#মেঘের_শহর
#পর্ব_২৬
Saji Afroz
.
মোখলেসের মা তার মুখে বিয়ের কথা শুনে খুশি হলেও পরের কথাটি শুনে মুখ টা ফ্যাকাশে করে ফেললেন। তার ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলের বিয়ে ধুমধাম করে দেয়ার। পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন সবাই কে নিয়ে ঘটা করা বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন তার। আর এখন কি না সাদাসিধে ভাবে বিয়ে টা সারতে হবে! কাউকে জানানোও যাবে না।
তিনি হতাশ হয়ে নিশ্চুপ রইলেন। মোখলেস মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল-
জেসিকার বাড়ির অবস্থা ভালো না। ওর একা চলতেও সমস্যা হচ্ছে। তাই বিয়ে টা সেরে নিতে চাইছে। কিন্তু পরে ঠিকই আয়োজন করা হবে। ওর বাবা সুস্থ হয়ে নিক?
-একেবারে তখনি তো করা যায় বিয়েটা।
-তা যেত। কিন্তু শহরে একা একটা মেয়ে…
.
মোখলেস কে থামিয়ে তার বোন মায়ের কানের কাছে মুখটা এনে বলল-
আপুর বাবা সুস্থ না হলে ঘটা করে বিয়ে কিভাবে করবে? আর ভাইয়ার তর সইছে না। এটা মেয়ে হয়ে তোমাকে বোঝাতে হচ্ছে আমার।
.
মেয়ের কথা শুনে তিনি কাশতে কাশতে মোখলেস কে বললেন-
বুঝেছি। তুই যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তাতেই আমরা রাজি। কিন্তু পরবর্তীতে অনুষ্ঠান করতেই হবে। কোনো বাহানা চলবে না।
.
মোখলেস বুঝতে পারলো না। তার বোন এমন কি বলল যে একবারেই মা রাজি হয়ে গেলেন!
.
.
.
ডাক্তার ঘুমের মেডিসিন দিয়েছিল মেঘ কে। তাই সারাদিন ঘুমিয়েছে সে। এদিকে হঠাৎ তার এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ চিন্তিত অন্তরা আহম্মেদ। তিনি বুঝতেই পারছেন না তার সুস্থসবল ছেলেটি হঠাৎ এমন পাগলের মতো আচরণ করছে কেনো।
ডাক্তার বলেছে সে কিছুটা মানসিক ভাবে অসুস্থ। একটু আরাম করে মাথায় চাপ না নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে সাইয়ারাও বুঝতে পারছে না মেঘের কি হয়েছে। সব তো ঠিকই আছে। হুরায়রাও ফিরে এসেছে। তবুও কেনো সে মানসিক ভাবে অসুস্থ হবে?
তবে কি হুরায়রা কিছু বলেছে মেঘ কে? সে কি কোনোভাবে কষ্ট দিচ্ছে তাকে! এমন কিছু হলে সে ছাড়বে না তাকে। কিছুতেই না।
.
মেঘের ঘুম ভেঙেছে। তবে মাথাটা এখনো ভার হয়ে আছে, ঝিমঝিম করছে।
শোয়া থেকে ওঠে বসলো সে। সাথে সাথে হুরায়রার কথা মনে পড়লো তার। আর সেই মেঘের রাজ্যের কথা!
মেঘ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। তার ভীষণ অস্থির লাগছে। এখুনি তার হুরায়রার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু কিভাবে বলবে? সে না চেনে তার বাড়ি না জানে তার ফোন নাম্বার। উফফ..
হুরায়রার তো ফোন নাম্বারই নেই। আর সে কি আদৌ এখানে কোথাও থাকে না কি সেই মেঘের শহরে!
.
মেঘের অস্থিরতা কাটছেই না। সে সারারুমে পায়চারি করে ভাবতে লাগলো কিভাবে হুরায়রার সাথে যোগাযোগ করা যায়।
হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল হুরায়রার বলা কথাটি।
উড়োচিঠির মাধ্যমে সে কথা বলতে পারবে…
তবে কি একটা চেষ্টা করে দেখবে মেঘ?
সে আর দেরী করলো না। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লো । লিখলো-
তুমি কোথায়? আজ যা ঘটেছে তা কি সত্যি? তুমি কি আসলেই মানুষ নয়, মেঘ পরী!
