#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩১)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৮০)
বাগান বাড়িতে নিজের জন্য নির্ধারিত রুমে এসে কুশল চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে আছে। কিছুসময় পর তরুনিমাও সেই রুমে প্রবেশ করে বিছানায় কুশলকে বসে থাকতে দেখে বিছানার কাছে গিয়ে কুশলের পাশে বসে শান্ত স্বরে বললো…
—“আপনি বাহির থেকে নিজেকে যতোটা কঠিন ও শক্ত রূপে প্রকাশ করেন ভিতর থেকে ঠিক ততোটাই নরম ও ভ*ঙ্গু*র হৃদয়ের মানুষ বলে মনে হয় আপনাকে।”
তরুনিমার কথায় কুশল ওর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে। পরক্ষণেই আবারও তরুনিমা কুশলের চোখে চোখ রেখে বললো….
—“পুরুষ জাতির কান্না করা বারণ এই নিয়ম যিনি করেছেন তিনি ঠিক কি বুঝে এমন উ*দ্ভ*ট নিয়ম তৈরি করেছেন আমি জানি না৷ নারী জাতির সামান্যতম কষ্ট হলে তারা কান্না করে নিজের মনকে হালকা করতে পারলে পুরুষ জাতি কেনো পাহাড় সমতুল্য ক*ষ্ট বুকের ভিতর চে*পে রেখেও কান্না করে নিজের মনকে হালকা করতে পারবে না?”
কুশল এখনও তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। তরু কুশলের চোখের সামনে নিজের হাত নাড়ায়। পরক্ষণেই কুশল তরুকে অবাক করে দিয়ে ওকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক কুশলের এমন কাজে তরু যেনো বরফের মতো জমে গিয়েছে। তরুর কাছে মনে হচ্ছে সময়টাও যেনো তার মতোই স্থির হয়ে আছে। কিছুসময় ওভাবেই কে*টে যাওয়ার পর তরু অনুভব করে ওর ঘাড়ে টপ টপ করে পানি জাতীয় কিছু পড়ছে। তরু বুঝতে পারে কুশল কান্না করছে। তরু ওর কম্পিত এক হাত কুশলের পিঠের উপর রাখতেই কুশল যেনো আরো শক্ত করে তরুকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
(৮১)
চৌধুরী মেনশনের স্টোর রুমের ভিতর দাঁড়িয়ে দু’জন ছায়া মানব একে-অপরের সাথে কথপোকথন করছে। সেইসময় স্টোর রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে আরো একজন ছায়ামানব। ৩য় ছায়া মানবটি স্টোর রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে ঐ ২য় ছায়া মানবের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ১ম ছায়া মানব বললো…
—“এভাবে আর কতোদিন চলবে? ২৮ বছর আগে সেই কালোরাতে যদি রায়হানুলের স্ত্রীর সাথে ওকেও মে*রে ফেলতেন তাহলেই ভালো হতো। না থাকতো বাঁশ আর না বাজতো আমাদের স*র্ব*না*শের বাঁশি।”
২য় ছায়ামানব ১ম ছায়ামানবের কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো…
—“এখন এই একটা মানুষের বেঁচে থাকা আমাদের জীবনকে জা*হা*ন্না*ম বানিয়ে তুলছে। এতোবছর ধরে রায়হানুলকে কো*মায় রেখে কুশলের সামনে সত্যটা আসতে দেন নি। কিন্তু কুশল যেভাবে রায়হানুলকে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তাতে মনে হয় না কালো চাদরে মোড়ানো অতীতের সত্যিগুলো ওর সামনে পরিষ্কার হতে খুব বেশি সময় লাগবে।”
১ম ও ২য় ছায়ামানবের কথাগুলো শুনে ৩য় ছায়ামানবটি ধ*ম*কের স্বরে বলে উঠলেন….
