#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩৬)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৯২)
তাহিরের মা রেবেকা তালুকদার তার বোনের মেয়ে হুমায়রাকে নিয়ে তাহিরের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখে তাহির বিছানায় উপুর হয়ে গভীর ঘুমে ডুবে আছে। হুমায়রা কানাডাতে থেকে বড় হলেও ওর সম্পূর্ণ শরীর আবৃত হয়ে আছে শালীন পোশাক দ্বারা। নরম জর্জেটের তৈরি গাড় নীল রংয়ের ভাড়ি কাজ করা কামিজ, সাদা রংয়ের চুড়িদার পাজামা ও সাদা রংয়ের ওড়না পড়ে আছে হুমায়রা। রেবেকা তাহিরকে ডাকার জন্য উদ্যত হলে হুমায়রা তাকে বাঁধা দিয়ে কিছুটা লজ্জা ভাব নিয়ে শান্ত স্বরে বললো…..
—“খালা তোমার ছেলেকে ঘুম থেকে উঠানোর দায়িত্ব কি তুমি তোমার হবু বউমাকে দিতে পারবে?”
হুমায়রার কথায় রেবেকা যে খুশিই হয়েছেন তা তার চেহেরায় ফুটে উঠা আনন্দের ছাপ দেখেই বোঝা সম্ভব৷ রেবেকা হুমায়রার কথায় সায় জানিয়ে বললেন…..
—“ঠিক আছে মা…তুমি ওকে ঘুম থেকে উঠাও আমি নিচে যাচ্ছি। তোমাদের নাস্তা তৈরি করি।”
—“আচ্ছা খালা।”
অতঃপর রেবেকা নিচে চলে যান। হুমায়রা ধীরপায়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাহিরের মুখশ্রী পানে দৃষ্টি স্থির করে বললো….
—“আমি আমার রাতের ঘুম হা*রা*ম করে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসলাম আর মশাইকে দেখো কেমন শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। তোমার শান্তির ঘুম এবার আমি ন*ষ্ট করতে যাচ্ছি মি. তওকির তালুকদার তাহির।”
এই বলে হুমায়রা বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস থেকে একটু পানি হাতে নিয়ে তাহিরের ঘুমন্ত মুখের উপর ছিটিয়ে দিয়ে বিছানার পাশে বসে লুকিয়ে রয়। ঘুমের মাঝে মুখের উপর পানির ছিঁটে পড়ায় তাহির বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। পরক্ষণে শোয়াবস্থাতেই নিজের চারপাশে চোখ বুলাতেই কাওকে দেখতে না পেয়ে বিরক্তির স্বরে বললো….
—“রুমে তো কেউ নেই তাহলে আমার মুখের উপর পানি ছিটিয়ে দিয়ে ঘুম ন*ষ্ট করলো কে? মা তো কখনও এভাবে আমার ঘুম নষ্ট করবেন না। আর কোনো সার্ভেন্টেরও সাহস এতো বড় হবে না। তাহলে কে করলো এই কাজ?”
তাহিরকে কনফিউজড হতে দেখে হুমায়রা ওভাবে থেকেই মুখ চেপে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। রুমের ভিতর কারোর হাসির হালকা শব্দ শুনতে পেয়ে তাহির এর ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে। তাহির শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসে নিজের হাতের বাম পার্শের দিকে একটু ঝুঁকতেই হুমায়রাকে উপুর হয়ে বসে থাকতে
দেখে কিছুটা অবাক হয়। হুমায়রা উপুর হয়ে বসে থাকার কারণে তাহির মুখ দেখতে পারে নি তাই ওকে চিনতেও ব্য*র্থ হয়েছে। পরক্ষণেই তাহির ধমকের স্বরে হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো…….
—“এই মেয়ে…কে তুমি? কার অনুমতি নিয়ে আমার রুমে প্রবেশ করেছো তুমি? আর আমার মুখের উপর পানি ছিটিয়ে দিয়ে ঘুম ভাঙানোর সাহস ই বা কোথায় পেলে তুমি হ্যা!”
আকস্মিক তাহিরের ধমকের স্বরে বলা কথাগুলো শুনে হুমায়রা কিছুটা ভ*য় পেয়ে যায়। পরমূহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে হুমায়রা বসাবস্থা থেকে উঠে তাহিরের দিকে ঘুরে কমোরের দুই হাত রেখে দাঁড়িয়ে বললো….
—“এইরকম ষা*ড়ে*র মতো চিল্লিয়ে জিঙ্গাসা করার কি আছে শুনি! আমাকে কি তোমার ঠ*সা বলে মনে হয় নাকি?”
দীর্ঘ ৬বছর পর হুমায়রাকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহির কিছুটা অবাক হয়ে বললো…..
—“হিমু তুইইইইই….?”
