#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৩৯)
সায়লা সুলতানা লাকী
লাবন্যের চেয়ে রুশ মনে হলো এই ঘটনায় বেশি আহত হয়েছে। ও ওর রুমের ভেতর বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলল। লাবন্যের নানি লাবন্যের রুমের দরজা খুলে ওর কাছে গিয়ে বসল কিছুক্ষণ । কেনো জানি উনি কোনো কথা বলছিলেন না এমন কি লাবন্যকে কাঁদতেও বারন করলেন না। পরিস্থিতিটাই কেমন জানি গুমোট হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর লিখনের নাম্বার থেকে কল এল তার মোবাইলে। রিংটোন শুনে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখলেন আর সাথে সাথে কলটা রিসিভ করে বের হয়ে এলেন লাবুর রুম থেকে
“হ্যালো”
“আসসালামু আলাইকুম আম্মা”
“হুমম বলো”
“আম্মা আমি এখন গাজীপুর যাচ্ছি, বাসায় মা একা আছেন। বোনদের বলছি বাসায় এসে থাকার জন্য। এখন এই সময়টার জন্য কি একটু বুয়াকে পাঠাবেন মায়ের কাছে থাকার জন্য! জানি এটা লাবুর পছন্দ হবে না তারপরও আমি খুব বেকায়দায় পড়েই বলছি। ওকে রাগ করতে মানা করবেন। মা’কে একা রেখে আসায় খুব টেনশন আছি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি পাঠাচ্ছি, আর কিছু লাগবে? রান্না করা আছে?”
“জি আম্মা তা আছে। আর কিছু লাগবে না। শুধু বুয়া গিয়ে আম্মার পাশে থাকলেই হবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, রাখছি।” বলে কলটা কেটে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন এরপর বুয়াকে ডেকে সবটা বুঝিয়ে নিচে পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর নিজেই রুশকে ডেকে টেবিলে আনলেন খাবারের জন্য। ওর চোখমুখ দেখে রীতিমতো ভরকে গেলেন তিনি। এতটুকু বাচ্চার মনের উপর এমন প্রভাব পড়বে তা হয়তো তিনি ভাবতে পারেননি। তাই নিজেই প্লেটে ভাত নিয়ে মেখে মুখে তুলে খাওয়ায় দিলেন। এরপর জোর করে লাবন্যকে নিয়ে নিজেও খেয়ে নিলেন। যদিও তার নিজেরও কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না এমন পরিস্থিতিতে। কিন্তু তিনি না খেলে লাবুও খাবে না তাই খেয়ে নিলেন। এরপর লাবু আর রুশকে নিয়ে নিজের রুমেই শুয়ে পড়লেন। দুজনকে খুব শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে রাখলেন সারা রাত। ভাইবোন দুজনও যেনো নানির বুকটাকে একটা আস্থার আশ্রয় ভেবে শক্ত করে জাপটে ধরে রাখল।
ভোর সকালেই বুয়া হাজির হল বাসায়। লাবণ্যের নানি জিজ্ঞেস করলেন সব ঠিক আছে কি না ওখানকার। আর তখনই বুয়া শুরু করল বয়ান–
“আর কেমনে ঠিক থাকবো, এগো কোনকিছুরই ঠিক নাই আর থাকবোও না কোনোদিন।আল্লার একটা বিচার আছে না! পাপ ছাড়ে না বাপেরও। এহন ভুগুক বেশি কইরা। আমারে আটকাইছিলো ভাইয়ের ছোড বইনে। কয় সকালে উইঠ্যা রানতে, নাস্তা বানাইতে। আমি ভোরডা হইতে অপেক্ষা করছি শুধু , হেগো লগে থাকন কি সহজ কথা? ওরে আল্লাহ এক রাইতে আমার মাথা খারাপ কইরা ফালায়ছে। ওই বেডির এত এত বদনাম কওন শুরু করছে চাচি। সারারাত বইয়া আফার লেইগ্যা কানছে খালি, কয় আমার রেশমায় কত ভালো আছিলো।আমার কত কত যত্ন করছে, গোসল করাইছে। যহন যা খাইতে চাইছি, রাইনদা খাওয়াইছে। আর এই শয়তানে কিচ্ছু করে না সারাদিন পায়ের উপর পা তুইল্লা বইস্যা থাকে। আর তা দেখলেই নাকি কেবল চাচির মাথা ঘুরায়, অস্থির লাগে। এহন আফার এত এত প্রশংসা করে তহন এমনডা করছিলো ক্যা? এইসব ঢং শুইন্যা আমারই মাথা নষ্ট হইতেছিলো। আর ভালো লাগে নাই। তাই আর থাকি নাই। ফযরের ওয়াক্তে উইঠ্যাই দৌড় দিছি। রুশবাবা স্কুলে যাইব, ওর লেইগ্যা নাস্তা বানানের কথা কইয়া আর বসি নাই একদণ্ড ।”
