ছায়া মানব ২
২৬.
সবাই বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। মাহতিম কিছুটা দেরী করছে। আনিফা মোহনাকে বলল মাহতিমকে ডেকে আনতে। সে গাড়ি থেকে পুনরায় নামতেই দেখল মাহতিম আসছে। তার মনতো যেতে চাইছে না তবুও যেতে হচ্ছে। কয়েকবার পেছন ফিরে দেখল অহনা আছে কিনা। সে নিজের ঘরেই আছে। মাহতিম দ্রুত এসে গাড়িতে বসল। সাথে সাথেই নূর পেছন থেকে বলল,’আমি মাহতিমের সাথে যাব। সামনে যেতে দাও আমায়।’
মোহনা রেগে বলল,’কানের নিচে একটা দেব। চুপ করে বসে থাক।’
নূর গাল ফুলিয়ে বলল,’বাবাইকে সব বলব। তুমি আমাকে বকেছ মোহনা আপু।’
‘তবে রে! আমিও বলব, তুই কী করে আমার ভাইয়ের পেছনে পড়ে থাকিস।’
‘তোমার সাথে কথা নেই। আজকে গেলে আর কখনো তোমাদের বাড়ি আসব না। সবাই খালি বকে আর কষ্ট দেয়।’
‘তুই গেলেই আমরা শান্তিতে থাকব। বেঁচে যাব সবাই।’
‘ ঠিক আছে, ঠিক আছে! চলে যাব আসব না। তবে মাহতিমকে আমার সাথে রেখে দেব। আর কখনো তোমাদের বাড়ি যেতে দেব না।’
নূরের পাগলামো দেখে মাহতিম হাসল। সত্যিই মেয়েটা তার জন্য পাগল। কিন্তু ভয়ও পাচ্ছে! তার এই পাগলামো না অসুখে পরিণত হয়। আনিফা চোখ রাঙিয়ে মোহনাকে বলল,’কী হচ্ছে মোহনা? ওর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?’
নূর মোহনাকে মুখ বাঁকিয়ে আনিফাকে বলল,’খুব করে বকা দাও মোহনাকে। বড়োদের সাথে কথা বলতে পারেনা ও।’
‘তুই বুঝি খুব পারিস?’
মোহনার কথায় আনিফা আবারো বলল,’বাচ্চাদের সাথে বাচ্চা হতে নেই। চুপ করে থাক। নূর, তুমি আমার পাশেই বসো। আরতো কিছুটা রাস্তা, বেশি সময় লাগবে না।’
মাহতিম হাঁসফাঁস করছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে বাহিরটা দেখছে। মন পড়ে আছে অহনার দিকে। হঠাৎ করেই আশিশের কল আসতেই তার হুঁশ ফেরে। কিছুটা চমকে ওঠেই কল রিসিভ করল। সাথে সাথেই আশিশ বলল,’দুই হাজার পনেরোর একটা ফাইল জয়ন্ত স্যার দিয়েছিল তোকে। সেটা ইমিডিয়েটলি নিয়ে আয়।’
‘কিন্তু আমি আসতে পারব না। কাকা হাসপাতালে, দেখতে যাচ্ছি।’
‘এখনই আসতে হবে। না হয় অন্য কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দে। আমি রাখছি।’
‘আমি এখন কাকে খুঁজে পাব।’
আশিশ কল কেটে দিল। মাহতিম বেশ কিছুটা চিন্তিত। ড্রাইভিং সিটে ছিল বর্ষণ। তাকে গাড়ি থামাতে বলল। আনিফা বাধা দিতেই বলল,’না গেলে সমস্যা হতে পারে। আমি এক সময় এসে দেখে যাব। আজ আর হচ্ছে না।’
বলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। একটা অটো নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
