#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৫,৬
পরদিন বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো চারুর। সাধারণত সে খুব ভোরেই ওঠে। ফজরের আজান কানে পড়া মাত্রই তার সজাগ মস্তিষ্ক শরীরকে জানিয়ে দেয়, ‘উঠতে হবে। নামাজ পড়তে হবে।’ কিন্তু আজ হঠাৎ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বেশ দেরি করেই নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। এর কারণ কি কাল রাতের সেই কান্নাকাটি না অন্য কিছু — চারু জানে না!
বাড়ি ভর্তি মেহমানে। গতকাল বিয়ের মূল আয়োজন ছিল। আজ বৌভাত। এ-বাড়ির সবাই ও-বাড়িতে যাবে দাওয়াতে। তারপর খেয়ে-দেয়ে বাড়ির মেয়ে আর মেয়ে জামাই নিয়ে ফিরে আসবে হাসিমুখে — যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই তো বাঙালিয়ানা প্রথা। নিচে আসতেই চারু দেখতে পেল, ইতোমধ্যেই বৌভাতে যাওয়ার তোড়-জোড় শুরু হয়ে গেছে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কি কি নিয়ে যাবেন সে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আজমীর রাজা। ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছেন তিনি। চারু সন্তর্পণে বাবাকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।
তিন জা, দুই ননদ আর দু’জন কাজের মহিলা — বাড়ির কর্ত্রীস্থানীয় সবাই যেন রান্নাঘরে উপস্থিত। কেউ মাছ কুটছে, থালা-বাসন ধুচ্ছে, সবজি কাটছে, একেক জনের একেক কাজ। ঘরময় তাদের পদচারণা, কথাবার্তার উচ্চস্বর, হাসা-হাসিতে কলকলিয়ে উঠছে পরিবেশ। তার উপর চুলোয় কি একটা চড়িয়েছে, তেলের ছ্যাঁত ছ্যাঁত আওয়াজ। চারুকে দেখেই আমেনা বলে উঠলেন,
— “চারু? এই তোমার উঠার সময়? ঘড়িতে দেখো তো, কতো বেলায় উঠলে?”
ভর্ৎসনা নয়, ফুপুর মুখে অভিমানী সুর। চারু লজ্জায় নত শীর করে বললো,
— “দুঃখিত, ছোট ফুপু। উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে!”
ভাইঝির কথা শুনে হাসলেন আমেনা। প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,
— “আচ্ছা, মা। সমস্যা নেই। হাতমুখ ধুয়েছ? নাশতা করবে না এখন?”
চারু ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো। মেজ চাচী রুটি বেলছিলেন, ওর দিক প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
— “কি খাবি, চারু? রুটি না পোলাও? পোলাও কিন্তু বাসি— আর রুটি খেলে গরম গরম ভেজে দিচ্ছি।”
— “আচ্ছা, দাও।”
মাথা নাড়ে মেয়েটা। মেজো চাচী তিনটে কাঁচা পরোটা বানিয়ে ওর মায়ের হাতে দেন। চমক সেগুলো ভাজবেন তখনই আহসান রাজাকে আসতে দেখা গেল এদিকটায়। তিনি সংবাদ দিলেন, খাবার ঘরে এখন দ্বিতীয় ব্যাচ চলছে; তৃতীয় ব্যাচের খাবার প্রস্তুত করত। কিছু ঘাটতিও হতে পারে! অতএব, রান্না-বান্না দ্রুত সারতে। অতিথিদের সামনে যেন খেলো হয়ে যেতে না হয়!
চমক ব্যতিব্যস্ত হাতে কোনোমতে পরোটাগুলো ভেজে, ডিম আর আলুভাজি সহযোগে মেয়ের হাতে দিলেন। চারু আর বাড়তি করে খাবার ঘরে যাওয়ার ঝক্কিতে গেল না। ফুপুদের একপাশে বসলো টুল টেনে নিয়ে বসলো। বড় ফুপুকে জিজ্ঞেস করলো,
— “তোমরা খেয়েছ, ফুপু?”
