#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: সতেরো|
দিবালোকের আলোয় ঝলমল করছে জগদ্বাসী। মিষ্টির ঘুম ভেঙেছে সবে। বাবার বাড়িতে ভোরে এসেই পৌছেছে। দীর্ঘদিন পর নিজের ঘরে আরামে সে ঘুমিয়েছে। আড়মোড়ে নড়তে গেলেই পেটের উপর কারো অস্তিত্ব অনুভব হয় তার। মাথা তুলে দেখতে পায় অন্তিক মিষ্টির পেটের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। স্মিত হেসে মিষ্টি অন্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরস্বরে ডাকে, ” এই অন্তু, উঠো!”
অন্তিক নড়েচড়ে মিষ্টির পেটের মধ্যে ঠোঁট ছুঁয়ে আবারও শুয়ে পড়ে। মিষ্টি অন্তিকের চুল খামচে ধরে। অন্তিকের প্রতিবারের ছোঁয়ায় অন্য জগতে চলে যায় সে।
” কি করছো সেখানে, পাপিষ্ঠা নারীর ছোঁয়ায় পাপী হয়ে যাবে তো!”
অন্তিক চোখ খুলে মিষ্টির পেটে হালকা কামড় বসিয়ে দেয়। মিষ্টি আহ করে আওয়াজ করে। অন্তিকের প্রচুর রাগ হয় এবার সোজা হয়ে সে মিষ্টির উপর মিষ্টি অত্যাচার শুরু করে। পেটে ছোট ছোট কামড়ে মিষ্টি ব্যাথা না পেলেও স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে। পেট ছেড়ে অন্তিক মিষ্টির মুখের কাছে আসে। মিষ্টির ঠোঁট ছুঁই ছুঁই হয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ” তুমি পূন্য, তুমি অনন্য, তুমি প্রীতি, তুমি অনবদ্য।”
মিষ্টিকে প্রত্ত্যুত্তরের সময় না দিয়ে অন্তিক খুব সফটভাবে মিষ্টির ঠোঁটে চুমু খায়। সময়ের হিসাব তাদের জানা নেই। ক্ষানিকের দুরত্ব ঘুচে দিচ্ছে আদরে আদরে। মিষ্টির চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। তার মনের শংকা কমেছে। তার অন্তু তাকে ভুল বুঝেনি। মিষ্টির ঠোঁট ছেড়ে বুকে মুখ গুঁজে অন্তিক। মিষ্টি চোখ বন্ধ করে অন্তিকের মাথায় হাত রাখে। নিবিড়ভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাতে।
” তুমিও কী আমাকে অবিশ্বাস করছো?”
” অবিশ্বাস তাদের মাঝেই হয় যাদের মনের অমিল হয়।”
পিনপতন নীরবতায় পাড় হচ্ছে সময়। মিষ্টির মন খচখচ করছে অন্তিককে প্রশ্ন করার জন্য। শুরু করবে কীভাবে সে? যদি অন্তিক কষ্ট পায়! দেখা গেল,মিষ্টির কিছু বলতে হয়নি। অন্তিক মিষ্টির বুকে মাথা রেখেই বলতে শুরু করে,
“মা চলে যাওয়ার দুই বছর পর এক সকালে পেট ব্যাথার যন্ত্রণায় মাটিতে শুয়ে ছটফট করছিলাম। ফিরোজ চাচা সেদিন বাবাকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিল। বাসায় তখন চাচী ছাড়া কেউ ছিল না। আমি যখন মা মা বলে আর্তচিৎকার করছিলাম চাচী তখন আসেন। আমাকে মাটিতে দেখে পিঠে দুইটা লাথি দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কাঁদছিস কেন মা’গী’র বাচ্চা। মা বে’শ্যা’গিরি করতে যাওয়ার সময় তোকে সাথে করে নিয়ে গেলো না কেন? এই কি হইছে তোর?’ বিশ্বাস করো মিষ্টি, সেদিন পেটের যন্ত্রণায় যতোটা না কষ্ট হচ্ছিল চাচীর মুখে মায়ের সম্পর্কে বাজে কথা শুনে তারচেয়ে বেশী কষ্ট হয়েছিল। আমি চাচীর পা ধরে বলেছিলাম, চাচী গো আমি আর পারছি না। পেটটা কেউ ছিড়েখুঁড়ে ফেলছে মনে হচ্ছে। কিছু করো! চাচী তখন লাথি দিয়ে ফেলে চলে গিয়েছিল।