ফুলকৌড়ি (৩২) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
1281

#ফুলকৌড়ি
(৩২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিয়ে বাড়ি মানেই হৈ-হুল্লোড়ে ছোটাছুটি।তবে বাড়ির অধিকাংশ অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা মেহেন্দি অনুষ্ঠানে যাওয়ায় বাড়িটা আপতত কিছুটা হৈ-হুল্লোড়মুক্ত শব্দহীন, শান্ত।সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন।মান্যতার পড়ার টেবিলে মনোযোগী হয়ে পড়ছে কৌড়ি।যদিও স্থির,মনোযোগী নজর তার বইয়ের পাতায় তবে অমনোযোগী মনটা তার পড়ে আছে অন্যকোথাও।অন্যকোথাওটা ঠিক কোথায়!যে মানুষটার থেকে বারংবার নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলো।তারকাছে?হ্যাঁ তার কাছেই তো!পারছে কোথায় ওই মানুষটাকে নিজের মনস্তাত্ত্বিকে ভাবনা থেকে দূরে রাখতে!যতোই দূরে রাখতে চাইছে,ওই মানুষটা যেনো ততোই টানছে তাকে।তারপ্রতি ভয়াবহ দূর্বল করে তুলছে।দূর্বল তো এমনিতেই হয়ে পড়েছে সে।শুধু উপরে নিজেকে শক্ত রাখার প্রয়াস করে চলে।তবে সেই প্রয়াস,প্রচেষ্টাটাও রাখতে দিচ্ছে কোথায় মানুষটা!বিকেলের বলা গম্ভীর মুগ্ধকন্ঠের অনূভুতিপূর্ন কথাগুলো বারবার মনস্তাত্ত্বিকে হানা দিচ্ছে।শান্তিতে কোনো কিছুতেই তাকে মনোযোগী হতে দিচ্ছে না।না পারছে বইয়ের পাতায় মনোযোগী হতে আর না পারছে বিয়ে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় করে কাটাতে।যদিও শারিরীক কারনে আপতত হৈ-হুল্লোড় তার ভালো লাগছেনা।আবার পনেরো দিন পর পরিক্ষা। আপতত সেই টেনশনে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।তারউপর ওই মানুষটা!যাকে না পারছে বিভিন্ন দিকের কথা ভেবে সহজে নিজের জীবনে জায়গা দিতে।আবার আর না পারছে নিজের মনস্তাত্ত্বিক থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে।বরাং বারবার মনেহচ্ছে,ওই মানুষটা শুধু তাকে চায়!উনার সকল মুগ্ধকরা অনুভূতি শুধুই তাকে ঘিরে!উফফ এই ভাবনা গুলো সর্বাঙ্গে যেমন থেমেথেমে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে তেমন মনমস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দিচ্ছে।দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো কৌড়ি।কি এক যন্ত্রণা!তাকে নিয়ে মানুষটার অনুভূতিগুলো জানার পর আরও যেনো মন ছটফট করছে।যতোই মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেনা কেনো,পারছেইনা!হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।সচকিত হয়ে মাথা উঁচু করে ফোনের দিকে তাকালো।বিথী ফোন করেছে।ফোনটা রিসিভ করে,কানে চাপলো কৌড়ি।প্রতিনিয়ত কথা হয় দু’জনের।সেই হিসাবে ভালো মন্দের বার্তা শুরু হলো।একপর্যায়ে গিয়ে বিথী জিজ্ঞেস করলো।

‘তোর মন খারাপ নাকি?

সচকিত হলো কৌড়ি।তড়িৎ বললো—আরেহ না।

‘তবে কথার স্বর ভালো লাগছে-না কেনো?কথাগুলো যেনো কেমন লাগছে!

‘জানিসতো বাড়িতে বিয়ে।তারউপর পনেরো দিন পর পরিক্ষা টেনশনে মাথায় কাজ করছেনা।এখানে আসার পর পড়ার গ্যাপ গিয়েছিলো প্রায় অনেকদিন।সেই গ্যাপ পড়া চ্যাপ্টারগুলো সেভাবে কভার করা হয়নি।তারউপর যা সিলেবাস।কিভাবে সবটা কমপ্লিট করবো সেটাই ভাবছি।

‘টেনশন নিচ্ছিস কেনো।আরেহ সব ভালো হবে।ইউ আর এ গুড স্টুডেন্ট।এটা তো শুধু আমরা বলিনা,তুই ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করিস।তবে কেনো এতো ভাবছিস?সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে দেখিস।বরাবরের মতো তোর পরিক্ষাও ভালো হবে।

‘হুমম।তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?

যদিও জানাশোনা উত্তর তবুও জিজ্ঞেস করলো কৌড়ি।—আরেহ এতো পড়াশোনা দিয়ে কি হবে ভাই।
তারউপর সেই পড়াশোনা নিয়ে টেনশন!আমি বিথী জানিসইতো পড়াশোনা নিয়ে সবসময় চিল থাকি।পড়াশোনা নিয়ে টেনশন নিয়েছি কখনো।তাতে যাহা আছে কপালে।আপতত তুইও টেনশন নিসনা।

টেনশন নিসনা বললেই কি হয়।মাথায় ভাবনা যে তার কতপ্রকার এসে চেপেছে এটা যদি সে,এই চিলমুডে থাকা মেয়েটাকে বোঝাতে পারতো!বোঝাতে চাইলোওনা কৌড়ি।তাই ওই বিষয়ে আর কথাও বাড়ালোনা।দুই বান্ধবীতে মিলে আরও কিছুসময় কথা বললো।কথা শেষ করে কৌড়ি যখনই ফোন কাটতে যাবে তখনই বিথী পুনরায় তাকে অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠলো।

‘এই কৌড়ি।

ডাকটা অদ্ভুত ঠেকলো কৌড়িরও। কপালও কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো।কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো—এভাবে ডাকলি কেনো?কিছু হয়নি তো ওদিকে?

