১.
জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং বাগানবাড়িতে বাঈজিদের নাচ দেখছিলেন নিজের ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধুকে নিয়ে। মোমবাতির আধো আলো,আধো অন্ধকারের মধ্যেই হঠাৎ একজন বাঈজি কোমরের খাপ থেকে ছুরি বের করে কো*প বসাতে যায় জমিদারের বুকে।বিধাতা সহায়,সেই মুহুর্তেই জমিদার রাজেন্দ্র নিজের ডান হাত দিয়ে বাম পাশ থেকে মদের গ্লাস নিতে যাচ্ছিলেন,ছুরির কো*প বুকে না লেগে তার হাতে লেগে যায়।আর্তচিৎকার করে জমিদার বাঈজি মেয়েটাকে খামচে ধরে। সেই মুহুর্তে কক্ষে থাকা সবগুলো মোমবাতি নিভে যায়,মেয়েটা একছুটে হাত ছেড়ে পালিয়ে যায়।বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়,বাতির আলোয় দেখা যায় ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে তিনটি ১৬ বছর বয়সী মেয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। তাদের মুখের অর্ধেক জরির কাপড় দিয়ে আবৃত করা।একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তাদের নাচের চতুর্থ সঙ্গিনীকে দেখতে না পেয়ে,তিনজনই বুঝে গেছে তাদের সঙ্গিনী মেয়েটিই এই কাজ করেছে।
জমিদারের চিৎকারের সাথে সাথে ছুটে আসে তার রক্ষীরা সবাই,বাগানবাড়িতে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। ডাক্তার বাবুকে খবর দেওয়া হয় তাৎক্ষণিক।
মুহুর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়েছে জমিদারের বাগান বাড়ির নাচমহল থেকে নিজের বাড়ি চন্দ্রমহলেও।
একে একে জমিদারের চার পুত্র ছুটে আসে পিতার কাছে।
বন্ধ করে দেওয়া হয় বাগান বাড়ির সকল দরজা,কেউ যাতে পালাতে না পারে।জমিদারের সেজো পুত্র প্রভাত নিজেই ডাক্তার,সে বাবার হাত সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে দেয়।
রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং চার পুত্রকে ডাকলেন।
জমিদারের চার পুত্র,বড় পুত্র প্রকাশ,মেজো পুত্র প্রতাপ,সেজো পুত্র প্রভাত আর ছোট পুত্র প্রলয়। থমথমে মুখে তিন পুত্র পিতার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। শুধুমাত্র প্রলয় বাদে,সিনা টান করে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো সে বাবার দিকে।দুচোখ দিয়ে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে,রাজেন্দ্র নারায়ণ কনিষ্ঠ পুত্রের তেজী চাহনির দিকে বেশীক্ষণ তাকাতে পারলেন না।কোনো এক অজানা কারণে তিনি তার এই কনিষ্ঠ পুত্রকে বেশ ভয় পান।প্রলয়ের দৃষ্টিতে কি আছে তিনি সেই হিসেব মিলাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। শুধু মনে হয় তার এই অগ্নিগোলকের ন্যায় দুই নয়ন তার খুব চেনা,খুব আপন কারো সাথে ভীষণভাবে মিলে যায়।
রাজেন্দ্র নারায়ণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললেন,”দুষ্কৃতিকারী মেয়েটিকে খুঁজে বের করো,এতো বড় দুঃসাহস কার আমি তা দেখতে চাই!
যেভাবেই হোক তাকে জ্যান্ত চাই আমি,একটা নখের আঁচড় ও যেনো না লাগে তার গায়ে।তার শাস্তি আমি দিবো।”
উপস্থিত সকলের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো জমিদারের কথা শুনে,কেননা সবাই জানে জমিদার সেই মেয়েটিকে কি কঠিন শাস্তি দিবে।
প্রকাশ,প্রতাপ,প্রভাত তিন ভাই ক্রোধান্বিত হয়ে বের হয়ে গেলো মেয়েটিকে খুঁজতে। প্রলয় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
তারপর বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে বললো,”আর কতো আব্বাজান? ”
প্রলয় যেতেই রাজেন্দ্র নারায়ণের বুকে অধিক চাপ অনুভূত হলো।”আর কতো” বলে প্রলয় কি বুঝাতে চেয়েছে?
২.