আমার কান্না তখনও থামেনি। বিকালে চাচী আবারও আসে আমাকে ধরে নিয়ে যায় হাসপাতালে। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চাচী এসে বলে, তোর জীবন শেষ। সেই বয়সে কিছু না বুঝতে পারলেও এতটুকু বুঝতে পারি আমার ভেতর কোনো রোগ আছে। এরপর বছরের পর বছর পাড় হয়ে যায়। আমি তখন টগবগে যুবক, তৈরী হয়ে ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম তখনই চাচী তার ঘর থেকে হাঁক ছাড়ে। আমি যেতেই বিনাবাক্যে পরিচিত এক হাসপাতালে নিয়ে যায়।সেখানে পুনরায় আমার শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। পূর্বের মতোই ফলাফল আসে। আমি তখন সব বুঝি, চাচীর কাছে রিপোর্ট চেয়ে দেখতে পাই সেখানে লেখা আছে, আমি কখনো বাবা হতে পারব না। আমার জীবন সেখানেই থমকে যায়। জীবনের সকল রং,ঢং মিশে যায় জমিনে। আমি হয়ে উঠি একজন যান্ত্রিক পুরুষ। চাচীর কাছেই রিপোর্ট রেখে দেয় লোকসমাজকে বলে দেওয়ার হুমকিও দেয়। আমিও লোকলজ্জার কারণে চাচীর কথায় উঠতে এবং বসতে শুরু করি। চাচীর যখন ইচ্ছে হতো আমাকে সারারাত নানান অজুহাতে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখতো আবার যখন ইচ্ছে হতো কথা শোনাতো। আমি কিছুই বলতাম না। এরপর, এরপর হঠাৎ আমার জীবন বদলে গেল। দাদার কথামতো একজন অচেনা মেয়েকে বিয়ে করি। তার আশেপাশে কম থাকতে চেষ্টা করি যেন তার মায়ায় আটকে না যাই। আমার অনিশ্চিত জীবনে তাকে জায়গা দিতে চাইনি। কিন্তু সে আমার জীবন পাল্টে দেয়। আমার সকল কষ্ট তার হয়ে যায়। আমাকে প্রেমিক পুরুষ বানিয়ে দেয়। আমি এখন তাকে ছাড়া অচল। আমি তাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না।”
মিষ্টি নাক টেনে টেনে কাঁদছে। আমরা খালি চোখে যা দেখি তা সত্যি নয়। হাসি ভরা মুখশ্রীর আড়ালে কতোটা ব্যাথা লুকায়িত আছে তা কাউকে বুঝতে দেয়নি অন্তু। অন্তিককে বুকের সাথে আরেকটু জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমরা খালি চোখে যা দেখি তা সবসময় সত্য হয় না, অন্তু! পরিচিত হাসপাতালের নয়, চলো আশেপাশের হাসপাতালে যাই। হতেও পারে চাচী মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়েছিল।”
অন্তিক চট করে মাথা তুলে। মিষ্টির চোখে চোখ রেখে বলে, ” এমন হলে কতোই না ভালো হবে বলো! অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।”
অন্তিকের কপালে চুমু এঁকে মিষ্টি বলে, ” তোমার সব দুশ্চিন্তা দূর হোক, কষ্ট লাঘব হোক।”
—————————
পূন্যালয় এতিমখানায় একজন মহিলা নাজমা বেগমের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। তার মনোযোগ তেল দেওয়ায় নয়, মনটা পড়ে আছে অন্য স্থানে। নাজমা বেগম বুঝতে পেরে কপাল কুঁচকায়। ব্যঙ্গ স্বরে বলে, ” নয়া নাগরের সন্ধান পাইছো নাকি? কাজে মনোযোগ দাও। তেল তো মাথায় না আমার কইলজায় ঢালতাছো মবে হইতাছে।”
” খালা, খুঁ’চা দিও না তো! আমার সকল চিন্তার কারণ তো তুমি জানো। ভাবছি মিষ্টির কথা, অভাগীর জীবনে আলো এসেও নিভে গেলো। এর দায়ভার কার?”
