলো ইভান।রান্নাঘর থেকে যেতে গিয়েও,কিছু ভেবে ফের মায়ের কাছে এসে দাড়ালো সে।জানে,তার কান্ডে মা বকবে।তবুও আবারও দুহাত দিয়ে মা’কে পিছন থেকে জাপ্টে ধরলো।নীহারিকা বেগম রাগান্বিত হয়ে কিছু বলার আগেই অতি স্বাভাবিক গলায় ইভান বললো।

‘আই এ্যাম রিয়্যালি ভেরি স্যরি মা।আমি আমার কথা কর্মদ্বারা কখনো কাওকে কষ্ট দিতে চাইনি আর চাইনা কখনো।তবুও বারবার সবাই আমার কথা কর্মদ্বারা কষ্ট পায়। আর পাচ্ছেও।তবে বিশ্বাস করো আম্মু,আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমার সেই কাছের মানুষগুলোকে মনোক্ষুণ্ণ হতে হবে,আমার কর্মদ্বারা সেসব মানুষগুলো কষ্ট পাবে।এটা আমি আরও চাইনি।তবুও সেই মানুষগুলোই কষ্ট পেয়েছে।হয়তো আমার ভাগ্য ভালো না,আমি চেয়েও কাওকে ভালো রাখতে পারিনা, এজন্য।বাট আমি নিরুপায় হয়ে এমন একটা ডিসিশন নিতে বাধ্য হয়েছি।আমি চাইনি তন্ময়ীর অন্য কোথাও বিয়ে হোক।আর সেই মেয়েটা আমার জন্য অসম্মানিত হয়েছে,এটা জেনেবুঝেও তাকে কিকরে আরও অসম্মানিত হতে দেই!যারজন্য না চাইতেও সেই সবাইকে কষ্ট দিতে হলো আমাকে।

ছেলের আগাগোড়া কথা কিছুই বুঝলেন না নীহারিকা বেগম।তবে এটা বেশ বুঝলেন তন্ময়ীর বিয়ে ভাঙার সাথে কিছু একটা সম্পর্ক আছে ইভানের।বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎই উনার গালে ছেলের ফের স্নেহময় আদর পড়লো।বিগলিত হলেন তিনি।এমনিতেই মন শান্ত হয়ে গিয়েছে উনার।ইভানের প্রতি যে অসন্তুষ্টটা মনেমনে ছিলো,সেটা কেটে গিয়েছে সেই কখন।তবে ছেলেকে সেটা দেখাতে চাইছেন না বলে মুখেমুখে এতো চোটপাট। তবে ইভানের এবারের কথাগুলো মাতৃত্ব মনে কেমন জেনো দাগ টেনে দিলো।ছেলের ভাগ্য খারাপ মানে!ইভানের কখনো কথায় কেউ কখনো তো কিছু মনে করেনা।তবে কেনো ছেলেটা এমন বলছে?হঠাৎ ইভানের ফের কথায় ভাবনার ঘের কাটলো উনার।

‘তবে সত্যিই তুমি দাদাভাইকে বেশি ভালোবাসো মা।

আর দাঁড়ালো না ইভান।চলে গেলো সে।সেদিকে শূন্য নজরে তাকিয়ে রইলেন তিনি।আজ ইভানের কথায় কোনোরূপ মশকরা ছিলোনা।অতি স্বাভাবিক গলায় ছেলেটা কথাটা বলেছে। তবে কি সত্যিই তিনি ইভানের থেকে নিভানকে বেশি ভালোবাসেন।হয়তো একটু বেশি।মাতৃত্ব মন সেটা বুঝলেও মুখে স্বীকার করলেন না।স্বান্তনা বেগমের দিকে চেয়ে দূর্বল গলায় বললেন।

‘এই ও কেনো বোঝেনা ছোটো।ওরা সবাই আমারই পেটের সন্তান।ওদের সবাইকে আমি একই পেটে ধরেছি।একইভাবে লালনপালন করেছি।ওদেরকে আমি সমান ভালোবাসি।তবে নিভান আমাকে প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি অনুভব করিয়েছে।ওর মধ্যে আমি আমার মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ অনুভব করেেছি।ওর মুখে আমি প্রথম মা ডাক শুনেছি।তাই ওর প্রতি একটু দূর্বলতা বেশি আমার।কিন্তু বিশ্বাস কর ছোটো,আমি ওদের সবাইকে সমান ভালোবাসি।আচ্ছা তুই বল,নাফির আর মৌনতাকে তুই সমান না আলাদা আলাদা কম বেশি ভালোবাসিস?