নাচমহলের আয়না ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমে এক কিশোরীকে পাওয়া গেলো হাত পা মুখ বাঁধা,অজ্ঞান অবস্থায়। বাগান বাড়ির সব দায়িত্ব রঙ্গনার উপর দেওয়া। এই বাগান বাড়ির একচ্ছত্র অধিপতি বলতে গেলে রঙ্গনা।কোন মেয়ে কবে কী পোশাক পরবে,কি করবে না করবে সব রঙ্গনার কথাতেই হয়।
১০ বছর বয়সী রঙ্গনা এই বাগানবাড়িতে এসেছিলো কাজের খোঁজে তারপর আর বের হতে পারে নি,রঙ্গনার এখন ৬৫ বছর বয়স।আজও তার বাঁকা ঠোঁটের হাসি দেখলে যে কারো মনে হয় যৌবনে এই নারীর রূপ-সুধা না জানি কেমন ছিলো!
তার দেহটা কতো উপভোগ্য ছিলো!
রঙ্গনা বাথরুমে থাকা মেয়েটাকে সহ চারটি মেয়েকে একত্র করে। তারপর নিজের দাসী অঞ্জলিকে আদেশ দিলো একটা সুপারি কাটার যাঁতি নিয়ে আসার জন্য।যে মিথ্যা বলবে তার একটা একটা করে সবগুলো আঙুল কে*টে নিবে রঙ্গনা।
বাগান বাড়ির সবাই উপস্থিত হলো বিচারালয়ে।স্বয়ং জমিদার এবং তার চার পুত্র ও আছে।সোফায় বসে আছে পিতা পুত্র সবাই।রঙ্গনা বসেছে অপেক্ষাকৃত নিঁচু একটা মোড়ায়।
মেয়ে চারজন দাঁড়িয়ে আছে,থরথর করে কাঁপছে চারজনেই। গলা শুকিয়ে মরুভূমি তাদের।
অন্যরা সবাই ফ্লোরে বসে আছে বিচার কার্য দেখার জন্য।সবাই জানে রঙ্গনার কঠোরতার কথা।
যাঁতা নিয়ে আসতেই রঙ্গনা চারজনকে জিজ্ঞেস করলো,”নাম কি তোদের?”
বাথরুমে বন্দী থাকা মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে বললো,”আমার নাম জ্যোতি,ওর নাম আরতি,ওর নাম সাবিত্রী আর ওর নাম দীপা।”
রঙ্গনা জিজ্ঞেস করলো,”তোকে বন্দী করেছে কে বাথরুমে,দেখেছিস তাকে?”
জ্যোতি কেঁদে উঠে জবাব দিলো,”আমি সাজগোজ করে একটু বাথরুমে গিয়েছিলাম,এসে দেখি আয়না ঘরে কেউ নেই,আগাগোড়া কালো চাদরে মোড়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে,মুখে কালো মুখোশ। আমি চিৎকার করতে যেতেই মেয়েট আমার ঘাড়ে আঘাত করে। তারপর আর আমার কিছুই মনে নেই।”
রঙ্গনা যাঁতার ফাঁকে জ্যোতির একটা আঙুল রেখে হিসহিসিয়ে বললো,”সত্যি কথা বল নটীর বাচ্চা,নয়তো কেঁ*টে দিবো আঙুল তোর,তুই নিজেই এই কাজ করছস।সত্যি করে বল?”
কাঁপা কাঁপা গলায় দীপা বললো,”জ্যোতির কথা বিশ্বাস করেন বড়দিদি,আসলেই ও জ্যোতি ছিলো না। জ্যোতি আমাদের সবার চাইতে একটু খাটো কিন্তু ওই মেয়েটা আমাদের সবার চাইতে একটু লম্বা ছিলো। নাচের সময় আমি একবার খেয়াল করেছিলাম এটা,পরে আর কিছু বলতে পারি নি ওই সময়।”
দীপার কথা শেষ হতেই রঙ্গনা জ্যোতির হাত সরিয়ে দীপার হাত টান দিয়ে ধরে যাঁতায় ফেলে দীপা কনিষ্ঠ আঙুল কে*টে ফেললো। দীপার আর্তনাদে পুরো বাগান বাড়ি কেঁপে উঠলো। রক্তে জবজবে হয়ে গেলো ঘরের মেঝে।দীপা অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো।
রঙ্গনা নিজের মুখকে আরো কঠোর করে বললো,”এটা হলো ওর শাস্তি,কেনো ও খেয়াল করলো না বিষয়টা।ও খেয়াল করলে এই দুর্ঘটনা ঘটতো না কিছুতেই।”
প্রলয় অবাক হয় একজন নারীর এই নিষ্ঠুরতা দেখে।রঙ্গনা আর কিছু বলার আগে জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং বলে,”এদের সবার হাত ভালো করে দেখো,আমি মেয়েটির হাতে খামচে ধরেছিলাম,নখের দাগ থাকতে পারে তার হাতে।”
একে একে সবার হাত দেখা হলো কিন্তু কোনো লাভ হলো না।অপরাধীকে পাওয়া গেলো না।
রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন এটা কিভাবে সম্ভব। তার এই বাগান বাড়ি দূর্গের চাইতে কম নয়,এখান থেকে কিভাবে কেউ পালাবে!
