#ফুলকৌড়ি
(৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
কৌড়ির একটা বিষমে গোটা বাড়ির লোক একজায়গায় হয়ে গেলো।বিষম লেগে কাশতে কাশতে গলা দিয়ে রক্ত উঠে যাওয়ার উপক্রম হলো তবুও কিছুতেই বিষম ছাড়তে চাইলোনা।তখন ছোটো ছোটো হাতে নাফিমকে পানি নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে,গ্লাসটা তার হাত থেকে তড়িঘড়ি করে নিয়ে পানি খেতে গিয়ে এই বিষমের উৎপত্তি।যা এখন রূপ নিয়েছে প্রাণনাশ করা কাশিতে।কৌড়ির বিষমের কাশিটা প্রথমে কানে যায় মান্যতার।কৌড়ির রুমে এসে দেখে কৌড়ি অনবরত বুক চেপে কেশে চলেছে।গালে হয়তো ভাতের লোকমা ছিলো,সেগুলো মেঝোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আর নাফিম ভয়ার্ত গলায় তাকে এটাওটা বলে চলেছে।দৌড়ে এসে কৌড়িকে ধরতেই নাফিমকে বকতে থাকলো সে।
‘এই তোকে না বলেছিলাম,ওকে একদম ডিস্টার্ব করবি না।নিশ্চয় তোর আবোলতাবোল বকার কারনে এই অবস্থা ওর।
আরও এটা-ওটা বলতে থাকলো মান্যতা।নাফিম শুধু বাচ্চামো অসহায় গলায় বললো’সত্যি বলছি আপু,আমি আজ আবোলতাবোল বলিনি।আর কিচ্ছু করিও নি।মান্যতাকে বকতে দেখে,কাশতে থাকা গলায় কৌড়ি-ও নাফিমের কথা মেনে বলতে চাইলো,ছেলেটা সত্যি বলছে,আপু।ওকে কিছু বলবেন না,ও কিছু করেনি।তবে গলা দিয়ে শব্দ বেরই করতে পারলো-না।
শুধু মাথা ঘনঘন নাড়িয়ে মান্যতা বকতে নিষেধ করলো। মান্যতা সেটা বুঝুলো কি বুঝলো না,কৌড়ির কাশি না থামতে দেখে এবার জোর গলায় মা’কে ডাকতে থাকলো।একপর্যায়ে মান্যতার গলার জোরালো স্বর শুনে সবাই এসে হাজির হলো কৌড়ির থাকতে দেওয়া ঘরে।সান্ত্বনা রহমান এসেই তড়িঘড়ি কৌড়ি পাশে বসতে বসতে, ছেলেকে ভয়ার্ত নজরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা আন্দাজ সরূপ ছেলেকে বকতে থাকলেন।সেটা শুনে সেই অনবরত কাশি গলায় কৌড়ে কোনোমতে বাধোবাধো স্বরে বললো।
‘ও কিছু করেনি,ওকে বকবেন না।
নাফিমকে ছেড়ে কৌড়িকে নিয়ে ব্যস্ত হলো সবাই।মাথায় হাত বুলানো,ফের পানি খাওয়ানো কোনো কিছুতেই জেনো কাশি কমলোনা কৌড়ির।একপর্যায়ে নীহারিকা বেগম এসে,কৌড়িকে নিজের সাথে জাপ্টে ধরে তার পিঠের মেরুদণ্ডে মৃদুভাবে হাতের তালু দিয়ে আঘাত করতেই আস্তে আস্তে বিষম ছেড়ে জোরালো কাশি থেকে মৃদু কাশিতে পরিনত হলো কৌড়ির।ততক্ষণে গলা চিরে রক্ত বের হয়ে গেছে।এখানো ছেড়ে ছেড়ে কেশে চলেছে সে।সেই অবস্থায় নীহারিকা বেগমেকে শক্তপোক্ত করে দু’হাতে জাপ্টে ধরে, গলা ছেড়ে কেঁদে দিলো।গলা দিয়ে যদিও কথা বের করতে কষ্ট হলো তবুও কান্নরাত ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললো।
‘আমি খেতে পারছিনা,গলায় প্রচন্ড ব্যথা করছে।গলা দিয়ে কিছুতেই খাবার নামতে চাইছেনা আমার।আমি পারছিনা খেতে…
ফুপিয়ে কেঁদে চললো কৌড়ি।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।মমতাময়ী স্পর্শে নিজের সাথে আগলে নিলেন কৌড়ি কে। ফের মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন,তবে সান্ত্বনা সরূপ একটা বর্নও মুখ দিয়ে বের করলেন না।স্বান্তনা সরূপ কি বানী দেবেন মেয়েটাকে,এটাই জেনো ততক্ষণাত মাথায় এলো না উনার।তবে রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা রানিসাহেবাকে বললেন।
‘রানী,ওর জন্য গরম স্যুপ জাতীয় কিছু বানিয়ে নিয়ে এসো।পাতলা করে সুজি রান্নাও করতে পারো।যাও….
