#ফুলকৌড়ি
(৩৩)বর্ধিত অংশ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
সংকোচ ছাড়াই পাশের মেয়েটার দিকে তাকালো নিভান।মনেমনে দুর্বোধ্য হেসে বললো–তবে মেয়ে দেখো বিয়ে করে ফেলি।
‘সত্যি বলছিস!কতোগুলো মেয়ে রিজেক্ট করছিস মনে আছে! তোরজন্য মেয়ে পছন্দ করবো ভাবতেই তো ভয় হয়।এই না আবার না করে দিস।মান ইজ্জত সব যায়!
তবে আমার ননদের মেয়ে আছে না,রুশা।তুই এবার বিয়েতে রাজি হলে,ও পাত্রী হিসাবে মন্দ নয়।দেখতে শুনতে বেশ ভালোই মেয়েটা।
নিভানের ঈশিতার কথায় কোনো কান-মন নেই।সে নির্লিপ্ত নজরে তাকিয়ে আছে কৌড়ির পানে।সে চাইছে উত্তর কৌড়ির দিক থেকে আসুক।বাক্যদ্বারা না আসলেও ভঙ্গিমাদ্বারা আসুক।আসলোও তাই।নিভান কথাটা বলতেই ফট করে নিভানের মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি। নিভানকে নির্লিপ্ত নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখেই মূহুর্তেি চোখ সরিয়ে নিলো সে।এবার শব্দকরে হাসলো নিভান।চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে, গা-ছাড়া ভাব দিয়ে বললো।
‘ওসব বাদ দাও তো।ওসব মেয়ে নিভানের চলবে না।
‘দেখেছিস,এই কারনেই মেয়ে পছন্দ হলেও তাদের কাছে প্রস্তাব রাখতে পারিনা।তুই পৃথিবীর সব বিষয়ে সিরিয়াস হলেও,বিয়ে বিষয় আসলেই এমন গা-ছাড়া ভাব দেখাস। কেনো করিস এমন?দুদিন পর ইভান বাচ্চার বাবা হয়ে যাবে।আর তুই বিজনেস নিয়েই পড়ে থাকিস।
‘আপু।
মান্যতা এতোসময় চুপচাপ খাবার খেতে খেতে দুপক্ষের কথা শুনলেও এবার কেমন হাসফাস করে উঠলো।ঘনোঘনো পানি খেতে থাকলো।বড়ো ভাইয়ের সামনে এহেন কথাবার্তায় কখনো সামিল হয়নি এমনকি সামনে ও থাকিনি সে।তাই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সেটা খেয়াল করেই ঈশিতাকে ডাকলো নিভান।ঈশিতা সেটা বুঝেই বললো।
‘ওরা তো কি হয়েছে।ওরাও বড় হচ্ছে,সবকিছু বুঝতে শিখছে।আর ইভান বাচ্চারা বাবা হয়ে যাবে এটাতে খারাপ কি বলা হলো।বাচ্চা হওয়াটা বুঝি খারাপ কথা!