‘নিজের পেটেধরা সন্তানদের কেউ আবার আলাদা আলাদা ভালোবাসতে পারে?নাকি আলাদা নজরে দেখা যায়?তুমি আবার ওর কথা শুনে এগুলো কি বলা শুরু করলে আপা?দেখোনা নাফিম আর মৌনতা সারাদিন কি নিয়ে ঝগড়ায় লেগে থাকে।ওদের ও তো একই কথা,একই অভিযোগ!মা আমাকে নয় তোকে বেশি ভালোবাসে।আমার প্রতিও কি ওদের অভিযোগ কম চলে!তবে সেসব কথায় আমরা অবুঝ হলে চলবে?নাকি চলে?তুমিই আমাকে এসব বোঝাও আবার এখন তুমিই আবার অবুঝ হচ্ছো?

‘ওরা ছোটো,ইভানতো আর ছোটো নয়।ও কেনো বোঝেনা।ও কেনো এমন অবুঝপনা কথা বলে বারবার।কেনো বলে?আমার সব সহ্য হলে-ও, এসব কথা সহ্য হয়না।ও বোঝেনা।

‘আমরা বড়রাই তাই মাঝে মাঝে কঠিন অবুঝ হয়ে যাই সেখানে ওর কথা বাদ দাওতো।ওসব নিয়ে মন খারাপ কোরো-না।বিয়ে করছে তো। বাচ্চার বাবা হোক তারপর সবই ঠিকই বুঝবে।আর ওসব কথা কি আর আজ,ও নতুন বলছে ।ও তো তোমাকে রাগানোর জন্য সবসময় ওসব বলে থাকে।

‘কিন্তু আজ ওর কথা রাগানোর জন্য ছিলো-না।কথাটা মনেমনে আওড়ালেন তিনি তবে মুখে আর সান্ত্বনা বেগমকে জানালেননা।কথা সেখানেই ক্ষান্ত রাখলেন তিনি।নিজ কাজে মনোযোগ দিলেও ইভানের বলা শেষ কথাটা বারংবার মনমস্তিস্কে চলতে থাকলো।

বিয়ে উপলক্ষে নীহারিকা বেগমের বাবার বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এসেছেন।সাথে নিভানের বৃদ্ধা নানুমা-ও এসেছেন।নিভানের সাথে ভদ্রমহিলার বেশ অমায়িক সম্পর্ক।সকাল সকাল এবাড়িতই উনার আসার কথা শুনতেই, নিভান উনার সাথে দেখা করতে এলো।মান্যতার রুমে আরামদায়ক বিছানায় পা মেলিয়ে বসে আছেন তিনি।নিভানকে দেখেই মিষ্টি হেসে কাছে ডাকলেন।ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।দুজনের ভালোমন্দ সাক্ষাৎ শেষে নিভানের শ্যামবর্ণ নিটোল কপালে বৃদ্ধা ঠোঁটের আদর দিতেও ভুললেন না।আদর পেতেই,ফিরতে আদর দিতেও ভুললোনা নিভান।নানুমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে,দ্বিধাহীন উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।নিভানের চুলের মাঝে নিজের দূর্বল আঙুলগুলো চাপিয়ে নড়াচড়া করতে করতে বেশ রসিকতার সহিত বললেন।

‘কি ব্যাপার বলোতো নানুভাই?তুমি ইদানীং আমার সাথে দেখা করতেই যাচ্ছো-না।যেখানে সপ্তাহে রোজ তোমাকে দেখা যেতো সেখানে সপ্তাহে একদিনও তোমার দেখা নেই।আজ প্রায় দুমাস হতে চললো,অথচ নানুমার কথা মনে নেই।ব্যাপারটা কি?নানুমার নাতবউয়ের দেখা মিললো নাকি?যে নানুমাকে ভুলতে বসেছো?

অপ্রিয় হলপও কথাটা সত্য।তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না নিভান।মৃদু হেসে নানুমার কথার উত্তর দিল।
–অফিসের প্রচুর ঝামেলা ছিলো।তারমধ্যেও আমি একদিন না জানিয়ে তোমার ওখানে গিয়ে দেখি,তুমি বাসায় নেই।বড়মামাদের ওখানে চলে গিয়েছো।তারপর তো আমি ফোনে তোমার সাথে কথা বলে নিয়েছি,তবুও এই অভিযোগ কেনো আমার নানুর রাঙা বউয়ের?