— “না রে, খাই নি। কখন খাবো? সকাল থেকে যে দৌড়াদৌড়ি—”
উত্তরটা শুনে বেশ অবাক হয়ে চারু বললো,
— “সে কি! এখনো খাওয়া হয় নি তোমাদের? একজনও খাও নি।”
ছোট চাচী কড়াইয়ে গতদিনের বেঁচে যাওয়া মাংস গরম করতে দিয়েছেন। খুন্তি দিয়ে সেটা নাড়তে নাড়তে ওর দিকে তাকালেন। শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন,
— “আর খাওয়া! কাজ করেই কূল পাচ্ছি না— তোর অতো হিসেব নিতে হবে না। তুই ঝটপট খেয়ে নে। একজন লোক অন্তত কমুক।”
এতোগুলো মানুষ না খাওয়া, অথচ চারু এখানে একা বসে গিলবে? কিছুতেই যেন মন মানলো না মেয়েটার। নরম হৃদয়ে খুব অশোভন লাগলো আচরণটা। একটু টুকরো রুটি ছিঁড়ে ভাজি লাগিয়ে দিলো বড় ফুপুর মুখে,
— “নাও নাও, হা করো।”
ফুপু প্রথমে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেও চারুর জেদের কাছে পারলেন না। টুপ করে গিলে নিলেন খাবারটা। এরপর একে-একে সবাইকেই একটু একটু করে খাইয়ে দিলো চারু। চমকের কাছে নিতেই উনি কপট রাগ করলেন,
— “নিজের মুখেও একটু দাও। এতো মানুষ কেউই একেবারে না খেয়ে নেই। নাশতায় চা-বিস্কুট সবারই জুটেছে। তুমিই শুধু বাকি।”
— “সে হোক। তুমি খাও তো!”
হাসতে হাসতে আরেকটা রুটির অংশ ঠুসে দিলো মায়ের মুখে।
সকাল হতেই ডেকোরেটরের লোক চলে এসেছে। সাজানো প্যান্ডেল খুলছে তারা। আসাদ রাজা লনে দাড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। তদারকি করছেন সবকিছুর। কখনো শান্ত সুরে, নরম গলায় কথা বলছেন, আবার কখনো বা বেজায় চটে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। “এই এই, এটা করছ কেন? আহ্ হা। তোমরা কি কিছু বুঝতে পারো না? আরে — ওটা করতে নিষেধ করলাম না!” — ক্ষণে ক্ষণেই তার মুখ থেকে এ-জাতীয় বাক্য শোনা যাচ্ছে। তার হম্বি-তম্বিতে ওরা সবাই অস্থির! ফলে আরও বেশি ভুল হচ্ছে কাজে, আর আসাদকেও সমানতালে চিৎকার করতে হচ্ছে!
এককাপ চা হাতে বাইরে বেরিয়েছে চারু। চাচাকে রাগ করতে দেখে এগিয়ে এলো এদিকে। কাপে চুমুক দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,
— “কি হয়েছে, ছোট চাচা? এতো রাগ করছ কেন? তোমার হৈচৈ শুনে তো মনে হচ্ছে ডাকাত পড়েছে বাড়িতে! এতো রাগ করলে চলে?”
ভাতিজির স্নিগ্ধ হাসিটা চোখে পড়তেই একটু থামলেন আসাদ রাজা। তার বরাবরই শর্ট টেম্পার। অল্পতেই রেগে একাকার। তবে আশার কথা হলো, বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি চেঁচামেচি করেন না। রাগটাও তেমন দেখান না। তাই আজও তার তথাকথিত ‘হট’ মেজাজটাকে ক্ষণিকের জন্য দমিয়ে রাখতে হলো। খানিক হতাশামথিত কণ্ঠে বললেন,
— “রাগ না করে করবো কি, বল? এরা একেকটা যে গাধার গাধা! একটা কাজও পারে না। উপরন্তু চোর! ওদের চেয়ারের সাথে সাথে আমাদের চেয়ারও নিয়ে যাচ্ছে! আবার বলে না-কি ডেকোরেটরের দোকান খুলে বসেছে। কতোবড় জোচ্চোর বুঝতে পারছিস?—”
আবহাওয়া বেশ গরম। বিlস্ফোlরণ হতে দেরি নেই। চারু বুঝতে পেরে সাবধান হয়ে গেল। আসাদ রাজার উদ্দেশ্যে নরম গলায় বললো,
— “সেজন্যে এতো চেঁচাতে হবে নাকি? তোমার যে বিপি হাই, সে কথা মাথায় নেই? তুমি এক কাজ কর, এদিকে অন্য কাউকে দাও। কাব্য, কবির ভাই বা কাউকে। তুমি ওদিকে গিয়ে বিশ্রাম করো গে!”