“আচ্ছা আসছিস যখন, এখন ঘুমা। চোখ দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমাস নাই। এখনই রান্না নিয়া বসতে হবে না।আগে শরীর ঠিক কর পরে কাজ করা যাবে।”
“আরে ঘুম! আফায় আইছে মেলা রাইতে। আর এরপর শুরু হইছে গীত। ওরে আল্লাহ এই কয়দিনে তাগো ঘরের বেবাক কথা মুখস্থ হইছে আমার। কি সেদ্দত যে হইছে তা শুনলে পাগল হইবেন খালা।”
“আমার এসব শোনার কোন ইচ্ছে নাই।”
“আমার আছে।” লাবন্য চোখ ডলতে ডলতে উঠে আসল।
“তুই আবার এখন উঠলি কেন? রাতে ঘুমাস নাই যা একটু ঘুমিয়েনে। এসব শুনতে হবে না।পরের ঘরের খবর শুনতে হয় না।”
“নানি তুমি বুঝবা না, সকালেই এমন শান্তির কথা শুনতে যে কি ভালো লাগছে, আহা এমন শান্তি অনেকদিন পর পেলাম।”
“লাবু এসব কিন্তু খুব খারাপ, অন্যের খারাপ সময় নিয়ে…. ”
“হুমম অন্যের খারাপ সময় আমার মনে শান্তি দেয়। এখন কেউ যদি আমাকে ইভেল বলে বলুক, কোন অসুবিধা নাই। ইয়েস আই এম ইভেল। এখন বুয়াখালা তুমি মজা নিয়ে বিস্তারিত আমাকে বলতে পারো কি কি মুখস্থ করলা একরাতে।”
“কমু কমু, তয় এহন না, এহন আগে নাস্তা বানাইতে যাই, রুশ বাবা স্কুলে যাইব। ওরে ডাকেন দেরি হইবতো।”
“উঁহু, ও ঘুমাক। রাতে ঘুম হয় নাই। অনেক রাত পর্যন্ত ফুপিয়ে কেঁদেছে। ফযরে উঠার পর দেখলাম ঘুমের মধ্যেও বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘুমটা ক্লিয়ার হোক।একদিন স্কুলে না গেলে তেমন কিছু হবে না। বাসায় বসে পড়ে নিবে।”
“হিহিহি, তাহলে আমিও কোথাও যাবো না। চলো বুয়া খালা শুরু কর আমি শুনছি, আচ্ছা দাঁড়াও এখানে বললে রুশের ডিস্টার্ব হবে তারচেয়ে চলো আমার রুমে যাই।” বলে বুয়াখালার গলা ধরে লাবন্য তাকে নিয়ে নিজর রুমে চলে গেল। ওর নানির দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস করল না কারন নানি চোখ গরম করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
দুপুর বারোটার দিকে লিখন আসল বাসায়। লাবন্যের নানি সবে মাত্র গোসল করে বের হয়েছেন। আর লাবন্য রুশকে নিয়ে নিজের রুমে পড়াতে বসেছে। লিখন কে দেখে নানি আগে লাবন্যের রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে লিখনের সামনে এসে বসলেন।
তাকে দেখেই লিখন দুই হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠল।
“আম্মা আমি আর পারতেছি না। আমার জীবনটা কেন এমন হল? সাজানো গোছানো জীবনটা হঠাৎ করেই এমন অগোছালো হয়ে গেলো কেন? এখন আমি এর কোন কূল খুঁজে পাচ্ছি নাতো। ”
“এর কূল তোমাকেই বের করতে হবে। এমন করেতো আর চলবে না। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। সামনে ওদের ভবিষ্যত পড়ে আছে। এসব তোমার মাথায় রাখা উচিৎ। ”