‘আরেহ না।তবে তোকে কিছু বলার ছিলো।

‘কি?

কথাগুলো বলবে কি বলবেনা কিছুটা দ্বিধায় ছিলো বিথী।যার কারনে কল করে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলেনি।তবে বলেই যখন ফেলেছে আর দ্বিধা রাখলো না।বললো।

‘জানিস নাহিদ ভাইয়া না ভালো হয়ে গেছে।আগের মতো আজেবাজে ছেলেদের সাথে মোড়ের মাথায় বসে থাকে না।এমনকি সময় অসময়েও তাকে আড্ডা দিতে দেখা যায় না।একেবারে খুবই ভদ্রসদ্র ছেলে না হয়ে গেলে-ও,স্বাভাবিক ছেলেদের মতো চলনফিরন করছেন।কথাবার্তা চালচলনে আগের সেই উগ্র আচারন আর নেই।জানিস আব্বু এসেও প্রায় বলে,মাস্টারের ভাইয়ের ছেলেটা বুঝি এবার ভালো পথে ফিরলো।নিশির সাথেও প্রায় দেখা হয়।ও-ও বলেছে,ভাইয়া নাকি আগের মতো ওসব উল্টো পাল্টা সাইপাস আর খায়না।ওর সাথে-ও নাকি আগের মতো বকাবকি চিল্লাপাল্লাও আর করে-না।মাঝে একদিন কলেজে যাওয়ার পথে আমার সাথে দেখা হলো। আমার কাছে-ও তোর খবর জানতে চাইলেন।উনি যেভাবে জিজ্ঞেস করলেন মনে তো হলো আমার সাথে যে তোর যোগাযোগ আছে।এটা উনি সিইওরলি জানেন।সেভাবেই তো প্রশ্ন করলেন বলেও মনেহলো আমার।তাই আমিও আর এড়িয়ে যেতে পারিনি।বলেছিলাম,তুই ভালো আছিস।তারপর ভালো ছেলের মতো চলে গেলেন।উনার আচারন দেখে আমার সত্যি মনেহচ্ছে উনি ভালো পথে ফিরেছেন তবে!আগে তো আমাকে দেখলেই,এই ছেমড়ি ছাড়া শব্দ ব্যবহার করতো না।সেদিন নাম ধরেতো ডাকলেন সাথে তুমি করেও কথা বললেন।

কিছুটা অবাক হলো কৌড়ি।দাদিআপার সাথে রোজ কথা হয়।কৈ,দাদিআপা তো এবিষয়ে তাকে কিছু বলেন নি!আবার বিথীর কথাও অবিশ্বাসযোগ্য নয়।মেয়েটাকে চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করে এমনটা নাহলেও অবিশ্বাস সে কখনোই করতে পারবেনা।যাই হোক এসব নিয়ে আর সে ভাবতে চায়-না।যে ছেলেটার জন্য মা-হীন জীবনটা তার আতঙ্কে কেটে গিয়েছে।জীবনে কতোকিছু ত্যাগ করতে হয়েছে।এমনকি নিজের বাড়িতে সাচ্ছন্দ্য বসাবস করার অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত।আজ পরের বাড়িতে আশ্রিতা হতে হলো।বাবার তাকে নিয়ে চিন্তায় ব্লাডপ্রেশার বাড়ানো বা এই অকাল মৃত্যুর জন্য ছেলেটা কোনোভাবে কি দ্বায়ী নয়?আর সেই ছেলেটার ভালোমন্দে চাইলেই কি মন সহানুভূতি দেখায়!দেখায় কি-না কৌড়ির জানা নেই।তবে সে দেখাতে পারলোনা।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিথীকে বললো।

‘যাই হোক,ভালো হলেই ভালো।তবে আমার ফোন নাম্বর চাইলে কখনো দিস-না যেনো।আমি সত্যি, তোকে কিন্তু দাদিআপার থেকেও একফোঁটা কম বিশ্বাস ভরসা করি না।

‘আমি জানি সেটা।আর আমার জ্ঞানত আমি কখনো তোর সেই ভরসা বিশ্বাস ছুটতে দেবনো।এটা তুই আমার উপরে ভরসা রাখতে পারিস।