” খবরদার! এসব চিন্তা মনেও আনবা না। আমার নাতনিকে আমি উপযুক্ত মানুষের হাতেই তুলে দিছি। দেখবা, মিষ্টিই দিনশেষে সবচেয়ে সুখী হবে।”
নাজমা বেগমের কথায় মহিলাটি মন খারাপ করে। মনে মনে কিছু একটা ভাবতে থাকে সে। তেল দেওয়া শেষে নাজমা বেগম বাড়ি ফিরেআসেন। শুনতে পান ছেলের কথা,
” মিষ্টি আমার আপন মেয়ে না হলেও আমরা তাকে অনাদরে বড়ো করিনি, আপা। মায়ের জন্যই আমি এত দূরে সম্পর্ক স্থাপন করতে রাজি হয়েছি নাজিম চাচার ভরসায়। এখন মেয়ে ও মেয়ের স্বামী বাড়ি ফিরে এসেছে বলে যে তাকে ফেলে দিব তেমন মানুষ নই আমি।”
কথাগুলো বলছিল মিষ্টির মা রেশমির উদ্দেশ্যে। আহমদ, মিষ্টির বাবার কথায় নাজমা বেগম খুশি হয়। এগিয়ে এসে বলেন, ” নাজিম ভাইকে আমি কাছ থেকে চিনি আব্বা। তিনি পৃথিবীতে না থাকলেও নাত নাতনির জন্য অবশ্যই পরিকল্পনা করে গিয়েছেন।”
” আমরা ধন সম্পত্তির লোভ করি না। আমাদের মিষ্টিকে খুব চিনি। সে স্বইচ্ছায় যেই ঘরে গিয়েছিল, ভালো ভেবেই গিয়েছিল।”
আহমদেট কথায় নাজমা ধমক দেন। আশেপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলেন, ” নাত জামাই যেন কিছু না জানে, আহমদ। কিছু রহস্য রহস্যই থাক। ভুলে যাস না, পূন্যালয়ের ইতিহাস!”
আহমদ চুপ হয়ে যায়। সত্যিই তো, পূন্যালয়ের রহস্য উন্মোচন করার সময় এখনো আসেনি।
———————
” মিষ্টিকে নিয়ে আমি আজই চলে যাব, বাবা। আমাকে অনুমতি দেন, দাদী। মিষ্টির হাত আমার হাতে তুলে দেয়ার সময় থেকেই সে আমার দায়িত্ব। আমরা মাঝে মাঝে আসবো, আপনাদের সাথে দেখা করতে।”
অন্তিকের কথায় মিষ্টির মা নাকচ করে, ” দুইটা দিন থেকে যাও,বাবা। ”
” বিয়ের পর মেয়ের স্বামীর ঘরই শেষ ঠিকানা। আপনাদের মেয়েকে সংসার দেখিয়েছি কিন্তু নিজের সংসার দেখাইনি। ধরে নিন, এই অকর্ম ছেলে আপনার মেয়েকে নিয়ে আজ থেকে আসল সংসার পাতা শুরু করব।”
মিষ্টির পরিবার অন্তিকের ব্যবহারে মুগ্ধ। বিদায়ের সময় মিষ্টি পূন্যালয়ের পাশ দিয়ে গমনের সময় দাঁড়িয়ে যায়।
” মনি মায়ের সাথে দেখা না করেই চলে যাব, অন্তু!”
” এই অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করো না, মিষ্টি!
চঞ্চলা মিষ্টি কথা বলে থামেনি। অন্তিকের প্রত্ত্যুত্তর শোনারও অপেক্ষা করেনি। মিষ্টির পিছনে পিছনে অন্তিকও ছুটে যায়। অসাবধানতায় যদি মিষ্টির কোনো ক্ষতি হয়! অন্তিক এতিমখানায় পৌঁছাতেই মিষ্টি কাউকে জড়িয়ে ধরে আছে দেখতে পায়। মহিলার চেহারা বুঝা যাচ্ছে না। অন্তিক কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যায়। মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে রাখা মানুষটির চেহারা এবার স্পষ্টত দেখতে পায়। অন্তিকের পা জোড়া মুহূর্তেই থেমে যায়। তার সারা শরীর কাঁপছে মানুষটাকে দেখে। হাতে রাখা ব্যাগপত্র মাটিতে পড়ে যায়। অন্তিকের চোখে পানি। অস্পষ্ট স্বরে কণ্ঠনালী থেকে বের হয়ে আসে, ” মা!”
চলবে………….
[আমি খুবই দুঃখিত। আজও এলোমেলো মনে হচ্ছে। আগামীকাল ভালো কিছু চেষ্টা করব।]