কথা দিলাম ‘ 🌸❤️ ||পর্ব ~ ২০|| @কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

0
257

‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ২০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

__ভিকি দা, ক্লাইন্ট এসে গেছে মিটিংয়ের জন্য। তুমি যাব…

মেয়েলি গলার স্বর পেয়ে সিয়ারা আর আধভিক দুজনেই হুঁশে ফিরলো এবং তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়ালো। হঠাৎই সিয়ারার মনে হলো, এই গলার স্বর ওর পূর্ব পরিচিত। গলার স্বরটা চিনতে পেরে ধীরে ধীরে সেদিকে তাকালে সিয়ারা অবাক হয় না। কারণ ওর ধারণা সঠিক, ও যাকে ভেবেছিলো সেই ওর চোখের সামনে উপস্থিত।

সিয়ারা: দিয়া!

সিয়ারা অবাক না হলেও দিয়ারা তাজ্জব হয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি? সে সত্যি তাঁর দিদিকে নিজের চোখের সামনে দেখছে? দিয়ারা ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে একসময় পায়ের গতি বাড়িয়ে সিয়ারাকে জড়িয়ে ধরলো। সেই মূহুর্তেই আধভিক ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। সিয়ারা সেটা দেখেও চুপ করে থাকে। ধীরে ধীরে বোনকে জড়িয়ে ধরে।

দিয়ারা: কোথায় ছিলি দি তুই? কোথায় ছিলি এতদিন? (কেঁদে কেঁদে)

সিয়ারা: তোদের থেকে অনেক দূরে।

দিয়ারা: কিন্তু কেন? কেন এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে গেলি তুই?

সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) বাহ রে! আমি না গেলে তোর যে তোর ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া হতো না। আমি চলে গেছি বলেই তো তুই তাঁকে নিজের করে…

দিয়ারা: (সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে) একদম না জেনে কথা বলিস না দি। তুই নিজের ইচ্ছায় তোর ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে গেছিলি। খুব তো প্রথমে আমাকে বড়ো মুখ করে বলেছিলি ফিলিংসটা খেলার জিনিস নয়। তাহলে শেষ মুহুর্তে গিয়ে ওই কাজটা কি করে করতে পারলি?

সিয়ারা: এমন ভাবে বলছিস জানো কিছুই জানিস না তুই?

দিয়ারা: মানে? কি জানি আমি? কি বলছিস?

সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) তুই চাসনি আধভিককে বিয়ে করতে?

দিয়ারা: (অবাক হয়ে) একদমই না! আমি কেন ওকে বিয়ে করতে চাইবো? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোর? তাই যদি হতো তাহলে আমি অনেক আগেই জানতে পেরেছিলাম তোদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। তোরা রিলেশনশিপে ছিলি, তো তখনই আমি তোকে বলতাম। যেমন প্রথমে বলেছিলাম যে আমার ওকে চাই।

সিয়ারা: দিয়া এখন এসব কি বলছিস তুই? তুই যদি আধভিককে বিয়ে করতে না চাইতি তাহলে মা আমাকে এসে কেন বললো যাতে আমি চলে যাই? সরে যায় তোদের মাঝখান থেকে সারাজীবনের মতো।

দিয়ারা: হোয়াট? মা এটা তোকে কীভাবে বলতে পারে? আমি তো কখনওই মা কে বলিনি যে আমি ভিকিদাকে বিয়ে করতে চাই। ইভেন মা তো এটাই জানে না আমি ভিকিদাকে পছন্দ করতাম। আমি কখনোই বলিনি।

সিয়ারা মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরে। সেইদিনের কথা সিয়ারা প্রথমে বলে যে ওর মা ওকে এসে কি বলেছে।

ফ্ল্যাশব্যাক…………………….…………

সিয়ারা নিজের ঘরে তৈরী হওয়ার পর নিজেকে একটু আয়নায় দেখছিলো হাসজ্জ্বল মুখে। ঠিক সেই সময় ওর মা ওর ঘরে আসে। মাকে দেখে সিয়ারা হাসিমুখে সেদিকে ফিরে বলে,

সিয়ারা: মা তুমি এখানে? তুমি থাকবে তো তাহলে আমার বিয়েতে?