.
মেঘ চিঠিটি ভাজ করে জানালার কাছে এল। বাতাসে উড়িয়ে দিলো চিঠি টি।
এই পাগলামো কেনো করছে সে জানে না। কিন্তু সে খুব করে চায়, হুরায়রার সাথে কথা বলতে।
.
দশ মিনিট যেতে না যেতেই মেঘের কাধের উপরে একটি কাগজ এসে পড়লো। যা দেখে তার মুখে হাসি ফুটলো। সে চিঠি টি খুলে পড়তে লাগলো-
আমি তোমার খুব কাছেই আছি। হ্যাঁ, যা ঘটেছে সবই সত্যি। আমি কোনো মানুষ নয়। মেঘপরী!
.
তাহলে এটা কোনো স্বপ্ন নয়! সত্যিই ছিল সবটা। সে আসলেই মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করেছিল।
মেঘ বিছানার উপরে কাগজ টি রেখে, টেবিলের পাশে এসে আবারো লিখলো-
আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
.
আগের মতোই চিঠি টা পাঠায় মেঘ। কিন্তু বিছানার উপরের চিঠি টা সে পেল না।
একটু পরেই আবারো চিঠি আসলো।
তাতে লেখা-
সবাই ঘুমিয়ে গেলেই আমি আসব তোমার কাছে।
.
মেঘ একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো। সে নিজের বুকের সাথে চিঠি টা চেপে ধরে বলল-
এবার আর কাছ ছাড়া করছি না তোমাকে।
একটু পরেই অন্তরা আহম্মেদ এলেন। ছেলে কে বসা অবস্থায় দেখে হেসে ভেতরে এলেন। মিন্নী কে খাবার নিয়ে আসতে বললেন। মেঘের হাতে কাগজ টি কিসের জানতে চাইলে সে বলল-
ও কিছু না।
.
মায়ের হাতে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো মেঘ। চিঠি টা বুকের মাঝে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলো। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবে সে। ঘুম ভাঙলেই হুরায়রার দেখা পাবে মেঘ।
.
.
রাত গভীর হয়। হুরায়রা মেঘের পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেঘের ঘুম ভাঙতে তার মোটেও ইচ্ছে করছে না। তাই সে চুপ করে বসে রইলো।
কিন্তু মেঘের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলেই চিঠি টা না পেয়ে হতাশ হয়ে বলল-
চিঠি কোথায়!
.
হুরায়রা হেসে বলল-
আমি থাকতে চিঠি কেনো?
.
হুরায়রা কে দেখে তার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলো মেঘ। সে বলল-
ওভাবে কি দেখছ? ভয় পাচ্ছ আমায়?
-ভয় পেলে কি তোমার খোঁজ নিতাম?
.
হুরায়রা হাসলো। মেঘ বলল-
হাসলে তোমায় ভারী সুন্দর দেখায়।
-তাই?
-হ্যাঁ। তুমি সত্যিই একটা পরী। আমার পরী!
-আমার নাম হুরায়রা নয়। মেঘা। ছদ্মনাম হুরায়রা।
-সেই যে নামই হোক তোমার, তুমি যেই হও না কেনো। তুমি শুধু আমার।
.
হুরায়রা ভেবেছিল মেঘ তাকে নানারকম প্রশ্ন করবে। কিন্তু এমন কিছু হলো না। বরং মেঘ হুরায়রার সত্যি টা জেনেও তাকে গ্রহণ করতে রাজি।
হুরায়রা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল-
আমি তোমায় ভালোবাস তে পারি না মেঘ।
-কিন্তু কেনো?
-আমাদের রাজ্যে মানুষের সাথে প্রেম নিষিদ্ধ। আমি পড়াশোনা করতে চেয়েছি বলেই এখানে এসেছি। কিন্তু শর্ত ছিল আমি কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারব না। কেবল লেখাপড়ায় হবে আমার সঙ্গী। জানো মেঘ? মানুষের জীবনযাপন আমার বেশ প্রিয়। ছোট বেলায় ছদ্মবেশে নানা জায়গায় যেতাম। মানুষের জীবনযাপন দেখে ভাবতাম, আমিও যদি মানুষ হতাম! জাদু শক্তি আমার ভালো লাগে না। একটা স্বাভাবিক জীবন আমার চাই। তাই আমি এখানে মানুষের মতোই চলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে জাদু শক্তি প্রয়োগ আমাকে করতে হয়েছে।
-আমি এত কিছু জানতে চাই না হুরায়রা। তুমি আমার থাকবে কি না বলো?