—“আহহ…বে*বা*কু*ফের দল থামো তোমরা। কবে কোনটা করলে ঠিক হতো বা হবে তা আমি খুব ভালো করেই জানি আমাকে কোনো বিষয় নিয়ে বুদ্ধি বা জ্ঞান দিতে এসে নিজেদের ব্রেইন শূন্য গো*ব*র ভর্তি মাথার রূপ প্রকাশ করো না। একবার রায়হানুলকে সুস্থ করে তোলার জন্য নিজস্ব ডাক্তার নিয়ে এসেছিলো তো! তার পরিণতি কি হলো তা নিশ্চয়ই তোমরা খুব ভালো করেই জানো? এভাবেই যতোবার রায়হানুল কে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা নিয়ে কুশল নিজস্ব ডাক্তার নিয়ে এ বাড়িতে আসবে ততোবারই সেইসব ডাক্তারদের শেষ পরিণতি মৃ*ত্যু*ই হবে। না সুস্থ হবে রায়হানুল আর না কুশলের সামনে প্রকাশ পাবে কালো চাদরে মোড়ানো অতীতের সেই কালো সত্যগুলো।”
(৮২)
বেশকিছুসময় কুশল আর তরু একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে পাড় করে দেয়। পরক্ষণেই কুশল নিজেকে সামলে নিয়ে তরুকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে। দু’জনেই নিজেদের দৃষ্টি ই নিচের দিকে স্থির করে রেখেছে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“আমি আমার কাজের জন্য দুঃখিত তরুনিমা, তুমি কিছু মনে করো না।”
তরু কুশলের দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো…
—“আপনার কোন কাজের জন্য আমি কি বা মনে করতে যাবো?”
কুশল তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির রেখে বললো….
—“যদিও একজন স্বামীর তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরার জন্য স্ত্রীর থেকে কোনো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তুমি তো এখনও আমাকে নিজের স্বামীরূপে পুরোপুরি ভাবে গ্রহন করো নি তাই তোমার অনুমতি না নিয়েই তোমাকে জড়িয়ে ধরায় তুমি যেনো আমায় ভু*ল না বুঝো তাই আমি তোমাকে আমার কাজের জন্য দুঃখিত বললাম।”
কুশলের মুখে এরূপ কথা শুনে তরু কিছু বলতে নিবে সেইসময় ওদের রুমের দরজায় কারোর নক করার শব্দ ভেসে আসে। কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো…
—“তুমি বসো..আমি দেখছি কে এসেছে।”
এই বলে কুশল দরজার দিকে অগ্রসর হয়। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দরজার বাহিরে একজন গার্ডকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। গার্ডটি কুশলকে দেখামাত্র বললো….
—“স্যার..আপনার কথানুযায়ী চেয়ারম্যানকে তার পরিবারসহ উঠিয়ে এনে গু*দা*ম*ঘরে বেঁ*ধে রাখার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো….
—“ঠিক আছে, তুমি যাও।”
গার্ডটি তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যগ করে। কুশল আবার তরুর সামনে এসে দাঁড়াতেই তরু শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো….
—“কে এসেছিলেন?”
—“একজন গার্ড।”
—“ওহহ।”
—“বাহিরে আনাচে-কানাচে বিভিন্ন বি*প*দ লুকিয়ে আছে তাই তুমি আর সন্ধ্যা বাড়িত ভিতর থেকে বের হইও না। মালতী চাচী সহ আরো বেশ কয়েকজন মহিলা সার্ভেন্ট আছেন বাড়ির ভিতরে। তোমাদের কোনোকিছুর প্রয়োজন পড়লে নির্দ্বিধায় তাদের বলিও। তারা তোমাদের সবরকম প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখবে।”
—“আপনি কি এখন আবার বাহিরে যাবেন?”
—“হুম..আমার কাজ এখনও শেষ হয় নি তাই বাহিরে যেতে হবে।”
—“নিজের খেয়াল রাখবেন।”
—“আচ্ছা।”
এই বলে কুশল রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। তরু কুশলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাত্র।
(৮৩)
গু*দা*ম*ঘরে প্রবেশ করতেই কুশল দেখলো ওর সামনে দুইটা চেয়ারে বাঁধাবস্থায় বসে আছেন চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী শরিফা বেগম। তাদের পাশেই খুঁটির সাথে দাঁড় করা বস্থায় বেঁধে রেখেছে চেয়ারম্যানের ছেলে আরিফকে। কুশল চেয়ারম্যানের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে। আমজাদ হোসেন কুশলকে নিজের চোখের সামনে দেখামাত্র ভ*র*কে যান। আমজাদ হোসেন মনে মনে ভাবেন…..
—“কুশল চৌধুরী গ্রামে তাও সম্পূর্ণ সুস্থরূপে আছেন কি করে! এতোক্ষণে তো ওনার শহরে হাসপাতালে ভর্তি থাকার কথা ছিলো! তবে কি ঐ চাষী আমার সাথে নে*মো*খা*রা*মী করলো!”
পরক্ষণেই আমজাদ হোসেন নিজের মধ্যে ভ*য় ও চিন্তা ভাব চে*পে রেখে রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললেন….
—“এগুলা কি ধরণের অভদ্রতা কুশল চৌধুরী সাহেব? আমার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে আমাকে ও আমার পরিবারকে উঠিয়ে এনে এভাবে বেঁধে রাখার মানে কি?”
কুশল চেয়ারম্যানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে রেখে বললো….
—“আমার সাথে আপনার কি কখনও কোনো বিষয় নিয়ে দ্ব*ন্দ্ব হয়েছিলো?”
—“না।”
—“তাহলে আপনি আমাকে আ*হ*ত করার জন্য লোক পাঠালেন কেনো এই হিসাবটা আমি কিছুতেই মিলাতে পারছি না।”
কুশলের মুখে এমন কথা শুনে আমজাদ হোসেন এর মাঝে ভ*য় ও চিন্তা ভাব দ্বীগুণহারে বেড়ে যায়। আমজাদ হোসেন আমতা আমতা করে বললেন….
—“এ-এসব ক-কি বলছেন আ-আপনি! আ-আমি ক-কেনো আপনাকে আ-আ*হত ক-করার জন্য ল-লোক পাঠাতে যাবো? আমার উপর এতো বড় ম-মি*থ্যে অ*প*বাদ দিবেন না আপনি। আমাকে ও আমার পরিবারকে ছেড়ে দিন।”
কুশল একজন গার্ডকে উদ্দেশ্য করে বললো…
—“ঐ চাষীকে এখানে নিয়ে এসো।”
গার্ডটি চলে যায় চাষীকে আনার জন্য। চেয়ারম্যানের আর বুঝতে বাকি নেই কুশল কোন চাষীকে আনার জন্য গার্ডকে পাঠিয়েছে। কিছুসময় পর হুইলচেয়ারে বসারত অবস্থায় সেই চাষীটিকে নিয়ে গু*দা*ম*ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে গার্ডটি। চাষিটিকে ক্রমশ নিজের দিকে অগ্রসর হতে দেখে চেয়ারম্যানের চোখে-মুখে ভ*য়ে*র ছাপ স্পষ্ট হয়। চেয়ারম্যান ভী*ত দৃষ্টি নিয়ে চাষীকে একবার দেখছেন তো আরেকবার কুশলকে দেখছেন। গার্ডটি চাষিটিকে কুশলের হাতের ডান পার্শে এসে রাখতেই কুশল শান্ত স্বরে চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“এনাকে কি চিনতে পারছেন চেয়ারম্যান সাহেব?”
চেয়ারম্যান কোনোরকমে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করে বললেন….
—“ন-না-না তো কে উনি? আমি চিনি না ও-ওনাকে।”
চেয়ারম্যানের মুখে এমন কথা শুনে চাষিটি উচ্চস্বরে বললেন….
—“মালিক..উনি মি*থ্যে কথা বলছেন। উনিই আমাকে আপনাকে আ*হ*ত করার জন্য পাঠিয়েছিলেন।”
আমজাদ হোসেন উল্টো স্বরে বললেন….
—“এ-এই কে তুই? আমার নামে এসব মি*থ্যে কথা কেনো বলছিস? কে তোকে পাঠিয়েছে কুশল চৌধুরী সাহেবের সামনে আমার নামে মি*থ্যে অ*প*বাদ র*টা*নোর জন্য? কার থেকে টাকা খেয়েছিস তুই বল?”