“আম্মা একজীবনে আমি রেশমার উপর হওয়া অন্যায়গুলোকে মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলাম। এসবই হচ্ছে সেই অন্যায়ের প্রতিফল। রেশমার আত্মার অভিশাপ লেগেছে আমার ভাগ্যে।”
“এসব কেন ভাবছো? এসব ভেবেতো আর আমার মেয়ের প্রতি করা অন্যায়গুলো ফিরিয়ে নিতে পারবে না। ”
“তা পারব না ঠিক তবে তার ফল ভোগ করতে হবে তাই বুঝেছি। এত অশান্তি যে জীবনে পাওনা রেখেছি তা ভাবিনি।”
“রুশ সারারাত কেঁদেছে, খুব কষ্টে আছে বাচ্চাটার। লাবুও বিধ্বস্ত। এমন পরিস্থিতি যেনো আরেকবার না ঘটে সেদিকে নজর দাও।”
“আমি ভেবেছিলাম সামনে থেকেই বাচ্চাগুলোর পাশে থাকবো। কিন্তু এমনও যে হতে পারে তা ভাবিনি।”
“এখন ভাবো। এমন হতে দেওয়া যাবে না আর।”
“জি আম্মা আমি….. ” বলে থেমে গেল লিখন। রুশ পানি খেতে ডাইনিংএ এসে পানি খেয়ে আবার চলে গেল। ওর আব্বুকে দেখে কোন রকম রিয়েক্টই করল না। ও বেশ অবাক হয়ে রুশের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
“এখনও সময় আছে বাচ্চাদের মনে বড় কোন সমস্যা তৈরির আগেই যা পারো একটা ব্যবস্থা কর।”
“জি আম্মা, করব। এখন আসি।” বলে লিখন আর দাঁড়ালো না, চলে গেল।
সকালে লাবন্য আর রুশ বের হয়ে গেল আগে আগে, উদ্দেশ্য নানি নামতে নামতে সিএনজি রেডি করতে হবে। রুশকে স্কুলে দিয়ে লাবন্য যাবে নানিকে নিয়ে বারডেম হাসপাতালে। হিমেল ঢাকার বাহিরে আছে তাই লাবন্যই যাবে নানির সাথে তেমনটাই কথা হয়েছে রাতে হিমেলের সাথে।
বাসা থেকে বের হতেই পাশের বাসার আন্টির সাথে দেখা হয়ে গেল ওদের। লাবন্য সৌজন্যতা দেখাতে বলল
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়ালাইকুম আস সালাম, কেমন আছো লাবন্য? ”
“জি আলহামদুলিল্লাহ। ”
“এই মেয়ে তোমার আব্বু শেষ পর্যন্ত এইটা কি বিয়ে করে আনল? না আছে সোশ্যাল কালচার, ম্যনার, না আছে শিক্ষা দিক্ষা। কি আজব এক মহিলারে বাবা! ভালোমতো কথাটাও বলতে পারে না কারউ সাথে। আমি তো দেখে পুরাই অবাক। আর কথা শুনেতো হাসতে হাসতে শেষ। রেশমা ভাবি ছিলো রাজরানী আর এ যেনো মিললো রুপকথার ঘুঁটেকুড়ানি তোমার আব্বুর ভাগ্যে। তোমার আব্বুর রুচি হয় কীভাবে এই মহিলার সাথে থাকতে? কোত্থেকে পেলো এই চিজ? একটু রয়েসয়ে দেখেশুনে বিয়েটা করতে পারলো না? কি যে হয় পুরুষদের বৌ মরার পর? বেহুশ হয়ে যায় দেখছি।”
“সরি আন্টি আমিতো আপনার এত এত প্রশ্নের কোনটারই সঠিক উত্তর দিতে পারবো না। কারন এর কোন উত্তর আমার জানা নাই। আপনি বরং আমার আব্বুকে পেলে তখন তাকেই জিজ্ঞেস কইরেন কি করে আব্বু তার সাথে থাকে। ইয়ে মানে কি করে, আই মিন… আরে ধুর কি বলবো তাইতো বুঝতেছি না। আপনার যা যা জানার আগ্রহ হয় তা সবই আপনি আব্বুকে কইরেন। আব্বু আপনাকে একেবারে ইনডিটেলসে বলতে পারবে। আই মিন কীভাবে কি করে। বুঝছেন না আন্টি? ওকে বাই।” বলে লাবন্য একটা হাসি দিয়ে রুশের হাত ধরে হন হন করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।
পেছন থেকে লাবন্যের নানি মোটামুটি সব কথাই শুনছিলেন। তার মুখে কোন কথা নাই। ঠিক এমন সব প্রশ্নের সঠিক কি উত্তর হয় তা নিয়েই যেনো ভাবছিলেন। লাবন্যের মুখে এমন উত্তর শুনে পাশের বাসার আন্টিও মনে হল একটু ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গেল। লাবন্যকে কি বলবে বুঝে উঠার আগেই তার চোখ পড়ল নানির উপর। কিছুটা আমতা আমতা করে বলে উঠল
“আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা, ইশশ আপনি কত রুচিশীল, কি সুন্দর টিপটপ করে চলেন। রেশমা ভাবিও ছিলেন আপনার মতোই বেশ গোছানো।”
“ওয়ালাইকুম আস সালাম, আমি সবসময়ই আমার মেয়েকে পারিবারিক কিছু শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছি। খুব সাধারণ যেগুলো, যেমন ঠিক কোন বয়সী কার সাথে কি বিষয়ে কথা বলা যায়! ঠিক কি ধরনের কথা সমাজে একে অপরকে বলা যায়………”
“এই জন্যইতো ভাবি এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতেন। আসলেই আন্টি পারিবারিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। ”
“হুমম, তা এখন আসি, একটু তাড়া আছে।” বলে আর দাঁড়ালেন না তিনি, সোজা পা চালালেন নিচে নামার জন্য।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দোতলায় আসতেই লাবণ্যের চোখ পড়ল দরজার দিকে।দেখল দরজায় তালা ঝুলছে। কিছুটা অবাক হল এই ভেবে যে, এই সকালে সব গেলো কোথায়? কিন্তু উৎসুক মন আর আগালো না নিচে নেমে গেল তাড়াতাড়ি করে।
সারা সকাল গেলো বারডেমে বসে বসেই। এরই মাঝে দুই তিনবার হিমেল কল দিয়ে ওদের অবস্থা জানতে চেয়েছিলো। যখন ওরা ফিরল তখন আর লাবন্য ক্লাসে গেলো না। রুশকে নিয়ে বাসায় ফিরে এল। হঠাৎ করেই নানির শরীরটা কমন জানি দুর্বল হয়ে গেল। লাবন্য ভাবলো রক্ত দিয়েছে অনেকগুলো টেস্ট করাতে তাই হয়তো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু না বাসায় আসার পর পরই নানির চোখমুখ ওর কাছে কেমন কেমন জানি লাগল। দুপুরে খেতেও চাইছিলেন না তিনি তেমন একটা। কিন্তু লাবন্য জোর করে তাকে একটু ভাত খাওয়ালো। আসরের পর থেকে টের পেলো নানির গায়ে অনেক জ্বর। টেম্পারেচার ১০৩/৪°f. লাবন্য ভয় পেয়ে গেলো। এই অবস্থায় কি করবে না করবে ভেবেই অস্থির। ওর নানি বারবার বলে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ওদেরকে ভয় না পেতে। কিন্তু লাবন্যের মন থেকে তবুও ভয় গেলো না। নানির শরীরটা মুছিয়ে দিয়ে দুইটা নাপা এক্সটেন্ড খাওয়ায় দিল নানির কথা মতো। তিনি একটু ঘুমান একটু জাগেন। জ্বর এই ঘাম দিয়ে ছাড়ে আবার বাড়ে। এই রকম দোটানায় দোলতে দোলতে রাতটা পার হলো। লাবন্য ঠায় বসে থাকলো নানির পাশে এক মুহুর্তের জন্যও সরলো না। হিমেল জানার পর পরই রওয়ান হল ঢাকার পথে। ওর কাছেই শুনল মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা রেহেনা বেগম। সকালেই নাজমুল সাহেবকে নিয়ে ছুটে আসলেন ওদের বাসায়। বড় খালামনিকে দেখে লাবন্য মনে মনে একটু সাহস পেলো কিন্তু মুখে কিছু বলতে সাহস পেলো না কারন খালা বাসায় ঢুকেই চিৎকার চেচামেচি শুরু করল মায়ের সাথে এখানে এসে থাকার জন্য । তার কথা এখানে তার মায়ের অনেক অযত্ন হচ্ছে। লাবন্য পুরাই চুপ, কি উত্তর দিবে তা যেনো জানা নাই। নানিী জ্বরটাই এখন মুখ্য বিষয় ওর কাছে। এদিকে জ্বর যাতে মাথায় না উঠে তাই রেহেনা বেগম লাগাতার মায়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগলেন আর তাতে হিতে বিপরীত হল। তার মায়ের ঠান্ডা লেগে গেলো, নাক দিয়ে পানি পড়তে লাগল । খাবার সামনে আনতেই নানির বমি হল তাই লাবন্য ইউ টিউব দেখে দেখে তার জন্য স্যুপ বানিয়ে আনল খাওয়ানোর জন্য, আবার একটু পর জাউভাত করে আনল। রেহেনা বেগম নিজেই এগুলো করতে চেয়েছিলেন কিন্তু লাবন্য তাকে কিছুই করতে দিলো না। বিকেলে খবর পেয়ে লিখন ডাক্তার নিয়ে আসল বাসায়। ডাক্তার সাধারণ ঔষধই দিলেন তিনদিনে জ্বর না কমলে পরে কিছু টেস্ট করতে দিয়ে চলে গেলেন। বিকেলে লাবন্যের মামারা আসল বাসায়। তারা মায়ের শারীরিক অবস্থা দেখে রেগে গেলেন। তাদের এক কথা তারা এখন তাদের মা’কে নিয়ে যাবে সাথে করে। কথাটা শুনেই লাবন্যের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না শুধু নানির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শুনার জন্য যে তিনি কি বলেন।
লাবন্যের নানা বাড়ির সবার সামনে লিখন আর দাঁড়ানোর সাহস পেলো না তাই দোতলায় ফিরে গেলো। রাতে হিমেল আসল। লাবন্যের জোরটা মনে মনে আরেকটু বাড়ল। আর যাই হোক একজন আছে যে ওদের হয়ে দুই একটা কথা বলতে পারবে ভেবে।
লাবন্য নিজেই সবার জন্য টুকটাক নাস্তা বানিয়ে এনে দিল সামনে। বুয়াখালা চা দিল কিন্তু কেউ কিছু খাচ্ছে না। সব খাবার সামনে পড়ে আছে দেখে অসুস্থ অবস্থাতেই লাবন্যের নানি ধমকের স্বরে বলে উঠলেন
“কি ব্যাপার কেউ কিছু খাচ্ছিস না কেন? এই যে মেয়েটা একা একা তোদের জন্য এতকিছু বানিয়ে আনলো কেউ তো তা মুখে নিয়ে দুই একটা প্রশংসার বাক্য ব্যয় করতে পারিস। কি পারিস না? নাকি সময়ের সাথে সাথে তোদের মনুষ্যত্বও বিলুপ্ত হতে চলছে? আল্লাহর নেয়ামত সামনে রেখে সব বসে বসে বড় বড় কথা বলছিস, এমন শিক্ষাই কি তোদেরকে দিয়েছিলাম?”
“আহা! নানুমনি তুমি এতটা উত্তেজিত হচ্ছো কেন? তুমি শান্ত হও। সবাই খাবেতো। মামারা তোমাকে নিয়ে চিন্তিত তাই এখনও নেয়নি। এখন নিবে, দেখো নিবে।” বলে হিমেল সবার দিকে তাকাল।
“মা আপনে এত রেগে যাচ্ছেন কেন?”
“রাগবো নাতো কি করবো? আমি তোদের কাছে থাকা সময়তে অসুস্থ হয়নি? তখন কোথায় পাঠিয়েছিলি আমাকে? মুখে রুচি থাকলেও ভাত রুটি না থাকলেও ভাত রুটিই খেয়েছি। মুখ ফোটে বলতেও পারিনি একটু জাউ করে দাও। সকাল বিকাল ডাক্তার এনে ঔষধ দিয়েছিস দ্রুত শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়ার জন্য। কিন্তু কখনও কি খোঁজ নিয়েছিস ঔষধ ছাড়া আর কি লাগবে মায়ের? মা কি হলে একটু সহজভাবে খেতে পারবে?ভেবেছিস শরীরটা অসুস্থ হলে সাথে মনটাও আক্রান্ত হয়। সেখানেরও ঔষধের প্রয়োজন! দায়িত্ব পালন করেছিস ঔষধ দিয়ে কিন্তু ভালোবাসা আদর যত্ন দিয়ে কি মনকে সুস্থ করেছিস কখনও? আজ এখানে মা অসুস্থ, তাই এসেছিস মাকে বাসায় নেওয়ার জন্য। দেখাচ্ছিস মায়ের প্রতি সব কতটা তৎপর । কিন্তু ভেবেছিস তোদের মতো তোদের মা’ও যে এখন নিজের স্বার্থ দেখতে শিখে গেছে। সে এখন আর যেতে চায় না তোদের কাছে। তার মনের ঔষধের সন্ধান সে পেয়েছে। সে এখন এত বছরের জখম হওয়া মনের চিকিৎসা করাতে এখানেই থাকতে চায়।”
নানির কথাটা শুনে লাবন্য কেঁদে ফেলল খুশিতে।
চলবে