ওনাকে ঠেলতে শুরু করলো। ওর কথা যেন গায়েই ফেলতে দিলেন না আসাদ রাজা। ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে বললেন,
— “আরে, আমি না দেখলে তো সব সাফ হয়ে যাবে। কবির – কাব্যের কথা বলছিস? তোর ওই বলদ মার্কা ভাইগুলো কিছু পারে নাকি? দেখবি ওদের চোখের সামন দিয়ে পুরো বাকি ফাঁকা করে দিয়ে গেলেও এরা কিচ্ছু টের পাবে না। ওদের উপর ভরসা করে মlরবো? বড়ভাই কতো ভালোবেসে দায়িত্ব দিয়েছে—”
— “কিন্তু তাই বলে..”
ওকে কথা শেষ করতে দিলেন না। আবারো চিৎকার করতে করতে ছুটলেন প্যান্ডেলের দিকে। ওরা স্টেজ খোলার নাম করে বাড়ির টেবিলের উপরে চড়ে কেমন অসভ্যের মতো দাপাচ্ছে। গলা উঁচিয়ে তারস্বরে চেঁচালেন ফের,
— “আরে! তোমাদের টেবিল নেই? ওটা আমাদের বাড়ির— ভাঙবে তো!”
চারু কিছুক্ষণ হতাশ চোখে তাকিয়ে পা বাড়ালো।
সৌভিকদের এই বাড়িটা আকারে বেশ বড়। দোতলা ছিমছাম ধরনের সুন্দর বাড়ি। সামনে বিরাট লন। গার্ডেন সাইডে গাছের সংখ্যাও কম নয়। একান্নবর্তী পরিবারের জন্য আদর্শ। সৌভিকের দাদা আহাদ রাজার সঙ্গে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখার পর উপলদ্ধিটা আসলো নিখিলের। বৃদ্ধ আহাদ রাজার চমৎকার বাসস্থান “অরুণা ম্যানশন”– সত্যিই মনোমুগ্ধকর!
বাগানের ভেতরে একটা কটেজের মতো করা। ছোট্ট ষড়ভুজ আকৃতির ঘর, উপরে টিনের চালার মতো করে মাটির টালি বিছানো। ভেতরে বসবার জায়গা আছে। বেতের চেয়ার সাজানো, মাঝখানে কাঠের টেবিল। দেয়াল নেই বিধায় অফুরন্ত বাতাসের কারখানা। পুরো বাড়ি ঘুরে এই জায়গাটাই সবচে’ পছন্দ হলো নিখিলের। আহাদ রাজার সঙ্গে এখানেই বসলো। একটু পরেই কাজের ছেলেটা চা দিয়ে গেল ওদের। আহাদ রাজা শুধালেন,
— “তারপর, দাদুভাই? বলো দেখি, আমার বাড়ি তোমার কেমন লাগলো?”
টেবিল থেকে নিজের কাপ তুলেছিল সবে। কাপে চুমুক দিয়ে হেসে জানালো,
— “সত্যি বলতে কি, ভীষণ সুন্দর! কি পরিপাটি, গোছালো বাড়ি আপনার! সবচে’ ভালো লেগেছে এই জায়গাটা। এতো বাতাস চারপাশে! আমি মুগ্ধ!”
নিজের দারুণ কৃতিত্বের কথা শুনে কে না ভালোবাসে? সবাই তো প্রশংসাই খোঁজে! তবে নিখিল ছেলেটার কথা নিছক সৌজন্যতা রক্ষায় নয়। ওর মুখের প্রশান্ত চেহারাই সেটা বলে দিলো অভিজ্ঞ আহাদ রাজাকে। তৃপ্তির হাসি হাসলেন বৃদ্ধ,
— “এই জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর। আমার নাতি-নাতনিরা সবাই এই জায়গা পছন্দ করে। প্রতিদিন বিকেলে আড্ডা দেয়। হৈ-চৈ করে এখানে বসে। ওরাই ভালোবেসে এর নাম দিয়েছে “দখিন হাওয়া”! আমার বড় নাতনি চারু, ওরই বেশি শখ ছিল এই নাম নিয়ে!”