মা: না। আমি তোর বিয়েতে থাকবো না।(গম্ভীর গলায়)

সিয়ারা: মা তোমাকে বললাম তো এসব পুরনো নিয়ম তোমাকে মানতে হবে না। তারপরেও তুমি…

মা: তুই বিয়েটা করলে তো তোর বিয়েতে থাকার প্রশ্ন আসবে।

সিয়ারা: মা? তুমি এসব কি বলছো? আমি তো কিছুই বুঝতে…

মা: তুই এই বিয়েটা করবি না সিয়া।

সিয়ারা জানো আকাশ থেকে পরে মায়ের কথা শুনে। এক পা পিছিয়ে যায় ও কিন্তু ওর মা স্থির ভাবে নীচের দিকে তাকিয়ে আছেন। ও চুপ করে থাকলে ওর না ওর দিকে মাথা তুলে বলতে শুরু করেন,

মা: আমি চাই না তুই এই বিয়েটা করিস। তোর জায়গায় বিয়ের কনে আমার মেয়ে দিয়া হবে।

সিয়ারা: আর আমি? আমি তোমার মেয়ে না মা?

মায়ের কথা শুনে চোখে জল ভরে উঠেছে সিয়ারার। কিন্তু ওর মা সেসবের পরোয়া না করে বললো,

মা: সৎ মেয়ে। তুই আমার সৎ মেয়ে সিয়া। যেখানে আমার মেয়ের জন্য এত ভালো সম্বন্ধ আসেনি সেখানে তুই কীভাবে এতো ভালো সম্বন্ধে, ভালো ঘরে বিয়ে করে যেতে পারিস? ভালো ছেলে, বড়ো বাড়ি, গাড়ি কোনো কিছুর অভাব হবে না এই ছেলের ঘরে যে মেয়ে যাবে তাঁর। আমি এইসব সুখ আমার মেয়ের জন্য চাই।

সিয়ারা: মা আভি আমাকে ভালোবাসে, দিয়াকে নয়। এইসব টাকা পয়সা দিয়ে সুখে থাকা যায় না মা, আসল সুখ তো ভালোবাসাই দিতে পারবে।

মা: আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস না সিয়া। আমি যখন বলেছি তুই এই বিয়ে করবি না তখন তুই করবি না।

সিয়ারা: এমন হয় না মা। তোমার যখন আপত্তি ছিল তাহলে প্রথমেই কেন বলোনি? এইভাবে শেষ মুহুর্তে এসে তুমি বলছো আমার জায়গায় দিয়াকে বিয়ে করতে বসাবে? মা আভি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমি দিয়াকেও বলেছি, তোমাকেও বলছি! আমি ওর ভালোবাসা নিয়ে খেলতে পারবো না, অসন্মান করতে পারবো না ওকে। এমন করল ওর অপমান হবে, ওর ভালোবাসার অপমান হবে যেটা আমি করতে পারবো না কারণ আমিও ওকে ভালোবাসি। ওকে আর কোনো কষ্ট পেতে দেবো না আমি।

সিয়ারা কথাটুকু বলে চোখের জল মুছে মাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। দরজার কাছে পৌঁছতেই সিয়ারা আটকে যায় ওর মায়ের কথা শুনে,

মা: আমার দিব্যি আজ এই বিয়ে তুই করবি না। যদি করিস তাহলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি। তোর মা মরে যাওয়ার পর থেকে তোকে কখনও মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি। কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছি, দিয়ার আর তোর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করিনি। কখনও কোনো কিছুর দাবিও করিনি তোর কাছে তাহলে আজ আমি যেটা চাইছি সেটা আমাকে দিতে পারবি না তুই?

সিয়ারা: (মায়ের দিকে ফিরে) আজ কেন ভেদাভেদ করছো মা? যেই সুখটা দিয়ার জন্য চাইছো, সেই সুখটা আমার জন্য কেন চাইতে পারছো না? আমিও তো তোমাদের জন্য কম কিছু করিনি বলো? হঠাৎ করেই বাবা চলে যাওয়ার পর তুমি যখন হিমশিম খাচ্ছিলে দুজনের পড়াশোনা চালাতে তখন আমি নিজের পড়া ছেড়ে কাজে নেমেছি। দিন রাত পার্ট টাইম জব, টিউশন করে সংসার আর বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব পালন করেছি। তোমার উপর কোনো চাপ আসতে দিইনি। নিজের অধিকারের সব কিছু প্রথম থেকে দিয়াকে দিয়ে দিয়েছি তারপরেও আজ তুমি ভেদাভেদ করছো? বলছো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ওর হাতে তুলে দিতে?

মা: হ্যাঁ বলছি। কারণ তুই আমার নিজের নয়। আমি আমার নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের কথাই দেখবো আগে কারণ এটা সারাজীবনের বিষয়।

সিয়ারা: (মায়ের পা জড়িয়ে) মা তুমি এমন করো না মা। আমি তোমার পায়ে পরছি তুমি এমন করো না। তোমার ধারণা নেই এমনটা করলে কতোটা ক্ষতি হয়ে যাবে আভির। ওর জীবনে ও নিজের কাছের মানুষকে অনেক আগেই হারিয়েছে। অনেক সাহস করে আমাকে ভালোবেসেছে নিজের ভয় কাটিয়ে। ও খুব ভয় পায় কাছের মানুষ হারানোর, আমাকে হারানোর। ও সহ্য করতে পারবে না এসব। প্লিজ? প্লিজ আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি? আমার আভির থেকে আমাকে আলাদা করো না।

সিয়ারার মা পিছন দিকে সরে গেলে সিয়ারা মেঝেতে দু হাত ভর দিয়ে বসে পরে। মায়ের দিকে তাকালে কোনরকম মায়া বা মমতা সে দেখতে পায় না। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

সিয়ারা: আভি আমাকে ভালোবাসে মা, পাগলের মতো ভালোবাসে। আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে ও কখনওই গ্রহণ করবে না। আমি চলে গেলে এই বিয়ে ও করবে না, দেখে নিও। বরং নিজের ক্ষতি করে ফেলবে। তাই তোমার কাছে আমি হাত জোড় করছি, নিজের মেয়ের জেদের খাতিরে এসব করো না।

মা: আধভিক কি করবে না করবে সেটা আমি বুঝে নেবো। তুই এই বিয়ে করবি না এটাই আমার শেষ কথা। যদি করিস তাহলে এই মুহুর্তে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো। আমার মেয়ে যদি না আধভিককে না পায়, আমি তোকেও আধভিককে পেতে দেবো না।

সিয়ারা জানো স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখের জলটা মুছে একভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে ও। এ কোন মারুপী মানুষকে দেখছে ও? যেই মা কে ও চিনত সেই মা তো কখনও এমন ছিলো না। বরং সে তো ওকে বকাবকি করতো যখন দিয়ার জেদের সঙ্গ দিতো ও। আর আজ সেই’ই দিয়ার অন্যায় জেদের প্রশ্রয় দিচ্ছে? সিয়ারার বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে। কর্তব্য নাকি ভালোবাসা, বেছে নেওয়ার এই জাতাকলে পিষে যাচ্ছে ও। সিয়ারা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে ওর মা সেন্টার টেবিলে থাকা ছুরিটা নিজের গলায় ধরে।

মা: তুই যদি মনে করিস আমি মিথ্যে বলছি তাহলে এক্ষুনি প্রমাণ করে দিচ্ছি আমি আমার কথা।

সিয়ারা দেখে তাঁর মায়ের গলা থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে ইতিমধ্যে। তড়িঘড়ি সে উত্তর দেয়,

সিয়ারা: আমি রাজি তোমার কথায়।

সিয়ারার মা ছুরিটা নামিয়ে ফেলেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে সিয়ারা বাধ্য হয় কর্তব্য বেছে নিতে। ছোটো থেকে যে মায়ের স্নেহে মানুষ করেছে তাঁর মৃত্যু এভাবে চোখের সামনে দেখতে পারবে না সে। তবে ভালোবাসা? সময়টা কম হলেও সিয়ারা মানুষটার নামে নিজের গোটা জীবনটা লিখে দিয়েছিল যে? তাঁকে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারলো সে? সিয়ারার মনে কথাটা আসতেই ও চোখ বুজে ফেললো।

মা: চিন্তা করিস না। এই বিয়ে আধভিক করবে। আমি কথা দিচ্ছি তোকে আধভিকের কোনো ক্ষতি আমি হতে দেবো না। চালাকি করিস না জানো? নিজের ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে তুই যদি ভাবিস এই বিয়ে আটকাবি তাহলেও কিন্তু এক পরিণাম হবে। আর যদি মরেই যাস তাহলেও সেই আধভিকই কষ্ট পাবে। তখন আরও সুবিধা হবে দিয়ার সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার, চান্স বেশি থাকবে আধভিকের রাজী হওয়ার। কিন্তু আমি তো মা, তাই তোকে মরতে বলতেও পারিনা আর দিতেও পারিনা। আমি দিয়াকে পাঠাচ্ছি, তুই সাজিয়ে দে ওকে তারপর চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি। এতো দূর চলে যাবি যাতে তোর নাগাল না পায় কেউ কখনও।

মা চলে যেতেই সিয়ারা ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ও। হাতের থেকে সোনার চুরি গুলো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তবে শাখা পলাটা খুলতে গিয়ে থেমে যায়।

সিয়ারা: আমি অনেক চেষ্টা করলাম তোমাকে কষ্ট না দেওয়ার কিন্তু পারলাম না আভি। আমি পারলাম না তোমার সাথে থাকতে। পারলাম না নিজের কথা রাখতে। পারলাম না! (ডুকরে কেঁদে উঠলো)

কিছুক্ষণ পর সিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের জল মুছে নেয়। চারিদিকে তাকিয়ে একটা কিছু খুঁজতে থাকে। খুঁজে পেতেই সেদিকে চলে যায় এবং সেটা হতে নিয়ে বলে,

সিয়ারা: আমার আভিকে আমি চিনি মা। ওকে জোর করা এতটা সহজ নয়। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলেও ও নিজের ক্ষতি করতে দুবার ভাববে না। এতো কষ্ট পাওয়ার পর এই কষ্টটা সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। তাই আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।

সিয়ারা চিঠি লিখতে শুরু করে। সেখানে সে বলে দেয় নিজের মা আর বোনের খেয়াল রাখবে আধভিক যদি ওকে ভালোবেসে থাকে তো। ও জানে এই কথাটা পরলে আধভিক নিজের ক্ষতি করতে পারবে না। চিঠি লেখা শেষ করে নিজের সাজ ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরে নেয় সিয়ারা।

অন্যদিকে,

দিয়ারা উপরে সিয়রাকে ডাকতে এসে নিজের মা কে সিয়ারার ঘর থেকে বেরোতে দেখলে মা কে বলে,

দিয়ারা: মা তুমি এখানে কি করছো? দি কি রেডি হয়নি? না মানে আমি তো জানতাম মেয়েরা তৈরী হয়ে গেলে মা’দের দেখতে নেই তাই বললাম।

সিয়ারার মা: তোর দিদি তোকে ডাকছে। (গম্ভীর গলায়)

দিয়ারা: ও আবার এখন কেন ডাকছে আমাকে? আমিই তো ওকে ডাকতে এলাম নীচে যাওয়ার জন্য। আশীর্বাদের আয়োজন…

সিয়ারার মা: বললাম তো তোকে তোর দি ডাকছে? যা! (ধমক দিয়ে)

দিয়ারা ঘাবড়ে গিয়ে আর কোনো কথা না বলে সিয়ারার ঘরে ঢুকে যায়। গিয়ে দেখে সিয়ারা একটা নরমাল শাড়ি পরে বসে আছে চুপ করে।

দিয়ারা: তুই রেডি হোসনি কেন?

সিয়ারা দিয়ারার দিকে ফিরলে দিয়ারা দেখে সিয়ারার মুখের মেক আপ আছে একটু আধটু। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে সিয়ারা হয়তো মেক আপটা তুলে দিতে চাইছে।

দিয়ারা: দি তুই কি মেক আপ তুলে দিচ্ছিস নাকি? আরে বিয়ের দিন তো এটুকু…কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমায়? বোঝানোর চেষ্টা করবি না একদম। দে আমি মেক আপ করিয়ে দিচ্ছি।

সিয়ারা দিয়ারার কোনো কথা শোনে না। চুপচাপ দিয়ারাকে ওর জায়গায় বসিয়ে। গয়নাগুলো এক এক করে পড়িয়ে দিতে শুরু করে। দিয়ারা অবাক হয়ে আটকাতে গেলে সিয়ারা চুপ করে বসতে বলে ইশারায়। পরানো শেষে দিয়ারা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়।

দিয়ারা: এই তোর মাথা খারাপ হয়েছে? আমাকে এসব গয়না কেন পরাচ্ছিস?

সিয়ারা দিয়ারাকে প্রথমে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে, পাশে থাকা ভেলটা মাথায় দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: সাজটা সুন্দর হয়েছে?

দিয়ারা: হ্যাঁ কিন্তু…

সিয়ারা দিয়ারাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে নেয়। তারপর দিয়ারার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

সিয়ারা: আমার ভালোবাসার মানুষটাকে তোর হাতে তুলে দিলাম। যত্নে রাখিস, খুব ভালোবাসিস। মানুষটা ভালোবাসার বড্ড কাঙাল।

সিয়ারা আর কিছু বলতে পারে না। এতক্ষণ নিজের কান্না চেপে রেখেছিলো কিন্তু এখন চোখ দিয়ে জল গাল গড়িয়ে পরতে শুরু করেছে। ও পিছন ফিরে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

পুরোটা সময় দিয়ারা সিয়ারাকে দেখে গেলো। সিয়ারার কথাগুলো ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে। সিয়ারা দরজা বন্ধ করলে সেই আওয়াজে দিয়ারা বাস্তবে ফিরে আসে।

দিয়ারা: কি আজে বাজে বলে গেলো দি? আমার হাতে তুলে দিলো মানে? কেন তুলে দিল? আর ওই বা কোথায় গেলো? কি হচ্ছে…ধুর!

দিয়ারা সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে সিয়ারার পিছু নিতে যায়। কিন্তু সেই সময় ওর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ওর মা।

দিয়ারা: মা তুমি জানো দির মাথাটা সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গেছে? ও আমাকে বলল, “আমার ভালোবাসার মানুষটাকে তোর হাতে তুলে দিলাম। যত্নে রাখিস, খুব ভালোবাসিস। মানুষটা ভালোবাসার বড্ড কাঙাল।” কোনো মানে আছে এইসব কথার? আমার হাতে কেন তুলে দেবে ও? কই একটা চলে গেলো। দেখি দাঁড়াও।

মা: কোথাও যাবি না তুই। সিয়ারা এই বিয়ে করতে চায় না। তাই ও তোকে নিজের জায়গায় বিয়ে করতে বলেছে।

দিয়ারা: কি? ও বলেছে এটা তোমাকে? (রেগে)

মা: হ্যাঁ। কিছুক্ষণ আগেই বলেছে।

দিয়ারা: ওকে তো আমি…ইয়ার্কি করছে নাকি ও? মানছি আমি প্রথমে বলেছিলাম যে আমার ভিকিদাকে চাই। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পেরেছে ভালোবাসার ক্ষেত্রে জেদ করলে হয় না। আর আমি ভিকিদাকে ভালো বাসিও না। তখন ও বললো যে ও এমন করবে না আর এখন শেষ মুহুর্তে এসব বলছে?

দিয়ারা সিয়ারাকে খুঁজতে যেতে নিলে ওর মা ওকে আটকে দেয়।

দিয়ারা: আমাকে কথা বলতে হবে মা ওর সাথে। যেতে দাও আমায়।

মা: তুই কোথাও যাবি না। এই বিয়েটা তোকেই করতে হবে।

দিয়ারা: কি? তোমারও মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?

মা: না। আমি যেটা বলছি সেটাই করবি তুই। নীচে গিয়ে বল সিয়ারাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। (একটু ধীরে) আর কিছু বলার দরকার নেই। (আবার স্বাভাবিক ভাবে) যা!

দিয়ারা: কিন্তু মা আমাদের দিকে খোঁজা উচিত। বেশি দূর যায়নি হয়তো ও।

মা: আমি যেটা বললাম সেটা কর চুপচাপ। নাহলে আমার মরা মুখ দেখবি বলে দিলাম। যা!

দিয়ারা ধমক খেয়ে চলে গেলো তবে ও বুঝতে উঠতে পারলো না মা এরকম ব্ল্যাকমেইল করে ওকে পাঠাচ্ছে কেন।

প্রেজেন্ট.……………………………

সিয়ারার কথাগুলো শুনে দিয়ারা কেঁদেই ফেলেছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে দিয়ারা সেদিন ওর সাথে যেটা ঘটেছিল সেটা বলে। সবটা শুনে সিয়ারা অবাক হয়ে যায়। কি করবে ভেবে পায় না।

দিয়ারা: তুই ঠিক ছিলি দি, একদম ঠিক ছিলি। ভিকিদা তুই ছাড়া অন্য কাওকে গ্রহণ করেনি।

সিয়ারা: ও নিজের কোনো ক্ষতি করতে যায়নি তো?

প্রতি উত্তরে দিয়ারা চুপ করে যায়। সিয়ারার আর উত্তরের প্রয়োজন পরে না, ও বুঝে যায়।

সিয়ারা: আঙ্কেল সব সময় ছিলো তো ওর সাথে?

দিয়ারা: হ্যাঁ। সেটাই তো বাঁচোয়া। বাড়িতে গেলে আঙ্কেল আর যতক্ষণ বাইরে থাকে ততক্ষণ সোহমদা। একবার তো ভীষণ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলো। আঙ্কেল ঠিক সময় না পৌঁছালে বাঁচানো যেত না।

সিয়ারা: (ভয়ে ভয়ে) ক..কি করেছিলো?

দিয়ারা: বাড়ি ফিরে রাতের বেলায় নিজের মায়ের ঘরে গেছিলো ভিকিদা। আঙ্কেল ভিকিদাকে নিজের ঘরে খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ওই ঘরে চলে গেলে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। জানলার কাছে যেতেই উনি দেখেন ভিকিদা শাড়িতে গিঁট দিচ্ছেন। কোনো সাড়া না দিয়ে তৎক্ষণাৎ সেই ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফেলেন। ততক্ষণে ভিকিদা চেয়ারেও উঠে গেছিল। পাগলামী করছিলো দেখে বাধ্য হয়ে গায়ে হাত তোলেন সেদিন প্রথম।

দিয়ারার কথাটা শুনে সিয়ারার সেইদিনের কথা মনে পরে যেদিন ও নিজের মায়ের ঘটনা বলেছিলো। সিয়ারা বুঝতে পারে আধভিক সেদিন নিজের মা কে মিস করছিলো প্রচুর। তাই জন্যেই হয়তো অমন করতে গেছিলো মায়ের ঘরে।

দিয়ারা: আঙ্কেলের কাছে সেদিন ভিকিদা প্রথম নাকি মায়ের জন্য কেঁদেছিলো।

সিয়ারা: হম, বুঝতে পেরেছি। মিস করছিলো ওর মা কে। ভাবছিলো যে, কেন ওর মা থেকে গেলো না ওর সাথে। ওর মা থাকলে ও নিজের সব কষ্ট মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারতো। এতোটা একা হয়ে থাকতে হতো না।

দিয়ারা: কতটা ভালো ভাবে চিনিস তুই ভিকিদাকে। আঙ্কেলও ঠিক এই কথাগুলোই বলছিলেন। সব শেষে এটাও বলছিলেন যে ভিকি দা বলছিলো…“মমের পর যাঁকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো সেও যখন ছেড়ে চলে গেলো। তখন আমি বেঁচে থেকে কি করবো? আমার বাঁচার কোনো ইচ্ছাই নেই।” সবটা ঠিক করে নে দি, প্লিজ! মানুষটা বড্ড কষ্টে আছে। প্রতিটা দিন হয়তো তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এইটা বাঁচার মতো করে বাঁচা নয় দি।

দিয়ারার শেষ কথাটা সিয়ারার বুকে গিয়ে বিঁধল। মনে পরে গেলো আধভিক তাঁকে বলেছিল, “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না সিয়ু। বাঁচার মত করে বাঁচতে পারবো না।” সিয়ারা চোখ বুজে নেয়। তারপর চোখ খুলে বলে,

সিয়ারা: মা কোথায় দিয়া? আমি মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।

দিয়ারা: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) সেটা সম্ভব না দি।

সিয়ারা: সম্ভব না মানে? কেন সম্ভব না?

দিয়ারা চুপ করে মাথা নীচু করে থাকলে সিয়ারা দিয়ারার বাহু ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: কি হয়েছে মায়ের? (নার্ভাস কণ্ঠে)

দিয়ারা: দু বছর ধরে মা কোমায় দি।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here