ছায়া মানব ২
২৪.
সকাল হতেই মামুন চৌধুরী রোস্তমের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। নাস্তা করেই যাবে। তাকে পরিপাটি হয়ে নিচে নামতে দেখে মাহতিম বেশ খানিকটা অবাক হয়। কারণ আজ দিনটা ছুটি। বেশি কাজ না পড়লে যেতে হবে না। অথচ মামুন তৈরি হলো। তাই আগ বাড়িয়েই বলল,’বাবা, কোথাও যাচ্ছ নাকি?’
‘হুম! অহনার বাবার সাথে দেখা করব।’
সবাই নাস্তার টেবিলে ছিল। আনিফা মৃদু হাসল। নিহা আর বর্ষণ চুপ করেই খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। নিহার চোখ ছলছল করছে। বর্ষণ সেটা খেয়াল করল। কারণ বুঝতে পারল না।
মোহনা উদগ্রীব হয়ে বলল,’অহনার বাড়িতে কেন যাবে?’
অহনা খানিকটা লজ্জা পেল। মাহতিমের দিকে তাকিয়ে পুনরায় চোখ সরিয়ে নিল। মাহতিমও ওর দিকে তাকিয়ে কিছু সন্দেহ করল। মামুন বলল,
‘বর্ষণের সম্বন্ধ নিয়ে।’
অহনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। দপ করে উঠে দাঁড়াল। সবকিছু কেমন আবছা। বুঝতে পারছে না। মাহতিমও বেশ অবাক। পাশে বসে থাকা নূরের চোখ-মুখ উজ্জ্বল। খুশিতে হাততালি দিয়ে বর্ষণকে বলে,’ওকে তুমি নিয়ে যাও ভাইয়া। মাহতিমকে দিও না কখনো।’
বর্ষণ কিছু বলল না। মোহনাও খুশিতে গদোগদো হয়ে বলল,’বাহ! আজকের জন্য এটা দারুণ খবর।’
আনিফা বলল,’অহনাও রাজি। তাই আর দেরী করতে চাইছি না। ওদের দুহাত এক করেই শান্তি পাব।’
মাহতিম আর এক মুহূর্তও দেরী করল। ইশারায় অহনাকে ডাকল। অহনাও ঠিক তার মুখোভঙ্গি দেখে বুঝতে পারল, মাহতিম তার সাথে কথা বলতে চায়। এদিকে বর্ষণও কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। সে সত্যিটা জানতে চায়। অহনাকে দেখে বুঝল, কিছু সমস্যা হয়েছে। সাথে সাথেই বর্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ল। মামুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ব্যস্ত হয়ো না। আমি নিজেই যাব রোস্তম আঙ্কেলের কাছে।’
‘তাহলে আমার সাথেই চল। একসাথেই কথা হবে।’
‘না বাবা, তুমি যেও না। কালকে যেও। এখন গেলে তুমি ওনাকে পাবে না।’
‘ কেন পাব না?’
বর্ষণ আমতাআমতা করে বলল,’ওনি ব্যস্ত, অহনা বলল। তোমার এখন যাওয়া ঠিক হবে না। তার ওপর আমার নতুন চাকরি হয়েছে। এখন বিয়ের কথা চিন্তা করতে পারছি না। আর কিছুদিন যাক। এমনকি অহনার পরীক্ষা সামনে। এই মুহুর্তে এসব চাপের হবে।’
‘আমিতো এখনের কথা বলছি না। কথা বলে রাখব।’
আনিফা টের পেল বর্ষণের কথার মানে। কিছুটা ব্যস্ত হয়েই বলল,’শুনো, আমি ক্লিনিকে যাব। একটু আমাকে নিয়ে যেও। এখন না গেলেই বরং ভালো হয় অহনাদের বাড়িতে।’
সবার এতো আপত্তি দেখে মামুন আর কথা বাড়ালো না। অহনা চট করেই উঠে গেল। আনিফা বলল,’তুমি না খেয়ে উঠে গেলে কেন?’
‘আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমি আসছি।’
সাথে সাথেই নিহা উঠে গেল। নিহার পেছন পেছন বর্ষণও উঠে গেল। আনিফা অবাক না হয়ে পারল না। তবে ততটা গুরুত্ব দিল না।
মাহতিম অহনার ঘরেই দাঁড়িয়ে আছে। অহনা দ্রুত নিজের ঘরে গেল। পেছনেই উপস্থিত হলো বর্ষণ। বর্ষণকে দেখেই মাহতিম বের হয়ে যেতে চাইলেই বর্ষণ তার হাত চেপে ধরে,’এখানেই থাক। কিছু কথা বলার ছিল।’
মাহতিম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অহনাও বেশ চিন্তিত। বর্ষণ তাদের দুজনকে পরখ করে বলল,’আমি জানি, তোমাদের মাঝে একটা সম্পর্ক রয়েছে।’
মাহতিম আর অহনা বেশ অবাক। বর্ষণ কী করে জানে সেটা? কে বলল তাকে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মাহতিমের মাথায়। তাকে আরো খানিকটা অবাক করে দিয়েই বর্ষণ বলল,’কিভাবে জানি সেটা বড়ো কথা নয়। তোমরা একে অপরকে পছন্দ করো। শুধু পছন্দ নয় তোমাদের সম্পর্কটা অনেকটাই গভীর হয়ে গেছে এতদিনে। আমি সবটাই জানি। হ্যাঁ, আমি অহনাকে ভালোবাসি। চেষ্টা করেছি অহনাকে পাওয়ার। কিন্তু যখন জানলাম আমার ভাই, তুই ওকে ভালোবাসিস তখন আমি আর চাইনি। আমি ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। জোর করে পাব, এমন কথা কল্পনাও করতে পারিনা। তবে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার ভাই আমাকে কিছুই বলেনি। আমার থেকে সবটা লুকিয়েছে।’
মাহতিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’আমি বুঝতে পারিনি কখন আমি…’
‘থাক, কিছু বলতে হবে না। এক্সপ্লেইন করতে হবে না কিছুই। শুধু এটা বল, তোদের মাঝে কী সমস্যা হয়েছিল? কেন অহনা বাবাকে বলল ও আমাকে বিয়ে করতে চায়?’
‘আমাদের মাঝে কিছুই হয়নি। আমিও বুঝতে পারছি না। ও কেন রাজি হলো!’
দুজনেই অহনার দিকে তাকাল। দুজনেই জানে না আসল কারণ। অহনা দুজনের প্রশ্নদীপ্ত চোখ দেখে সহসাই নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। ভেজা গলায় বলল,’আমি বুঝতে পারিনি। আমি আঙ্কেলের কথা বুঝতে পারিনি। ওনি বলেছেন, ওনার ছেলে আমাকে পছন্দ করেন, এবং আমিও করি, তাই আমি ভেবেছি হয়ত সে….’
বর্ষণ হেসে বলল,’তুমি ভেবেছ মাহতিমের কথা বলেছে। আমিও এটাই ভেবেছি। হলোও তাই। ঠিক আছে। আমি সবাইকে গিয়ে বলছি আসল বিষয়টা। আমি চাই না কেউ নিজের ভালোবাসা হারিয়ে ফেলুক আমার মতো।’
বর্ষণ কোনোরকমে ঢোক গিলে প্রস্থান করল। মাহতিম বেশ অবাক। অহনা তাকে বিয়ে করতে চাইছে। সেটা যেন তার বিশ্বাস হতে চাইল না। আচমকা এগিয়ে এলো অহনার কাছে। ভীষণ উত্তেজনায় অহনার হাত দুটো মুঠোবদ্ধ করে ধরল,
‘তুমি আমার কথা ভেবেই রাজি হয়ে গেলে? বিশ্বাস হচ্ছে না।’
অহনা মাথা নিচু করে ফেলল। মাহতিমের হৃদয় খুশিতে আত্মহারা। দিশেহারা হাতদুটোও। বলেই বসলো,’তোমাকে জড়িয়ে ধরব?’
পরপরই নিজে থেকেই আবার বলল,’ধরা বারণ হবে কেন? কিছুদিন পর অধিকারটাও জোড়ালো হবে। এখন তবে ছাড়ছি না।’
মাহতিম দ্রুত অহনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। এতোটাই শক্ত করে হাত দিয়ে বেঁধে ধরল, যেন বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলবে। অহনাও বেশ আয়েশ করে মাহতিমের শার্ট খামচে ধরল। দু’জন মিলে গেল পরিচিত সেই ভালোবাসায়। তাদের মধ্যে আর কোনো বাধা থাকল না। দুজনেই একে অপরের অনুভূতিতে তলিয়ে গেল। অহনার ঘরের পাশ দিয়েই মোহনা যাচ্ছিল। দরজাটা খোলা ছিল। কিছুটা শব্দ পেতেই মোহনা সেদিকে তাকাল। অহনা এবং মাহতিমকে এমন অবস্থায় দেখে মুখ থেকে একটা কথাই বের হয়ে এলো,’আস্তাগফিরুল্লাহ!’
চোখের চশমাটা খুলে পুনরায় দেখল। সাথে সাথেই চশমা পরে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। মাথায় কাজ করছে না কিছুই । ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায়। একজনের সাথে বিয়ে ঠিক হলো আর অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। এমনটা দেখে মোহনার মন-মানসিকতা ঠিক নেই। অহনার প্রতি কেমন একটা ঘৃণাও জন্ম নিল তৎক্ষণাৎ। দ্রুত চলে গেল সেখান থেকে।
আনিফা আর মামুন ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। হঠাৎ করেই বর্ষণের আগমণ। কিছুক্ষণের মাথায় বলল,’আমার কিছু কথা ছিল।’
মামুন গুরুত্ব দিল না তার কথায়। আনিফা জিজ্ঞেস করল, ‘বল। কী হয়েছে?’