চারুর প্রসঙ্গ উঠতেই উত্তাল হলো বুকের ভেতরটা। চনমনিয়ে উঠলো সারা দেহমন। এখন বসন্ত নয়, শীতের আমেজ। তবুও ওই একটি নাম কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই যেন শরীরে বসন্ত বাতাস ছুঁয়ে দিলো। হৃদয়ে দোলা লাগিয়ে মানসপটে ভাসলো, সেই পবিত্র-স্নিগ্ধ মুখখানি। কি সুকোমল চাহনি, সরলা বালিকার ন্যায়! অজান্তেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল,
— “অপূর্ব!”
আহাদ রাজা দাম্ভিক হাসলেন। নিজের সন্তান, নাতি-নাতনিদের গল্প বলতে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। ভালোবাসেন তার সুখী পরিবারটির গল্প বলতে!
কল্পনায় এঁকে চলা রূপসী নারীকে দেখতে বিভোর ছিল নিখিল। হঠাৎ চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেল সেই মুখশ্রী! স্মৃতিপটের অতীন্দ্রিয় দেবীর আগমন ঘটলো কল্প থেকে মর্ত্যলোকে। আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে চারু আসছে এদিকেই কোথাও। হাতে চায়ের কাপ, চুমুক দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। চারুকে দেখেই হাঁক ছাড়লেন আহাদ রাজা,
— “ও চারু? এদিকে আয় তো, ভাই!”
চট করে ফিরে তাকালো মেয়েটা। কটেজের ভেতরে বসা দাদুকে দেখতে পেয়ে প্রত্যুত্তর করলো,
— “আসছি, দাদু!”
নিখিল এক দৃষ্টিতে চেয়েই ছিল মেয়েটার দিকে। পরনের জামাটায় লালচে রঙের শেড। ওড়নাটা ধবধবে সাদার! ঘন কালো চুলে লম্বা বেণী থেকে আলুথালু কেশ বেরিয়ে। সেই গুচ্ছ গুচ্ছ এলোকেশ এসে কপালের দুপাশে দুলছে। চোখের চশমাটা নাকের ডগায় নামানো। কাচ ভেদ করে দৃশ্যমান হয়েছে ফোলা ফোলা নেত্র। চোখে চোখ পড়তেই নিখিলের হঠাৎ গতরাতের কথা মনে পড়লো। এতক্ষণ ও যেই স্মৃতিচারণ করছিল, বারে বারে মুগ্ধ হচ্ছিল, সেই উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়লো। গতরাতের ক্রন্দনরত সেই ব্যাকুল নারীর সঙ্গে আজকের দিনের আলোয় দেখা এই নারীর কতো ফারাক! রাতের রহস্যময়ী আর দিনে স্নিগ্ধতার মায়ায় জড়ানো — আসলে সে কেমন? কেন সে রাতে কাঁদলো? তাও মাঝরাতে, একা ছাদে? কোন গভীর ব্যথায়? আচ্ছা, মেয়েটা যে একা একা কাঁদে; তা কি এরা কেউ জানে? জানে কি, ওই হাস্যোজ্বল মুখের পেছনের কষ্ট কি? চারুর মুখের দিকে অনিমেষ চেয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলো নিখিল।
___
অনুর বৌভাত। অনুষ্ঠানে অরুণা ম্যানশনে সবাই এসেছে। বাড়ির মেয়ের বৌভাত, না আসলে হয়? সবাই সেজে-গুজে, হাসি হাসি মুখ করে চলে এসেছে। দুপুরের খাবারের দাওয়াত। তারপর নববর-বধূকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি যাবে তারা।
বেশ কিছুক্ষণ হলো একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিখিল। এতোক্ষণ সৌভিকের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কে যেন এসে ডাকায় ওকে রেখে চলে গেছে ছেলেটা। অগত্যা অপরিচিত বাড়িটায় একা একা ঘুরতে হচ্ছে নিখিলকে। এতে অবশ্য ও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং, অতি আগ্রহের সাথেই সে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর আনমনে খুঁজে বেড়াচ্ছে চারুকে। কি জানি কেন, গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে এই নামটি তার মাথা থেকে বেরোচ্ছেই না! কেমন আঠার মতো লেগে গেছে মাথার ভেতর। চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে সে। তাকে নিয়েই ওর যতো কল্পনা-জল্পনার আয়োজন চলছে! এর কারণ ঠিক প্রেম না অন্যকিছু, অনুভূতি বিশ্লেষণে অনভিজ্ঞ নিখিল নওশাদ তা জানে না!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৬
বাড়িতে খুশির আমেজ। কতো কতো মানুষ! সবই অপরিচিত, কাউকেই চেনে না নিখিল। তারপরও এই হাস্যোজ্বল মুখগুলো দেখতে ভালোলাগছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ রিংকু-টিংকুর সঙ্গে দেখা হলো ওর। ওরা দু’ জনে দাড়িয়ে আছে একগাদা মেয়ের মাঝখানে। ঠাট্টা-তামাশা করছে। নিখিলকে দেখতে পেয়েই রিংকু ডাকলো,
— “নিখিল ভাইয়া, এদিকে এসো তো। জলদি জলদিই!”
এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলো টিংকু। একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল ওকে। নিখিল বিপন্ন হলো,
— “আরে, আরে! হয়েছে কি? টানছ কেন?”
হুড়মুড়িয়ে মেয়েদের মাঝখানে ঢুকানো হলো ওকে। ও আসতেই কলকলিয়ে উঠলো মেয়েরা। বিদ্রুপের সুরে বললো নেত্রী গোছের কেউ একজন,
— “ভাইয়া? ভয় পাচ্ছেন নাকি? আমরা কি খেয়ে ফেলবো?”
নিখিল একটু অপ্রস্তুত হাসি দিলো,
— “খেতেও পারো। বলা তো যায় না, মানুষরূপী রাক্ষস যদি হও!”
সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠলো রিংকু-টিংকু। সাবাশি দিলো,
— “ফাটিয়ে দিয়েছ, ভাইয়া। চালিয়ে যাও!”
মেয়েগুলোও সাড়া দিলো,
— “বাপ রে, ছেলে মানুষের এতো ভয়! আমরা তো ভেবেছিলাম—”
হৈ-হৈ করে উঠলো বাকিরা। নিখিলের বুঝতে বাকি রইলো না কেন তাকে এভাবে বগলদাবা করে হাজির হলো টিংকু। ওকে নিয়ে হুল্লোড় থেকে একটু সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— “আমাকে এখানে এনেছ কেন, টিংকু? এসব কি?”
টিংকু হড়বড় করে বললো,
— “আরে ভাইয়া দেখছেন না মেয়েগুলো কেমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে আমাদের? কেমন ভাবটা নিচ্ছে? যেন আমরা কিছুই না! এখন ওদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে না, কাদের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে? তাই—”
ওদের সমস্যাটা বুঝলো নিখিল। দু’ জন ছোট ছেলে সাত-আটটা মেয়ের সঙ্গে চাপার জোরে পারবে নাকি? তাই দলভারী করতে ওকে ডাকা। কিন্তু নিখিল যে এসব পারে না। মেয়েদের সাথে বচসা করা ওর স্বভাববিরুদ্ধ। মেয়েরা হয় নরম – কোমল। ওদের সঙ্গে গল্প করে আরাম। তা না করে ঝগড়া?
বিব্রত হয়ে বললো,
— “ইয়ে, টিংকু কিছু মনে করো না। একটা কথা বলি। মেয়েদের সঙ্গে আর যাই করো, ঝগড়ায় যেও না। তুমি মরে গেলেও ওদের যুক্তির সাথে পারবে না। ওরা চাইলেই আকাশকে মাটি, মাটিকে আকাশ বানিয়ে দিতে পারে শুধু চাপার জোরে! তাই বলছি ভাই–”
— “তুমি মেয়েদের ভয় পাও?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিখিল চটপট বললো,
— “না, ভাই। মেয়েরা ভয় পাওয়ার জিনিস না। কিন্তু ওদের সাথে ঝগড়াটা ভয় পাওয়ার। ওরা কখন কি করে বসে, পরে কি-না-কি হয়! তোমরা এসব সামলাও। আমি নেই।”
সটকে পড়ার মতলব। টিংকু অসহায় গলায় বললো,
— “নিজেদের এতো ছোট ভাবলে হয়, ভাইয়া? ছেলে হয়ে ছেলেমানুষের ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করতে পারো না? আমি বলছি, একবার এসো তুমি। দেখো আগে ওদের কি করে তুলোধুনা করি!”
হাত ধরে এগোতে চাইলো। নিখিল ওকে ফিরালো,
— “কিছু কিছু জায়গায় ছোট ভাবার দরকার আছে। ছোট তাই বুঝবা না। এককাজ কর, তোমাদের দলে তোমাদের বড় আপুদের এনে ঢুকাও। মেয়েতে-মেয়েতে ঝগড়া হলে জিতলেও জিততে পার!”
নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করলো। টিংকু কিন্তু হাত ছাড়লো না। বিরস মুখে বললো,
— “তুমি এমন করছ কেন? আপুরা কেউ আসলে কি আর তোমায় ধরে টানাটানি করি? বলো?”
— “কেন? আসবে না কেন?”
— “ঋতু আপু, প্রমি আপু ছবি তোলায় মগ্ন। ডেকে মরে গেলেও নড়বে না। ইমা আপু তো আরেক। সারাক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত! আমাদের কথায় আসবে, ভেবেছ?”
নিখিলের হুট করেই চারুর কথা মনে পড়লো। সাত-পাঁচ না ভেবেই জিজ্ঞেস করে ফেললো,
— “আর চারুলতা? সেও আসবে না?”
— “দূর! বড় আপা কি করে আসবে। ও তো এ-বাড়িতেই আসে নি।”
এতক্ষণে আসল কথাটা শুনলো। চারু তবে আসে নি? কিন্তু কেন? শুধালো,
— “কেন? অনু তার ছোট বোন না?”
সঠিক কারণটা যদিও জানা, কিন্তু তবুও সেটা ওকে জানালো না টিংকু। সে ছোট হলেও জানে, সবকথা সবাইকে বলতে নেই। এড়িয়ে গেল কথাটা,
— “আসলে বড়পা একটু অসুস্থ। এতো চিৎকার-চেঁচামেচিও পছন্দ করে না। তাই বাড়িতেই থেকে গেছে!”
— “ওহ্ আচ্ছা।”
নিরাসক্ত গলায় প্রত্যুত্তর করলো ছেলেটা। টিংকু চেয়েই ছিল ওর পানে। চারু আসে নি শুনে, কীভাবে ওর চেহারার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে গেল সেটা ঠিকই নজরে এলো ওর। সন্দেহী মনে খটকা লাগলো বেশ!
___
নব পরিণীত বর-বধূকে নিয়ে যখন অরুণা ম্যানশনে প্রবেশ করলেন আহাদ রাজা তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। গোধূলির হলদে আলোয় রাঙিয়ে, তুমূল ঢাকঢোল পিটিয়ে সকলে ফিরলো বাড়ি। দুদিন আগেই যে মেয়েটা ছিল এবাড়ির পরম কাছের মানুষ, হেসে-খেলে বেড়াতো যে সারা বাড়িময়, সেই মেয়েটাই আজ এথায় হয়েছে আত্মীয়। সদ্য পরিণয় প্রাপ্ত অনুলেখা আজ এ-বাড়ির অতিথি!
সদ্য বিবাহিত দম্পতিটিকে প্রথমেই তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো না, বরং বসবার ঘরে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখা হলো। আত্মীয়-স্বজনের ভীড় অনেক। ইতোমধ্যেই অনেকে চলে যাবার তোড়জোড় শুরু করেছেন। বিদায় নিতে আসছেন অনুলেখার কাছে। নব্য জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে; প্রাণভরে দোয়া করে, তারা একেকজন বিদায় নিচ্ছেন। অনেক্ষণ হল এই চলছে।
কিছুক্ষণ পর ওদের রেখে নাশতা আনতে ছুটলেন বড়রা। সোফায় অনু হাসিমুখে বসে। কিন্তু কেমন উসখুস করছে মাহাদ। যেন বসে থেকে স্বস্তি পাচ্ছে না। ক্রমাগত এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। অনু চাপা গলায় শুধালো,
— “হয়েছে কি তোমার? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন? কাউকে খুঁজছ?”
মাহাদ অন্য দিকে তাকিয়েই বললো,
— “আচ্ছা, চারুভাবীকে দেখছি না যে? কাল বিয়ের আসরেও তো ওনাকে দেখলাম না? আমাদের বাড়িও তো যায় নি বোধ হয়—”
চারুর নাম শুনতেই ভ্রু কুঁচকে এলো অনুর। ত্যক্ত গলায় বললো,
— “যাবে কি করে? যাওয়ার মুখ থাকলে তো!”
মাহাদ কেমন যেন চোখে তাকালো। অবাকের সুরেই বললো,
— “এভাবে বলছ কেন? ইট ওয়াজ অ্যান এম্ব্যারেসিং সিচুয়েশন ফর বোথ ওফ্ দেম। ভাইয়ার জন্যও, আর ভাবীর জন্যও। কিন্তু আমার কথা হলো, এ-বাড়িতে তার দেখা নেই কেন? উনি কি এই বিয়েটাতে খুশি হন নি?”
— “যাও যাও। ওর খুশি-অখুশির দাম কে দিচ্ছে!”
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলো অনু। বোনের সম্পর্কে ওর এহেন উদাসীন মন্তব্য মাহাদ কে ভাবিয়ে তুললো। বরাবরই দেখছে, অনু এ ব্যাপারে একটু কেমন যেন! সন্দিহান হয়ে জানতে চাইলো,
— “তারমানে চারু ভাবী এই বিয়েটায় নাখোশ? তাই উনি নেই?”
অনু বিপাকে পড়লো। কি মুসিবত হলো! মাহাদ কেন বারবার চারুর প্রসঙ্গ টানছে? ওদের মধ্যে তাকে আনার কি প্রয়োজন? অগত্যা বললো,
— “ও বাড়িতেই আছে, আর খুশিও হয়েছে। বিয়েতেও ছিল তুমি হয় তো দেখো নি।”
— “আর এখন?”
খুব বিরক্ত হলো এবারে,
— “তুমিও তো মাত্র এলে, আমিও মাত্র এলাম। তো কি করে বলবো কে কোথায়?”
অন্য দিকে তাকালো। মাহাদের এই জাতীয় কথাবার্তা তার পছন্দ হচ্ছে না। একদম না! মাহাদ কিন্তু দমে গেল না। স্ত্রীর কোমল হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। অনুকে ফেরালো নিজের দিকে। নমনীয় স্বরে বললো,
— “শোনো, অনু। কখনো কাউকে কষ্ট দেবে না। যদি ভুল করেও দিয়ে ফেলো তবে মাফ চেয়ে নিবে। কাউকে কষ্ট দিয়ে কিন্তু কখনোই পার পাওয়া যায় না! সেই কষ্ট কোনো না কোনো ভাবে ঠিকই ফিরে আসে নিজের দিকে।”
অনু বুঝেও না বোঝার ভান করলো,
— “এসব বলছো কেন? আমি কাকে কষ্ট দিলাম?”
— “কষ্ট দাও নি হয় তো। কিন্তু তবুও বললাম। আমাদের এই বিয়েটা অনেকেই পছন্দ করে নি, অনু। ভাইয়া-ভাবীর গল্পে বিচ্ছেদটা না থাকলে হয় তো এমন হতো না। কিন্তু কি আর করা— আমি চাই না, এ নিয়ে তোমার কারো সঙ্গে মনোমালিন্য থাকুক। যদি থেকে থাকে তবে তুমি সেটা ঠিক করে নেবে। ঠিক আছে?”
ওর দু’ গালে হাত রেখে কথাগুলো বললো মাহাদ। কথাগুলো ভালো না লাগলেও স্বামীর মন রক্ষার্থেই ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো অনু। খুশি হয়ে ওর কপালে উষ্ণ চুম্বনের পরশ বুলিয়ে দিলো মাহাদ! সে চায় না, তাদের নতুন জীবনে কোনো দুঃখ আসুক। কারো হতাশার হাহাকার লাগুক! সে চায়, সুখী হতে! ভীষণ রকমের সুখী হতে!