-এটা সম্ভব না মেঘ। আমাদের রাজ্যের নিয়ম লঙ্গন করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
তার চেয়ে তুমি আমায় ভুলে যাও।
.
হুরায়রার কথা শুনে মেঘ নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। তার মাথার যন্ত্রনা টা আবারো বেড়ে গেল। মাথায় হাত চেপে জোরে একটা চিৎকার দিলো সে। সাথে সাথেই সেখানে উপস্থিত হলো অন্তরা আহম্মেদ ও মিন্নী। অন্তরা আহম্মেদ মেঘ কে জড়িয়ে ধরে কি হয়েছে জানতে চান।
মেঘ বলল-
হুরায়রা এসব কি বলছে শুনো মা! ও আমার হবে না বলছে।
.
মিন্নী ও অন্তরা আহম্মেদ একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। তারা এখানে মেঘ ছাড়া কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। তবে মেঘ এসব বলছে টা কি!
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল মেঘ। চারদিকে সে হুরায়রা কে খুঁজতে লাগলো। হুরায়রার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে নদীর পাড়ে চলে গেল সে। যেখানে হুরায়রা কে পেয়েও গেল। মেঘ সোজা তার সামনে এসে বলল-
তোমাকে পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই?
.
হুরায়রা মুখ মলীন করে বলল-
হ্যাঁ আছে। তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে, আমার রাজ্যে মেঘের শহরে।
.
কথাটি শুনে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মেঘ বলল-
মানে?
-কোনো মানুষ কে যদি বিয়ে করতেই হয় তবে সেই মানুষ কে পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে। সারাজীবনের জন্য চলে যেতে হবে আমাদের রাজ্যে। আর না হয়…
-না হয়?
-আমাদের ত্যাগ করতে হবে নিজের রাজ্য। আর কোনোদিন ওই রাজ্যের কারো সাথে দেখাও করতে পারব না।
.
মেঘ একটা কথাও বলল না। সে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
হুরায়রার চোখে পানি চলে এসেছে। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল-
ঘরে ফিরে যাও মেঘ। ঘরে ফিরে যাও।
.
মেঘ বলল-
তুমি আমায় ভালোবাসো?
.
হুরায়রা নিশ্চুপ। মেঘ বলল-
প্লিজ চুপ থেকো না। বলো!
.
এবার হুরায়রা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। মেঘ কে জড়িয়ে ধরে বলল-
আমি তোমাকে ভালোবাসি মেঘ। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
.
মেঘ হুরায়রা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল-
তবে আমার কাছে চলে এসো। আমি তোমাকে কোনো কষ্ট পেতে দিব না। এত যত্নে রাখব যে সবাই কেই ভুলে যাবে তুমি।
.
হুরায়রা মেঘ কে ছেড়ে বলল-
আমার মা বাবা?
-তারা তোমার সাথে অভিমান করে থাকতেই পারবে না। ঠিকই আসবেন দেখা করতে।
-তুমি কিছু জানো না। ওখানের সবাই ভালো নয়। তারা নানাভাবে তোমার আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।
-তাহলে?
-তোমাকেই যেতে হবে। এইরকম অনেকেই গিয়েছে। ওই রাজ্যে আমাকে বিয়ে করে প্রবেশ করলেই পৃথিবীর সব কিছু তুমি ভুলে যাবে। তোমার কাউকেই মনে থাকবে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এমন হবে না। আমি তাদের স্মৃতি ভুলে কিভাবে থাকব বলো?
.
মেঘ কে চুপ করে থাকতে দেখে হুরায়রা বলল-
আমিও তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি ভাবো। তিন দিন সময় নাও। তিন দিন পরেই তোমার সিদ্ধান্ত জানাও। বেছে নাও নিজের পরিবার বা আমাকে।
.
চলবে
.
বি:দ্র: সকাল থেকেই ইলেক্ট্রিসিটি প্রচুর ডিস্টার্ব করছে, তাই বেশি লিখতে পারি নি। 😑