কে এই শত্রু তার!
কিভাবে খুঁজে পাবেন তিনি তাকে!
এসব ভেবেই জমিদার নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।
জমিদারের তিন পুত্র নাচতে আসা জ্যোতি,সাবিত্রী এবং আরতিকে নিয়ে এবং জমিদারের তিন বন্ধু বাগান বাড়িতে বাস করা পছন্দের রক্ষিতাদের নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন।মুহুর্তেই যেনো সবাই ভুলে গেলেন একটু আগে ঘটা দুর্ঘটনার কথা।
নারীদেহ নিয়ে আদিম খেলায় মত্ত হলেন তারা।বসার ঘরে বসে প্রলয় শুনতে পেলো বিভিন্ন রুম থেকে আসা নারীদের গোঙানির শব্দ,খিলখিল হাসি,বিলাপ করে করা কান্না।
লজ্জায়,ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে বাগানে চলে গেলো প্রলয়। ঘৃণা হতে লাগলো তার নিজেকে জমিদার পুত্র ভাবতে। উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,”হে ঈশ্বর,এর চাইতে ভালো হতো যদি কোনো চাষার ঘরে জন্ম নিতাম,না হয় অভাবে থাকতাম,এক আধ বেলা খেয়ে বাঁচতাম তবুও এই লজ্জাজনক জীবন বয়ে বেড়াতে হতো না।বেঁচে থাকতেই নরকের যন্ত্রণা পাচ্ছি ঈশ্বর। ঘরে স্ত্রী থাকার পরেও কেনো এসব পুরুষেরা এভাবে নিজের কামনা চরিতার্থ করে?
এদের কেনো বিচার হয় না ঈশ্বর! ”
৩.
জমিদার পত্নী প্রমিলা রূপার পালঙ্কে হেলান দিয়ে বসে আছেন।একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তার খাঁসদাসী হাতে রুপোর পানের বাটা নিয়ে।প্রমিলা হাত বাড়াতেই একটা পান সে বাড়িয়ে দিলো।
পান মুখে দিয়ে প্রমিলা বললো,”বাগান বাড়ির কি খবর হেনা?দুষ্কৃতিকারী ধরা পড়েছে কি?”
হেনা জবাব দিলো,”না গিন্নিমা।”
প্রমিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আস্তে করে বললো,” পাপের বিনাশ এভাবেই হয়। ”
হেনা কিছু বুঝতে না পেরে চুপ হয়ে রইলো। আকাশে মেঘ ডাকছে,যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে।হেনা ছুটে গেলো ছাদের দিকে,শুকনো কাপড় তুলতে হবে।
বারান্দায় বসে বড় বউ অনিতা,তার সতীন জুই,মেজো বউ রূপসা,সেজো বউ জয়ী লুডু খেলছে।তাদের ঘিরে আছে মেজো বউয়ের সতীন নিতা এবং সেজো বউয়ের সতীন দেবী।
হেনা এক নজর তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,সতীন হয়েও এদের মধ্যে এতো মিল কিভাবে থাকে!ছয়জন এমনভাবে একে অপরের সাথে মিশে থাকে যেনো ছয় বোন তারা।
চারতলা দালানের ছাদে উঠে হেনা দেখতে পেলো বাড়ির বাহিরে দুই পা,এক হাত ভাঙা বোবা ভিক্ষুকটি ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে আছেন।হেনার খুব আফসোস হলো।এই ভিক্ষুকটি এখানেই থাকে সবসময়,মাঝেমাঝে জমিদার বাড়ির ফটকের বাহিরে থাকা ছোট কক্ষে কেউ দিয়ে আসলে একটু শুতে পারে আর তা না হলে এভাবেই বসে থাকে।
চলবে…….
চন্দ্রমহল (০১)
জাহান আরা
(সবার গঠনমূলক মতো মন্তব্য আশা করছি। আপনাদের মন্তব্য লিখার অনুপ্রেরণা জোগায়।)