ফুলকৌড়ি (৩১) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
990

#ফুলকৌড়ি
(৩১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

আজ তন্ময়ীর মেহেন্দি অনুষ্ঠান।ইভানদের বাড়ি থেকে যখন অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন নিয়ে ওবাড়ির পথে রওনা হবে সবাই।তখনই ইভানকে ফোন করে জানিয়ে দিলো,সে মেহেন্দি অনুষ্ঠান করতে চায়না।এমনকি হাতে মেহেদি লাগাতেও সে ইচ্ছুক-নয়।ইভান অসন্তুষ্ট হলো!মেয়েটাকে এতোকরে বোঝালো অথচ মেয়েটা তাকে বোঝার চেষ্টাই করলোনা। বুঝলোই না তাকে!দগ্ধ হলো মন।কি করবে হঠাৎ বুঝে উঠলো না।মেয়েটাকে ছেড়ে দেওয়া তাঁরপক্ষে কখনো সম্ভব নয়।আর এখন এই পরিস্থিতিতে এসে মেয়েটাকে মাঝ দরিয়ায় দাঁড় করিয়ে তো আরও কখনো নয়!দু-জনের মধ্যে তর্কবিতর্ক হলো।ইভান পুনরায় তন্ময়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করলো।
তবুও কাজ হলোনা।তন্ময়ীর একটাই কথা,মেহেন্দি অনুষ্ঠানে জন্য কেউ যেনো ওবাড়ি থেকে তাকে মেহেদী পরাতে এবাড়িতে না আসে।অসহায়বোধ করলো ইভান।কি করবে সে এখন?কিভাবে তন্ময়ীর এসব জেদালোপূর্ন অযৌক্তিক কথাটা বাড়িতে জানাবে?কথা শেষ করে কল কেটে দিয়েছে তন্ময়ী।হাতে থাকা ফোনটার দিকে দূর্বল নজরে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঘনোঘনো।ক্লান্ত শরীরের ন্যায় বসে পড়লো নিজের বেডে।মাথার চুলগুলো দু’হাতে খামচে ধরে বেশ কিছুসময় ভাবলো।সামনের চলা দিনগুলোতে কি আছে ভাগ্যে,এটা তার জানা নেই।তবুও তন্ময়ীকে কোনোমূল্যে ছাড়তে চাওয়া বা ছাড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।জোরেশোরে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।গমন পথ বাড়িয়ে দিলো মায়ের কাছে যাওয়ার পানে।
নীহারিকা বেগম তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে কর্মে লিপ্ত।মায়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো ইভান।ভরাট গলায় ডেকে উঠলো

‘আম্মু।

কন্ঠ যেনো কেমন শোনালো।উদ্বিগ্ন হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললেন নীহারিকা বেগম। তড়িৎ কাজের হাত থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘কি হয়েছে?কিছু বলবি?

ভিতরে ভিতরে ইভান ইতস্ততবোধ করলো।তবুও বলতে তো হবেই।তাই মনের দ্বিধা কাটিয়ে বললো–এবাড়ি থেকে মেহেন্দির ডালা নিয়ে, ওবাড়িতে না পাঠালে হয় না?

‘এ কেমন কথা ইভান!যদিও এই আচার অনুষ্ঠান কড়াকড়ি নয় তবুও মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা বিয়েতে মানা হয়।আর যেখানে সবাই যখন মনস্থির করেছে ওবাড়িতে যাবার জন্য সেখানে হঠাৎ না মানাটা কেমন দেখায়?আর ওরাও অপেক্ষা করছে,সেখানে না যাওয়াটা কতোটা যৌক্তিক!সবকাজে ছেলেমানুষী করলে হয়-না ইভান।আর মেহেন্দির ডালা নিয়ে ওরা যাবে,তোর সমস্যা হচ্ছে কোথায়?

সমস্যা আমার নয় সমস্যা তোমার ছোটো বউয়ের। কথাটা মনেমনে কঠিন গলায় আওড়ালেও, তন্ময়ীকে দোষী করতে চাইলো না।তাই ইনিয়েবিনিয়ে বললো—আমার সমস্যা নেই।তন্ময়ীর কথা ভেবে বলছিলাম, মেয়েটার মানসিক অবস্থা আগের ন্যায় নেই।ও বলছিলো,এতো উহ্য করে মেহেন্দি অনুষ্ঠান করার দরকার নেই।বিয়ে যখন হচ্ছে মেহেদী এমনিতেই পরে নেবে।

মন মিথ্যা বলতে চাইলোনা।তবে বাধ্য হয়ে বলতে হলো তাকে।কিছুটা অবাক হয়ে নীহারিকা বেগম বললেন-
—তন্ময়ী নিজেই চাইছেনা মেহেন্দির অনুষ্ঠান করতে?

