বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প #পর্ব-১৩ #লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

0
867

#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-১৩
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

সেদিনের পর দুদিন কেটে গেল। হুর রুদ্ধের সাথে কথা বলে না। মুখোমুখি এবং চোখাচোখি হয়ে গেলেও মুখ ফুলিয়ে অদেখা হয়ে চলাফেরা করে। রুদ্ধ চোখ বাকিয়ে সবটাই দেখে।তবে এই বিষয় নিয়ে হুরকে কোন প্রশ্ন করেনা।এতে মুখ ফোলানোর মেয়াদ আরো দীর্ঘ হতে থাকে হুরের।হুরের এমন মুখ ফোলানো নিয়ে লিলি আর জেরিন ব্যাপক আনন্দ পায়।সেটা হুরের সামনে প্রকাশ্য ও করেছে।লিলি আর জেরিনের রঙ্গিলা হাসি যখন হুরের পছন্দ হয় না তখন তাদের প্রতি আরো মেজাজ দেখায়। হুরের এমন মেজাজ দেখে যেন তাদের মজা আরও দ্বিগুণ বাড়ে। রাগে দুঃখে হুরের চোখে পানি চলে আসে। তখন শান্ত হয় লিলি আর জেরিন। কলেজ ড্রেস পড়ে হেলে দুলে সিঁড়ি দিয়ে নামছে হুর।চোখের কোনা দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে রুদ্ধ আছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করছে। এত কষ্ট করে চোরা চোখ করে রুদ্ধকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হলো সে। কয়েক সিড়ি এগিয়ে নিচে নামতেই দেখল রুদ্ধ সোফায় আয়েসি ভঙ্গিতে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে লেগে আছে তার তীক্ষ্ণ চাহনি। এই তীক্ষ্ণ চাহনির মানেটা বুঝতে পারলো না হুর। তাই তো সেও রুদ্ধের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।চাহনি নিক্ষেপ করতে করতে সিঁড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তবে রুদ্ধের তীক্ষ্ণ চাহনির রহস্য বের করতে পারল না।সোফার কাছে এসেও সেখানে গেল না সে। পা উল্টো করে ডাইনিং এর দিকে এগোতে লাগলো। তবে রুদ্ধর দিকে তাকাতে তাকাতে তার দিকে চেয়ে থেকে ভেংচি মারল। হকচকিয়ে গেল রুদ্ধ। খানিকটা সময় ধরে বোঝার চেষ্টা করল হয়েছেটা কি!যখন বুঝলো তখন ধমকে বলে উঠলো।

“হেই দাড়াও!

পা জোড়া স্থির হয়ে গেল হুরের।আস্তে আস্তে করে পিছন ফিরে চাইলো। রুদ্ধ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এক সময় রুদ্ধ এগিয়ে এসে হুরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়া হল। মধ্যেখানে তাদের পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি ই দূরত্ব। দূরত্ব বজায় রেখে রুদ্ধ ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল।
“তুমি আমায় ভেংচি কেন কাটলে?

অবাক হওয়ার মত ভান করল হুর। চোখ বড় বড় করে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল। অবাকতার স্বরে বলল,
“আমি কেন আপনায় ভেঙচি কাটবো?

পুনরায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে মারল রুদ্ধ।
“তুমি আমায় ভেংচি কেন কাটবে তা তুমিই জানো! তাই এখন অ্যাক্টিং না করে ফটাফট বলে দাও কেন ভেংচি কাটলে।

মিইয়ে গেল হুর।হুর মনে করেছিল রুদ্ধ তার ভেংচি কাটা দেখেনি। কিন্তু জল্লাদ টা তো দেখে নিয়েছে। এখন এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে হুরের।তাইতো মস্তিষ্কে প্রেসার দিতে লাগল। কিন্তু মীরজাফর মস্তিষ্ক কোন বুদ্ধি খুঁজে বের করতে পারছে না। এতে আরো নার্ভাস হলো হুর। কি জবাব দিবে না দিবে ভাবতে ভাতে ফট করে বলে ফেলল।

“আরে ওটা ভেংচি ছিল না,ওটা চু’মু ছিল।

এমন বাক্য শুনতেই আকাশ ভেঙ্গে পড়লো দুজনের মাথায়। হতবিহ্বল হয়ে গেল হুর ও। এটা কি বলে ফেললো ও? বিস্ময় নিয়ে রুদ্ধ প্রশ্ন করল,
“ওটা চু’মু ছিল?ওভাবে মুখ বাঁকিয়ে মানুষ চু’মু দেয়?যাও ধরে নিলাম ওটা চু’মু ই ছিল। কিন্তু তুমি চু’মুটা দিলে কাকে? আমাকে?

আৎকে উঠলো হুর। এ প্রশ্নের জবাব এখন আবার কি দিবে? অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভুলভাল মুখ থেকে বের হওয়ার স্বভাব তার। এই স্বভাবটা কোনক্রমে সে বদলাতে পারে না। তাইতো ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাকে মাইনকার চিপায় পড়তে হয়। বিড়বিড় করে কিছু আওড়ানোর পর আবারো ফট করে বলে উঠলো।
“আরে আপনাকে কোন দুঃখে চু’মু দিতে যাব?আমি তো চু’মু আপনার পিছনে থাকা বিড়ালকে দিয়েছিলাম।

“মিথ্যা বন্ধ করে সত্য বল। এ বাড়িতে কোন বিড়াল নেই। তোমার এই ফালতু এক্সকিউজ আমায় না দিয়ে অন্য কাউকে দিও তারা না হয় বিশ্বাস করবে।

চোখের পলক বারবার ঝাপটা মেরে রুদ্ধের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে।হার মেনে বলে উঠলো,
“আমি আপনার চু’মু নয় ভেংচি কেটেছি।

তেরে আসলো রুদ্ধ। হকচকিয়ে কিছুটা পিছনে সরে গেল ও হুর।মুখশ্রীতে ভীতু আকৃতি।নিজেদের দূরত্বের ব্যবধান কমিয়ে এনে রুদ্ধ কয়েক কদম হুরের সামনে এগিয়ে আসলো। রাগে ক্ষোভে হুরের নাক টিপ দিল। সেভাবেই ধরে রাখলো। হিসহিসিয়ে বলল,
“পরেরবার ভেংচি কাটার পূর্বে মাথায় গেঁথে রাখবে যে দ্বিতীয়বার তোমার এই নাক তোমার মুখমন্ডলে থাকবে না।

বলে আরো কিছুটা জোরে চেপে ধরে ঝাটকা মেরে হুরের নাক থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল। বেশ ব্যথা পেল হুর। আর্তনাদ করে উঠলো ।ডান হাত দিয়ে নাক ডলতে লাগলো। রুদ্ধের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল।
“এভাবে মানুষ ব্যথা দেয়?

আরো কিছুক্ষণ নাক ডলার পর নাক থেকে হাত সরিয়ে দিল। নাকের দিকে চোখ রাখল রুদ্ধ। লাল টকটকে হয়ে আছে। দুই আঙ্গুল চেপে ধরার কারণে স্পষ্ট দু আঙ্গুলের দাগ বোঝা যাচ্ছে।মনে মনে বিস্মিত হলো রুদ্ধ।চমকালো, ভড়কালো।একবার অনিচ্ছাকৃতভাবে কর্ণপাতে এসেছিল হুর খুবই সেনসিটিভ। তা এখন স্বচক্ষে দেখেও নিল। সামান্য নাক টিপেতে নাকের নাজেহাল অবস্থা।খানিকটা বিরক্ত হলো ।নিজের কাজে নাকি হুরের অবস্থাতে সেটা বুঝতে পারল না।হুরের নাক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে এগিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল।রান্নাঘরে যেতেই লিলি আর জেরিনকে কাজ করতে দেখা গেল। রান্না ঘরের রুদ্ধকে দেখে থমকে দাঁড়ালো লিলি আর জেরিন। থমকিত নয়নে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল।লিলি আর জেরিনের চাহনি তোয়াক্কা না করে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। ফ্রিজ খুলে সেখান থেকে বরফের টুকরো বের করল। একটা বাটিতে ঢেলে আবার হুরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়া হল। ভ্রু কুঁচকে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল হুর। রুদ্ধের হাতে বরফের বাটি কেন সেটার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল। তবে ফলাফল শূন্য। উত্তর পেল না।অপ্রত্যাশিতভাবে এক ঘটনা ঘটে গেল।

হাতের গতি বাড়িয়ে বাটি থেকে বরফের টুকরো উঠিয়ে হুরের নাকে চেপে ধরল রুদ্ধ। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হুরের। ঘটনাটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত হলেও রুদ্ধের কাছে তা নয়। কারণ সে জেনে বুঝেই অ কাজটি করেছে। হুরের কাছে এটা অ’কাজ ই মনে হচ্ছে। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে এলো তার।থমকালো, ভড়কালো, চমকালো।থমকে গেল তার নিঃশ্বাস।অসার হয়ে আসলো শরীর।এক তো রুদ্ধের এত কাছে আসা, দ্বিতীয়ত নাকে ঠান্ডা বরফের ছোয়া।এমন পরিস্থিতিতে হুর এই প্রথমবার পড়েছে।ধুকপুক করছে হৃদয়।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই নিশ্বাসের গতি স্বাভাবিক এর চেয়ে বেড়ে গেছে।উথাল পাথাল হয়ে গেছে ভেতর।হুরের এমতা অবস্থা চক্ষুদ্বয়ে দেখছে না রুদ্ধ। সে তার কাজে মগ্ন হয়ে আছে। খুব ধীর গতিতে হুরের নাকে বরফ ঘষা দিচ্ছে। হুর এখনো থমকিতো নয়নে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে।বরফের পানি নাক বেয়ে ঠোঁট, থুতনি, গলা ছুয়ে যাচ্ছে।রুদ্ধের চোখ গেল হুরের সিক্ত হওয়া নরম অধরের দিকে।তৎক্ষণাৎ তার হাত থেমে গেল।পলক বিহীন এক দৃষ্টিতে ভেজা অধরের দিকে তাকিয়ে রইল সে।হালকা গোলাপি রঙা অধরে পানি লেপ্টে থাকায় দেখতে আকর্ষণীয় লাগছে।হুরের মাঝেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না।সে থমকিত নয়য়ে পুরুষালী শক্ত কন্ঠ ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে আছে।বড়বড় আঁখি পল্লব আগের চেয়ে আরো বড় হয়ে আছে।

ঘোরে ডুবে গেছে রুদ্ধ।হুরের অধরের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে আসছে।হাত হুরের নাক থেকে সরে আসলো।গলে যাওয়া বরফের ছোট কণা হাত থেক পড়ে গেল।দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার জন্য আরো কিছুটা সামনে এগুতে নিলেই পিছন থেকে লিলির কন্ঠ দুজনের কানে ভেসে আসে।ঘোর কাটে দুজনের। দ্রুত গতিতে ছিটকে সরে আসে।অপ্রত্যাশিত কান্ডে আচানক ঘাবড়ে গেল হুর।তবে রুদ্ধ স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি।এতক্ষণ তো নাক, থুতনি, গলা ভেজা ছিল হুরের। কিন্তু এখন অতিরিক্ত ঘাবড়ে যাওয়ার কারণে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। ভয় পেয়ে হাত ও কচলানো শুরু করে দিয়েছে। ঘাবড়ানো অবস্থাতে একবার রুদ্ধের দিকে তাকাল। সে দিব্যি তার মত দাঁড়িয়ে আছে। লিলির চোখ পড়ল হুরের দিকে। হুরের সারা মুখোশ্রী ভেজা দেখে বিচলিত স্বরে বলল।

“কি হয়েছে হুর তোমার মুখে এমন ভেজা কেন? আর তুমি এতটা ঘাবড়ে আছো কেন? কিছু কি হয়েছে?

ঘাবরানো স্বরেই হুর বলে উঠলো,
” হু?

হুরের এমন ঘাবড়ানো স্বর দেখে লিলি রুদ্ধ এবং হুরকে পরখ করল।রুদ্ধ একবার হুরের দিকে তাকিয়ে গটগট পায়ে উপরে চলে গেল। রয়ে গেল হুর আর লিলি। হুরের নিকটে এগিয়ে এসে লিলি হুরের হাত ধরে শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল।
“রুদ্ধ স্যার কে তোমায় কিছু বলেছে?বকেছে তোমায়?

প্রান ভরে এক নিশ্বাস ছেড়ে স্মিত হেসে হুর উত্তর দেয়,
” না আপু উনি আমায় বকেন নি।নাকে একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম। সেখানে বরফ ঘষেছি,তাই মুখে পানি লেগে আছে।এখন আমি যাচ্ছি কলেজে, লেট হয়ে যাচ্ছে আমার।

পিছু ঘুরে দৌড় দিল হুর।আর এক মূহুর্ত এখানে থাকা ঠিক মনে করছে না সে।ভাগতে পারলেই যেন বাঁচে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here