‘আমি আর কিচ্ছু খেতে চাইনা।
কান্নারত কৌড়ির কথার বিনিময়ে নীহারিকা বেগম কিছুই বললেন না।শুধু রানিসাহেবাকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন যেতে।মেয়েটার শরীর কাঁপছে,ক্ষুধায় কাঁপছে নাকি অতিরিক্ত কাশতে কাশতে ছেড়ে দেওয়ার কারনে বুঝতে পারলেন না তিনি।তবে ক্ষুধার জন্য এটাই উনার মনে হলো।কারন উনাক জড়িয়ে ধরা মেয়েটার হাত দুটো খুবই দূর্বল আর নিস্তেজ মনে হচ্ছে সাথে, শরীরটাও ভিষণ হালকা লাগছে।
ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত কৌড়ি নিশ্চুপ নীহারিকা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো।আর ঘরে উপস্থিত ব্যক্তিগুলো সবাই অসহায় নজরে তারদিকে তাকিয়ে রইলো।কি শান্ত ফুটফুটে একটা মেয়ে,তার মানসিক পরিস্থিতি সবাইকে জেনো ভিতর থেকে বেশ ব্যথিত করলো।
.
কৌড়িকে থাকতে দেওয়া হয়েছে নিচের একটি ঘরে।সেই ঘর থেকে বের হয়ে রানিসাহেবা দ্রুত পায়ে কিচেনের দিকে চলে গেলেন।আর তার পিছে ধীরপায়ে বের হলো নাফিম।মাথা নিচুকরে ছেলেটা এগিয়ে সিঁড়িপথ ধরলো।শেষ সিঁড়িটা পার করে দোতলার টানা বারান্দার পা রাখতেই,নজরে পড়লো স্থির মোটাসোটা একজোড়া পা। তড়িৎ গতিতে বুঝতে পারলো পাজোড়া কার?মুখ উচু সেই ব্যাক্তির দিকে তাকালো নাফিম।সবসময়ের শক্ত চোয়ালের শীতল নজরখানা নজরবিদ্ধ হলো।কালো ট্রাউজার আর এ্যাশ কালারের টিশার্ট পরা পাহাড়ের মতো উঁচু লম্বা মানুষটা সটান দাঁড়িয়ে আছে।নাফিমকে তাকাতে দেখে মূহুর্তেই প্রশ্ন করলো সামনে স্থির দাড়িয়ে থাকা মানুষটি।
‘সবাই ওভাবে ছোটাছুটি করে ও রুমে গেলো কেনো?কি হয়েছে নাফিম?
দাদাভাই এরকম ভয়ংকর গম্ভীর গলায় সবসময় কথা বলে কেনো বুঁজে আসেনা নাফিমের।এভাবে কথা বললে তার যে সহজ কথাও গুলিয়ে যায় এটা জানেনা দাদাভাই? কেনো ছোটো দাদাভাইয়ের মতো তার সাথে একটু সহজ গলায় কথা বলতে পারেনা।
‘আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি নাফিম?
‘আমার ফুলকৌড়ি ভাত খেতে পারছে-না।খেতে গিয়ে বিষম লেগেছে। তাই কাঁদছে?
‘আমার ফুলকৌড়ি মানে?
থতমত খেলো নাফিম।কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে মূহুর্তেই জেনো ভুলে বসলো সে।কথা শুধরে নিতে ফের চটপট গলায় বললো– আমার নয়,তোমার ফুলকৌড়ি।
‘আমার ফুলকৌড়ি!
সময় নিয়ে ধীরকন্ঠে বাক্যগুলো উচ্চারণ করল নিভান।মুহূর্তেই গভীর কালো-বাদামী মিশেলে নজরজোড়া আর-ও শীতল হলো তার।সেটা দেখে আর-ও ঘাবড়ে গেলো নাফিম।নিজের কথার ভুলটা বুঝতে পেরে চোখ মোটামোটা করে ফেললো সে।ফের চুপসে যাওয়া গলায় ধীরেধীরে বললো।
‘আমার ফুলকৌড়ি তোমার ফুলকৌড়ি,কারও নয়।ওই যে মেয়েটাকে তখন তোমার সাথে নিয়ে আসলে না।আমি তারই কথা বলছি।আর ওর নামই ফুলকৌড়ি।
চুপসানো গলায় কথাগুলো কোনোরকমে একটানা বলে ফাঁকফোকর খুঁজলো কোথা থেকে দৌড় দেবে সে।তবে দাদাভাই নামক পাহাড়ের মতো দেখতে উচু লম্বা মানুষটাকে পাশ কাটিয়ে দৌড় দেওয়া-ও সহজ কথা নয়।তাই নিভানো গলায় ফের নাফিম বললো।
‘দাদাভাই আমি যাই?
একটু চমকালো নিভান। যদি-ও চমকানোর কথা নয়।তবুও, গড়ীতে বসা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কেঁদে যাওয়া সেই রমনীর কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেলো তার।তখন পাশে না তাকিয়েও অনুভব করতে পেরেছিলো, মেয়েটার কাঁদছে। আর সারাপথ কেদেছে এটা-ও তার অজানা নয়।তবে আশ্চর্যের বিষয় হলেও,মেয়েটার সাথে তার কোনো প্রকার কথা হয়নি।
‘দাদাভাই যাবো?
‘হুমম।
হাঁপ ছেড়ে বাচলো জেনো নাফিম।এক সেকেন্ড-ও দাঁড়ালো না।দৌড়ে চলে গেলো সে।নাফিম চলে যেতেই
নিচে ঘরটার দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করলো নিভান।যাবার আগে মৃদুস্বরে একবার আওড়ালো,–ফুলকৌড়ি।অদ্ভুত নাম।
দোতলার খোলা বারান্দার ওমাথায় দাঁড়িয়ে দিবা লক্ষ্য করলো নাফিমের সাথে নিভানের কথা বলাকে।কাছে এগোতেই নিভানের প্রশ্নগুলো না শুনলেও,নাফিমের বলা চঞ্চল্য স্বরের কথাগুলো শুনতে পেলো এবং বুঝতে পারলো কার বিষয়ে কথা বলছে নিভান।নিভান,মেয়েটা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে!মন কিছুতেই মানতে চাইলো-না তার।এবাড়িতে তো মেয়েটার ভালোমন্দের খোঁজ নেওয়ার অনেক মানুষ আছে,তবে নিভানকে কেনো খোঁজ নিতে হবে?খোঁজ না নিলে হচ্ছে না তার।তবে কি মেয়েটার প্রতি ইন্টারেস্ট হয়ে পড়লো নিভান?তবে কি করবে সে?
.
‘হঠাৎ মেয়েটার কি হয়েছিলো?