‘ভরসা রাখি বলেই তো তোকে এক্সট্রা সর্তক করলাম।

‘হুমম।

দু’জনে আরও কিছু সময় ভালোমন্দ কথা বললো।ফের ফোন রাখলো।ফোন কেটে দিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত হলো কৌড়ি।হঠাৎ উগ্র স্বভাবের ছেলেটার পরিবর্তনের কারন কি!ছোটো বেলা থেকেই বাজে উগ্র স্বভাবের ছেলেটা হঠাৎই পরিবর্তন হয়ে গেলো!বিষয়টা বিস্ময়কর!
যেখানে ওর মা-ও কখনো আশা রাখেনি ছেলেটার আর ভালো পথে ফিরবে।একপ্রকার আশা ছেড়ে দিয়ে, নিজের ছেলে নেই বলে ঘোষনাও দিয়ে দিয়েছিলো।সেখানে নিজের মায়ের ওমন কথাতেও যে ছেলে ভ্রুক্ষেপ করেনি,সেই ছেলের হঠাৎ পরিবর্তনের কি কারন?তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা!যদি তাই হয় তবে তা কখনোই সফল হতে দেবেনা কৌড়ি।আর যাই হোক ওই ছেলেটাকে জীবনসঙ্গীনি কখনো সে হবেনা। আর না কখনো সে নিজের জীবনসঙ্গিনী করবে তাকে।

‘ফুলকৌড়ি।একা একা রুমে বসে কি করছো তুমি?

নাফিমের ডাকে ভাবনা কাটলো কৌড়ির।সম্বিৎ ফিরে মিষ্টি হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কিছুটা বিস্ময় স্বরে নাফিম ফের বললো—তুমি পড়ছো?তোমার পড়তে এতো ভালো লাগে?যে সবাই এতো আনন্দ মজা করছে,তারমধ্যে তুমি তাদের সাথে আনন্দ মজা, সাজগোজ না করে বই পড়ছো!আমার তো একটুও লাগেনা পড়তে।আরও বাড়িতে কোনো আনন্দ মজা হলে-তো মোটেই ভালো লাগেনা।

কথা বলতে বলতে কৌড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো নাফিম।চেয়ার ঘুরিয়ে নাফিমের সম্মুখীন হলো নিজেও।আদূরে স্পর্শে নাফিমের গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো—পাকা বুড়ো।আমার যে কয়দিন পর পরিক্ষা, না পড়লে হবে!না পড়লে তো আমি পরিক্ষায় গোলগোল ডিম পাবো।তখন এবাড়িতে আমার জায়গা হবে।ফেল করার অপরাধে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।কে খাওয়াবে তখন আমাকে?হুমম?

মজার ছলে কথাগুলো বলতেই নাফিম তড়িৎ উত্তর দিলো।–দাদাভাই খাওয়াবে।দাদাভাই তো অনেক টাকা উপার্জন করে,তুমি জানোনা?আর জানো দাদাভাই খুব ভালো।দুষ্টমী না করলে,সে কাওকেই বকেনা।এমনকি আমি পরিক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলেও আমাকে-ও বকেনা।শুধু দাদাভাই কেমন গলায় শান্ত হয়ে অল্প কথা বলে তাতেই ভয় পাই আমরা।নাহলে দাদাভাই খুব ভালো।আমি যা চাই তাই এনে দেয়।মা বকলেও কি! এনে দেয় দাদাভাই।আর আমার খারাপ রেজাল্টে সবাই বকলেও দাদাভাই আর বড়আম্মু কখনো বকেনা।তুমি পরিক্ষা খারাপ করলে তোমাকেও কিছু বলবেনা,দেখো।

দাদাভাই খাওয়াবো”কথাটা বুকের ভিতর কেমন একটা শিরশিরি অনুভূতি জাগালো।তবে ভিতরেটা ভিতরে হজম করে বাহিরের প্রকাশভঙ্গীতে মৃদু হাসলো কৌড়ি।প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো–আচ্ছা যাই হোক।তুমি মেহেন্দি অনুষ্ঠানে যাওনি?

মূহুর্তেই মুখ ভার করে মন খারাপ করে নিলো নাফিম।ফের বললো–আমার গায়ে জ্বরতো এজন্য আম্মু যেতে দেয়নি।তুমি-ও আমার মতো অসুস্থ নাকি?তুমি যাওনি কেনো?

নাফিমের কপালে হাত দিয়ে জ্বরের তাপমাত্রা দেখলো কৌড়ি।বললো–জ্বর আসলো কখন?আর আমি-তো এমনিতেই যায়নি।

‘আমাকে রেখে যাওনি ভালো হয়েছে।এখন আমি তোমাকে মেহেদী মাখিয়ে দেবো।চলো

কথাটা কৌড়ির হাত ধরে বললো।কৌড়িও সচকিত দৃষ্টি ফেললো নাফিমের হাতে।ছেলেটার হাতে একটা মেহেদী টিউব।এতক্ষণে খেয়াল করলো সে।নাফিম এটা পেলো কোথায়?তবে কিি মেহেন্দি অনুষ্ঠান সেরে আপুরা এসেছে?প্রশ্ন করলো কৌড়ি।

‘ওবাড়ি থেকে মেহেন্দি অনুষ্ঠান সেরে আপুরা চলে এসেছে নাফিম?

‘না-তো।কেনো?

‘তবে তুমি মেহেদী পেলে কোথায়?উনারাতো ডালা সাজিয়ে সব নিয়ে গেছেন।তাহলে এটা পেলে কোথায় তুমি?

নাফিম সহজ সাবলীল স্বীকারোক্তি জানালো—দাদাভাইয়ের হাতে তো আরেক ডালা মেহেদী দেখলাম।তোমার রুমের দিকে আসছিলাম,সেটা শুনে আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,তোমাকে দিতে।আমিও ভাবলাম তোমাকে লাগিয়ে দেই।

স্তব্ধ হয়ে নাফিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।
এটাও মানুষটার স্মরণে থাকতে হলো।মনে মুগ্ধতা ছেয়ে গেলো।মন দূর্বল হয়ে পড়লো আরেকধাপ।তবে মূহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে একগাল হেসে নাফিমকে বললো—তুমি লাগাতে পারবে?আমি কিন্তু আবার লাগাতে পারিনা।

‘আমিও তো,ওইযে হাতে ড্রয়িং করেনা!ওরকম পারিনা।তবে এমনি অনেককিছু ড্রয়িং করতে পারি।আমি সেরকম একে দেবো।আমার ড্রয়িং খাতা দেখো,আমি একটুও বাজে আকাই না।আমার অন্যন্য সাবজেক্ট বাজে হলেও আমার ড্রয়িং বাজে নয়।টিচার্সরা আমার আকা খুবই ভালো বলে।

বাচ্চা ছেলেটা এমনভাবে কৈফিয়ৎ দিচ্ছে,কৌড়ির মায়া হলো।যদিও তার ফর্সা হাতদুটো নাফিমের ড্রয়িং খাতা নয়।যে আঁকলাম ভালো হলোনা আবার মুছে আঁকলাম।হাতের অবস্থা খারাপ হতে পারে বুঝেও নাফিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।বললো–তবে আঁকাও।

নাফিম হাত ধরে বেডে এনে বসালো কৌড়িকে।খুশি মনে কৌড়ির ডান হাতটা ধরলো মেহেদি লাগানোর জন্য।তবে হাতের সীমিত তালুর দিকে তাকিয়ে আকা ভুলে গেলো সে।বুঝতে পারলো এটা সত্যিই তার ড্রয়িং খাতা নয়।এখানে যেমন খুশি ঘরবাড়ি নদীনালা বা প্রাকৃতিক যেকোনো দৃশ্য আকা সম্ভব নয়।তবে কি আঁকাবে সে?কৌড়ির উৎসাহিত ঝকঝকা মুখের দিকে তাকালো।মুখটা নীরসত করে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বললো।

‘এতো ছোটো জায়গায় আঁকাবো কি?

কৌড়ি দুকাধ ঝাঁকিয়ে ঠোঁট উল্টে বোঝালো-সে কি জানে।সেটা দেখে নাফিম আরও হতাশ হলো।তন্মধ্যে সেখানে প্রবেশ করলেন নিভানের নানুমা।রসিকতা করে বললেন– ব্যাপার কি?দু’জনে চুপিচুপি কি করছো?

কৌড়ি কিছু বলার আগে নাফিম নীরস ভঙ্গিতে বললো-ফুলকৌড়িকে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি।তবে আমি আঁকতে পারছিনা নানুমা।এটুকু জায়গায় কি আঁকানো যায়?

ভদ্রমহিলা এসে বসলেন দু’জনের পাশে ফের নাফিমের কথায় তাল মিলিয়ে বললেন-আসলেইতো এতো ছোট্টো হাতে আকা যায়!যাই হোক,আমার কাছে মেহেদী টিউবটা দাও দেখি।দেখি আমি পারি কিনা লাগিয়ে দিতে?

নাফিম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো–তুমি আকাতে পারো নানুমা?

‘দেখি পারি কি-না।

দু’জনের কথার মাঝে কোনো কথা বললো না কৌড়ি।নাফিম টিউবটা দিতেই ভদ্রমহিলা কৌড়ির পানে তাকিয়ে বললেন–কিরে আমার হাতে মেহেদি লাগাতে কোনো সমস্যা নেই তো?

কৌড়ি মৃদু হাসলো।জানেনা নানুমা মেহেদী লাগাতে পারেন কি-না।তবে তিনি ভালোবেসে যখন লাগাতে চাইছেন,সে যেমনই হোক না কেনো না বলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।তাই মাথা নাড়িয়ে মুখে বললো—আপনি লাগিয়ে দিন।আমার সমস্যা নেই।

ভদ্রমহিলা হাসলেন।নাতী উনার নাতবৌ নির্বাচন করতে মোটেই ভুল করেনি।আজ দুদিন মেয়েটার সাথে থাকছেন।সত্যি বলতে মেয়েটাকে উনার সর্বদিক থেকে মনে ধরেছে।কৌড়ির হাত ধরে কোনো আঁকাআকি নয়, শুধু ফর্সা চিকনচাকন আঙুলের গোলাকৃতি করে নখ বাদে চামড়ার উপর প্রলেপ লাগিয়ে দিলেন।সঙ্গে সঙ্গে নাফিম মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো।–কি করছো নানুমা। না আঁকিয়ে এরকম লেপ্টে দিচ্ছো কেনো?

‘আমিও তো ভাই আঁকতে পারিনা।তাই আমদের সময় আমরা যেভাবে শুধু আঙুলে মেহেদী মাখতাম সেভাবেই মাখিয়ে দিচ্ছি।

নাফিম কৌড়ির মুখের দিকে তাকালো।দেখলো কৌড়ির স্বাভাবিক মুখাবয়ব।তারমানে নানুমা ভুলভাল লাগাচ্ছে না।তাই সেও চুপচাপ হয়ে গেলো।দুহাতে নখের অংশটুকু ছাড়া একটা নির্দিষ্ট পরিমাপ করে গাড় কালো খয়েরী মেহেদী রঙটা ফর্সা হাতজোড়ায় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।বামহাতের তলায় আবার গোলাকৃতি করে মেহেদীর প্রলেপ আঁকিয়ে দিয়েছেন।ফর্সা হাতটা সত্যিই নজরের মাধুর্য ছড়িয়েছে।

‘নাও,আমি যেটুকু পারি সেটুকু করে দিলাম।

টিউব দিয়ে নয়।টিউবের মাথায় মেহেদী এনে,নানুমা উনার তর্জনী আঙুলের মাথায় করে মেহেন্দিটা এতো সুন্দর পরিমাপ করে লাগিয়ে দিয়েছেন।সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।প্রশংসা করলোও কৌড়ি।খোশমেজাজে বললো।

‘খুব সুন্দর হয়েছে নানুমা।আমি এভাবে মেহেদী লাগাতে গেলে তো শুধু লেপ্টে যায়,এঁকেবেঁকে যায়।

নাফিমও কৌড়ির মতো নানুমাকে প্রশংসা করলো।ফের কিছু একটা ভাবলো।তড়িৎ বললো–ফুলকৌড়ি তোমার ডানহাতটা দাও।

কৌড়ি,কেনো?প্রশ্ন করার আগেই তার হাতটা সর্তকতা অবলম্বন করে নিজের কাছে নিলো নাফিম।ফের নানুমার হাত থেকে টিউবটা নিয়ে কৌড়ির হাতের তালুতে ইংরেজিতে ওর নামের ওয়ার্ড গুলো ক্যাপিটাল লেটারে লিখে দিলো।সেটা দেখে কৌড়ি কপাল কুঁচকে বললো।–এটা লিখছো কেনো?

‘আমার নামটা তোমার হাতে লিখে দিলাম।

স্বাভাবিক হলো কৌড়ির কপালের ভাজগুলো।ফের বললো—কেনো?

নাফিমের মুখ কাচুমাচু হয়ে গেলো।নানুমাও কৌতুহলী নজরে তারদিকে তাকিয়ে আছেন,কি উত্তর দেয় ছেলেটা।নাফিম একবার নানুমা তো একবার কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সংকোচ নিয়ে বললো।

‘আমি দীবা আপুকে দেখেছি সিয়াম ভাইয়ার নাম তার হাতে লিখতে।

‘উনিতো আপুর হাজবেন্ড তাই লিখেন।তুমি কেনো লিখলে?

‘ বড় হয়ে আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।তাই আগে থেকে তোমার হাতে আমার নাম লিখে দিলাম

‘ওমা তাই।তুমি তবে বউ হিসাবে ফুলকৌড়িকে ঠিক করে রেখেছো।

নিভানের নানুমা হেসে কথাটা বললেন।কৌড়ি কিছুটা অবাক হলো।ফের হেসে মজার ছলে বললো–তুমি জানো, তুমি যখন বড় হবে।আমার তখন নানুমার মতো বয়স হয়ে যাবে।তখন তোমার পাশে আমাকে মানাবে?খারাপ দেখাবেনা।লোকে বলবে,ওরে বাবাহ নাফিমের বউতো দেখি বুড়ি।

মন খারাপ হলো নাফিমের।তবে প্রশ্ন করতে ভুললো না।
‘কেনো?তখন তুমি অসুন্দর হয়ে যাবে?

‘তা তো অবশ্যই।

‘তবে আমি তোমার মতো দেখতে সুন্দর আরেকটা মেয়েকে নাহয় আবার বিয়ে করে নেবো।

‘আমাকে ছেড়ে তুমি আরেকটা বিয়ে করবে?

মিছেমিছি বিস্ময় দেখিয়ে কথাটা বললো কৌড়ি।এই নিয়ে নানুমা আর কৌড়ি নাফিমের সাথে বেশ মজার ছলে তর্কবিতর্ক করতে থাকলো।একপর্যায়ে গিয়ে নাফিম বললো,হাতে লেখাটা থাক।তবে সে কৌড়িকে নয়,কৌড়ির মতো দেখতে সুন্দর একটা মেয়েকে না-হয় বিয়ে করবে।

দ্বিতীয় আর কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই তন্ময়ীর আর ইভানের বিয়েটা হয়ে গেলো।তৃনয়ের সেই বন্ধুর বাংলোবাড়িতেই বিয়েটা অনুষ্ঠিত হয়েছে।বিয়ে বাড়িতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলেও বিয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম এখনো বাকি।সেগুলো কাজী সাহেব নিপুণ হাতে করে চলেছেন।আপতত বিয়ে বাড়ির সকলের উপস্থিতি সেখানেই।কৌড়িও সবার সাথে সেখানে ছিলো।তবে নাফিমের জন্য বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াতে পারলো।ছেলেটার জ্বর বেড়েছে।জ্বর অবস্থায় কিছুতেই স্বান্তনা রহমান আসতে দিতে চাননি।তবে ইভান মানেনি।ছোটো ভাইটা তার বিয়েতে উপস্থিত থাকবে না!এটা কিকরে হয়ে!অসুস্থ ছেলেটা বিয়ে বাড়িতে এসে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।জ্বরটাও প্রচন্ড বেড়েছে।এতো সময় মান্যতার কাছে থাকলেও,বিয়ে পড়ানোর আগে নিরিবিলি কৌড়ির কাছে রেখে গিয়েছে সে।হাত ধরে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার কপালে হাত রাখতেই হাতটা যেনো জ্বলে গেলো কৌড়ির।ফর্সা গোলগাল মুখটা কেমন টকটকে টমেটোর মতো লাল দেখাচ্ছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানুষের ভিড় থেকে ওকে নিয়ে সরে দাঁড়ালো কৌড়ি।নেতিয়ে আসা নাফিমকে কাছে টেনে জড়িয়ে নিলো।নাফিমও দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো কৌড়ির কোমর।শীতের মধ্যেও আগুনের মতো তপ্ততা অনুভব করলো কৌড়ি।নাফিমের অবস্থা মোটেই ভালো না।আপতত বিশ্রাম খুবই জরুরি।চঞ্চল নজরে এদিক ওদিক তাকালো কৌড়ি।অধিকাংশ পরিচিত মুখ।তবে কাকে ডাকবে সে?

‘কি হয়েছে?ওর জ্বরটা বেড়েছে নাকি?

নিভানের কন্ঠ পেয়ে পাশে তাকালো কৌড়ি।মূহর্তেই নজর ঘুরিয়ে নিজের ডানহাতের দিকে নজর পড়লো তার।হাতের তালুটা দেখতে গিয়েও দেখলো-না।রাতে নানুমা মেহেদী মাখিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর হাত ধুয়ে যখন হাতদুটো দেখলো।ফর্সা হাতদুটো গাঢ় খয়েরি রঙে চকচক করছিলো।সাথে নাফিমের নামটাও।অথচ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর হাত ধুতে গিয়ে হাতের দিকে নজর পড়তেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো সে।নাফিমের নামের এন অক্ষরটা সুস্থ সাবলীল,আস্ত থাকলেও পরের অক্ষরগুলো মেহেদী দিয়ে লেপ্টে মুছে দেওয়া।একটু নয় খুব আশ্চর্য হয়েছিলো কৌড়ি।সেই থেকে এই পর্যন্ত যতবার হাতে নজরে পড়ছে,মনে প্রশ্ন জেগেছে।কে করেছে এই অকাজ?তবে এই মানুষটাকে সেখান থেকে যতবার নজরে পড়েছে,কৌড়ির মনের সন্দেহের তীরটা কেনো জানেনা কারন ছাড়াই মানুষটার উপর গিয়েই বর্তাচ্ছে।কৌড়ির ভাবনার মধ্যে নাফিমের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরীক্ষা করলো নিভান।নাফিম একটু মুখ উচু করে দেখলো তাকে।দেখেই বললো।

‘দাদাভাই বাড়িতে যাবো।

নিভান কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো।–ওরতো প্রচুর জ্বর!বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন!কি করি এখন!

সম্বিৎ ফিরলো কৌড়ির।তন্মধ্যে ফোন বের করে তৃনয়কে কল করলো নিভান।নাফিম সম্পর্কে জানিয়ে বাড়ি যাওয়ার মনস্থির করলো।

‘নাফিমকে আমার কাছে দাও।

দ্বিধান্বিত গলার স্বর।–আমি-ও যাবো।

আশ্চর্য হলো নিভান।মেয়েটা তারসাথে যেতে চাইছে!কৌড়িকে যেটুকু চিনেছে,তার অনুভূতি জানার পর মেয়েটা একা কখনোই তার সঙ্গ পছন্দ করবেনা।সেই মেয়েটা তারসাথে যেতে চাইছে।শরীর খারাপ নয়-তো মেয়েটার! যদিও কাল মেয়েটার চোখমুখের প্রকাশভঙ্গি বলছিলো,মেয়েটা কোনো কারনে অসুস্থ।তবে কি সত্যিই অসুস্থ মেয়েটা!বললো–তুমি কেনো যাবে?শরীর খারাপ লাগছে?নাকি এখানেই থাকতে ভালো লাগছে না।

দুটোই।তবে কৌড়ি কারন হিসাবে প্রথমটা বেছে নিয়ে বললো–শরীর ভালো লাগছেনা।

কিছুটা বিচলিত হলো নিভান।বললো–ডক্টরের কাছে যাওয়া কি প্রয়োজন?

‘না।ডক্টরের প্রয়োজন নেই।বাড়িতে নিয়ে গেলেই হবে

অস্বস্তি হলো কৌড়ির।এই কারনেই বলতে চাইছিলোনা। তবে সত্যিই শরীর ভালো লাগছেনা তার।পিরিয়ড জনিত সমস্যা তো আছেই।অনিয়মিত পরিয়ড।তাতে তো বিভিন্ন কমপ্লিকেশন্স রয়েছে।সকাল থেকে আবার মাথাটাও কেমন ধরে আছে।সব অনুষ্ঠান অসুস্থতা বলে কাটিয়ে দিলেও,বিয়েতে আসবেনা।এটা কেমন দেখায়!তাই শরীর খারাপ নিয়েও বাধ্য হয়ে বিয়েতে আসতে হলো তাকে।এখন আবার যেতে চেয়ে এই মানুষটার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।এজন্য বলতে চাইছিলো না।তবে নাফিম যখন যাচ্ছে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছিলোনা।তারমধ্যে নিভান বললো।

‘এখনো তো খাওনি।বিয়ে বাড়িতে না খেয়ে চলে যাবে?

‘নাফিম না খেয়ে চলে যাচ্ছে আমি না খেয়ে গেলে সমস্যা কোথায়?আর এমনিতেই আমার খেতেও ভালো লাগছেনা।বাড়ি যেতে মন চাইছে।

কৌড়ির মুখের পানে শান্ত নজর ফেললো নিভান।সাধারণ একটা মুখাবয়ব।বিয়ে বাড়ির এক্সট্রা সাজগোজের লেশ সেই চোখেমুখে নেই।সাজ বলতে গাঢ় নেভিব্লু কালোরের একটা দামী চুড়িদার পরা।সাথে নেভিব্লু রঙেরই হিজাব জড়ানো মাথায়।ব্যাস এটুকুই। তাতেই এই বিয়ে বাড়ির সকল রমনীর মধ্যে নিভানের নজর কাড়ছে এই মেয়েটা।কৌড়ির এলোমেলো নজর নাফিমের দিকে,সেটা খেয়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।বললো–চলো।

স্বস্তি পেলো কৌড়ি।নাফিমকে কোলে তুলে নিল নিভান।গাড়িতে গিয়ে বসে মান্যতাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো নাফিম আর কৌড়িকে নিয়ে এসেছে সে।কারন জানতে চাইলোনা মান্যতা। দাদাভাই নিয়ে গেছে মানেই কারন আছে।আর নাফিমের তো জ্বর ছিলোই।পিছনের সিটে নাফিমকে জড়িয়ে বসা কৌড়ির পানে একপলক তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো নিভান।কিছুদূর আসতেই সামনের আয়নায় দেখতে পেলো কৌড়ি ফের তার হাতটা দেখছে।মনেমনে হাসলো নিভান।ফের সাবলীল গলায় কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘তোমার সন্দেহ ঠিক।কাজটা আমিই করেছি।

চমকে সামনে তাকালো কৌড়ি।তবে তার ধারণা ঠিক। ফের নাফিমের দিকে তাকালো।এতোটুকু একটা বাচ্চা ছেলেকে কেউ হিংসা করে,আশ্চর্য!নিভান বুঝি কৌড়ির মনোভাব কিছুটা বুঝলো।ফের বললো।

‘তবে ভুলে-ও ভেবো-না,আমি নাফিমকে জেলাস ফিল করে কাজটা করেছি।যদি জেলাসি হয়ে থাকে তবে পাত্র স্থান ভেদে নামটায় হয়েছে।তোমার হাতে অন্য কারও নামের সিলমোহর।মানা যায়!কৌড়ির হাত হোক বা সর্বাঙ্গে,অন্য কারও অধিপত্যে।মানবে বলছো নিভান!উহুম।মানবে না নিভান!

ছিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে নিয়েছে সেই কখন।শরীটা কেমন অসাড় অসাড় লাগছে তার।মাথাটার ঝিমঝিমানিটা কেমন একটু একটু বাড়ছে।এই মানুষটাকে আর উপেক্ষা করবে কিকরে সে?সবাই বলে মানুষটা অনুভূতিহীন। তার দেখাও তেমনটাই।সবার সামনে মানুষটা কেমন অদ্ভুত গম্ভীর্যপূর্ন,শান্ত,চুপচাপ। অথচ তার কাছে কতো সহজ সাবলীল।রাখঢাক নেই।সেই মানুষটার অনুভূতি গুলো কিভাবে আর উপেক্ষা করে চলবে!তবে দাদীআপাকে কি কৈফিয়ত দেবে সে?মৃত বাবা মাকে কোনোপ্রকার অসম্মানিত করা হবে নাতো!মানুষটার প্রতি দূর্বলতা বাবা মাকে ছোটো করে দেবে না-তো!মনের মধ্যে আবারও দোটানা শুরু হলো।
বুঁজে থাকা চোখের কোণ ঘেঁষে গড়ালো নোনাজল।সেটা লক্ষ্য করেই গাড়ি থামিয়ে পিছে ফিরলো নিভান।বিচলিত গলায় বললো।

‘এই কৌড়ি,শরীর বেশি খারাপ লাগছে?আমাকে বলো কি হচ্ছে?

কান্নারা যেনো ভিতর থেকে এবার উপচে বেরিয়ে আসতে চাইলো।তবে দাঁতে দাত চেপে সেই কান্না আটকালো কৌড়ি।কার উপর অভিমান হলো জানা নেই।তবে অভিযোগের স্বরে বললো–আমাকে কেনো একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না?

মুখাবয়ব পাল্টে গেলো নিভানের।কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়।মেয়েটার চোখের নোনাজল বলছে,তারপ্রতি দূর্বলতা।তবে কেনো এতো আপত্তি?এবার অভিযোগ সেও হানলো।রুক্ষ গলায় বললো—-এই তুমি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছো,বলছো?দিচ্ছো কোথায়!

তড়িৎ উত্তর দিলো কৌড়ি।—তবে কি চাইছেন,এবাড়ি থেকে আমি চলে যাই?আপনার শান্তি হোক?

‘তুমি যদি আমার শান্তি প্রশান্তিটা কিসে সেটা বুঝতে! তবে তো হয়েই যেতো।

কঠিন হয়ে এলো নিভানের চোয়ালদ্বয়।আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলো-না সে।আর না কৌড়ির উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় রইলো।হাতের তালু দ্বারাা স্ট্রারিংয়ে আঘাত করে,গাড়ি চলমান করলো।সেই আঘাতে কেঁপে উঠে ঘুমন্ত নাফিমকে আরও শক্তকরে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তবুও চোখ খুললোনা।

বাড়িতে ঢুকতেই ছেলের অবস্থা দেখে স্বান্তনা রহমান অস্থির হলেন।নাফিম ঘুমিয়েছে।নিরিবিলি জায়গা হিসাবে মান্যতার রুমে শুইয়ে দিলো ওকে।ওকে শুইয়ে দিয়েই চলে গেলো নিভান।স্বান্তনা রহমান ছেলেকে ভালোভাবে শুইয়ে,গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে কৌড়িকে ওর খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলেন।হাতে অনেক কাজ।বিয়ে বাড়ির কাজ বলে কথা।তা বাদেও একটু পরে বউ নিয়ে আসবে তার বিশেষ আয়োজন।বাড়িতে বরযাত্রী যাওয়া ছাড়াও অঢেল মেহমান।তাদের খেদমত খাদিম তো লেগেই আছে।স্বান্তনা রহমান চলে যেতেই কৌড়ি ওয়াশরুম ঢুকলো। জামাকাপড় চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লো নাফিমের পাশে।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা তার পাশ ঘেঁষে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে তলিয়ে গেলো।সেটা দেখে নাফিমের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে কপালে ছোটো করে একটা চুমু দিলো কৌড়ি।গায়ের পাতলা কম্বলটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে সে-ও চোখ বুজলো।খানিকক্ষণ পর অনুধাবন করলো রুমে কেউ ঢুকেছো।অকারনেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো তার।তবে ভুলেও চোখ খুললোনা।তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে,সেই মানুষটা এসেছে।যতোই তার পায়ের গতিবেগ বেড়ে কৌড়ির কাছাকাছি হতে থাকলো।রুমে ঢোকা মানুষটার গায়ের সুগন্ধে অনুধাবন সত্যি হতে লাগলো কৌড়ির।বেডের পাশে এসে সেই পদধ্বনি স্থির হয়ে যেতেই,নিজেও বরফ জমার মতো জমে চুপ হয়ে রইলো।হঠাৎ সমস্ত রুমে পদচারণেট শব্দ শুনে চোখ অল্প খুললো সে।কি খুঁজছে মানুষটা!নিভানকে আবার তাদের দিকে ফিরতে দেখেই চোখ বন্ধ করে নিলো সে।আবার বাহিরের পানে পদচারণ শুনে চোখ খুলে দেখলো,মানুষটা চলে যাচ্ছে। স্বস্তি পেলো কৌড়ি।উঠে দারজা লাগিয়ে ঘুমাবে কি-না ভাবতেই আবার সেই পদচারণ।দ্রুত ফের চোখ বন্ধ করে নিলো।সেই একই ব্যাক্তির পদচারণ এসে থামলো বেডের পাশে।মূহুর্তেই ভারী কিছু একটা গায়ের উপর পড়তেই বুঝতে পারলো,ভারী কম্বল জাতীয় কিছু একটা তাদের গায়ের পাতলা কম্বলটার উপর ঝাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।আসলেই প্রয়োজন ছিলো।আর সেটা থেকে সেই একই কড়া সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।দম বন্ধ হয়ে এলো কৌড়ির।চেয়েও চোখ খুলতে পারলোনা।হঠাৎ নিজের নাকেমুখে শক্ত চুলের আবরণ অনুভব হতেই মিটিমিটি চোখ খুললো সে।দেখলো,মানুষটা নাফিমের কপালে চুমু দিচ্ছে।শিহরে উঠলো কৌড়ির সমস্ত শরীর।একটু আগেই সে ওই একই জায়গায় নাফিমকে চুমু দিয়েছে।নিভানকে সরে যেতেই দেখেই আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো।সেটা আরও প্রগাঢ় হলো,কারও শক্ত হাতের ছোঁয়া নিজের মাথায় পেতেই।নড়চড় করলোনা,শুধু নির্জীব হয় পড়ে রইলো।সেই বুঁজে রাখা চোখের দিকে, মুখের দিকে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নিচু করে কৌড়ির কাছাকাছি হলো।ফের ধীর,শিথিল গলায় বললাে।

‘তুমি যদি জানতে তুমি নিভানের ঠিক কোথায় নিজের জায়গাটা করে নিয়ে বসেছো?তুমি নিভানের ঠিক কি?তবে আর শান্তিতে থাকতে চাইতে না,নিভানকেই চাইতে।আমাকে চাইতে কৌড়ি।আমি জানি তুমি জেগে আছো।তবে এবার তুমি না চাইলে নিভানের শেষ চাওয়াটুকুসহ সে-ও নিঃশেষ হয়ে যাবে।তবে তোমার শান্তি ভঙ্গ করতে,তোমার দুয়ারে আর আসবে-না।তবুও চলে যাওয়ার কথা আর কখনো মুখে এনো না কৌড়ি!কখনোই বোলো-না কৌড়ি!কখনো না!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here