ছায়া মানব ২ ৩৯.

0
277

ছায়া মানব ২

৩৯.
বিকেলে কলেজ থেকে ফিরল অহনা আর মোহনা। তাদের আজ একটু দেরি হয়ে গেল। ওসমান, ফারাহ, তমা, রাবি এদের সাথে আড্ডা দিয়েছে খানিকক্ষণ। আসতে আসতে সন্ধ্যা প্রায়। বাড়িতে এসেই দেখল সোফায় বসে আছে ইমন। মোহনাকে নজরে পড়তেই ইমন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে যায় গত দিনের কথা। বুকের যেপাশটায় মোহনার হাত লেগেছিল সে জায়গাটায় এখনো চিনচিনে ব্যথা। হৃদস্পন্দন হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। সে দ্রুত পকেট থেকে ফোনটা বের করেই মিছেমিছি হ্যালো হ্যালো করতে করতে চলে যায় আড়ালে। মোহনার ভাবগতি দেখা গেল না। গতদিন মনমেজাজ ভালো ছিল না বলে খারাপ ব্যবহার করেছে‌। আজ আর সেটা নেই। তবে তার কাজ দেখে অনেকটাই মোহিত। নিজের ঘরে এসে শাওয়ার নিল‌।
অন্যদিকে অহনা এসেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। গতরাতে বেশি ঘুমাতে পারেনি তার ওপর সকাল সকাল কলেজ করে ক্লান্ত। তাই ফ্রেশ না হয়েই সোজা ঘুম। মাহতিম‌ও অফিসে গেছে। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে বসে থাকা তার পছন্দ নয়। তাই কাজে মনোযোগ দিতেই চলে গেল।

আনিফা চা নিয়ে এসে দেখে ইমন নেই। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। মোহনাও নিচে নেমে এসেছে। আনিফা মোহনাকে জিজ্ঞেস করল,‘ইমনকে দেখেছিস?’

মোহনা কিছুটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,‘আমি কি তার খবর নিয়ে বসে থাকি নাকি?’

‘সেটা বলিনি। আমি ওর জন্য চা করে নিয়ে এলাম আর ও চলে গেল?’

মোহনার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো, বলল,‘বারান্দায় গেছে দেখেছি, তুমি ডেকে আনো।’

আনিফা ইমনকে ডাকার জন্য যেতেই মোহনা ঝটপট কিছু লবণ এনে ইমনের চায়ের কাপে দিয়ে দিল। তারপর স্বাভাবিক হয়েই অন্যপাশে গিয়ে বসল। মোবাইলে এমনভাবে মনোযোগ দিল যেন ইমন বুঝতে না পারে। আনিফা ইমনকে ডেকে আনে। অপর পাশে মোহনাকে দেখে কিছুটা বিচলিত হয় সে। আনিফা জোর করে তাকে বসিয়ে বলল,‘চা টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নাও। মাহতিম আসলে তার সাথে কথা বলে নিও‌।’

ইমন‌ও কাঁপা কাঁপা হাতে চা নেয়। একবার মোহনার দিকে তাকিয়ে একহাতে চশমাটা ওপরে তুলে অন্যহাতে চা মুখের সামনে ধরে। সাধারণ যারা চা পছন্দ করে তারা ঘ্রাণ দেখেই বুঝে নিতে পারে চা টা কেমন হয়েছে। ইমন‌ বুঝতে পারল চায়ে কিছু সমস্যা আছে। সে মুখের কাছে নেওয়ার আগেই একবার মোহনাকে দেখল। মেয়েটা তাকেই দেখছে। ঠোঁটে কামড় দিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন ইমন খাবে। মোহনার নজর স্বাভাবিক না দেখে ইমন চা রেখে দেয়। সে কাপের গায়ে লবণ দেখেছে। আন্দাজ করল এটা মোহনার কাজ। মোহনার মুখ মলিন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ইমন ইচ্ছে করেই হঠাৎ চায়ে চুমুক দেয়। মোহনার চোখে-মুখে দুষ্টুমি ফুটে ওঠে। সে ইমনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। অথচ ইমন পরপর তিনবার চায়ে চুমুক দিল। মোহনা ধপ করে উঠে দাঁড়ায়। ইমনের কোনো ভাবগতি না দেখে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। মনে মনে বলল,‘তাহলে কি লবণের পরিমাণ কম ছিল? না কি ওনি লবণ কম খান?’

ইমন আরেক চুমুক দিয়েই ফোন চ্যাক করে। কানে দিয়েই বারান্দায় যায়। মোহনা বোকা বনে গেল। ইমনের কিছুই হলো না দেখে নিজেই চায়ের কাপটা হাতে নেয়। দেখল কাপের গায়ে এখনও লবণ লেগে আছে। মোহনা চারিদিকে তাকিয়ে চায়ের স্বাদ টেষ্ট করার জন্য মুখে দিল। সাথে সাথেই তার চোখ-মুখ কুঁচকে এলো। যেন গলা জ্বলে গেল। সাথে সাথেই কেউ তাকে পানি এগিয়ে দিল। গ্লাসটা হাতে নিয়ে কিছুটা পানি খেয়ে পাশে তাকাতেই দেখল ইমন দাঁড়িয়ে। ইমন পানিটা দিয়েই চলে যেতে চাইল। কিন্তু মোহনা তার হাত চেপে ধরল। কেঁপে উঠল ইমনের বুকের পাঁজর। থেমে যায় সে। মোহনা অকপটে বলল,‘ইচ্ছে করে এমন করেছেন তাই না? না কি লবণ বেশি খান?’

ইমন কোনোরকমে বলল,‘আমি লবণ একদম‌ই খাই না। বারান্দায় গিয়ে ফেলে এসেছি মুখে জমা করা চা টা। আমি আপনাকে নারাজ করতে চাইনি‌। কিন্তু ভাবিনি এক‌ই চা আপনি ..’

মোহনা সাথে সাথেই তার হাত ছেঁড়ে দেয়‌। সত্যিইতো বলেছে! সে কী করে অন্যের মুখের এঁটো করা চায়ে মুখ দিয়েছে। আবার হাত‌ও ধরেছে। মোহনা টালবাহানা করে বলল,‘আমি আসলে কালকের জন্য সরি। সেটা বলতেই এসেছিলাম।’

ইমন‌ও বলল,‘সরি বলার এটা কেমন স্টাইল?’

‘আপনার না জানলেও চলবে। সরি পেয়েছেন, এতেই খুশি থাকেন‌। কৈফিয়ত দিতে পারব না।’

ইমন‌ও আর কথা বলল না। সে কেমন দিশেহারা। কালকের পর থেকেই তার ভেতরকার পরিবর্তন যেন অন্যরকম। সে মোহনার কাছে আসতে চাইছে অথচ পারছে না। হয়ত তার সাহসে কুলাচ্ছে না নতুবা মোহনার জেদের কাছে হার মেনে যাচ্ছে। আর একটাও কথা না বাড়িয়ে ইমন বাইরে চলে গেল। মাহতিম আসলেই আবার একবার কষ্ট করে দেখা করে যাবে বলেই ঠিক করল। মোহনাও মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল।

বাইরে যেতেই ইমনের ফোনে কল আসে। তার ভার্সিটিতে থাকাকালীন বন্ধু রিয়াজ। কথার এক পর্যায়ে বলল,‘একটা প্রশ্ন করব। এটা আমাদের টপিকসের বাইরে। কিন্তু আমার হয়ত জানা জরুরি।’

‘কী বলবি বল। আমি সব বিষয়ে ধারণা রাখি।’

‘একটা মেয়ের সামনে গেলে কেন হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়? মেয়েটা খুব জেদি, তাও তার রাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। যখন প্রথম স্পর্শ করে তখন থেকেই এই সমস্যাটা শুরু হয়।’

‘প্রেমে পড়েছিস তুই। আমি সিউর! অবশেষে তুইও প্রেমে পড়লি, আমার সত্যিই আনন্দ লাগছে। মেয়েটা কে?’

‘তেমন কিছুই নয়। আমি শুধু আমার উত্তর চাইছি।’

‘আমার কথা মিথ্যে নয়। তুই নিজেই সেটা খুঁটিয়ে দেখতে পারিস। তবে এক্ষেত্রে তোর সাহসের দরকার।’

‘আমি এমনিতেও সাহসী!’

‘কেমন সাহসী সেটা আমিও জানি। সে সাহস দিয়ে হবে না। তোকে মেয়েটার একদম কাছাকাছি যেতে হবে। যদি দেখিস হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে এবং মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে তাহলে ভাববি প্রেমে পড়েছিস।’

‘একটু আগে আমি সেটাই বলেছি। তুই আমার কথাটাই ঘুরিয়ে বললি।’

‘তাহলে নিঃসন্দেহে তুই প্রেমে পড়েছিস। এবার মেয়েটাকে পটিয়ে নিলেই হবে। আর কতকাল সিঙ্গেল থাকবি? এবার অন্তত বিয়ে পর্যন্ত যাওয়ার জন্য একটা মেয়ে খোঁজ।’

‘কিন্তু কী করে? আমার তো মোহনাকে দেখলেই ভয় করে। সবসময় রেগে থাকে। আমাকে পছন্দ‌‌ও করে না।’

‘তার মানে আমার ফিউচার ভাবীর নাম মোহনা। মোহনার প্রিয় হতে হলে তোকে তিনটা টিপস্ ফলো করতে হবে।’

‘কী কী?’

‘আমি লিখে দিচ্ছি। তুই প্রয়োগ করে দেখবি। যদি এতেও কাজ না হয় তাহলে ভেবে নিবি মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড তোর থেকেও ভালো খেলোয়াড়।’

‘কিসের খেলোয়াড়?’

‘প্রেমে পারদর্শী আর কী। তুই এখন আমার কথামতো কাজ কর।’

ইমন কিছুটা খুশি হলো। ভাবতে থাকে, সত্যিই কি সে প্রেমে পড়েছে? সেও সবার মতো কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে? তার ভাবনার ছেদ ঘটল মাহতিমের আগমনে। মাহতিমের সাথে আলোচনায় বসতে হবে তাই পুনরায় চৌধুরী বাড়িতে পা রাখে। মোহনা সোফাতেই বসে ছিল‌। পুনরায় ইমনকে দেখে চশমাটা ঠিক করে চলে গেল। মোহনার দেখাদেখি ইমন‌ও চশমা ঠিক করল।
দীর্ঘ আলোচনা শেষে ইমন যখন বাড়ি যাবে তার আগেই ইসহাক কল করে মাহতিমকে। ইসহাকের কল পেয়ে মাহতিম ইমনকে ইশারা দিয়ে বসতে বলল। ইসহাক জানতে চাইল ইমনের ব্যাপারে। বলল,‘বিকেলে বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। তাই তোমাকেই কল করলাম জিজ্ঞেস করার জন্য। জানোতো, ছেলেটা কেমন প্রকৃতির। তোমাদের বাড়ির মেয়েকে নিয়েও হয়ত এতোটা চিন্তা করো না তোমরা আমি যতটা ছেলেকে নিয়ে করি। সে এক্সি’ডেন্টের পর থেকে ছেলেটা আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। ভুলভাল কাজ করে সবসময়। তাই ভয় পাই। সে কি ঠিক আছে?’

মাহতিম কিঞ্চিত হেসে বলল,‘একদম ঠিক আছে। আমার জানামতে সে যে এপার্টমেন্টে থাকে সেখানে তার কিছু বন্ধুও থাকে। আশা করি ভালোই আছে।’

‘স্ট্যান্ডের কাছেই?’

‘হ্যাঁ! সেখানেই থাকে।’

‘ও আমাকে বলেছে বাসাটা চেঞ্জ করবে। সেখানকার ছেলেরা এবং পরিবেশ ভালো নয়। ওর ক্ষতি হতে পারে। আমি ভয় পাচ্ছি ওর জন্য।’

‘আপনি চিন্তা করবেন না। অন্য একটা বাড়ি নিয়ে নেবে না হয়। আমি বলব। তাছাড়া আপনি আসা পর্যন্ত আমাদের এখানেও থাকতে পারে। আমাদের পরিবারের সাথে। একা একা কেন অন্য কোথাও থাকবে?’

‘না, না, তোমাদের বাড়িতে থাকার প্রয়োজন নেই। তুমি একটু কষ্ট করে তাকে নিরাপদ একটা বাড়ির ব্যবস্থা করে দাও।’

‘সমস্যা নেই। আপনি এসেই না হয় সব ঠিক করবেন। এখন যদি আমি অন্য কোথাও তাকে থাকতে বলি, সেখানে যদি ক্ষতি হয়?’

এসব কথোপকথন শুনে ইমনের মাথা ঘুরে গেল। মনে মনে বাবার ওপর তার রাগ হলো। তার বয়সী একটা ছেলের কাছে তাকে দুর্বল প্রমাণ করছে। অথচ সে ছেলের বোনের প্রেমেই পড়েছে। ইমন সাথে সাথেই বলল,‘আমি বড়ো হয়েছি বাবা। চিন্তা করো না।’

মাহতিম ইসহাককে বলেই দিল,‘আঙ্কেল, আর কোনো কথা নয়। ও আমাদের বাড়িতেই থাকুক। মাত্র দশ পনেরো দিনের‌ইতো ব্যাপার।’

ইসহাক আর অমত করেনি। কিন্তু ইমনের কান জ্বলে ওঠল। তার মনে হলো মোহনার কথা। মেয়েটা তাকে এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারবে না। জানতে পারলে গলা টিপে ধরবে। যেহেতু সে প্রেমে পড়েছে তাই বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়ি থাকাটাও উপযুক্ত মনে করল না। মাহতিমকে বলায় সে কিছুতেই মানল না। বুদ্ধি করে ইমন বলল,‘ঠিক আছে, আমি তাহলে আমার জিনিসপত্র নিয়ে আসি।’

‘ওকে, চলো, আমিও যাই তোমার সাথে।’

‘আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি একাই যেতে পারব।’

‘তোমার বাবা বলেছে চোখে চোখে রাখতে। তাই ছাড়তে পারব না।’

না চাইতেও ইমন মাহতিমের সাথেই র‌ওনা দিল। পুরো রাস্তাতেই সে কোনো না কোনো ভাবে মাহতিমকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। মাহতিম তাকে আবার নিজের সঙ্গে করেই নিয়ে এলো। সেও চায়নি ইমনের কোনো ক্ষতি হোক। তার আরেকটা মতলব ছিল। বাড়িভর্তি সবার সাথে মেলামেশা করলে হয়ত ইমন তার পুরনো স্মৃতি ভুলতে পারবে। ভয় ছেড়ে সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে পারবে। ভয়কে জয় করার জন্য একটা পরিবার দরকার।

বাড়ি ফিরেই মাহতিম আনিফাকে সবটা বলল। পরিস্থিতি স্বাপেক্ষে ইমনকে দেওয়া হলো মোহনার পাশের ঘরটা। একটু অগোছালো ছিল তাই মাহতিম গিয়ে অহনাকে ডেকে আনলো। দুজন মিলে পুরো ঘরটা তৈরি করে দিল ইমনের জন্য। ইমন চিন্তা করেই শেষ। এতক্ষণ ধরে শুধু দাঁত দিয়ে নখ খুঁটেছে। সব সমাপ্ত করে অহনা তার হাল দেখে বলল,‘পুরো আঙুলটাই খেয়ে ফেলবেন দেখছি।’

ইমন বিচলিত হয়ে বলল,‘এখানে আমার ভয় করছে।’

মাহতিম তার পিঠে চাপড় মেরে বলল,‘পুরুষ মানুষের আরও ভয়? তুমি কি মেয়ে নাকি?’

শেষের কথাটা অহনার দিকে তাকিয়ে বলল। অহনাও ঠেস মারা বুঝতে পেরে বলল,‘ভাইয়া আপনার ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আপনার এই বোন সামনের তৃতীয় ঘরেই আছে। দরকার পরলেই ডাকবেন। তাছাড়া আপনার পাশের ঘর মোহনার। অর্থাৎ আপনার চারপাশেই আমরা মেয়েরা আছি, ভয় করার কোনো চান্স‌ই নেই।’

মাহতিম বলল,‘আমার ভয় করছে এখন। তাই তোমার উচিত আমার সঙ্গ দেওয়া।’

ইমনকে বিদায় জানিয়ে অহনা আর মাহতিম একচোট মারপিট করতে করতেই চলে গেল। ইমন ভয়ে জড়োসড়ো। হঠাৎ করেই চমকে উঠল কাউকে দেখে। মোহনা দরজার সামনে বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাক্ষাৎ ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠে ইমন।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here