নীহারিকা বেগম ঘরে ঢুকতেই বেডের উপর শয়নরত জাহিদ হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বামীর কাছে এগোলেন তিনি।পাশ গিয়ে বসতেই বললেন।
‘অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফলে গলায় ব্যথা করে ফেলেছে তাই খাবার খেতে গিয়ে গলায় আটকিয়ে গিয়েছিলো।সেই খাবার গিলবার জন্য তারাহুড়ো করে পানি খেতে গিয়ে বিষম লাগিয়েছে।
‘এখন কি অবস্থা?
‘এখন ঠিক আছে।তবে ভাত খেতে পারিনি।পাতলা করে সুজি রান্না করে দিয়েছে রানি।তাই খাইয়ে,ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে আসলাম মেয়েটাকে।ওর ঘুমানো প্রয়োজন। কাল থেকে ঘুমিয়েছে বলে তো মনে হয় না।ঘুম হলে শারিরীক, মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থতাবোধ করবে। ঠিক হয়ে যাবে।
‘মান্যতা আর মৌনতাকে ওর সাথে একটু সময় কাটাতে বলো।মাইন্ড ফ্রেশ থাকবে, বাড়ির দিকের কথা আর সেভাবে ততোটা খেয়ালে আসবে-না।এখন কাকে রেখে এসেছো ওর কাছে?মেয়েটার যা বিধস্ত অবস্থা, একলা ঘরে মেয়েটা আবার ভয় পায় কিনা তার ঠিক নেই।
‘আপনি চিন্তা করনেন না আমি মান্যতাকে ওর কাছে থাকতে বলে এসেছি।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহিদ সাহেব।কাছের বন্ধুটা হঠাৎ ইহকাল ত্যাগ করলো অথচ নিজের পঙ্গুত্বের অসহায় অসুস্থার জন্য একবার দেখতে যেতেও পারলেন না তিনি।বন্ধু নামক মানুষটার কাছে কতো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ছিলো উনার।সারাজীবন-ও হয়তো সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও কম পড়বে।হয়তো মানুষটার ঋন শোধ করেছেন উনি,তবুও সেই দুঃসময়ে তার উপকারের কথা ভুলবেন কিকরে!যেখানে নিজের আপন রক্ত সম্পর্কিত ভাইয়েরা তাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেখানে ওই বন্ধু নামক মানুষটা যে উনার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্যে করেছিলেন।তপ্ত শ্বাস ফেলে নীহারিকা বেগমের হাতের উপরে হাত রাখলেন জাহিদ সাহেব। ফের বললেন।
‘মেয়েটার দিকে খেয়াল রেখো নীহারিকা।একটা সময় মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়ে ওই মেয়েটার বাবা আল্লাহর রহমত সরূপ সেই থুবড়ে পড়া থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলো।এটা মনে রেখো।ওর জেনো একুটও অযত্ন নাহয়।আমি জানি তুমি থাকতে তা কখনো হবেনা।তবুও বলছি।কারনটা তুমি জানো।তবুও,কারনটা বাদে মেয়েটা কিন্তু আহসানের যক্ষের ধন ছিলো,অতিরিক্ত আদরের ছিলো।যারজন্য ভাবিসাহেবা তার নিজের জীবন তুচ্ছ মনে করেছিলো।আহসান আর দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা ভাবেনি।সেই মেয়েটাকে ভালো না রাখতে পারলে,সেখানে গিয়ে তো আমাকে তারকাছে জবাবদিহিতা করা লাগবে।আর জবাবদিহিতার চেয়ে বড়কথা।আমার বিবেক আমার বিবেচনা।আমাকে জেনো আমার বিবেক বিবেচনার কাছে কখনো ছোটো, বা অসম্মান হতে না হয়।আমি সারাজীবন কিভাবে চলেছি তুমি তো দেখে এসেছো।
নীহারিকা বেগম চুপচাপ স্বামীর কথাগুলো শুনলেন।
ফের জাহিদ সাহেবের শক্তপোক্ত হাতটার উপর নিজের অন্য হাতটার কোমল স্পর্শে রেখে নমনীয় গলায় বললেন। —বলেছিতো আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।ও এবাড়ির অন্য সব ছেলেমেয়েদের মতো করে থাকবে।তাই অযথা চিন্তা করে প্রেশার বাড়িয়ে নিজেকে আর-ও অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেবেন না।
‘আমাকে সেবা করতে তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না নীহারিকা।
মধ্যেবয়স্ক সুদর্শন জাহিদ সাহেবের মুখের দিকে নিটোল নজর ফেললো নীহারিকা বেগম।যৌবন বয়সে মানুষটা অতিমাত্রায় সুদর্শন ছিলো,এখানো সেই সৌন্দর্যের বিন্দু পরিমাণ ঘাটতি হয়নি।যদিও বয়স বেড়েছ,পঙ্গুত্বের অসহায়তায় তাকে ঘরে শুয়ে বসে থাকতে হয়।তবু-ও সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়নি।সুদর্শন শরীরে যৌবন বয়স চলে যাওয়ার সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে। তবে সেই পরিবর্তনগুলো জেনো আরও তার সুদর্শনতা বাড়িয়ে দিয়েছে।এই মানুষটার কাছে তিনিও খুবই ঋনী।সেখানে তাকে সেভাবে করতে কষ্ট,অনিহা!তা কিকরে সম্ভব!
সময় নিয়ে উত্তর দিলেন নীহারিকা বেগম।
‘এটা কেমন কথা! আপনার এতোদিনে তাই মনে হলো।আমি বিরক্ত হই আপনার সেবা করতে?তবে যে বলতে হয় আমিও তো আপনার কাছে ঋনী।যে সম্মান আপনি আমাকে আর নিভানকে দিয়েছেন।সেই সম্মানের পরিবর্তে সারাজীবন আপনার সেবা-ও যে কম পড়ে যাবে।তবে শুধু সেই সুবাধে আমি আপনার সেবাযত্নটা করি না।আপনি আমার বিশ্বাস ভরসার স্থান,আমার জীবনের শান্তি সুখের বটবৃক্ষ।সেই ছায়াস্থল বটবৃক্ষটাকে সেবাযত্ন ছাড়া অযত্নে রাখি কিকরে?আমি যে তবে অসহায়।
‘নিভান আমারই সন্তান নীহারিকা।কখনো ওভাবে আর বলবেনা।আমি মনেপ্রাণে মানি,ও তোমার গর্ভধারণ করা মানে আমারই সন্তান।আমার বড় সন্তান।আর তুমি আমার পরম পাওয়া সৌভাগ্যময় স্ত্রী।সেখানে তুমি বা সে আমার কাছে কোনো ঋনি হওয়ার স্কোপ রাখো না।আর কখনো এই ধরনের কথা তোমার মতো বুদ্ধি বিবেচিত নারীর মুখ থেকে না শুনি।
স্বামীর কথায় মনভরা তৃপ্তি পেলেন নীহারিকা বেগম। বরাবরই এই তৃপ্তি তিনি পেয়ে এসেছেন।নিভান এই মানুষটার সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও তাকে কখনো বুঝতে দেওয়া হয়নি,যে সে এই মানুষটার সন্তান নয়।এবাড়ির আর নিজের ছেলে হওয়ার সেই প্রাপ্য স্নেহ সম্মান মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে ছেলেটাকে তিনি দিয়ে এসেছেন।যদিও ছেলেটার পক্ষ থেকেও সেই শ্রদ্ধা মর্যাদাও তিনি পেয়ে এসেছেন আর পানও।শুধু বাবা ডাকটা বাদে।তবে সেই ডাকটা ডাকার জন্যও তিনি কখনো জোরাবাদি করেননি।হয়তো নীহারিকা বেগমের মতো, ছেলের বাবা ডাকটা নিয়ে মনেমনে আক্ষেপ রয়েছে উনারও।যেটা উনি মুখফুটে কখনো বলতে পারেন না।
‘নিভান কোথায়?এতো পথ জার্নি করে এসে আবার অফিস গেছে নাকি?এসে তো আমার সাথে দেখা করল না।
সচকিত হলেন নীহারিকা বেগম।বললেন–না,ও অফিস যায়নি।বাড়িতে আছে তো।
‘ডেকে দাওতো।দেখি ওদিকের খবরা-খবর একটু শুনি।আর মেয়েটা উঠলে আমার কাছে একবার নিয়ে এসো।
‘আচ্ছা।
বলে উঠে দাঁড়ালেন নীহারিকা বেগম।রুম থেকে প্রস্থান করার আগেই জাহিদ সাহেব ফের বললেন।—আমকে একটু উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে যাও তবে ও আসলে কথা বলতে সুবিধা হবে।
জাহিদ সাহবকে উঠে বসিয়ে দিয়ে নীহারিকা বেগম নিভানকে ডাকতে গেলেন।তাকে ডেকে দিয়ে তিনি আর বাবা ছেলের মধ্যে থাকলেন না।
.
দরজায় করাঘাত পড়তেই সেদিকে নজর দিলেন জাহিদ সাহেব।নিভানকে দেখেই ভিতরে আসতে বললেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে ভিতরে এলো নিভান।বেডের পাশে অবস্থানরত ড্রেসিং টেবিলটার সামনে থেকে টুলটা টেনে খাটের পাশঘেষে বসলো সে।বসা মূহুর্তেই হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলো জাহিদ সাহেবের দিকে।নিভানের হাতের পুরনো ফাইলের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললেন জাহিদ সাহেব।অফিস ফাইল তো এমন নয়। জিজ্ঞেস করলেন।
‘কিসের ফাইল এটা?
‘আহসান আঙ্কেলর আম্মা দিয়েছেন। বলেছেন আপনার কাছে দিতে। আমি দেখিনি।
ফাইলটা হাতে নিলেন জাহিদ সাহেব।মূহুর্তেই নিভানের সামনে খুললেন সেটা।মনোযোগ দিয়ে ভিতরের কাগজপত্র গুলো দেখতে দেখতে বললেন।–মেয়েটার নাম জেনো কি?
জাহিদ সাহেবের মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো নিভান।মেয়েটার নাম কি সে-ও তো জানে-না। কাল যখন জাহিদ সাহেব তাকে ডেকে বললো-উনার এক কাছের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মারা গিয়েছেন সেখানে উনার অবশ্যই উপস্থিত থাকা দরকার।তিনি তো যেতে পারবেন না,এবাড়ির কেউ একজনের উপস্থিত থাকাটা সেখানে জরুরি।আর ছেলে মানুষ বলতে উপস্থিত তখন নিভান ছাড়া কেউ বাড়িতে ছিলো-না।তাই নিভানকে যাওয়ার কথা বললেন তিনি।নিভান উনাকে বাবা বলে না ডাকলেও,সহজে উনার আদেশ নিষেধ ফেলেনা।তাই সময় নিয়ে রাজিও হয়েছিলো।সেখানে যেতে যেতে প্রায় দাফনকার্য শেষ হয়ে গিয়েছিলো আহসান আঙ্কেল নামক মানুষটার।নিজের পরিচয় জানান দিয়ে কবর জিয়ারত করে,আহসান আঙ্কেলের মা নামক বৃদ্ধাকে বলে যখন চলে আসবে।তখন ক্রন্দনরত অসহায় মুখে বৃদ্ধা জাহিদ সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাইলেন। নিভানও না করতে পারিনি।জাহিদ সাহেবের নম্বরে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল নিভানের জানা নেই।তবে জাহিদ সাহেবের সাথে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার কথা বলা শেষ হলে যখন তাকে ফোনটা ধরিয়ে দেওয়া হলো।জাহিদ সাহেব শুধু তাকে এটুকু বললেন।—মেয়েটাকে তোমার সাথে করে নিয়ে এসো নিভান।
মেয়েটাকে নিয়ে যখন চলে আসতে চাইলো নিভান।আরেক ঝামেলায় পড়েছিলো।এমনিতেই মেয়েটা তো আসতে চাইছিলোনা।তারউপর মেয়েটার চাচারাও তাকে আসতে দেবে-না।তারমধ্যে থেকে মেয়েটার এক চাচাতো ভাইও খুবই উগ্র আচারন করেছিলো।মেজাজ তো নিভানেরও চড়ে গিয়েছিলো।তবে মৃত্যু বাড়িতে অশোভনীয় আচারন করাটা ঠিক হবেনা বিধায় নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছিল।বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা আবারও জাহিদ সাহেবকে ফোন দিয়ে, উনার ছেলেদের কাছে ধরিয়ে দিতে বললেন।নিভান ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে সহজ সমাধান হিসাবে তাই করলো।
জাহিদ সাহেবের ফোন ধরতেই,আহসান আঙ্কেলের মেঝো ভাই নামক লোকটা কেমন মিইয়ে গেলো।পরবর্তী আর ঝামেলা করেনি। মেয়েটাকে চুপচাপ তার সাথে আসতে দিয়েছিলো।তবে ওই উগ্র মস্তিষ্কের ছেলেটাকে সহজে শান্ত করা যাচ্ছিলো।সেটা আর সামান্যতম গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি নিভান।মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসেছিলো।গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার মূহুর্তে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি করে তার হাতে ফাইলটা ধরে দিয়েছিলেন।তখন-ও মেয়েটা না আসার জন্য বাহানা করেই যাচ্ছিলো।
‘নিভান।
হঠাৎ মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ডাকটা নিভানকে একটু চমকাল।কি জিজ্ঞেস করেছিলেন জাহিদ সাহেব মনে হতেই আবারও খেয়াল হলো,না মেয়েটাকে সেভাবে খেয়াল করেছিলো সে।আর না তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়েছিলো,তবে মেয়েটার নাম বলবে কি করে সে।তবে একটু আগে নাফিমের থেকে জেনে নেওয়া নামটা বলবে কি সে?সত্যিই কি মেয়েটার নাম ফুলকৌড়ি?হঠাৎ তখন দিবার প্রশ্ন করা কথাটার কথা মনে পড়লো।দিবাও তো বলেছিলো মেয়েটার নাম কৌড়ি।তবে ফুলকৌড়ি না বলে কৌড়ি বলবে কি?
‘নিভান,কিছু হয়েছে কি?তুমি কি কিছু নিয়ে ভাবছো?
‘না তেমন কিছু নয় আপনি বলুন?ওহ আপনি তো মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করছিলেন।মেয়েটার নাম মনে হয়….
‘নামটা আমি জেনে নিয়েছি ফাইল থেকে।মেয়েটার নাম
,কাশফিয়া আহসান কৌড়ি।
নিভানের চুপ থাকা দেখে জাহিদ সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন,মেয়েটার নামটা সম্পর্কে নিভান জ্ঞাত নয়।তবে ফাইলের বিভিন্ন কাগজে মধ্যে মেয়েটার স্কুল কলেজ সম্পর্কিত কাগজও আছে।সেখান থেকে জেনে নিয়েছেন তিনি।যদিও নামটা তিনি আহসানের মুখে বেশ কশেকবার শুনেছিলেন তবে খেয়ালে ছিলোনা উনার।
চলবে…
আচ্ছা আপনাদের কি গল্পের চরিত্র গুলো সম্পর্কে ভালো মন্দ কিছু অনুভূতি জানাতে ইচ্ছে করেনা।আমার তো জানতে ইচ্ছে করে আপনাদের কোন চরিত্রটা কেমন ….