—“হুম আমি। কেনো আমার উপস্থিতি বুঝি তুমি এক্সপেক্ট করো নি?”
—“৬বছর আগে তো কেমন পুঁচকিদের মতো দেখতে ছিলি এতো তাড়াতাড়ি এতো বড় হয়ে গিয়েছিস যে তোকে চিনতে পারাটাও মুশকিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
—“এই হিমু এখন আর সেই পুচকি হিমু নেই তাহির। ২১ এর ঘরে পা দিয়ে চলেছি সামনের মাসের ১০ তারিখে।”
তাহিরে ভ্রু কুঁচকে বললো….
—“এই…তুই আমাকে নাম ধরে ডাকলি কেনো? তুই জানিস আমি তোর থেকে গুণে গুণে ৮ বছরের বড়। আর বড়দের যে সম্মান দিয়ে কথা বলতে সেই খেয়াল কি নেই তোর! এরপর আর কখনও যদি আমাকে ভাইয়া বলে সম্বোধন না করে নাম ধরে ডেকেছিস তাহলে তোর কানের নিচে দিবো একটা থা*প্প*ড়।”
হুমায়রা চোখ ছোটছোট করে তাহিরের দিকে তাকিয়ে নাক ছিঁ*টকে বিরবিরিয়ে বললো….
—“আরে ব্যটা তোকে আমি আমার হবু সন্তানদের একমাত্র পিতা বানাবো বলে মনঃস্থির করেছি আর তুই কিনা আমাকে তোকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করতে বলছিস! জামাইকে কেও ভাইয়া বলে সম্বোধন করে নাকি আজব তো।”
তাহির বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হুমায়রার মাথার বাম পার্শে আলতো করে একটা চা*টি মে*রে বললো….
—“কি এতো বিরবির করছিস?”
হুমায়রা নিজের মাথার ঐ অংশে হাত বুলাতে বুলাতে বললো….
—“তাহির..ভালো হচ্ছে না কিন্তু।”
হুমায়রার মুখে আবার নিজের নাম শুনে তাহির হুমায়রার বাম কান টেনে ধরে বললো…..
—“তোকে বললাম না আমায় ভাইয়া বলে সম্বোধন করবি কথা কি কানে ঢুকে নি তোর!”
হুমায়রা নিজের কান ছাড়ানোর চেষ্টা নিয়ে বললো….
—“আহহহ…লাগছে তো…ছাড়ো ছাড়ো…বলছি!”
তাহির কান ছেঁড়ে দিতেই হুমায়রা এক দৌড়ে তাহিরের পাশ থেকে সরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাহিরকে একবার জিহ্বা বের করে দেখিয়ে বললো….
—“আমার বয়ে গিয়েছে তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকতে! এই হুমায়রা রেহমান হিমু ম*রে গেলেও তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে না হুহ।”
হুমায়রার মুখে এমন কথা শুনতেই তাহিরে চোখ পাঁকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো…
—“তবে রেএএএএ….!”
হুমায়রা “খালা বাঁচাও ষাঁ*ড়*টা ক্ষেপেছে” এই বাক্যটি উচ্চারণ করে এক দৌড়ে নিচে চলে যায়। তাহির বললো…
—“তোকে তো পরে দেখে নিবো আমি।”
এই বলে তাহির টাওয়াল হাতে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে যেতে নিয়ে আবারও পিছনের দিকে পিছিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আয়নার উপর পড়া নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বললো….
—“আমাকে ঠিক কোন এঙ্গেল থেকে দেখলে ষাঁ*ড় বলে মনে হয়! হিমুর বাচ্চা তোকে আমি কাঁচা চিঁ*বি*য়ে খাবো।”
এই বলে তাহিরে ওয়াশরুমে চলে যায়।
(৯৩)
অনন্যা নিজরুমে বিছানায় বসে আছে। সেইসময় অনন্যার শ্বাশুড়ি সাবরিনা চৌধুরী ও ১জন মহিলা সার্ভেন্ট হাসিমুখে অনন্যার রুমে প্রবেশ করে। মহিলা সার্ভেন্টটির হাতে একটা ট্রে রয়েছে যা নীল চাদরে ঢাকা। অনন্যা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো…
—“মা….আপনি?”
সাবরিনা হাসিমুখে অনন্যার দিকে অগ্রসর হতে হতে বললেন….
—“বসো তুমি বউমা। আমার সামান্য একটু কাজ ছিলো তোমার সাথে তাই আসতে হলো।”
অনন্যা আগের ন্যয় বিছানায় বসে। সাবরিনা অনন্যার সামনা-সামনি বিছানার উপর বসে সার্ভেন্টের হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে অনন্যার সামনে বিছানার উপর রেখে ট্রের উপর থেকে নীল চাদরটি সরিয়ে ফেলে। চাদরটি সরাতেই অনন্যা দেখতে পায় ট্রেটির উপর একটা ভাড়ি কাজের বেনারসি ও বেশ কিছু স্বর্ণালংকার রাখা রয়েছে। সাবরিনা শান্ত স্বরে সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..