___
রাতের খাবার শেষে সবে ঘরে ঢুকেছে নিখিল। এসেই দেখলো, সৌভিক ইতোমধ্যেই মশারি টাঙিয়ে প্রস্তুত করে ফেলেছে শয্যা। কাঁথা-টাথা খুলে গায়েও পেঁচানো শেষ! নিখিল হাসলো,
— “কি রে? ন’টা নাই বাজতে ঘুম?”
— “বাজে নি কে বলেছে? দেখ তো, ঘড়ির দিকে! ন’টা তেতাল্লিশ বাজে! একটু পর দশটা বাজবে।”
দেয়াল ঘড়ির দিকে ইশারা করলো। ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে নিখিলও চাইলো ওই দিকে। অতঃপর হাসলো খানিক,
— “তা না হয়, বাজলো। কিন্তু তারপরও। দশটায় ঘুমিয়ে যাবি, এটা কোনো কথা? লোকে শুনলে কি বলবে?”
— “লোকের কথায় আমার কি? ওরা কি জানে, দু’দিন ধরে ঘুম হয় না আমার? ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছি – ঝক্কি কতো জানে? কতো খাটনি!”
ঠোঁট বেঁকালো সৌভিক। নিখিল হাসলো আবারও,
— “ও বাবা! খুব পরিশ্রম গেছে, না? কাজ করে তো একেবারে উল্টে দিয়েছ তুমি! দেখলাম না?”
— “হ্যাঁ, দেখলিই তো।”
তারপর মাথা চুলকে বললো,
— “কথা বাদ দিয়ে ঘুমোতে আয় তো। চটপট শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দেব।”
নিখিল এলো ঠিকই কিন্তু শুয়ে পড়লো না। আধশোয়া হয়ে বসলো। বন্ধুকে প্রস্তাব দিলো,
— “এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে ভাল্লাগছে না। চ’ গল্প করি?”
সৌভিক বিরক্ত হয়,
— “কি গল্প করবি? তোর বৌ-বাচ্চার? বিয়ে করেছিস তুই?”
নিখিল কপট লাজুকতায় মুড়িয়ে নেয় নিজেকে,
— “করিনি। কিন্তু করতে কতক্ষণ?”
— “আচ্ছা?”
নড়েচড়ে বসলো সৌভিক। এবার কথার বিষয় খুঁজে পেয়েছে সে। বিছানা থেকে বালিশটা তুলে, কোলের উপর রাখলো। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ভ্রু নাচালো,
— “তারমানে মেয়ে তোর পছন্দ করা আছে? হু?”
বলেই ঠেলা মারে। কোনোমতে মাথা নেড়ে নিখিল সায় দিতেই, উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে সৌভিক,
— “আমি জানতাম! জানতাম তোর মধ্যে একটা খিচুড়ি পাকছে। তোর ফেইস দেখেই আমি টের পেয়েছিলাম। তা বলতো, কে এই ছাম্মাক ছাল্লো? কি দেখে পাগল হইলি, মাম্মা?”
শেষের কথায় দুষ্টুমি মিশে। ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে সৌভিক। যেন, বন্ধুর মনের গোপন দুয়ার খুলে গুপ্তকথা বের করাটা কোনো মহান কীর্তি! ওর মনোভাব বুঝতে নিখিল বিব্রত হয় তাতে। কথাটা কীভাবে বলবে ভেবে পায় না! অবশেষে বলে,
— “এভাবে বলিস না। মেয়েটা খুব ভালো। তুই চিনবি।”
— “চিনবো? ও বাপ রে? কোনখানে দাও মারলি, ভাই? কে এই মেয়ে!”
নিখিল দু’ সেকেণ্ড সময় নেয় উত্তর দিতে। তারপর ঢিমে যাওয়া গলায় বলে,
— “চারু।”
আশেপাশেই কোথাও বিস্ফোরণ ঘটলো। হতবিহ্বল সৌভিক সর্বোচ্চ স্বরে চেঁচায়,
— “কীহ্?”
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল ওর মুখ। চোখ দুটো এতো বড় করে তাকালো যে মনে হতে লাগলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই কোটর থেকে ঠিকরে বেরোবে তারা!
চলবে___