—“মালিক…আমি আমার মায়ের কসম কা*ই*টা কইতাছি আমি একটা শব্দও মি*থ্যা বলি নি। চেয়ারম্যান নিজেরে বাঁচানোর লাইগা এমন নাটক করতাছে।”
আমজাদ হোসেন প্রতিত্তুরে কিছু বলতে নিবেন সেইসময় কুশল হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন….
—“চেয়ারম্যান সাহেব..আপনার অতিরিক্ত রেগে যাওয়ার চেষ্টা করা, চেহেরায় ফুটে উঠা ভ*য়ে*র ছাপ ও আটকানো স্বরে বলা কথাগুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে আপনি মি*থ্যে বলছেন। এখন মি*থ্যে নাটক করে সময় ন*ষ্ট না করে সত্যিটা বলে দিন নয়তো আপনার মুখ দিয়ে সত্য বের করার জন্য আমার নেওয়া পদক্ষেপটি আপনার জন্য সুবিধাজনক হবে না।”
কুশলের কথাগুলোকে হালকা ভাবে নিয়ে চেয়ারম্যান না*ক*চ স্বরে বললেন….
—“যেখানে আমি কোনো মি*থ্যে কথা বলিই নি সেখানে কোন লুকিয়ে রাখা সত্য আপনাকে বলবো?”
চেয়ারম্যানের মুখ থেকে সত্য বের করতে কুশল ওর বা’হাত দিয়ে একজন গার্ডকে ইশারা করতেই গার্ডটি চেয়ারম্যানের ছেলে আরিফের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আরেকজন গার্ড আরিফের দিকে ব*ন্দু*ক তাঁক করে রাখে যেনো আরিফ ছোটার চেষ্টা না করে। আরিফের পাশে দাড়ানো গার্ডটি আরিফের দু’হাতের বাঁধন খুলে ওর হাত দুটো কমোরের পিছনে নিয়ে বেঁধে দেয়। সেইসময় উপর থেকে একটি দড়ি নেমে আসলে গার্ডটি ঐ দড়িটি আরিফের গলায় বেঁধে দিয়ে ওর পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে খুঁটির পাশে থাকা সুইচটিতে চাপ দেয়। যার ফলে আরিফের পায়ের নিচে থাকা লোহার ঢাকনা ওয়ালা মেঝেটি সরে যেতেই ওর গলায় ফাঁ*স লাগে। আরিফ নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে শুরু করে। কিন্তু হাত বাঁধা থাকায় নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হয় আরিফ। নিজের একমাত্র ছেলেকে নিজের চোখের সামনে ফাঁ*সি*তে ঝুলে ছটফট করতে দেখে শরিফা বেগম কান্নায় ভে*ঙে পড়েন আর কুশলকে অনুরোধ করতে থাকেন আরিফকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমজাদ হোসেন আর কোনো উপায় না পেয়ে অনুরোধের স্বরে বললেন…
—“চৌধুরী সাহেব…আমার ছেলেটাকে ছাইড়া দেন। ও ম*রে যাবে। ওরে ছাইড়া দেন, আমি স্বীকার করছি আমি আপনাকে আ*হ*ত করার জন্য ঐ চাষীরে পাঠিয়েছিলাম। কোনো পাঠিয়েছিলাম সেই সব সত্যিও বলছি আমি আপনাকে। আমার পোলারে ছেড়ে দিতে বলেন।”
চেয়ারম্যানের কথা শুনে কুশল হাত দিয়ে ইশারা করতেই গার্ডটি আবারও সুইচে চাপ দেয় যার ফলে আরিফের পায়ের নিচের ঢাকনা মেঝেটি আগের ন্যয় হয়ে যায়। নিজের পায়ের নিচে মেঝের সাপোর্ট পাওয়া মাত্র আরিফ জোড়ে জোড়ে কাশতে শুরু করে। মৃ*ত্যু*র খুব কাছে থেকে যেনো বেঁচে ফিরলো সে।
চলবে ইনশাআল্লাহ………