‘তোমরা ভুল করেছ। অহনা আর আমার মাঝে কিছুই নেই। বিয়েটা হলে দুজনেই কষ্ট পাব।’
আনিফা বেশ অবাক,
‘তুই নিজেই বলেছিলি তুই অহনাকে পছন্দ করিস।’
‘এখন আর করিনা। ভাই অহনাকে ভালোবাসে। অহনাও ভাইকেই চায়। আমি কী করে তাদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াই বলো? আমি স্ট্রিট কথা বলছি। জানি, অনেকটা বেশি সাহস করে ফেললাম। আমি চাই ভাই আর অহনার বিয়ের কথা পাকাপাকি করো তোমরা। আমার কথা ভাবতে হবে না।’
‘ তা কী করে হয়? বড় ছেলের বিয়ে না দিয়ে আমি ছোট ছেলের কথা ভাববো?’
‘সমস্যা নেই। আমার যখন ইচ্ছে হবে তখনই বিয়ে করব। তুমি ভাইয়ের ব্যবস্থা করো।’
মামুন উঠে দাঁড়াল,’বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা নয়। তোমার আগে মাহতিমের কথা চিন্তা করতে পারিনা।’
আনিফাও বলল,’এটা সম্ভব নয়!’
বর্ষণ চুপ করে রইল। সে কিছু শুনতে চাইছে না। সে মাহতিমকে সুখী দেখতে চায়। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কী বলা উচিত তাও বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে সে সজ্ঞানে নেই। হঠাৎ করে কিছু না ভেবেই বলল,’আমি নিহাকে ভালোবাসি। ওকেই বিয়ে করব। দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করো। আমি বিয়ে করব।’
বলেই সে চলে গেল। আনিফা তাজ্জব হয়ে গেল। নিহাকে সে পছন্দ করে না তেমন। অথচ মামুন বলল,’বাহ! আমারতো মনেই ছিল না নিহাও বড়ো হয়েছে। মেয়েটা দেখতেও সুন্দর, স্মার্ট। ভালোই হবে তাহলে।’
আনিফার গা জ্বলে ওঠল। মামুনের সামনে তার বোনের মেয়েকে নিয়ে কিছু বলতেও পারবে না। সে তো আর বাড়িতে থাকে না সর্বক্ষণ তাই জানে না নিহা কেমন।
অনেকটা সময় চলে যেতেও মাহতিম অহনাকে ছাড়ছে না। অহনা জোর করে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারল না। মুখ ফুলিয়ে বলল,’এমন করছ কেন? ছাড়ো আমায়। কেউ দেখে ফেলবে!’
‘সবাই দেখুক। তাদের হিংসে হওয়া উচিত।’
‘এখানে হিংসে করার মতো কেউ নেই শুধু নুর ছাড়া। সে যদি আমাদের একসাথে দেখে তাহলে কী যে হবে! সরে যাও।’
একবার বিয়েটা হতে দাও। তোমার নিঃশ্বাসের শব্দই হবে আমার প্রতিদিনকার রুটিন। এতো ভালোবাসা দেব, চিন্তাও করতে পারবে না।’
আচমকা অহনা বলল,’তোমাকে রিজেক্ট করলাম। প্রেম নিবেদন না করেই কোন সাহসে বিয়ের স্বপ্ন দেখো?’
মাহতিম অহনাকে ছেড়ে দিল। ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না তবুও ছাড়তে হলো,
‘প্রেম নিবেদন অবশ্যই করব। যেটা তোমার সারাজীবন মনে থাকবে। আমার হৃদয়ের রাণীকে রাণীর মতোই প্রেম দেব আমি। আচ্ছা, তুমি কী জানো প্রেম মানে কী? কখনো ভেবে দেখেছ?’
‘আপনি পন্ডিত, তাই আপনারই জানা উচিত।’
‘রোমান্টিক মোড নষ্ট করে দিতে তোমার এই কথাটাই যথেষ্ট ছিল। ধ্যাঁত! তবে আমিও জানি কী করে কন্ট্রোল করতে হয়।’
মাহতিম অহনার মুখোমুখি হয়ে দীর্ঘ চোখে তাকাল। তৃপ্তির হাসি দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিল একবার। অহনার দু’কাঁধে হাত রেখে ওর ঠোঁটের দিকে তাকাল। নিষ্প্রাণ গোলাপি ঠোঁটজোড়া তাকে আরো দুর্বল করে দিল। নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে সে মিলিয়ে নিতে চাইল অহনার ঠোঁটজোড়া।
সেটা আর হলো না। নুর ওদের মাঝখানে ঢুকে যায়। কোমরে দু’হাত রেখে কাঠকাঠ গলায় বলল,’অহনার বাচ্চা, দূরে সরো।’
পরপরই মাহতিমকে বলল,’নিচু হও।’
মাহতিম আবার ঝামেলার কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নূরের কথামতো নিচু হলো। নূর কোনো কথা না বলে ঠা’শ করে একটা চ’ড় বসিয়ে দিল মাহতিমের গালে। যদিও বেশি লাগেনি তাও সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নূর মুখ ফুলিয়ে অহনার দিকে তাকাল,’টিকটিকি তুমি। মাহতিমের থেকে দূরে থাকো।’
পরপরই মাহতিমকে বলল,’ওকে কখনো চুমু খাবে না। আমাকে চুমু খাবে সবসময়। না হয় এভাবে শাস্তি পাবে।’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকের মন্তব্যের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership