#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৮
অতীতের সেই রগচটা, জেদি ছেলেটা এরপর নিজেকে একটা গন্ডির মধ্যে আটকানোর চেষ্টা করে। নিজের স্বভাবসুলভ স্বকীয়তা ত্যাগ করে নিজেকে পালটে ফেলার চেষ্টা করে। রাগ, জেদ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। সেইসাথে যোগাযোগ, আত্মিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেয় অতীতে জড়িয়ে থাকা সবার সাথে। এমনকি তমালিকার বাপের বাড়ির লোকেদের সাথেও। সবকিছু বাদ দিয়ে নিজেকে তীব্রভাবে স্বাভাবিকতার বেড়াজালে আটকে ফেলতে চায়। কিন্তু! ওই! ভাগ্য তাকে বারবার একটা গোলকধাঁধার সামনে এনে দাঁড় করায়, যেখান থেকে বেরুনোর কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, যে গোলকধাঁধায় ঘুরেফিরে বারবার তিক্ততা আর একরাশ দুঃখের গল্প পথ আটকে বসে
থাকে।
একদিন, দু’দিন, এক সপ্তাহ!
দিনগুলো কাটতে থাকে। প্রায় রাতেই, যেদিন ঝুমুরের মুখভার থাকে বা মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হয় সেদিন তাখলিফ ওর মন ভালো করার জন্য ঝুমুরের আবদারেই ওর সাথে দেখা করে। ঝুমুরের শত অভিযোগ, চোখের পানি সে দু’হাতে মুছে নেয়। ললাটে দেওয়া উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়াতে মিলিয়ে যায় ঝুমুরের দুঃখগুলো। তাখলিফ বসে বসে শোনে এই মেয়েটার শতশত গল্প। ওর দু-চোখ ভরা স্বপ্নগুলো মনের আকাশে ডালা মেলে ওড়ে বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছায় তাখলিফের মনের গহব্বরেও। অথচ বোকা প্রণয়িনী তা টেরই পায় না। তাখলিফ কখনো আনমনে হাসে। বাকি রাতটুকু কেটে যায় এভাবেই। ভোরের আলোতে সৌন্দর্যে ডুবা পৃথিবী নামক গ্রহটির প্রথম প্রহরেই সে আবারও ফিরে আসে তিনতলায় নিজের ঘরটিতে। সানওয়ার হক তার সবকিছুই টের পান, তবে কিছুই বলেন না। আজকাল বাবার গাম্ভীর্যতা অবশ্য বড্ড ভাবায় তাখলিফকে। কি এত ভাবে কে জানে! কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি, বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন তিনি। তাই তাখলিফও বাবাকে আর ঘাটায় না।
______
এমনই এক দিন মেয়ের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে
পাখি বেগম ক্ষেপে ওঠেন ঝুমুরের প্রতি। আন্দাজ করে ফেলেন তার এই মেয়েটি তাখলিফের সাথে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করে। অথচ তিনি স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়েসুঝিয়ে মেয়েকে এমন করতে ‘না’ করে দিয়েছিলেন। তারপরও মেয়ে তার কথা শোনে নি? এজন্যই এতদিন চুপচাপ ছিলো আর ভেতরে ভেতরে এতদূর? পাখি বেগমের পুরো গা জ্বলে ওঠে। ঝুমুরকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। মায়ের রাগী মুখ দেখে ভয় পেয়ে ঝুমুর অস্বীকার করে। কিন্তু পাখি বেগম তাতে আরও রেগে যায়। চড়-থাপ্পড় দিতেই ঝুমুর স্বীকার করলেও পাখি বেগম থামেন না। সেদিনের মতো আবারও মারধর করেন। এদিকে মায়ের চেঁচামেচি, হৈচৈ এবং দুশ্চিন্তায় ঝুমুর পুরো চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। প্রমিলা আর তুসি এসে আটকায় পাখি বেগমকে। ততক্ষণে অবশ্য জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে ঝুমুর। পাখি বেগম রাগে ফুঁসতে থাকলেও মেয়ের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যান। প্রমিলা আর তুসিও ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মাথায় পানি-টানি ঢেলে, হাত-পায়ের তালু ম্যাসাজ করতে থাকে সবাই মিলে। তবুও জ্ঞান ফেরে না ঝুমুরের। বাড়িতে তখন তেমন কেউ ছিলো না। তুসি ফোন করে ইয়াসিফকে। অফিসের ব্যস্ততার মাঝে বোনের এ খবর পেয়ে সেও ভড়কে যায়। অফিস থেকে তৎক্ষনাৎ ছুটি চাইলেও তা মেলে না। বাধ্য হয়েই সে তাখলিফকে খবরটা জানায়।
অফিসের কাজের চাপের পাশাপাশি এসব কাহিনী
শুনে তাখলিফের মাথা হ্যাং হয়ে যায়। একজন
অভিজ্ঞ ডাক্তারকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। তেমন
কিছু বাড়াবাড়ি দেখলে হসপিটালাইজড করতে হবে ভেবেই রাখে তাখলিফ! বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় প্রমিলা। তাখলিফ হন্তদন্ত হয়ে ঝুমুরের ঘরে ঢুকে। ওকে দেখেই পাখি বেগম কান্না থামিয়ে গজগজ শুরু করলে সেও জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। ওর এমন দৃষ্টি দেখে পাখি বেগমও আশ্চর্য হয়ে যান৷ এই ছেলের সাথে কোনোদিনও তার বনিবনা না হলেও এমন অসম্মান করেনি। কিন্তু আজ? তিনি মেয়ের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে আর কথা বাড়ায়নি। ডাক্তার ঝুমুরকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে জানায়,
তেমন গুরুতর কিছু নয়। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আর খাওয়াদাওয়ার অনিয়মের ফলেই এরকম হয়েছে। এরজন্য হাসপাতালে নিতে হবে না। ডাক্তারের পরিচর্যা পেয়ে ঝুমুরের জ্ঞান ফিরে আসে। সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এদিকে তাখলিফকে দেখে দুর্বল গলায় কিছু বলতে চায় ঝুমুর, কিন্তু তাখলিফ তা হতে দেয় না। ডাক্তার ওকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে। যার ফলে ঝুমুর গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। এরপর ডাক্তারের পরামর্শগুলো চুপচাপ শুনে তাখলিফ। তাকে বিদায় দিয়ে প্রেসক্রাইব করা ঔষধগুলো নিয়ে বাড়ি চলে আসে। এবার দোতলায় গিয়ে অভাবনীয় এক কান্ড ঘটায় সে। ঝুমুরের ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত ঝুমুরকে দু’হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে তিনতলায় নিয়ে আসে পাখি বেগমের সামনে দিয়ে। তুসি, প্রমিলা অবাক হলেও কিছু বলার সাহস করে না। কিন্তু পাখি বেগম ঠিকই সাপের মতোন ফুঁসে ওঠেন৷ তাখলিফ তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে ঝুমুরকে এনে নিজের ঘরে শুইয়ে দেয়। এরপর অফিসের পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে ওর পাশে নিজেও ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্ত বিকেলের মোহমায়া গোধূলির আলোতে ঝুমুরের রক্তিম আভা ছড়ানো মুখ খানি অবলোকন করতে করতে সেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
________
অবসন্ন, দুর্বল চোখজোড়া বহুকষ্টে মেলতেই নিজেকে অচেনা এক জায়গায় আবিষ্কার করে ঝুমুর। দু’পাশে মাথা নেড়ে চোখ পিটপিট করে কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করতেই গম্ভীর কণ্ঠস্বরটি শুনতে পায়,
“ঘুম কেমন হয়েছে?”
ঝুমুর চট করে মাথা তুলে। বিছানার হেডবোর্ডে হেলে বসে আছে তাখলিফ। দৃষ্টি হাতের ল্যাপটপে। ঝুমুর আশেপাশে তাকাতেই বুঝে যায় ও এখন কোথায় আছে। কে এনেছে? তাখলিফ? ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে যায়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভয় পেয়ে ঢোক গিলে। কে জানে কি অশান্তি হয়েছে! ও ওঠে বসে। ভয়ে ভয়ে নির্লিপ্ত তাখলিফকে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে এখানে এনেছেন কেন?”
তাখলিফ ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই উত্তর দেয়,
“আজ থেকে এখানে, আমার সাথে থাকবি।”
ঝুমুর আসন্ন বিপদ আশঙ্কা করে ঢোক গিলে বলে,
“সবাই কি ভাববে? না না, মা-বাবা খুব রাগ করবে। অহেতুক অশান্তি হবে…”
তাখলিফ এবার ল্যাপটপটা ছুঁড়ে মারে বিছানার একপাশে। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। ভয়ে ঝুমুরের আত্মা তখন নাই হয়ে গেছে। ও কাঁপা গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাখলিফ ওর দুবাহু চেপে ধরে। এরপর চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করে ছোট করে জিজ্ঞেস করে, “আবারও মেরেছে?”
ঝুমুর একটু ধাতস্থ হয়। চোখ নিচু করে দুপাশে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ ‘না।’ মিথ্যে শুনে হাত-পায়ের তালু নিশপিশ করতে থাকে তাখলিফের। গালে সটান এক ‘চড়’ বসাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তা না করে দাঁতে দাঁত চেপে হুমকি দেওয়া স্বরে মৃদু হেসে ওর গালে হাত রাখে, “আমার সাথে মিথ্যে বলবে না। একদম পছন্দ করি না বাবু…”
ঝুমুর আপ্লূত হয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে,
“মেরেছে।”
“সেটা তো বুঝতেই পেরেছি। এবার ঝটপট কারণটা বলে ফেল।”
ঝুমুর ক্ষোভিত কন্ঠে বলল,
“আপনাকে বাজে বলছিলো। আমার কষ্ট লাগে।”
দু-মিনিট চুপ থেকে রাশভারী কন্ঠে তাখলিফ বলল,
“কেন যেচে পড়ে মার খেতে যাস? ওরা আমাকে যা দেখেছে তাই বলে। তো ঠিক আছে, বলতে দে। আমি তো তাদের মুখ আটকে রাখিনি। আই ডোন্ট কেয়ার। তাহলে তুই কেন কষ্ট পাবি? স্ট্রং হ!”
ঝুমুর ফট করে ওর দিকে চোখ তুলে তাকায়। মিনমিন করে বলে, “আমাকে যদি কেউ বাজে বলে, তাহলে আপনিও চুপ করে থাকতেন? না তো? আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।”
তাখলিফ সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। এটাই কি স্বামী-স্ত্রী’র বন্ধন? একে অপরের পরিপূরক?একজনকে পৃথিবীব্যাপী সবাই মিলে আক্রমণ করতে এলে অন্য মানুষটা এসে প্রতিবাদ জানায়? লড়াই করে? হ্যাঁ, তাই! ঝুমুরের নামে কেউ ওর সামনে কেউ অপমানজনক কিছু বললে সে নিজেও হেস্তনেস্ত করে ছাড়ে। যেমন করেছিলো ঝুমুরের পিছু লাগা সব ক’টা বখাটে আর জে’লফেরত গুন্ডা কবিরের! হুহ! ওকে আনমনে ভাবতে দেখে ঝুমুর নাক টেনে
আপ্লুত কন্ঠে বলে, “আপনি কেন ওমন ভুল করেছিলেন? না করলে আজ বাবা-মা নিদ্বিধায় আপনাকে মেনে নিতো। আমাদের খুব সুন্দর, ছোট্ট একটা সংসার হতো। যেখানে মন খারাপের জায়গা নেই, যেখানে— আমরা, আমাদের পরিবার নিয়ে সুখী থাকতাম।”
তাখলিফ বুকের ভেতর মেঘ পাকানো দীর্ঘশ্বাসটা বের করে সময় নিয়ে। আর্ত কন্ঠে শুধায়, “কোনটাকে বড় ভুল বলবো আমি? সতেরো বছরের তাখলিফের করা সেই নিকৃষ্টতম অন্যায়টাকে নাকি ছাব্বিশ বছরের তাখলিফ হাসান তূর্যের সজ্ঞানে করা ‘বিয়ে’ নামক অন্যায়টাকে? দুটোর জন্যই তো প্রতিনিয়ত পস্তাচ্ছি আমি। আমার জীবনটা ভুলেই ভরা রে ঝুমুর। সবকিছু ভুল, সব অন্যায়। তোকে বিয়ে করাটাও ভুল। সেদিন যদি…”
ঝুমুর ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে কথা আটকালো। দু’পাশে মাথা নেড়ে ম্লান গলায় বলল, “আমি ভুল ,অন্যায় কিছুই মনে করি না৷ এটা নিয়তি। আপনি আমার হবেন সেটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো।”
তাখলিফ আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু’হাতে ঝুমুরের মুখটা আগলে নিয়ে বলল, “তোর আফসোস হয় না, ওমন একটা খু’নিকে মন দিয়ে বসে আছিস? রাতে লুকিয়ে তার সাথে দেখা করতে হয় চোরের মতো! মনে প্রশ্ন জাগে না? আমার তো অনুশোচনা হয় রে!”
ঝুমুর সন্দেহী চোখে তাকায়। অবাক গলায় ফিসফিস করে উত্তর দেয়, “আমি তো কোনো খু’নিকে মন দিইনি। আমার স্বামীকে মন দিয়েছি। আমার তো জীবনে একটা প্রেমিকও ছিলো না…”
তাখলিফ চট করে নিষ্পলক ওর দিকে তাকায়,
“তোর প্রেমিকের অভাব নেই ঝুমুর। এক্ষুনি বললে রাস্তায় লাইন লেগে যাবে ছেলেপেলেদের। সেখানে আমাকেই কেন এত ভালোবাসলি? কি দিয়ে শোধ করবো বলতো?”
ঝুমুর কথা ঘুরানোর জন্য হেসে বলল, “এই আপনাকেই দিয়ে দিন। আর কিছুই লাগবে না আমার। সেদিনের ওই মোটা অঙ্কের চেকটাও না…”
“মারবো চড়। ওটা তোর হকের টাকা। এইযে তোকে ছুঁলাম, এটা এখন পুরোপুরি হালাল।”
ঝুমুর মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এরপর আবারও ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলো। মিনমিন করে শ্বাস টেনে বলল, “আপনার পারফিউমের স্মেলটা দারুণ।”
তাখলিফ রয়েসয়ে বলে,
“তোর শ্যাম্পুরটাও।”
হেসে ফেললো ঝুমুর। ওর ইচ্ছে করছে এই লোকটার চোখেমুখে অসংখ্য চুমু দিতে৷ কিন্তু লজ্জায় পারছে না। যদি রেগে আবার চড় মেরে দেয়? কেউ শুনে ফেললে সর্বনাশ হবে তখন।
_______________
সাজেদা বেগম আর প্রমিলা ছাড়া দোতলার সব ক’টা মানুষ আজ তিনতলায়। বসার ঘরে আলোচনা বসেছে। ঝুমুরকে না বলে কয়ে এভাবে নিয়ে আসায় শামসুল হক বেজায় ক্ষেপেছেন। আর তাতে আরও ঘি ঢেলেছেন পাখি বেগম। স্বামীকে সত্যমিথ্যা বুঝিয়ে তিনি এনেছেন যাতে করে তাখলিফকে আজ সবার সামনে অপদস্ত অবস্থায় দেখতে পান! কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। উলটে তাখলিফের কথাগুলো শুনে বসার ঘরে ক্রমে ক্রমে বি’স্ফোর’ণ হচ্ছে। সানওয়ার হক, সাঈদ হক থমথমে মুখে বসে আছে। পাখি বেগম আর শামসুল হক জ্ব’লন্ত চোখে তাকিয়ে আছেন তাখলিফের দিকে। সবার এমন স্তব্ধতা দেখে কোনোরকম হেলদোল হলো না ওর। দ্বিতীয়বারের মতো বলল, “ঝুমুরকে আমি নিয়ে এসেছি। এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে। তাতে আপনাদের আপত্তি থাকুক বা না থাকুক ডা’জেন্ট ম্যাটার। আমি কিন্তু কারোর অনুমতি চাচ্ছি না, নিজের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। ক্লিয়ার?”
পাখি বেগম গলা উঁচু করে কিছু বলতে চাইলেন। তাকে থামিয়ে দিলেন শামসুল হক। শান্ত গলায় তাখলিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু আমার মেয়েকে তো আমি তোমার কাছে দেবো না।”
তাখলিফ নির্দ্বিধায় বলল,
“আপনার কাছে তো আমি ওকে চাইতে আসিনি চাচাজান! তাহলে অহেতুক কথা কেনই বা বাড়াচ্ছেন? সব কথার এক কথা হলো, ওকে এখান থেকে কোথাও যেতে দেবো না।”
শামসুল হক তাখলিফের বেয়াদবিতে মনে মনে ফুঁসে ওঠলেন। বাইরে তা প্রকাশ না করে বললেন,
“তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক হইতেসি। আমার সামনে খাড়ায়া বলতাসো আমার মেয়েরে দিবা না?”
“জি চাচাজান। আমি আপনাদের পরোয়া করি না।”
শামসুল হক বিস্ময়ে, ক্রোধে জর্জরিত কন্ঠে বললেন, “বড়ভাই আপনার পোলারে সামলান কইতেছি৷ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েন না।”
সানওয়ার হক দীর্ঘশ্বাসটুকু গোপন করলেন। চিন্তায় চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। এক ধাক্কায় বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে তার। বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে যতটা না তার টেনশন তারচেয়ে শতগুণ চিন্তা হচ্ছে ছেলে সত্যি জেনে যাবে এই আশায়। মেজোভাইটার এমন রুপ তাকে ক্রমেই বিচলিত করছে। স্বার্থে আঘাত লাগলে যে বড় ভাইকেও সে মান্য করবে না তা তিনি আগেই বুঝেছেন। তিনি নরম চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে নম্র ভাবে কথা চালানোর অনুরোধ করলেন। কিন্তু তাখলিফ বাবার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলো না। কারণ সেও জানে, বাবা এখানে নীরব ভূমিকা পালন করবে৷ ও নিজেও তাই করবে ভেবেছিলো। ঝুমুরের পিঠের আঘাতগুলো পরোক্ষভাবে ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছিলো প্রতিক্ষণে। যা ওর শান্তি, ঘুম বিনষ্ট করেছে। এতেও ধৈর্য্য ধরার চিন্তা করেছিলো সে, কিন্তু পুনরায় ঝুমুরকে বেধড়ক আঘাত করায় ওর পুরুষালি সত্তা, স্বামী সত্তা একবিন্দু পরিমাণ সহ্য করতে পারছে না পাখি বেগম নামক শ্রদ্ধেয় মেজোচাচী তথা নিকৃষ্ট শ্বাশুড়িকে। তাই সব ঝেড়ে কেশে এবার সে নিজেই হেস্তনেস্ত করবে ভেবেছে। ঝুমুরকে নিজের কাছেই রাখবে এটাই শতভাগ সত্যি। তাতে কার কি হলো,
কে কি চাইলো, কে কি ভাবলো সেসব দেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। তাখলিফকে এমন নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শামসুল হক এবার তেজ দীপ্ত কন্ঠে আসল কথাটা বললেন, “তোমাদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে সেটা অনাকাঙ্খিতভাবে। আমি সেটা অস্বীকার করছি না। তবে তোমার কাছে থাকলে আমার মেয়ে কেন কারোর জীবনেই ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু হবে না তা আমি হলফ করে বলতে পারি। আর সেইজন্যই আমি এখন তোমাদের ছাড়াছাড়ির ব্যবস্থা করছি। তুমি এবার আমার মেয়েটাকে রক্ষে দাও…”
তাখলিফ শুনলো। সময় না নিয়ে পরক্ষণেই ভাবুক গলায় বলল, “আমার কাছে থাকলে আমার বউয়ের ক্ষতি হবে, আর আপনাদের কাছে থাকলে সুরক্ষিত থাকবে? তাই বলতে চাচ্ছেন?”
তাখলিফ আজ নিদ্বির্ধায় ঝুমুরকে ‘ঝুমুর’ না বলে সরাসরি ‘বউ’ বলছে। শামসুল হক কিঞ্চিৎ থতমত খেলেন, এরপর মাথা দোলালেন। তাখলিফ তা দেখে শ্লেষের হাসি হাসলো। এরপর আচমকাই চোখমুখ র-ক্তবর্ণ হয়ে এলো ওর। দরজার পাশে থাকা ফুলের টবে লাথি মেরে ক্রোধিত কন্ঠে বললো, “আপনার মেয়ে আইনত, শরীয়ত আমার বউ। গুণে গুণে আড়াই বছর হতে চললো আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের। এখন অবধি একটা চড় ছাড়া কোনোদিন ওকে তেমনভাবে ছুঁয়েও দেখলাম না, সেখানে আপনার স্ত্রীর সাহস কি করে হয় অমানুষের মতো আমার বউয়ের গায়ে হাত তোলার?”
সবাই চমকে ওঠলো তাখলিফের আকস্মিক ক্রোধ বর্ষণে। সকলেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো কিয়ৎক্ষণ। বাড়ির ছোট সদস্যরা সবাই ভেতর ঘরের পর্দার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে কাহিনী দেখছে, আর ঝুমুর তাখলিফের ঘরে বসে বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। তুসি তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, কিন্তু তাতে কান্না না থেমে ক্রমশই বাড়ছে। ইয়াসিফ চুপচাপ তাখলিফের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মা-বাবার বাড়াবাড়িতে ওর নিজেরই মনে ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। এমন প্যাঁচালো মানুষ তো তারা নন, কেন এমন করছে! জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায়নি কোনো। এদিকে তাখলিফের কাটকাট কথাগুলো শুনে ক্রোধে ভেতরটা পুড়তে লাগলো পাখি বেগমের। এতগুলো মুরুব্বি মানুষের সামনে ছেলেটা যেভাবে কথা বলছে দেখেই তার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। স্বামীর আদেশে তবুও তাকে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু মনে মনে তিনি এবার ঠিক করে ফেলেছেন, উল্টাপাল্টা কিছু হলে তিনি আর কোনো রাখঢাক করবেন না। আগুন লাগিয়ে দেবেন একদম। কি ভেবেছে তাকে? তার আদরের মেয়েকে দিয়ে দেবে ওমন একটা ছেলের হাতে? কক্ষণো নাহ! ভাবনার মাঝেই মুখ ফসকে বিচার দেন তিনি, “দেখছেন বড়ভাই আপনের পোলার ব্যবহার? ওদের তো দেখাশোনা করতে বারণ আছিলো৷ কিন্তু ও-য় রাতে দোতলায় যায়, ওর কি
ওইখানে? রাইতে একঘরে ঝুমুরের লগে…”
বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে গেলো তাখলিফের মন-মস্তিষ্ক। এই মহিলা নিজের মধ্যে নেই নাকি? পাখি বেগমকে তার কথার মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে ও বলে ওঠলো, “আমি তো আমার বউয়ের কাছে যাই মেজোচাচী। এখন ঘরের ভেতর কি করি না করি সেটাও সবাইকে বলতে হবে? তাহলে তুমি কেন বলছো? তুমি তো তখন ঘরের ভেতর থাকো না, থাকি আমি। আমাকেই জিজ্ঞেস করো ওখানে গিয়ে কি করি! তোমরা আগ্রহী হলে আমি রচনা বলা শুরু করবো…”
সকলেই অপ্রস্তুত হলো। ইয়াসিফ কেশে ওঠলো।
লজ্জায় মাথা কাটা গেলো পাখি বেগমের। সকলেই একপলক তাখলিফকে লক্ষ্য করলো। এই ছেলের মুখ রাগে থমথম করছে। বেফাঁস কিছু বলে ফেলবে এটা নিশ্চিত। তাই আলোচনা সভা ভেঙে গেলো। যে যার মতো এদিকওদিক সটকে পড়লো। পাখি বেগম আহাম্মকের মতো চলে যেতে নিলে তাখলিফ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাগত স্বরে বলল, “মেয়ের মা হয়ে মেয়েকে অসম্মান করছো, কেমন
মা তুমি? রাতে কি আড়িও পাতছিলে আমাদের ঘরে? প্রচন্ড লেইম ব্যাপার এটা চাচী, প্রচন্ড লেইম।”
তাখলিফের দেওয়া জ্ঞান শুনে পাখি বেগমের মুখটা
দেখার মতো হলো একদম!
’
___________________
[আর একটা কনফিউশন, সেটাও পরবর্তীতে জানতে পারবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
[কৌতূহলবশত জানতে চাচ্ছি, আপনারা কেমন ইতি চান? অবশ্যই শুধুমাত্র আপনাদের কথানুযায়ী দেবো না, এরপরেও জানতে আগ্রহী।]
চলবে…