হাসলেন ভদ্রমহিলা।নিভানের কথার প্রসঙ্গ গেলেননা।প্রসঙ্গ এড়িয়ে নিভানের মাথায় স্নেহপূর্ন হাত বোলাতে বোলাতে বললেন—আমার ছোটো নাতী বিয়ে করছে অথচ বড়নাতী এখনো একটা নাতবউ খুঁজে নিতে পারলোনা।বিষয়টা কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা নানুভাই।তাড়াতাড়ি নাতবউ খুঁজে ফেলো?
আমি যে আমার নানুভাইয়ের সুন্দরী বউটা দেখেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে চাই।

নিভান মৃদু হাসলো।বৃদ্ধার চোখ সেটা এড়ালো-না।তিনি বললে—ব্যাপার কি আমার নানুভাইয়ের মুখে হাসি কেনো?সত্যিই কি নাবৌ খুঁজে পেয়েছো তবে?

নিভান মুখে কিছু বললোনা।তবে নানুমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘনঘন উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা জানালো।বৃদ্ধা যেনো আসমানের চাঁদ হাতে পেলেন,এমনটাই খুশি হলেন।বললেন–সত্যি বলছো নানুভাই।কোথায় পেয়েছো তাঁকে!আর কে সে?দেখাও দেখি আমাকে।

‘সিক্রেট,নানুমা।তার কথা তো এখন কাওকে বলা যাবে না।

‘নানুমার কাছেও তাকে গোপন রাখতে চাও?নানুমা কাওকে বলবে-না। দেখাও দেখি,সেই সৌভাগ্যবতীকে।যে আমার নানুভাইয়ের শক্তপোক্ত মনটা দূর্বল করে সেখানে জায়গা করে নিতে পেরেছে…

কথা শেষ করতে পারলেন না তারমধ্য সেখানে উপস্থিত হলো নিভানের এক মামতো বোন।নাম ঈশিতা।মেয়েটা বিবাহিত।দুই বাচ্চার মা। নিভানের সাথে মেয়েটার একটা আবেগময় সম্পর্ক আছে।বাবা হারিয়ে যখন নানুবাড়িতে নিভানদের জায়গা হলো।সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতো ছোট্টো নিভান।মায়ের মানসিক টানাপড়েনে একটা সময় এই বোনটায় তাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে।যে একটা বছর মামাবাড়িতে ছিলো,তাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করেছে।আদর ভালোবাসা দিয়েছে।ছোট্ট নিভানকে নিয়মমাফিক খাইয়ে দেওয়া,গোসল করিয়ে দেওয়া, ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া,ঘুরতে নিয়ে যাওয়া।রুটিন ছিলো যেনো মেয়েটার।সেই সময় থেকে মেয়েটার প্রতি কঠিন একটা দূর্বলতা রয়েছে নিভানের।আর তার থেকে দূর্বলতা বোন নামক ঈশিতা মেয়েটার তারপ্রতি।মেয়েটাকে রুমে ঢুকতে দেখেই কিছুটা আনন্দিত গলায় নিভান বললো।

‘ঈশু আপু।তুমি কখন এলে?

মেয়েটা মৃদহেসে সামনে এগোতে এগোতে বললো–এই তো কেবলই আসলাম।কেমন আছিস তুই?আমার ব্যস্ত ভাইটা বুঝি এখন আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে!ইদানীং যে তাকে আর বোনের বাড়িতে দেখা যায়না।

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?আর তুমি তো জানো,খুব ব্যস্ত না থাকলে কোনো না কোনো এক ফাঁকে আমি তোমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।

দুই ভাইবোনের ভালোমন্দ কথা চলতেই থাকলো।তার মধ্যে প্রসঙ্গ পাল্টে নানুমাও যোগ দিলেন।কথার একপর্যায়ে খোলা দরজায় কড়া নড়লো।রুমের সকলের নজর চলে গেলো সেদিকপানে।তবে কড়া নাড়া মানুষটা খেয়াল করলো-না,ভিতরে দু’জন নারী বাদেও একজন পুরুষ পরম আহ্লাদে তার নানুমায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।অথচ পুরুষটা ঠিকই প্রিয় নারীটাকে খেয়াল করলো।অনুমতি পেতেই চায়ের ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকলো কৌড়ি।যতো সামনে এগোলো ততো সাদৃশ্য হলো,একজন নারীর পিছনে আরেকজন নারীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা পুরুষটাকে।অপ্রস্তুত হলো সর্বাঙ্গ।মূহুর্তেই ভিতরে ভিতরে শিহরে উঠলো তার পেলব শরীর।অকারণেই বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো।পায়ের গতি কমে গেলো।তবে থামলো না।মনেমনে আশ্চর্যও হলো।এতোটা আবেগময় হতে এই মানুষটাকে কখনো দেখিনি।সবসময় গম্ভীর্যরূপে ফর্মাল ড্রেসে শুধু বাড়ির বাহির যেতে আর ঢুকতে দেখেছে সে।এবাড়ির কখনো কারও সাথে হাসিমজা বা এরকম কোনো আবেগঘনো দৃশ্যমান হতে দেখিনি।
মাথা নিচু করে বেডের পাশে এসে চায়ের ট্রেটা বেডের পাশে টেবিলেটায় রাখার আগেই পুরুষালী কন্ঠে হাত কেঁপে উঠলো তার।

‘ট্রে একদম টেবিলের উপর রাখবে-না।ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি।

আশ্চর্য হলো উপস্থিত তিন নারীর মধ্যে দু’জন নারী।
আড়ষ্টতায় সামনে দাঁড়ানো সুন্দরী মায়ময় মেয়েটার পানে তো এক একবার নিভানের পানে তাাকালো তারা।
নিভান তো এমন ছেলে নয় তবে এমন কথা কেনো বলছে?আর মেয়েটাই বা কে?খুব সুন্দর মেয়েটা এবাড়িতে আগে কখনো দেখেননি উনারা।তবে কে?যার সাথে এমন আচারন করছে নিভান?আর নিভানতো এমনিতেই মেয়ে দেখলে,নিজের আগ্রহ টোটাল সেখানে খরচ করেনা।সেখানে মেয়েটার সাথে অকারণে এমন ব্যবহার।নিভানের নানুমা খেয়াল করে কৌড়িকে দেখতে থাকলেও,ঈশিতা চুপ থাকলো না।কপাল ক্ষীন কুঁচকে নিভানকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘ও অকারণে কেনো দাঁড়িয়ে থাকবে?আশ্চর্য, তুই ওরসাথে এমন করে কথা বলছিস কেনো?

গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো নিভান।–‘দোষ করেছে তাই।

‘মানেটা কি?ও দোষ করলো কখন?ও হয়তো কার-ও আদেশে চা দিতে এসেছে।এখানে দোষের কোথায়?

নিভান কথা বললো না।শান্ত নজরে শুধু কৌড়ির অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।কাল কতো করে বললো,অল্প সময়ের জন্য হলেও তারসাথে যেনো দেখা করে।অবশ্যই দেখা করে।কিন্তু ফাজিল মেয়েটা,এরপর আর টোটাল দেখাই দিলো-না তাঁকে।
নিভান নিজেকে কিভাবে শান্ত রেখেছিলো, সেটা শুধু সেই জানে।নানুমা খুব খেয়াল করে নিভানকে দেখলেন।বয়োবৃদ্ধ নজরে যেনো বুঝে নিতে পারলেন নাতীর মনের কথা।ফের কৌড়ির সুশ্রী মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন।মজার ছলে বললেন।

‘নিশ্চয় দোষ করছে মেয়েটা।না-হলে আমার নানুভাই অকারনে কাওকে শাস্তি দেওয়ার মতো ছেলে তো নয়।

অপ্রস্তুত হলো আরও কৌড়ি।মানুষটা এখানে আছে জানলে জীবনেও এই রুমের আশেপাশেও আসতোনা।এখন বের হতে পারলেই বাচে।কোনোমতে প্রসঙ্গ এড়াতে স্বভাবমতো নরম কন্ঠে বললো–বড়মা,নানুমার জন্য চা পাঠিয়েছেন।তাই আমি দিতে এসেছি।

ঈশিতা তড়িৎ করে বললো –এখানে দোষের কি করলো ও,যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।আর দাদুমা তুমি ওর হয়ে কথা বলছো!এই তোমার নাম কি?

‘কৌড়ি।

‘আচ্ছা কৌড়ি,তুমি চা রেখে যাও।

সময় নিলো না কৌড়ি।নাম জানা গোলুমোলু দেখতে সুন্দর মেয়েটাকে মনেমনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে চায়ের ট্রেটা রেখে চলে গেলো সে।সেদিকপানে তাকিয়ে নানুমা নিভানের কানের কাছে মুখ নিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন—ওই সুন্দর দেখতে ফুলকৌড়িটাই আমার নাতবৌ তাহলে?

মৃদু হেসে নিভানও ফিসফিসিয়ে বললো–কোনো,পছন্দ হয়নি?

‘ভিষন পছন্দ হয়েছে।আমার নাতীর একবারে যোগ্য নাতবৌ।

নানুমার কথার উত্তর সরূপ অমায়িক হেসে দিলো নিভান।তবে মনেমনে আওড়ালো-সে যোগ্য কি অযোগ্য জানিনা আর জানতে চাইওনা আমি।তবে ওই মায়াহরিনী ফুলকৌড়িটাকেই তোমার নাতীর চাই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here