মা নানুমা আর এই মানুষটা তাকে বিয়ে দেওয়া নিয়ে যেনো মাঝেমাঝে প্রসঙ্গ উঠলেই পাগল হয়ে যায়।তাই ঈশিতাকে ঠান্ডা করতে বললো—আবার আমার বিয়ে নিয়ে হাইপার যাচ্ছো!উফফ, তোমাদেরকে বুঝিয়ে আর পারা যায়না।তবে বললেই কি যে কাওকে নিজের জীবনে জায়গা করে দেওয়া যায়।নাকি নিজের বলে ভাবা যায়।আমি পারিনা ভাবতে।সে হবে আমার পুরো জীবনের সঙ্গীনি।তাকে তো বুঝেশুনে নিজের জীবনে জড়াতে হবে তাইনা?বিয়ে করবো ভাবলাম,আর যে কাওকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিলাম।হলো এটা?যাকে আমি আমার আমিটা দিয়ে দেবো,তাকে পরোখ করে নেবোনা।তাকে আমার আমিটা দেওয়া যায় কি-না। তবে…
কথা শেষ করতে দিলোনা ঈশিতা।বললো–কেমন মেয়ে চাই তোর?সেটা তো বললেই হয়।তা না,যার কথাই বলি সে রিজেক্ট।পৃথিবীর সব মেয়ে তোর অযোগ্য তাই না।
রহস্যময় হাসলো নিভান।শান্ত গলায় বললো–তা বলতে পারো।শুধু একজন বাদে আর পৃথিবীর সব মেয়ে নিভানের অযোগ্য।
ঈশিতা সন্দিহান নজরে নিভানের দিকে তাকালো।ফের সন্দিহান গলায় বললো।—তোর কাওকে পছন্দ আছে বলে মনে হচ্ছে।
আর বসে থাকতে পারলোনা কৌড়ি।এভাবে বসে থাকা যায়না।দরকার নেই তার পেট-মহাজনকে শান্ত করার।না খেয়ে কেউ মরেনা।বরং হৃদযন্ত্রায় সে যখনতখন মরে যেতে পারে।আর এখানে বসে থাকা মানে নিজের মৃতুকে চুপিসাড়ে আহ্বান জানানো।উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো গরম চুলার উপরের ঝলছে যাওয়া আগুন থেকে কেউ তাকে বাঁচিয়েছে।তড়িৎ কিচেনের দিকে অগ্রসর হলো সে।তাকে দেখে মান্যতাও চলে গেলো।সেদিকে গভীর নজরে তাকিয়ে রইলো নিভান।ঈশিতার সন্দেহতা বাড়লো।হঠাৎ মাথায় যা খেললো মুখে বলে বসলো সে।
‘আমার অভিজ্ঞ নজর এবং মন বলছে তুই কৌড়িকে পছন্দ করিস।
হাসি চওড়া হলো নিভানের।নজর ঘুরিয়ে নিস্পাপ নজরে ঈশিতার পানে তাকালো সে।সেই হাসিহাসি শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নিলো ঈশিতা।কিছুটা বিম্ময় নিয়ে বললো–ও-তো বাচ্চা মেয়ে ভাই!
মূহুর্তেই নজর অসহায় দেখালো নিভানের।সেটা বুঝে দমে গেলো ঈশিতা।ভাইয়ের অসহায় নজরে পড়ে নিতে অসুবিধা হলোনা।সেখানে স্পষ্ট অক্ষরে খোদাই করে যেনো লেখা-ওই বাচ্চা মেয়েতে তোমার ভাই মন হারিয়ে বডে আছে, এখন তোমার ভাইয়ের উপায় নেই।
দুঃখী হলো ঈশিতা।তবে মেয়েটা কৌড়ি ভেবেই মনেমনে খুশিও হলো।রূপেগুনে একেবারে পরিপূর্ণা।নিভানের জন্য উপযুক্ত মেয়ে।তবে?
কন্ঠ ধীর করে ঈশিতা শুধালো—তবে ‘বাড়িতে বিয়ের কথা কেনো বলছিসনা?ফুপা-ফুপুকেও জানা।অবশ্যই তুই সিদ্ধান্ত নিলেই তো সবকিছু ওকে।
রান্নাঘর থেকে এখনো পানির আর থালাবাসনের টুংটাং শব্দ হচ্ছে। চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে নিলো নিভান।বললো—ওকে বোঝাও তবে।
‘কৌড়ি জানে তোর ফিলিংস সম্পর্কে?
চোখ বুঁজে রেখেই মৃদু হাসলো নিভান।ধীর গলায় বললো—‘জানে।
বিস্ময় নিয়ে ফের শুধালো ঈশিতা–ও রাজি নয়?
এবার হাসি চওড়া হলো নিভানের।ঈশিতার বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়ে বললো–‘না
‘বলিস কি?তুই কে আর অন্যন্য মেয়েদের নজরে কি!
আর কারা তোকে মেয়ে দেওয়ার জন্য ওতপেতে বসে আছে।এটা ও জানে!নাহলে তোকে না বলে!
হাসিটা আরও একটু চওড়া হলো নিভানের।বললো–‘এবার বোঝো কেনো তোমার ভাই মেয়েটাতে মন হারিয়েছে।এতোদিনের শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্ব চূর্ণ করে দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়েতে পাগল হয়েছে।
এগো খোলামেলা অনুভূতি প্রকাশ।সত্যিই সামনে নিভান বসে আছে,এটা যেনো ক্ষনিকের জন্য অবিশ্বাস্য মনে হলো ঈশিতার।ভাইটা যে তার বেকায়দায় ফেসে গেছে বেশ বুঝলো।কৌড়ি রাজি নয়।মনেমনে ভাইটার জন্য দুঃখও অনুভব হলো।নরম কন্ঠে বললো
‘আমি বোঝাই ওকে।
বোনের নিজের প্রতি স্নেহময় কথায় হাসলো নিভান।চোখ খুলে একপলক ঈশিতার দিকে তাকিয়ে ফের বন্ধ করে নিলো।বললো।
‘আপতত না।পনেরো দিন পর ওর পরিক্ষা।আপতত সেদিকেই ধ্যানজ্ঞান থাকুক।তারপর এডমিশনের পড়া পরিক্ষাটাও ঠিকঠাক দিয়ে নিক।এরপরেরটা আমিই বুঝে নেবো।
‘এখনো তো পাঁচ-ছয় মাসের ব্যাপার?
এবার মৃদু শব্দ করে হাসলো নিভান।সেই চমৎকার হাসিটা স্নেহভরা নজরে দেখলো ঈশিতা।নিভান বললো।
‘ভাই বিয়েতে ঘোর আপত্তি ছিলো।এখন এটুকু সময় অন্তত সবুর করো।আর আপতত কাওকে কিছু জানিও না।মা’কেও না।ঝামেলাটা ওর হবে।
‘হুমম।
দুভাইবোনের মধ্যে আর বিশেষ কথা হলোনা।ঈশিতা উঠে দাড়ালো।কিচেনের দিকে একপলক তাকিয়ে ফের নিভানের বুঁজে থাকা চোকমুখের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো।ঈশিতা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মান্যতা আর কৌড়িও নিভানকে পাশ কেটে চলে যাওয়ার আগেই মান্যতাকে ডেকে উঠলো নিভান।
‘মান্য।
দাঁড়িয়ে পড়লো দুজনেই।চোখ খুললো নিভান।নজর ফেললো মান্যতার মুখে,তারমধ্যে একপলক কৌড়িকেও দেখে নিলো।কেনো যানি মেয়েটার ফ্যাকাসে চোখমুখ বলছে,মেয়েটা কোনো অসুখে ভুগছে কিন্তু নিজের স্বভাবজাত অনুযায়ী কাওকে কিছু বলছে না।বা বলতে পারছেনা।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।স্বাভাবিক গলায় অকপটে মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।—কাল ইভানের রিসিপশন,কাল যাওয়া হবে কিনা জানা নেই।হয়তো যাওয়া হবেনা।তবে পৌরসু দিন অবশ্যই ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে।তুমি তো ডক্টর মৌমিতাকে চেনো।
মাথা নাড়ালো মান্যতা।ফের মুখে বললো।–চিনবো না কেনো।উনার কাছেই তো যাওয়া হয় বেশিরভাগ আমাদের।
‘উনাকে বলে রাখবো আমি।তোমারা শুধু গিয়ে দেখিয়ে আসবে।অসুস্থতা কি জনাবে।
আশ্চর্য হয়ে কৌড়ি নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।ফের বললো—কিন্তু আমি-তো কোনো অসুখে ভুগছিনা।তবে আমি উনার কাছে কেনো যাবো?
আমি যেতে বলেছি তাই যাবে।অসুস্থ না থাকলেও সাধারণ চেকাপ করেই চলে আসবে।
নিভানের জেদপূর্ন কথায় রুক্ষ গলায় কৌড়ি বললো।
‘এটার কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না আমি।
‘কিন্তু আমি দেখছি।
‘তবে আপনি অযথা জোরাবাদী করতে চাইছেন আমার সাথ।
রাগ হলো নিভানের।রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে কৌড়ির মুখের পনে তাকিয়ে মান্যতাকে বললো।—মান্য রুমে যাও।ও একটু পরে যাচ্ছে।
আশ্চর্য হয়ে কৌড়ি আর নিভানের ঝগড়া দেখছিলো মান্যতা।শান্ত ভিতু মেয়েটা তার ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছে!নিভান ডাক দিতেই ধরপড়িয়ে উঠলো বুক।কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো,সে-ও আতঙ্কে আছে।তার নজর বলছে,আমাকে একা রেখে যাবেনা আপু।সেই হিসাবে নিভানকে ডাকলো সে।
‘দাদাভাই।
মান্যতার ডাকের স্বর শুনে এবার কিছুটা জোর গলায় বললো নিভান।—-মান্যতা তুমি রুমে যাও।আমি বলছি তো ও একটু পরে যাচ্ছে।
“মান্যতা” ডাকটা ঠিক হজম হলো-না মান্যতার।এই ডাকটা দাদাভাইয়ের ভালো মেজাজের ডাক নয়,বুঝে কৌড়ির পানে দূর্বল নজর ফেলে চলে গেলো সে।কৌড়িও পা বাড়াতে চাইলো কিন্তু কিছুতেই যেনো তার পা উঠলোনা।আর এটাও বুজে আসলো না,সে যে অসুস্থ এই মানুষটা বুঝলো কিকরে?
‘রাগ জেদ যতো পারো দেখা-ও।গোটা তুমি হাজারটা সহ্য করার ক্ষমতা নিভানের আছে।তবে রাগ জেদ এমন জায়গায় অযথা প্রয়োগ করোনা,যেখানে বাধ্য করা লাগে তোমাকে।আমি কোনোরূপ চাইনা তোমাকে বাধ্য করতে।আমি চাই,নরমালি তুমি কথা শোনো আমার।অযৌক্তিক বা অযথা হলে শোনার দরকার নেই।কিন্তু তুমিতো শুনতেই চাইছোনা।তবে নিজের রাগ জেদ বহাল রাখার জন্য ডাক্তার দেখাতে চাইছোনা ভালো কথা।একটু নয় বেশ ভালো কথা।তবে অসুস্থতায় ভুগে যদি কোনো কঠিন অসুখ বাধিয়েছো।বিশ্বাস করো কৌড়ি, সেদিন তোমাকে আমি নিভান আস্ত রাখবো-না।
সেদিন রাগ জেদ কাকে বলে,নিভানকে দেখবে।
একটু থামলো নিভান।কৌড়িকে দেওয়া বিকালের কথাটা রাখতে পারলো-না সে,আর আদৌও রাখা সম্ভব নয়।তার কথার নড়চড় কখনো হয়না অথচ এই মেয়েটার বেলায়।সব কেমন এলোমেলো।চোখ খিঁচে বুঁজে থাকা কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।রুক্ষ গলার স্বর ছেড়ে শান্ত গলায় বললো।–মোটেও ভবিষ্যৎ নিভানকে দেখার চিন্তা ভাবনা করেনা কৌড়ি।যদি মনেমনে ভেবে থাকো,আমি শুধু মুখেমুখে বলছি।তোমাকে কিছু বলবোনা।তবে খুব ভুল ভাবছো।ভবিষ্যত রাগে জেদেপূর্ন নিভানকে যদি দেখতে চাও,তোমাকে ডিস্টার্ব করা ছেলেগুলোর থেকে জেনে নিও।নিভানের রাগ জেদ ঠিক কতোটা বাজে।
এতো দূরে যাওয়ার দরকার নেই।তোমার বড়মার কাছে জিজ্ঞেস করবে, সেই রাগান্বিত জেদালো নিভান কেমন?নাহলে তোমার মান্যতা আপুর কাছে জিজ্ঞেস করো।দরকার পড়লে তোমার ইভান ভাইয়াকেও জিজ্ঞেস করতে পারো।সবার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে জেনে তারপর যেটা খুশি সেটা করো।এরপর তোমার ইচ্ছে তুমি ডাক্তার দেখাবে কি দেখাবে না।
আমার থেকে নিজেকে দূরে রাখবে রাখো কিন্তু রাগে জেদে হারিয়ে ফেলার চিন্তা ভাবনা ভুলেও করো-না।
থামলো নিভান।সময় পার হলো চোখ খুললো কৌড়ি।হরিণী বড়বড় চোখে তখন নোনাজলে টইটম্বুর।নিভান তখনও চেয়ে কৌড়ির মুখপানে।মনেমনে নিভানের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো কৌড়ির।সেই ক্ষোভ থেকে সংকোচ ছাড়াই বললো।
‘আপনি প্রচন্ড খারাপ!
চলবে….