অহনা বসে বসে এসাইনমেন্ট তৈরি করছিল। এক পর্যায়ে গিয়ে কফি বানিয়ে আনলো। খেতে খেতেই বাকি কাজটা কমপ্লিট করার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ করেই পেটে কিছুটা ব্যথা অনুভব করল। ব্রুক্ষেপ না করেই কাজে মন দিল। কিন্তু আস্তে আস্তে ব্যথার পরিমাণটা বেড়ে গেল। মোবাইলে তারিখটা দেখেই কিছুটা চমকে ওঠল। যা ভেবেছে তাই হয়েছে। পিরিয়ড শুরু হয়েছে। বিছানা থেকে উঠে পড়ল। র’ক্তের ছোপ ছোপ দাগ বসে আছে। সব কাগজপত্র টেবিলে নিয়ে রাখল। চিন্তিত হয়ে পড়ে অহনা। দ্রুত ব্যাগে প্যাড খোঁজার চেষ্টা করল। অনেক খুঁজেও পেল না। নিশ্চয়ই ম্যাচে ফেলে এসেছে। মোহনাও নেই এখন, কী করবে বুঝতে পারছে না। আচমকা দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আঁতকে ওঠে। বাড়ির চাবি তো আনিফার কাছে তাহলে কে এলো? কোনোকিছু না ভেবেই অহনা ঘরের বাইরে বের হলো। মাহতিমকে আসতে দেখে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাহতিমও অহনাকে খেয়াল করল। দ্রুত অহনা ঘরে চলে এলো। মাহতিম যে কাজেই আসুক। তার কাজ শেষ করে চলে যাক। কথা বলবে না এখন। কিন্তু মাহতিম এসেই অহনার ঘরের সামনে দাঁড়াল। অহনা বিছানার দিকে তাকায়। এক মুহূর্তও দেরী না করে খাটের ওপর বসে পড়ে। যেখানটা নোংরা হয়েছে সেখানটায় বসল। অহনার এমন আচরণ দেখে মাহতিম বেশ অবাক। সে ঘরে আসতেই অহনা তাড়াতাড়ি বলল,’তুমি হঠাৎ আসলে কেন? কোনো কাজ আছে বুঝি?’
‘হ্যাঁ! একটা ফাইল নিতে হবে। কিন্তু তুমি আমাকে দেখে এমন পালাচ্ছ কেন?’
অহনা ঘেমে যায়। এসি চলছে নিজ গতিতে, তবুও ঘেমে একাকার। ঢোক গিলে বলল,‘তুমি ভয়ঙ্কর কোনো প্রাণী নও। আমি কেন ভয় পাব? নিজে যে কাজে এসেছ সে কাজে যাও। আমাকে বিরক্ত করো না।’
‘আমি তোমাকে বিরক্ত করছি? আমি আসাতে কি তুমি খুশি হতে পারোনি?’
‘খুশি হওয়ার কী আছে? তুমি তোমার কাজে যাও। আমিও কাজ করি।’
মাহতিম পেছন ফিরে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই অহনা শ্বাস নিল। বুকে হাত রেখে উঠার জন্য প্রস্তুত হতেই মাহতিম পুনরায় ফিরে তাকাল। অহনা দ্রুত আবার নিজের পজিশনে চলে যাও,
‘কী হলো? যাচ্ছ না কেন?’
‘তুমি আমাকে বিদায় করতে চাইছ কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে? তুমি কি অসুস্থ?’
মাহতিম অহনার কাছে এগিয়ে আসে। অহনা দ্রুত হাত বাড়িয়ে বলল,‘আমার থেকে দূরে থাকো। আমি অসুস্থ না। তুমি নিজের কাজে যাও দয়া করে। এতো কথা বাড়াও কেন?’
মাহতিম আরো কিছুটা এগিয়ে আসে। অহনার কপালে হাত দিয়ে দেখল,
‘কই জ্বরতো নেই। তাহলে এত ঘামছ কেন? এই ঠান্ডার মধ্যেও তোমার এমন অবস্থা কেন? কী লুকাচ্ছ আমার থেকে?’
অহনার বিরক্তিতে মুখ খিঁচে আসে,
‘এত কথা বাড়াও কেন? চলে যাও না প্লিজ।’
‘ঠিক আছে, যাচ্ছি! কিছু দরকার লাগলে বলবে আমায়।’
‘হ্যাঁ, যাও যাও।’
অহনা হাঁফ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এই অল্পক্ষণে অবস্থা আরো নত। মাহতিম দরজার সামনে গিয়েই আবার ফিরে এলো,
‘ওঠো এখান থেকে।’
অহনা আঁতকে ওঠে। নড়ল না,
‘পারব না।’
‘আমি বলছি ওঠো।’
কিছুটা ভেবে বলল,
‘তুমি যাও। আমি উঠে যাব।’
‘ আমি এখন বলছি। সে কখন থেকেই দেখছি বিছানা দখল করে বসে আছ। সমস্যা কী?’
কথাটা বলেই মাহতিম অহনার হাত ধরে তাকে টেনে তুলল। সাথে সাথেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। দ্রুত হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,‘সরি! আমি বুঝতে পারিনি।’
অহনা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে মাহতিমের গলা চেপে ধরুক। সবকিছুতে এতো কৌতুহল ভালো নয়। মাহতিম পুনরায় বলল,‘তোমার কোনো সাহায্য লাগবে?’
অহনা রাগ আর কন্ট্রোল করে রাখতে পারল না। মাহতিমের টাই টেনে ধরে,‘সবকিছুতে এতো কৌতুহল কেন তোমার? বিরক্ত লাগছে আমার।’
মাহতিম গম্ভীর হয়েই বলল,‘এতে এতোটা ভাবারতো কোনো বিষয় নেই। এটা স্বাভাবিক বিষয়। ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ দেখতে পাচ্ছি না। তুমি এমন অবস্থায় কিভাবে বসেছিলে? কষ্ট হচ্ছিল না? আমাকে ল’জ্জা পাচ্ছিলে?’
অহনা চুপ করে রইল। মাহতিম ঠিকই বলেছে। বিষয়টা স্বাভাবিক নেওয়া উচিত ছিল। মাহতিম পুনরায় বলল,’চেঞ্জ করে নাও তুমি। আর শোনো, পিরিয়ড ভয় বা লুকানোর কোনো বিষয় নয়। এটা স্বাভাবিক! ল’জ্জা পাওয়ার তো কোনো ব্যাপারই থাকছে না। কী অবস্থা হয়েছে দেখো! দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি মেডিসিন আনছি।’
অহনা ক্ষেপে গেল। বলল,
‘ঠিক আছে। সাহায্য করার সখ থাকলে এখনই করো। দোকানে যাও আর স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আসো। আমার কাছে নেই।’
‘আমি?’
‘ হ্যাঁ! তুমিই। যাও এখন।’
মাহতিম কোনোরকমে বলল,‘ঠিক আছে।’
বলেই মাহতিম ঘড়ির দিকে তাকাল। সময় গড়িয়েছে। একটু পরেই হয়ত আশিশ আবার কল করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে অহনার তাকে বেশি প্রয়োজন। নিজের কাজ ফেলে সে ফার্মেসীতে যায়। কখনো না কেনার কারণে কিছুটা ইতস্তত করছিল। পরপরই অহনার কথা মনে হতেই দোকানিকে বলল,’ন্যাপকিন লাগবে।’
‘কোনটা চাই?’
মাহতিম চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,‘যেটা আরামদায়ক হবে সেটাই দিন।’
ন্যাপকিন এবং ঔষধ কিনে রওনা দিতেই আশিশের কল আসে পুনরায়। কল ধরেই বলল,‘একটু সমস্যায় আছি। আমার যেতে দেরী হবে।’
আশিশ খুব রেগে গেল। কিন্তু মাহতিম কল রেখে দেয়। সে অহনার চিন্তায় আছে এখন। ফিরে গিয়েই অহনাকে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,’সাবধানে!’
অহনা মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। এই সময়ে মাহতিম বিছানার চাদরটা পরিবর্তন করে নেয়। খেয়াল করল এসাইনমেন্ট পুরোটাই এখনো বাকি। অহনা বেরিয়ে আসতেই বলল,‘এখন ঠিক আছ?’
অহনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। কেন জানি সে মাথা নিচু করেই আছে। তাকাতে পারছে না। মাহতিম দ্রুত বলল,‘ঔষধটা খেয়ে নাও। আমি এসিটা কমিয়ে দিচ্ছি। কিছু লাগলে আমাকে বলো, আমার তেমন ধারণা নেই।’
‘না! আর কিছু লাগবে না। তুমি যেতে পারো।’
মাহতিম আর দাঁড়াল না। নিজের ঘরে গেল। অহনা পুনরায় এসাইনমেন্টে মনোযোগ দিল। মাহতিম ফাইল নিয়ে বের হয়ে এলো। পুনরায় অহনাকে দেখতে এলো। সে বারবার কোমরে হাত রেখে ক্লান্ত চোখে পেপারের দিকে দেখছে। মাহতিম দাঁড়াল কিছুক্ষণ। অহনা টেবিল ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। একটু বিশ্রাম নেওয়া জরুরী। একটানা বসে কাজ করতে পারবে না। অহনা উঠে বিছানার কাছে যেতেই নতুন চাদর খেয়াল করল। এতক্ষণ তার মনেই ছিল না। মাহতিমের কথা ভেবে আপনমনে হাসল। আচমকা চিনচিনে ব্যথা অনুভব হতেই মাথাটাও কেমন চক্কর দিয়ে ওঠল। পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মাহতিম আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। অহনাকে ধরে বিছানায় বসালো। অহনা চোখ-মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,‘তুমি এখনো যাওনি কেন?’
‘তোমায় ফেলে কী করে যাই? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?’
‘আমাকে ছেড়ে দাও। তোমার খারাপ লাগতে পারে।’
‘পবিত্রতাকে ছুঁতে কি কারো খারাপ লাগে? আমি যাব না। তোমার সাথেই থাকব।’
‘চাকরি যাবে তোমার।’
‘চাকরি গেলে কি তুমি আমাকে মেনে নেবে না?’
‘এমন প্রশ্ন করছ কেন? আমিতো সকল প্রকারের থাকতে চাই।’
‘তাহলে এখন কথা না বলে শুয়ে পড়ো। আমি গরম গরম কিছু নিয়ে আসছি। খেলে দেখবে ভালো লাগবে।’
মাহতিম চলে যেতে চাইলেই অহনা বাধা দিল। আচমকা জড়িয়ে ধরল মাহতিমকে,
‘এত সুখ কি সইবে আমার কপালে? ভয়টা যেন বেড়ে যাচ্ছে।’
‘ভয় কিসের আমি থাকতে? তোমাকে আগলে রাখতে আমিই যথেষ্ট। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি। এটা সস্তা কোনো শব্দ নয়। তোমাকে সুখী করতে লড়াই করব পৃথিবীর সাথেও।’
হঠাৎ করেই কারো কাঁশির শব্দ শুনতেই অহনা ছিটকে দূরে সরে যায়। মাহতিম আশিশকে দেখে অবাক হয়ে যায়। মাহতিম কিছু বলার আগেই আশিশ বলল,
‘তুই কাজ ফাঁকি দেস, সেটা আজ জানতে পারলাম। এখানে এসে কয়েকবার ডাকলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। ব্যস্ততার কারণ তাহলে বুঝলাম।’
‘তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি আসলে…’
‘কিছু বুঝাতে হবে না। ফাইলটা চাই আমার।’
টেবিলের ওপরে দেখতে পেয়েই সেটা হাতে নিল। এবং মৃদু হেসে চলে গেল। মাহতিম আসার সময় দরজা দেয়নি বলে খোলাই ছিল। সে সুযোগেই আশিশ প্রবেশ করেছে। মাহতিম আশিশের পেছন পেছন গেল। কিন্তু আশিশ কোনো কথা শুনতে চাইল না। তাড়া থাকায় দ্রুত গাড়িতে ওঠে বসলো। তবে যাওয়ার আগে শুধু জিজ্ঞেস করল,‘মেয়েটা কে? সেই মেয়ে?’
মাহতিম মাথা নাড়াল, বলল,‘হ্যাঁ! অহনা। যার কথা বলেছিলাম তোকে।’
আশিশ হাসলো। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট করল। তার হাসি দেখে এটা প্রতিয়মাণ যে, সে কোনো সূত্র পেয়েছে।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership