হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(১৭) #Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা

0
998

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(১৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৪১)
নিলাদ্র সন্ধ্যার থেকে নেওয়া গতকাল রাতের ঠিকানার সেই ক্লিনিকের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে রিসিপশনের কাছে গিয়ে দাড়াতেই রিসিপশনে বসারত মহিলাটি নিলাদ্রের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন….

—“জ্বী স্যার বলুন, কিভাবে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি?”

—“ডাক্তার খালেকুজ্জামান স্যার তো এই ক্লিনিকের আন্ডারেই চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন!”

—“জ্বি স্যার।”

—“আমি একটু ওনার সাথে পারসোনালি সাক্ষাৎ করতে চাই।”

—“স্যার, এভাবে তো আমরা আপনাকে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে দিতে পারি না। উনি আমাদের এই ক্লিনিকের সবথেকে সিনিয়র ডাক্তার। তাই ওনার রোগীরা ব্যতিত বাড়তি কেও যদি ওনার সাথে পারসোনালি সাক্ষাৎ করতে চায় সেক্ষেত্রে আমাদের তার নিকট থেকে অনুমতি নিতে হবে।”

—“ঠিক আছে আপনি অনুমতি নিন।”

—“আপনার পরিচয় দিয়ে সাহায্য করুন স্যার।”

—“আপনি ওনাকে বলুন রায়হানুল চৌধুরীর পরিবার থেকে একজন এসেছেন তার সাথে পারসোনালি সাক্ষাৎ করার জন্য।”

মহিলাটি নিলাদ্রের কথানুযায়ী খালেককে কল করে বললে খালেক নিলাদ্রকে তার কেবিনে যাওয়ার অনুমতি দেয়। অতঃপর নিলাদ্র মহিলাটির থেকে খালেকের কেবিনে যাওয়ার রাস্তা দেখে নিয়ে সেই দিকে হাঁটতে শুরু করে। কিছুসময় পর খালেকের কেবিনের দরজার সামনে দাড়িয়ে দরজায় নক করলে ভিতর থেকে একটি বয়স্ক কন্ঠ নিলাদ্রকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলে সে খালেকের কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে।
খালেক নিজের ডেস্কে চেয়ারে বসে আছে। নিলাদ্র খালেকের ডেস্কের অপর পার্শে রাখা চেয়ারে বসতেই খালেক শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন…..

—“আপনার সাথে চৌধুরী পরিবারের সম্পর্ক কি? আগে তো কখনও আপনাকে চৌধুরী মেনশনের কোনো সদস্যের সাথে এই ক্লিনিকে আসতে দেখি নি।”

—“আমি রওনাক আজমাইন চৌধুরী কুশলের বেস্ট ফ্রেন্ড নিলাদ্র আহমেদ। বড়বাবা অর্থাৎ রায়হানুল চৌধুরীর বর্তমান চিকিৎসার দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছে।”

—“তো এখন আমার সাথে পারসোনালি সাক্ষাৎ করতে আসার কারণ কি?”

নিলাদ্র ওর হাতে থাকা ফাইলটি ডেস্কের উপর খালেকের সামনে রেখে বললো….
—“ফাইলটি চেক করলেই বুঝতে পারবেন।”

খালেক ফাইলটি খুলতেই দেখে এটা রায়হানুলের ব্লা*ড পরীক্ষার রিপোর্ট। যেখানে বড় বড় করে লেখা আছে দীর্ঘ সময় ধরে রায়হানুলের শরীরে ক্ষ*তি*কর কড়া ডোজের ঔষধ ইনজেক্ট করে আসা হয়েছে যার ফলে রায়হানুল আজ পর্যন্ত কো*মা থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন নি। নিলাদ্র চেয়ারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে খালেকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে রেখে বললো….

—“এই রিপোর্ট যদি আমি এখন পুলিশের কাছে জমা করি তাহলে আপনার এই ক্লিনিক ও আপনি যে পুরোপুরি ভাবে নি*শ্চিহ্ন হয়ে যাবেন তা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন!”

নিলাদ্রের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে খালেকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। নিলাদ্র খালেকের দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো….

—“এসি চলাকালীন এভাবে ঘামলে কি চলে ডাক্তাসাহেব! পানিটুকু পান করে কপালের ঘামগুলো মুছে নিন।”

খালেক পানির গ্লাসটি হাতে নিয়ে এক ঢোকে গ্লাসের সবটুকু পানি পান করে হাত দিয়েই কপালের ঘামগুলো মুছে নেয়। নিলাদ্র শান্ত স্বরে বললো…

—“এবার আপনি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিন তো যে, কার কথায় আপনি দীর্ঘ ২৮ বছর যাবৎ বড় বাবার ভু*ল ট্রিটমেন্ট করে এসেছেন!”

—“তার নাম বললে তিনি আমাকে সহ আমার পরিবারকে মে*রে ফেলবেন।”

—“আর নাম না বললে আমি খুব তাড়াতাড়ি আপনার নিশ্চিহ্ন হওয়ার সুব্যবস্থা করবো।”

খালেক কিছুসময় নিরব হয়ে থাকার পর বললেন….
—“ঠিক আছে, আমি আপনাকে তার নাম বলবো কিন্তু এখানে না৷ আপনি আমার বাসায় আসুন আজ রাতে আমি তখন আপনাকে সব ডিটেইলসে বলে দিবো।”

নিলাদ্র ভ্রু যুগল কুঁচকে নিয়ে প্রশ্ন করলো….
—“এখানে বলতে কি সমস্যা আপনার?”

—“আমি ক্লিনিকে থাকাকালীন পুরো সময়টাতে আমার উপর তাদের ঠিক করা লোকেরা নজর রাখে। তাই আমি আমার জীবন ও আমার পরিবারের জীবন নিয়ে কোনো প্রকার রি*স্ক নিতে পারবো না।”

নিলাদ্র বিষয়টা নিয়ে কিছু সময় ভাবার পর বললো….
—“ঠিক আছে, আমি আজ রাতেই আপনার বাসায় যাবো। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি, আমার সাথে বিন্দুমাত্র চালাকি করার চেষ্টাও করবেন না। তাহলে ফল ভালো হবে না। এটাকে আপনি আমার দেওয়া লাস্ট ও*য়া*র্নিং হিসেবেও ভাবতে পারেন৷”

এই বলে নিলাদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খালেকের থেকে তার বাসার ঠিকানাটা নিয়ে ক্লিনিক থেকে বেড়িয়ে আসে। নিলাদ্র চলে যেতেই খালেক ডেস্কের উপর থেকে নিজের ফোন উঠিয়ে কাওকে কল করে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই খালেক নিজের ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললেন….

—“কাজ হয়ে গিয়েছে।”

(৪২)
সকালের নাস্তাপর্ব শেষ করে তরুনিমা রুমে এসে মেঝেতে পায়চারি করছে আর একটু পর পর দরজা দিয়ে বাহিরের দিকে উঁকি মা*র*ছে। বেশ কিছুসময় পেরিয়ে যাওয়ার পর তরুনিমা ভাবুক স্বরে বললো…

—“এই খা*রু*শ*টা বাসায় ফেরার পর থেকে আমাকে ইগনোর কেনো করছেন কিছুতেই তার কারণ বুঝে উঠতে পারছি না।”

পরক্ষণেই তরুনিমা ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির উপর দৃষ্টি স্থির রেখে বললো…..

—“আর সবথেকে বড় প্রশ্ন ওনার করা ইগনোরের জন্য আমার মন এমন অশান্ত হয়ে আছে কেনো? উনি আমাকে ইগনোর করুক বা আমার সাথে সম্পর্কই না রাখুক তাতে আমার তো যায় আসার কথা না। তবে কি আমি ধীরে ধীরে উনার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছি! উনার আমার সাথে কথা বলা, আমার রাগ সহ্য করা, আমার প্রতি কেয়ার দেখানো এইসব কিছু কি আমার অভ্যাসের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে!”

তরুর কথা বলার মাঝেই সে আয়নায় কুশলকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে। কুশল রুমে প্রবেশ করে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলমারির উপর থেকে একটা খালি সুটকেইস পেড়ে বিছানার উপর খুলে রাখে। তরু কুশলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে কুশলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। কুশল আলমারি খুলে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়-চোপড় সুটকেইসে ভরতে শুরু করে। কুশল আবারও আলমারীর কাছে চলে গেলে তরু নিজের ডান হাতের আঙুলগুলোর গিঁটের উপর লাল রংয়ের লিপস্টিক হালকা করে লাগিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে সুটকেইসের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেকৃত সুটকেইসের ভিতর ডান হাতের আঙুলগুলো রেখে সুটকেইসের ঢাকনাটি সাবধানে হাতের উপর ফে*লে মি*থ্যে ব্য*থা পাওয়ার নাটক করে মুখ দিয়ে ‘আহহহ আমার আঙুলগুলো বুঝি ভে*ঙে গেলো’ বাক্যটি উচ্চারণ করে। তরুর কন্ঠে এমন কথা শুনে কুশল পিছন ঘুরে তাকাতেই তরুর হাতের উপর সুটকেইসের ঢাকনাটি পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে তরুর কাছে এসে ঢাকনাটি সরিয়ে তরুর হাত বের করে হাতের উপরিভাগে ফু দিতে দিতে রাগী স্বরে বললো…

—“সুটকেইসের কাছে আসতে কে বলেছিলো তোমায় হ্যা! সবসময় কেয়ারলেসহীনের মতো করে চলাফেরা করো তুমি। সুটকেইসের ঢাকনাটি আঙুলগুলোর উপর পরে কেমন লাল হয়ে গিয়েছে। ওয়াশরুমে চলো পানি দিতে হবে হাতে। নয়তো আঙুলের গিঁ*টগুলোতে র*ক্ত জমাট বেঁধে যাবে।”

কুশলের মুখে এমন কথা শুনে তরু যেনো বি*ষম খেলো। তরু মনে মনে ভাবে….
—“এই রেএএ..এখন হাতের উপর পানি দিলে তো লিপস্টিকের সব রং উঠে যাবে আর উনিও বুঝতে পারবেন আমি ব্য*থা পাওয়ার মিথ্যে নাটক করেছি। এখন কি করবো আমি?”

—“কি হলো চলো!”

তরু কুশলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো…
—“ন-না-না লাগবে না পানি দেওয়া। এ-এমনিই সেরে যাবে। এখন আর ব্য*থা নেই বললেই চলে৷”

কুশল কিছুসময় তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকার পর মুখে কিছু না বলে সরাসরি ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে তরু তৎক্ষনাৎ নিজের হাত-পা ছুঁ*ড়*তে ছু*ড়*তে বললো….

—“নাআআআ…আমি হাতে পানি দিবো না। আমাকে নামিয়ে দিন, আমি ওয়াশরুমে যাবো না।”

কে শুনে কার কথা! কুশল তরুর কোনো কথা কানে না নিয়ে ওকে কোলে নেওয়া অবস্থাতেই ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।

(৪৩)
নিলাদ্র চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুসময় পর নিলাদ্র নিজের রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে সন্ধ্যা ওর বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আপেল খাচ্ছে। নিলাদ্র ভ্রু কুঁচকে সন্ধ্যার দিকে তাকায় পরক্ষণেই দরজা দিয়ে বাহিরের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে দেখে চারপাশে কেও নেই। নিলাদ্র রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকে দেয়। অতঃপর সন্ধ্যার সামনা-সামনি রাখা ওয়ারড্রবের সাথে হেলান দিয়ে বুকের সাথে দুই হাত ভাঁ*জ করে দাড়িয়ে সন্ধ্যার উপর শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখে বললো….

—“কি ব্যপার ম্যডাম আজ নিজ ইচ্ছায় আমার ঘরে এসে বসে আছেন যে! এমনি সময় তো আমার থেকে শুধু পালাতে পারলেই বেঁচে যান যেনো। আজ হঠাৎ কি হলো আপনার জানতে পারি কি?”

সন্ধ্যা আপেল খেতে খেতে বললো….
—“আহহ, দেখছেন তো আপেল খাচ্ছি। এখন আমাকে কোনো প্রশ্ন করে ডি*স্টা*র্ব করবেন না একদম।”

নিলাদ্র তৎক্ষনাৎ সন্ধ্যার একদম কাছাকাছি এসে ওর দু-পাশে বিছানার উপর দু-হাত রেখে ওর দিকে কিছুটা ঝু*কে দাঁড়িয়ে পরে। আকস্মিক নিলাদ্রকে নিজের এতো কাছে আসতে দেখে সন্ধ্যার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সন্ধ্যা ওর দাঁত দিয়ে আপেলে কা*ম*ড় বসিয়ে ওভাবেই আপেলটি মুখে ধরে রেখে হাত নামিয়ে নেয়। সন্ধ্যাকে অবাক করে দিয়ে নিলাদ্র আপেলের অন্যপাশে কা*ম*ড় বসায়। এতে করে সন্ধ্যার চোখযুগল যেনো কো*টর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়। পরক্ষণেই নিলাদ্র সন্ধ্যার কাছে থেকে সরে নিজের আগের স্থানে এসে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে শুরু করে। সন্ধ্যার হেঁচকি উঠলে আপেলটা ওর মুখ থেকে নিচে প*রে যায়। নিলাদ্র সন্ধ্যার এমন অবস্থা ভালো ভাবেই উপভোগ করছে। কিছুসময় পর সন্ধ্যা নিজেকে সামলে স্বাভাবিক হলে নিলাদ্র বললো…..

—“এই সামান্য কাছে যাওয়াতেই তোর এমন অবস্থা! বিয়ের পর যখন তোকে পুরোপুরি ভাবে নিজের করে নিবো তখন কি করবি শুনি?”

নিলাদ্রের মুখে এমন কথা শুনে সন্ধ্যা লজ্জায় চোখ-মুখ কুঁচকে নিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। পরক্ষণেই সন্ধ্যা বিছানা থেকে নেমে চলে যেতে নিলে নিলাদ্র সন্ধ্যার হাত ধরে ওকে আটকে দিয়ে বললো…..

—“তোর মুখে ভালোবাসি শব্দ টা শোনার জন্য এই মনটা সবসময় ব্যকুল হয়ে থাকে রে। একটাবার ‘ভালোবাসি তোমায়’ এই দু’টি শব্দ নিজের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে আমার ব্যকুল হয়ে থাকা মনটাকে শান্তি দিবি প্লিজ!”

নিলাদ্রের মুখে এমন কথা শুনে সন্ধ্যার হার্ট স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক দ্রুত বিট করতে শুরু করে। পরক্ষণেই সন্ধ্যা বললো….

—“আজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি আপনার জন্য ছাদে অপেক্ষা করবো। আমার অপেক্ষার অ*ব*শান ঘটিয়ে আপনি ছাদে আসলে, তখন আমার মুখে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ দু’টি শুনতে পারবেন।”

সন্ধ্যার মুখে এমন কথা শোনামাত্র নিলাদ্র ওর হাত ছেড়ে দেয়। হাত ছাড়া মাত্র সন্ধ্যা আর দিক-বেদিক লক্ষ্য না করে নিলাদ্রের রুমের দরজা খুলে এক দৌড়ে বাহিরে চলে যায়। নিলাদ্র ওর চেহারায় হাসি ফুটিয়ে বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দেয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here