মুখে কিছু না বলে এবার মাথা উপর নিচ মৃদু ঝাঁকিয়ে ইভান জানালো।সেটা দেখে সহসা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নীহারিকা বেগম।মেয়েটার বিয়ে ভেঙে গিয়ে আবার নতুন করে অন্যত্র বিয়ে হচ্ছে। মানসিকভাবে হয়তো প্রস্তুত নয়।একজনকে নিয়ে এক রকম ভেবে রেখেছিলো।এখন আবার হঠাৎ আরেকজনকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে ।তাই হয়তো এসব আচারনিষ্ঠা বিশেষভাবে ভালো লাগছে-না।নীহারিকা বেগম,উনার মতো বুঝে আপতত সবাইকে তন্ময়ীদের বাড়িতে যাওয়া থেকে আটকে রাখলেন।তিনি কথা বলবেন তন্ময়ীর সাথে।যেভাবেই হোক বিয়ে যখন হচ্ছে আচার অনুষ্ঠানতো করতে হবে।এসবে বাড়ির সম্মানও জড়িয়ে আছে।বুঝিয়ে শুনিয়ে ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে।না-হলে এবাড়ির সম্মানের ব্যাপার তো পরে,মেয়েটাকেই কটুবাক্য শুনতে হবে।নিন্দিত হতে হবে।তিনি হাতের কাজ ফেলে ছুটলেন নিভানের কাছে।যদি মেহেন্দি অনুষ্ঠান হয় তবে ছেলেটা ঠিক তন্ময়ীর দিকটা সামলে নিতে পারবে।যেখানে ওবাড়ির সাথে আগে থেকে নিভানের একটা দারুণ সম্পর্ক আছে।আর যদি মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা না-হয় তবুও ছেলেটা,সমাজের নাকউঁচু মানুষের উল্টো পাল্টা বলা বা ভাবা থেকে দমিয়ে রাখতে পারবে।এ-বাড়ির ও-বাড়ির দু-য়োবাড়ির সম্মান,নিজের যোগ্যতা বলে অটুট রাখতে পারবে।


নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে তন্ময়ী।ঘোলাটে নজরজােড়া তার ফোনের পানে নিশ্চল।ইভান কতশত বার ফোন দিয়েছে অথচ সে ধরেনি।নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন জড়বস্তু মনেহচ্ছে।একটু আগে কতোকরে ভাইয়া তাকে বুঝিয়ে গেলো,অথচ মন কিছুতেই গলতে চাইছেনা।এইযে মা,হলুদের অনুষ্ঠানের পর এখনো তার সাথে সেভাবে কথা বলেনি।দায়ী কে?ইভানের সবকিছু মাফ করা গেলেও,মায়ের সাথে তার যে অস্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।এটার জন্য ইভানকে ক্ষমা করবেনা সে।কিছু সময় মনেহচ্ছে বিয়েটা ভেঙে দিতে।আবার মন বলছে,এবার বিয়ে ভেঙে গেলে মা আর ভাইয়ের সম্মান তো নষ্ট হবেই।সাথে মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়!

কিন্তু মায়ের এই ব্যবহার তাকে কষ্ট দিচ্ছে। আর সেই কষ্ট ইভানের প্রতি রাগ জেদ অভিমান আরও বাড়াচ্ছে।
অথচ বিপরীত লিঙ্গ বলতে,ইভানের প্রতিই তো তার প্রথম অনুভূতি জন্মেছিলো।তবে বাবাহীন,মায়ের একার এই শ্রমের সংসারে গা ভাসিয়ে চলতে চায়নি সে।তেমন মন মানসিকতা নিয়ে-ও বেড়ে উঠেনি।মা এবং ভাইয়ের আদর্শমতো চলার চেষ্টা করেছে।সেখানে ইভানের রাখা প্রস্তাব, তার করা পাগলামির প্রতি অনূভুতি জন্মালেও তা প্রকাশ করেনি তন্ময়ী।বরাবর অনুভূতি চেপে রেখে নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে সে।সেই দমিয়ে রাখা মৌন সম্মতিও যেনো ইভানের প্রতি অগাধ আগ্রহী আর দূর্বল ছিলো।থাকবেনা কেনো,ছেলেটা তাকে বুঝে কি নিখুঁতভাবে তার মনের মতো করে প্রস্তাব রেখেছিলো।যা কখনো সে কোনো পুরুষ মানুষের কাছে আশা রাখেনি।প্রেমের সম্পর্কে না জড়িয়ে সময় মতো তাকে চেয়ে নেওয়া।ইভানের এহেন প্রস্তাবে মনেমনে বিগলিত হয়েছিলো তন্ময়ী।তবে হ্যা সূচক সম্মতি না দিলেও,নাকচ সে করেনি।দেখা না হলেও,ফোনালাপে তার সকল ইতরামি কথাগুলো সহ্য করে তাকে আশকারা দেওয়ার হকতো সেই তৈরী করে দিয়েছিলো।একদিন দু’দিন তিনদিন করে যখন সময় পার হয়ে সপ্তাহে গিয়ে ঠিকতো,তখন একটা মানুষের কলের অপেক্ষা তো সে করতো!সম্পর্কের নাম ছিলোনা।অথচ সেই সম্পর্কে মায়া,টান ছিলো অদ্ভুত।সেই মায়া টান নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লো,ইভানের একটা কার্যে।অথচ ইভান,সেই কার্যে নিজের পক্ষে কি নিপুনভাবে সাফাই গেয়েছে।সেই সাফাই সত্য কি মিথ্যা জানা নেই তার।তবে ইভানের হয়ে নিভান ভাইয়া কখনো মিথ্যা বলতে পারে!এটাও সে বিশ্বাস করেনা।নিজের ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ,ভরসা করে নিভানকে তন্ময়ী।অথচ ইভানের হয়ে সেই সবার কথা ভেবেচিন্তেও নিজের মনকে মানাতে পারছে-না তন্ময়ী!

না নিজের মায়া টান থেকে ইভানকে ক্ষমা করতে পারছে!না ইভানের সাফাই তার মনকে গলাতে পারছে।আর না নিভানের যৌক্তিক কথায় নিজের মনকে ইভানের প্রতি মানাতে পারছে!কি এক যন্ত্রণায় আছে।উফফ!তবে এই পরিস্থিতির জন্য নিজেকেও কম দ্বায়ী করছেনা তন্ময়ী!ইভানের এ-কথাতো সত্য। ইভানকে নিজের জীবনে প্রশ্রয় দেওয়ার হক যখন নীরবে দিয়েছিলো।তখন নিজের চোখে দেখা দৃশ্যাবলী নিয়ে একবার তো তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতো!ভালো হতো বা মন্দ তবে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন তো তাকে হতে হতোনা।ইতুরে ইভানকে তো সে আগে থেকেই চিনতো জানতো।বিয়ে ভাঙার মতো কান্ড,ছেলেটার দ্বারা অসম্ভব কিছু নয়।তবুও কেনো এরকম ভুলটা করলো!এখন কোনদিকে যাবে?

‘তুমি ওবাড়ি থেকে মেহেন্দি দিতে আসতে নিষেধ করেছো কেনো?

চমকে মায়ের মুখের দিকে তাকালো তন্ময়ী।এখনো গম্ভীর সেই ফর্সা গোলগাল মুখখানা।মায়ের প্রশ্ন এড়িয়ে ধরা গলায় বললো।–বিশ্বাস করোো আম্মু, উনারা যে অভিযোগ জানিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন।আমি তেমন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে নেই।

‘আমি জানি।

‘তবুও তুমি আমার সাথে কথা বলছোনা?অভিমান করে আছো?তুমি ছাড়া কে আছে আমাদের?তুমি ওরকম আচারন করলে,আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসে।মনে হয়, আমার বলে এই পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই।

দুচোখ বেয়ে নোনাঅশ্রু গড়ালো তন্ময়ীর।দ্রুতপানে পা বাড়িয়ে মেয়ের কাছে গেলেন।মা’কে সামনে পেতেই জড়িয়ে ধরলো তন্ময়ী।ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিলেন তাহমিনা বেগম।মুখে কিচ্ছুটি বলেননা,শুধু দীর্ঘশ্বাস আওড়ালেন।তন্ময়ীর বিয়ে ভাঙার পর ক্ষনিকের জন্য উনারও মনে হয়েছিলো,কিছু না ঘটলে এরকম কথা পাত্রপক্ষরা পেল কোথায়?নিজ মনে সেসব কথা ভেবে তন্ময়ীর উপরে অভিমান জন্মে ছিলো উনার।সেই অভিমান গলেছে কাল রাত্রে নিভানের সাথে কথা বলার পর।কালরাতে ছেলেটা দেখা করতে এসেছিলো উনার সাথে।ভালোমন্দ কথার পর,ভণিতা ছাড়াই ইভানের করা ভুলের দোষ স্বীকার করেছে সে।সাথে মিনতি-ও করেছে,বিয়েটা না ভাঙার।ছেলেটা নাকি তন্ময়ীকে ভিষন পছন্দ করে।যেখানে তন্ময়ীর কোনো সম্মতি বা হাত ছিলোনা।আর যখন শুনলো,তন্ময়ীর বিয়ে।সেই বিয়ে ঠেকাতে কিভাবে কি করবে বিবেচনা না করে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।এসব শুনে তাহমিনা বেগমও চড়াও হয়েছিলেন।এমনকি ইভানের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবেননা,এটাও জানিয়ে ছিলেন।তবে নিভানের অমায়িক যুক্তিতর্ক আর নরম ব্যবহারের কাছে নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছেন।আর দ্বিতীয়বার মেয়ের বিয়ে ভাঙার খবর পাড়াপ্রতিবেশি বা আত্মীয় স্বজন জানলে, মেয়েটার বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে।সব বিবেচনা করে তিনিও আর কথা বাড়ালেন না।তবে নিভান যাওয়ার আগে ভাইয়ের পক্ষ থেকে বারবার ক্ষমা চেয়ে গিয়েছে।যদিও মেয়ের সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার জন্য, ইভানের প্রতি তিনি মনোক্ষুণ্ণ হয়ে রয়েছেন তবে তা আর চেয়েও প্রকাশ করতে চাইলেন না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন।

‘মা হও তারপর বুঝবে মায়েদের কতো জ্বালা।আর যদি হয় মেয়ে সন্তান তখন যেনো,চিন্তা-ভাবনা,বিবেচনাবোধ বিবেকবোধর জ্বালা শতগুণ!যাই হোক,সত্যি বলতে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে মা তোমাকে অবিশ্বাস করেছিলো। তোমার প্রতি মনোক্ষুণ্ণও হয়েছিলো।মা’কে ক্ষমা করে দিও।

‘এসব কি বলছো আম্মু!আমার জন্য তোমাকে অসম্মানিত হতে হয়েছে,আমিই স্যরি।খুব খুব স্যরি আম্মু।

তাহমিনা বেগম এবার শব্দকরেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
প্রসঙ্গ এড়িয়ে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন–মেহেন্দির অনুষ্ঠান হবে।ওবাড়ি থেকে মেহমান আসার আগে রেডি হয়ে নাও।আর তোমার বান্ধবীরাও তোমার অপেক্ষা করছে,ওরা তোমার জন্য রেডি হয়নি।চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে আছে।আমি ওদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেবে।

তন্ময়ী মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তাতেই তাহমিনা বেগমের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।মেয়েকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।তন্ময়ীর কপালে চুমু দিয়ে ফের রেডি হয়ে নিতে বলে চলে গেলেন।মা যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তন্ময়ী।মনে প্রশ্ন জাগলো বিভিন্ন। তার বিরুদ্ধে মায়ের এই মান ভাঙলো কিকরে মন জানতে চাইলো।তবে আপতত জানার যখন উপায় নেই।মা’কে প্রশ্ন করার সাহসও করতে পারলোনা।তখন আর মনে প্রশ্ন রেখে লাভ আছে!তবে যে এই সাধনটা করেছে,তাকে মন থেকে ধন্যবাদ।

তন্ময়ী বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চায়না,এটা নিভান ছাড়া দ্বিতীয় কান হতে দিতে চাইলেন না নীহারিকা বেগম।
বাড়ির একটা পিঁপড়া পক্ষীকেও জানতে দিলেনও না।
তবুও কথাটা কিভাবে কি করে যেনো ইভানের ফুপু ডালিয়া বেগমের কান অব্দি পৌঁছে গেলো।আর তিনিও যেনো এমন একটা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় মূখিয়ে ছিলেন,নিজের পেটের কথাগুলো উগরে দেওয়ার জন্য। যা তিনি নিজের বড়োভাইয়ের জন্য পারছিলেন না।এখন যখন সুযোগ পেয়েছেন তবে কথার খেই কেনো ছাড়বেন?ছাড়বেন না তিনি।এমনিতেই ইভান ওরকম একটা মেয়কে বিয়ে করতে চাইছে, এটা যেনো তিনি সেদিন থেকেই মানতে পারছিলেননা।তবে বাধ্য হয়ে চুপ থাকতে হয়েছে উনাকে।এবার কথার খেই যখন পেয়েছেন চুপ থাকার প্রশ্নই উঠেনা।কন্ঠে উপহাস মিশিয়ে,ড্রয়িংরুমের ভরা মজলিসে বেশ কটাক্ষ করে তিনি নিজের মা’কে অর্থাৎ ইভানের দাদুমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

‘এমনিতেই মেয়েটার গায়ে রঙ ময়লা,চাপা!তারউপরে বংশের কোনো বিশেষ নামগন্ধ নেই।তাতে আবার,মেয়েটার বিশেষ ছেলেবন্ধু আছে বলে নাকি বিয়ে ভেঙেছে।সেই মেয়েকে কোন হিসাবে ইভান বিয়ে করতে চাইলো আমার বুঁজে আসছে না।তোমারা-ও আবার তাতে ইন্ধন জুগিয়ে,বিয়েতে মতামত দিলে।ছেলেটার না-হয় মহান হওয়ার সাধ জেগেছে তাই বলে তোমারাও কিকরে, ছেলেটার ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে ওর সম্মতিতে সহমত পোষণ করলে?ওর নাহয় বুদ্ধুিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে,তোমরা কিকরে বুদ্ধিতে খাটো হলে!নাও,এখন রঙঢঙ সহ্য করো। জাত-বংশ না দেখে, ঘরে বউ আনতে চাইলে যা হয়!যত্তসব রংঢং!

হঠাৎ এতো আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কথাগুলো এমন কটাক্ষের স্বরে বলায় ইভানের দাদুমা কিছুটা থতমত খেলেন।বিব্রতবোধ-ও করলেন।মধ্যবয়স্ক মেয়ে উনার।উপযুক্ত এক মেয়ের মা অথচ কোন কথা কোথায় কিভাবে বলতে হয়,মেয়েটা যেনো উনার শেখেইনি।শেখেনি বলতে ভুল,সারাজীবনতো নিজের মতো করে বুঝিয়ে শিখিয়েই তো এসেছেন।তবে মেয়েটা নিজগুণে আয়ত্ত করলে তো!নিজের একমাত্র মেয়ে বলে ছোটো করে কথাও বলতে পারেন না বলে।তাই বলে নিজের বাড়ির সন্মান নিয়ে ছোটো করে কথা বলা।তিনি মানতে চাইলেন না।কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললেন।

‘তুমি এভাবে কথা বলতে পারোনা ডালিয়া।মেয়েটা দেখতে শুনতে,যথেষ্ঠ মার্জিত।নাহলে নিভান বা তোমার বড়োভাই কখনো এ-বিয়েতে সম্মতি প্রকাশ করতো না।আর মেয়েটাকে আমারও বিশেষভাবে পছন্দ।সেখানে ইভান দাদুভাই কোনো ভুল করেছে বলে আমার মনে হয়না।

রাগ লাগলো ডালিয়া বেগমের।মা-ও ওই মেয়েটার হয়ে কথা বলছেন।তাও আবার এতোগুলা মানুষের সামনে,ওই সামন্য মেয়েটার জন্য উনাকে ছোটো করে কথা বলছেন!তিনি পুনরায় কটাক্ষের স্বরে বললেন।

‘এবাড়ির বউ হিসাবে কোনদিক থেকে উপযুক্ত বলে মনে হলো ওই মেয়েটাকে তোমার?যেমন গায়ের রঙ,ইভানের পাশে মানায় মেয়েটাকে?ওর থেকে বাড়িতে যে মেয়েটার পিছনে ঘুরঘুর করতো সেটাই তো ভালো ছিলো।অন্তত দেখতে তো শ্রী।জাতপাতেও চলার মতো।

ভদ্রমহিলা আবারও মেয়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য মুখ খুলতে যাবেন।তার আগেই রাগান্বিত গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বরের বার্তা এলো–সংসার করবো আমি।
মেয়েটা বউ হবে আমার।তার গায়ের রঙ ময়লা হোক বা কয়লা,তা নিয়ে আপনার এতো মাথাব্যথা বা চিন্তা কিসের ফুপিমণি?সংসার তো আপনি করবেন না আর না তাকে এবাড়িতে এনে আপনার কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে!তবে এতো সমস্যা কিসের আপনার?আপনি এবাড়ির আউটসাইডার, আপনি তাকে পছন্দ করে চাইলে ভালোবাসতে পারেন,না চাইলে নয়।তাই বলে আমার বউয়ের যোগ্যতা অযোগ্যতা মাপার বিচারক আপনি কে?আপনাকে তো মানা হয়নি বিচারক!না আপনার সিদ্ধান্ত জানা হয়েছে।তবে তাকে নিয়ে ছোটো বড়ো কথার দুঃসাহস দেখান কিকরে আপনি?

‘উনি তোমার ফুপুমনি হয় ইভান।উনার সম্মান বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করো।

দাদুমার থমথমে গলার আজ্ঞা পেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দাঁড় করালো ইভান।সে হাসিতে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যতা।কিছুটা দ্বায়ী হলেও আজ দাদুমায়ের জন্য ফুপুমনির এই অধঃপতন।তবে সে বিষয়ে ভাবনা না এগিয়ে গম্ভীর গলায় বললো —উনি বড়ো হয়ে নিজের ব্যবহার আর যবান দ্বারা আগে নিজের সম্মান আর শ্রদ্ধার স্থানটা ধরে রাখার চেষ্টা করুক।আমি অবশ্যই উনার সাথে সম্মান শ্রদ্ধার সহিত কথা বলবো।

অপমানে থমথমে হয়ে থাকা ডালিয়া বেগম আবারও মুখ খুললেন।বললেন-আমি তোমার ভালোর কথা ভেবে কথাগুলো বলছিলাম আর তুমি আমাকে এমন কথা শোনালে?আমি এবাড়ির বহিরাগত!

‘ভালোর জন্য।আমার ভালো আপনাকে ভাবতে হবেনা।কে বলেছে আমার ভালো জন্য আপনাকে ভাবতে?আমার ভালো ভাবতে গিয়ে পিছনে কি কি করে এসেছেন,জানা নেই আমার।নাকি মনে নেই আপনার?সেসব বলে নিজের অপরাধকেও ছোটো করে দেখতে চাই না আমি।তবে আমার ভালো আর আপনাকে না ভাবলেও চলবে।এবাড়িতে আমার ভালো ভাবার জন্য অনেক মানুষ আছে।আপতত তারাই যথেষ্ট।আর আপনার ভালো ভাবার,সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো আপনার মেয়ে।তাই নিজের মেয়ের জন্য যে ভালোটা করে রেখেছেন,আমার ভালোটাও সেখানেই ব্যয় করুন।হয়তো তার এলোমেলো জীবনটা পুরোপুরি নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে।

‘ইভান।

ডালিয়া বেগমের চড়াও গলার ডাকে ইভান হাসলো।ফের বললো —ভুল কিছু বললাম নাকি আমি?ভুল বলে থাকলে,আদরের ভাইপো হিসাবে ক্ষমা করে দেবেন।তবে আমি ইভান।নিভানের মতো অত ধৈর্য্য, সহ্যশক্তি আমার নেই।যে যা বলছে,যা করছে আপনজন মনে করে চুপচাপ শুনবো।আর না আমি জাহিদ হাসান,শাহেদ হাসান।যে তাদের আদরের ছোটোবোন, নিজের স্ত্রীকে লোকসমাগমে নিচু করে কটুবাক্য শোনাচ্ছে,তা নীরবে হজম কর নেবো।

ড্রয়িংরুমে মানুষ বলতে ইভানের মামিরাই ছিলো।ডালিয়া বেগমের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে উনারা অবগত তাই আর বিশেষ কথা কেউ বাড়ালেন না।চুপচাপ দুপক্ষের ছুড়াছুঁড়ি কথা শুনে গেলেন।একপর্যায়ে যখন ডালিয়া বেগম নীরব হয়ে গেলেন,উনারা ইভানকে থামার জন্য বললেন।ডালিয়া বেগমের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে থামলো ইভান।সে চায়নি এতো মানুষের সামনে ফুপিমণিকে ছোটো বড় এতো কথা শোনাতে।তবে কথা না বলার উপায় কি রেখেছেন ফুপুমনি?আর তন্ময়ীকে ওভাবে বলায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি সে।মেয়েটার ওই মায়াবী গায়ের রঙ তাকে যে বিশেষ আকর্ষণ করে।আর সেই গায়ের রঙ নিয়ে কটাক্ষ করে কথা।মোটেই ভালো লাগিনি ইভানের।এরমধ্যে নীহারিকা বেগম এসে তাড়া দিলেন,মেহেদীর ডালা নিয়ে ওবাড়িতে যাওয়ার।কথাটা শুনতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো ইভান।মেয়েটা জেদ ছেড়েছে তবে!যাক তবেই শান্তি।বিয়ে বাড়ির পরিস্থিতি ফের মুখরিত হলো।চাপা পড়ে গেলো ডালিয়া বেগমের থমথমে মুখ।

গোধুলি বিকাল।সন্ধ্যা নাম নাম ভাব।বাড়িতে এখন লোক সমাগম কম।মেহেন্দি অনুষ্ঠানে গিয়েছে সবাই।নিভানের যাওয়ার কথা থাকলেও নিভান যেতে পারিনি।
নানু-মায়ের ঘরে ঢুকলো নিভান।ঘরটা ফাঁকা।নানুমা ঘরে নেই?তাহলে কোথায়?নিচে কোথাও তো দেখলো-না।পিছে মুড়ে বের হতে গিয়েই অনুভব করলো বেলকনির দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।নানুমা বেলকনিতে ছিলো!শব্দ পেয়ে পিছে মুড়ে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই।মানেটা কি!সে স্পষ্ট কারও নরম পায়ের শব্দ শুনলো।মান্যতারা তো বাড়িতে কেউ নেই তবে ওখানে কে?আর নানুমা তার সাথে নিশ্চয় লুকোচুরি খেলবেনা।ধূর্ত মস্তিস্কে কিছু একটা ভাবতেই কৌতুহল বশত বেলকনির দিকে এগোলো।বেলকনির দরজায় গিয়ে, বেলকনিতে কৌড়িকে দেখেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।তবে আন্দাজ ঠিক ছিলো।কিছুটা কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো।

‘তুমি এখানে।মান্যতাদের সাথে যাওনি?

রক্ষা হলো-না।নানুমা মনে করে সে দেখতে গিয়েছিলো রুমে কে এসেছে।মানুষটাকে দেখেই নিঃশব্দে পা চালিয়ে ফের চলে এসেছে তবুও বুঝে ফেলেছে মানুষটা।উফফ। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কথার উত্তর দিতে চাইলো।কারন,সকালে নানুমায়ের কথাগুলো শুনে আর মানুষটাকে নিখুঁত নজরে দেখে মনে কিছু-মিছু একটা অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।সেই অনুভূতি আজ সারাদিন তাঁকে জ্বালিয়ে মেরেছে। এখন কথা বাড়িয়ে সেই অনুভূতিকে আর প্রশ্রয় দিতে চায়না।হোক একটু বেয়াদব!তবুও ওই গম্ভীর স্বরের মানুষটার কথার উত্তর সে দিতে চায়না।সামনে মানুষটা কি বুঝলো কি বুঝলো না।ওয়ালে কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়ালো।ফের দুষ্ট হেসে বললো।

‘গ্লাস আঁটকে দেই?কি বলো?

বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে। উত্তর না দিলে ছাড়া পাবেনা সেটা বেশ আন্দাজ করতে পারলো কৌড়ি।স্বভাবজাত
নমনীয় অথচ অসন্তুষ্ট গলায় বললো–আমার ভালো লাগছিলো না।তাই যায়নি।

কৌড়ির অসন্তুষ্ট গলার স্বরে মৃদু হাসলো নিভান।বললো—মান্য আর মৌনতা তোমাকে না নিয়ে যেতে চাইলো?

‘আপু অনেক জোরাজোরি করেছিলো।এমনকি রাগ করেছে।আমিই যায়নি?

কৌতুহলী গলা নিভানের–‘কেনো?

‘এমনিতেই।

এমনিতেই যায়নি এমনটা নয়।পিরিয়ড চলছে তার।আর পিরিয়ডে পেটব্যথা সহ বিভিন্ন সমস্যা চলে তার।তার উপর আরও একটা সমস্যা আছে।আর সেসব সমস্যা জনিত কারনে কোথাও গিয়ে মনোশান্তিতে থাকতে পারেনা সে।বিধায় মান্যতাকে বুঝিয়ে না করে দিয়েছে।না-হলে মান্যতা আপু বাদ অমায়িক ব্যবহারের ঈশিতা আপুর কথা সে ফেলতে পারতোনা।কৌড়ির কথা শুনে সংগোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিভান।মেয়েটার মলিন মুখ বলছে অন্য কথা।গোধূলি লগ্নের মিষ্টি আলো এসে পড়েছে মেয়েটার মসৃন মুখে।সেই আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কোনো কারনে অসুস্থ।চোখমুখ শুখিয়ে আছে।তবে অসুস্থতার কথা বলতে পারছেনা কাওকে।বা ইচ্ছাকৃত কাওকে বলছেনা।দীর্ঘশ্বাস চেপে নিভান ফের শান্ত গলায় শুধালো।

‘কোনো কারনে শরীর খারাপ তোমার?

চমকে নিভানের মুখের পানে তাকালো কৌড়ি।সুগভীর শান্ত নজরের নিভানকে তারদিকে নিটোল নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখেই মূহুর্তেই মুখটা আবার ফিরিয়ে নিলো।মানুষটা বুঝলো কি করে সে অসুস্থ?তবে কি বুঝে গিয়েছে তার কি কারনে শরীর খারাপ? উফফ! ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিতে গাঁট হলো মনস্তাত্ত্বিক।লজ্জায় হাসফাস করে উঠলো সর্বাঙ্গ।তড়িৎ বললো—আমার তো শরীর খারাপ নয়।

নীরব, অথচ গভীর নজর।কৌড়ির মুখের পানে স্থির রেখে বললো –তবে চোখমুখ ওরকম দেখাচ্ছে কেনো?

মনেমনে বিচলিত হলো কৌড়ি।কেমন দেখাচ্ছে?খুব বাজে?উফফ! কি এক জ্বালা!এতো খেয়াল করতে বলেছে কে মানুষটাকে!উত্তর দিতে চাইলো না।তবুও বাধ্য হয়ে উত্তর দিতে হলো।বেকায়দায় আছে সে।এই মানুষে ভরা বিয়ে বাড়িতে যদি মানুষটাকে আর তাকে আঁটকে থাকা বেলকনিতে কেউ দেখে ফেলে তবে কি হতে পারে ভাবতে পারছে সে!তাই ফের তড়িৎ গলায় বললো—আর পনেরো দিন পর পরিক্ষা।পড়াশোনার চাপ যাচ্ছে তো এজন্য।

”পনেরো দিন পর পরিক্ষা। এবিষয়ে তো খেয়াল রাখা হয়নি।এখন আর মেয়েটা শুধু এবাড়ির দায়িত্ব নয়।মেয়েটার ভালোমন্দের সুব্যবস্থার দ্বায় তো এখন তাকেই রাখতে হবে।খেয়াল ছিলোনা তবে খেয়াল তো এবার রাখতে হবে।বললো — পড়াশোনা কেমন চলছে?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

‘পড়াশোনাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

‘না।

কথা যেনো বাড়াতেই ইচ্ছে করলো।কি অসুস্থতায় মেয়েটার এই মলিন মুখ।সেটাও জানতে ইচ্ছে করলো।তবে মেয়েটার আড়ষ্টতায় পথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দমিয়ে নিলো নিভান।শ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাড়ালো সে।চলে যাবে বলে মনস্থির করেও দাঁড়িয়ে রইলো।ফের কি মনে করে কৌড়ির পাশাপাশি গিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়ালো।উঁচু লম্বা মানুষটাকে কাছাকাছি অনুভব হতেই নিঃশ্বাস আঁটকে এলো কৌড়ির।সেটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো,পাশে দাঁড়ানো মানুষটার গায়ের কড়া পারফিউমের সুগন্ধে।তবে নড়চড় বন্ধ করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কৌড়ি।শক্ত হাতো চেপে ধরে রইলো গ্রীলের লৌহ। পলকহীন নজর তার বাহিরের পানে।সেই মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে নিভানও নজর ফেললো গোধূলি লগ্নের ধীমে আসা সূর্যের পানে।শান্ত আর খুব সাবলীল গলায় বললো।

,জানো কৌড়ি,ভালোলাগা ভালোবাসাটা ঠিক কি।এর বিশেষ সজ্ঞায়িত আমার জানা ছিলো না।ছিলোনা বলতে,আমার লাইফে আমি ভালোলাগা ভালোবাসার বিভিন্ন বিভিন্ন ডেফিনেশন্স শুনে এসেছি।দেখেছি তেমনটাও।বিভিন্ন বইতে পড়েছিও তেমনটা।তবে নিজে জানার উপলব্ধিটা হয়নি কখনো।অনুভব করিনি কখনো আমি।এই উনত্রিশের কাছাকাছি বয়সে আমার পছন্দনীয়,মোহনীয়,নজর আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছুই নজরে পড়েছে।এমনকি বিভিন্ন রূপবতী মেয়েও।নজরে দেখেছে তাদের তবে কখনো তাদের প্রতি বিশেষ অনুভূতি অনুভব করাইনি।নজর দেখেছে,ওখানেই ক্ষান্ত। দ্বিতীয়বার আর নজর সেদিকে ফিরে তাকায়নি।অথচ হঠাৎ একদিন একজোড়া ক্রন্দনরত চোখ আমার স্বপ্নে মিললো।জানো,আমাকে ঘুমাতে দিলোনা কতোদিন।আমার একটাই দোষ ছিলো,আমার খুব কাছে বসে সেই চোখজোড়া ক্রন্দন করেই চলছিলো।অথচ আমি ফিরে তাকাইনি।তাই বাধ্য হয়ে চোখজোড়া আমার স্বপ্নে হানা দিলো।শাস্তিসরূপ কতোগুলো দিন আমাকে ঘুমাতে দিলোনা।আমি জীবনের প্রথম মায়া,টান অনুভব করলাম সেই ক্রন্দনজোড়া নজরে।যখন তাকে বুঝলাম সে স্বপ্ন আসা বন্ধ করে আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিলো।অথচ সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া পরিনত হলো সচ্চ একজোড়া মায়ামায়া ডাগরডাগর হরিনী চোখে।সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া আমাকে রাতে আরামে ঘুমাতে দিলেও সেই সচ্চ ডাগরডোগর চোখজোড়া কেঁড়ে নিলো আমার দিনগুলো।এরপর এক বিকালের গোধূলি লগ্নে একটা গোলগাল মায়াবীনি মুখ,আমার বুকের বা পাশটায় জায়গা করে নিলো।বিশ্বাস করো আমি মোটেও হিংসুটে ছেলে নই।অথচ আমি হিংসে করলাম এক যুবককে।কারন তার নজরও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো সেই গোলগাল মায়াবিনী মুখশ্রীতে।আমার কেনো জানি সহ্য হলোনা।সেই একই অপরাধের অপরাধী হয়ে আমার অপরাধ মুক্ত পাখির মতো ছেড়ে দিয়ে তার অপরাধে অভিযুক্ত করে নিষেধাজ্ঞা দিলাম।তারপর এক বৃষ্টি ভেজা দিনে সেই মায়াবিনীর অসহায় মুখ আমার বুকে ঝড় তুলে দিলো।আমি তাকে পুরোপুরি জায়গা করে দিলাম আমার সত্তায়।

‘আচ্ছা কৌড়ি,ওই টান ওই মায়া,ওইযে বুকে ঝড়তোলা অনুভূতি ওগুলোকে ঠিক কি অনুভূতি বলে?ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা?আমার মতে তো,এই দুই অনুভূতির উর্ধ্বে গিয়ে,তাকে পেয়ে যাওয়া মানে আমাকে পৃথিবীতে এক টুকরো জান্নাতের সুখ অনুভব করানো।স্বর্গসুখ লাভ করা।

চলবে…

আমি কথা দিয়েও কথা রাখতে পারিনি।তবে আল্লাহ যদি না চান,আনি কথা রাখবো কিজটে!আমার ফ্যামিলিতে আবারও একটা শোকছায়া।আমার বোনের হাসবেন্ড মারা গিয়েছে, কোনো ব্যাধি ছাড়া হঠাৎই।আপন বোন নয়,তবে আপন খালাতো বোন।আপনের থেকেও একাংশে কম নয়।আমরা তাকে বুবুমনি বলে ডাকতাম।সেই বুবুমনির অল্প বয়সে হঠাৎই বিধবা হয়ে যাওয়া।উফ কি করুন দৃশ্য!কি মানসিক অবস্থা সবার!আল্লাহ মাবুদ জানেন।আমার আম্মুকে কখনো কোনো বিপদে বা ছেলেমেয়ের কোনো সুখঅসুকে গলা ছেড়ে কাঁদতে দেখিনি।সেই আম্মু কাঁদছে!আমি আজও গল্প দিতাম না।তবে গল্পটা ছিলো,তাই সুযোগ পেয়ে দিয়ে দিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here