—“তুমি এখন চলে যাও।”
সার্ভেন্টটি চলে যেতেই সাবরিনা অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন…….
—“আমাদের চৌধুরী বংশের একটা নিয়ম আছে। পরিবারের মূল কর্তা-কর্তীর ছেলেদের সংখ্যা যে কয়জনই হোক না কেনো তাদের ভিতর বড় ছেলের সম্মান ও ক্ষমতা বাকিদের তুলনায় বেশি থাকে। তারপর মেজো ছেলের জায়গা, তারপর সেজো ছেলে এভাবে করে বাকি সব ছেলেদের সম্মান ও ক্ষমতার মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তোমার দাদী শ্বাশুড়ি অর্থ্যাৎ আমার শ্বাশুড়ি মায়ের ছেলে সন্তান হলেন ৩জন। রায়হানুল ভাই হলেন সবার বড় তারপর তোমার শ্বশুড় মশাই এবং শেষ সন্তান হলেন রিজভী। নিয়ম অনুযায়ী রায়হানুল ভাই এর সম্মান ও ক্ষমতা সবথেকে বেশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, রায়হানুল ভাইয়ের স্ত্রী সন্তান জন্মদেওয়ার সময় মৃ*ত সন্তান জন্ম দিয়ে মা*রা গিয়েছিলেন। কনকের বয়স যখন ২বছর তখন কুশল আমার গর্ভে আসে। কিন্তু পরবর্তী বংশধর হিসেবে কনকের সম্মান ও ক্ষমতা কুশলের থেকে একটু হলেও বেশি। এরপর রিজভীর ছেলে রাজবীর এর জায়গা। এগুলো বলার কারণ হলো তোমার কোল আলো করে আমাদের চৌধুরী বংশের আগামীদিনের নতুন ও প্রথম বংশধর আসতে চলেছে তাই তোমার সন্তানের সম্মান ও ক্ষমতা সবথেকে বেশি হবে। কিন্তু যদি তোমার ১ম সন্তান মেয়ে হয় আর এরপরই যদি ছোট বউমার ১ম সন্তান হয় তাহলে ওর সম্মান ও ক্ষমতাই সবথেকে বেশি হবে। আশাকরি আমার কথাগুলো তুমি বুঝতে পেরেছো বড় বউমা।”
অনন্যা স্মিত হাসি দিয়ে বললো…..
—“মা সন্তান ছেলে হোক কিংবা মেয়ে দুইজনই তো আল্লাহর দেওয়া রহমতের একটা বড় অংশ। তাই আমার সন্তান ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক এতে আমার কোনো স*মস্যা নেই। আর রইলো বংশগত ক্ষমতা ও সম্মান লাভের কথা! আমার সন্তান মেয়ে হলে আমি ওকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে একজন আদর্শবান, সৎচরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো। আর তখন আমার মেয়ে বংশগত ক্ষমতা ও সম্মান না পেলেও দুনিয়ার মানুষের মাঝে নিজের এমন একটা জায়গা তৈরি করবে যার জন্য দুনিয়ায় বসবাসরত লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার মেয়েকে অনেক সম্মান করবে এবং ভালোবাসবে। বংশগত ক্ষমতা ও সম্মান তো আপনা-আপনি পাওয়া সম্ভব। তাই সেই সম্মান ও ক্ষমতার থেকে নিজ অর্জিত সম্মানের জায়গা ও ক্ষমতা লাভের মান অনেক বেশি হবে।”
অনন্যার মুখে এরূপ কথা শুনে সাবরিনা স্মিত হাসি দিয়ে বললেন….
—“তোমার এতো সুন্দর চিন্তা-ভাবনা দেখে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না বড় বউমা। সবসময় এমনই থেকো। নিজের মানসিকতা ও চিন্তা-ভাবনায় কোনোরূপ পরিবর্তন এনো না কখনও।”
—“জ্বি মা…দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”
—“সন্তানদের জন্য বাবা-মায়েদের দোয়া সবসময়ই থাকে বড় বউমা। আর হ্যা…এই যে বেনারসি শাড়ি আর স্বর্ণালংকার গুলো দেখছো! এগুলো আমাকে আমার শ্বাশুড়ি মা দিয়েছিলেন। আজ সন্ধ্যার পার্টিতে তুমি এই শাড়ি আর স্বর্ণালংকার গুলো তুমি পড়বে কেমন!”
—“ঠিক আছে মা।”
—“আচ্ছা..এখন তুমি বিশ্রাম করো। আমি আসছি।”
এই বলে সাবরিনা বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অনন্যার রুম থেকে বেড়িয়ে যান।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……..