হিয়ার_মাঝে ৮. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
680

#হিয়ার_মাঝে ৮.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

গায়ে টাঙ্গাইলের নতুন শাড়ি পরেছে। কৃত্রিম সাজসজ্জার সাথে ভারী গয়নায় নিজেকে রাঙালো নুবাহ। মায়ের অনুপস্থিতিতে সে শাড়ি পড়ে সারা ঘর চষে বেড়ায়। আপনমনে অভিনয়, নাচ, গান সবই করে। আয়নার সামনে দাঁড়ানো সে। লাজুক রাঙানো হাসিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে। হলদেটে গায়ের রঙ সামান্য সাজেও বেশ ফুটে উঠেছে। রুকাইয়া না থাকলে মাঝে মধ্যে প্রায়শ এমন সাজগোছ করে। তখন নিজের সুপ্ত মেধারও বিকাশ ঘটায়। তার উপর এত ভারী সাজে বাইরে যাওয়া যাবে না। তাই লুকিয়ে চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে অপ্সরী তৈরি করে।

দীর্ঘ সময় শাড়ি পরে বেশ হাঁপিয়ে গেছে। তাই শাড়ি খুলে মাত্রই ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম গেল। তার মাঝেই মুঠোফোনে ভূকম্পন শুরু হল। নুবাহ কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল। এ লোকের জ্বালায় সে ওয়াশরুম গিয়ে শান্তি পাচ্ছে না। গুণে গুনে চারবার কল আসল। এখনও মুঠোফোনের কর্কশ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে বের হল। ছয় নাম্বার কল কর্কশ ধ্বনি তুলার আগেই চট জলদি রিসিভ করল।

নুবাহ সালাম দেয়ার আগেই ইমদাদ ভেজানো গলায় বলে উঠল। ‘কোথায় ছিলে এতক্ষন?’

নুবাহ পড়ল মহাবিপাকে। কি বলবে এখন। বাথরুমে ছিল। অসম্ভব! এটা বলা যাবে না। তড়িৎ নিজমনে অন্য উত্তর সাজালো।
‘আসলে আমি কিচেনে ছিলাম। আর মোবাইল বালিশের নিচে ছিল তাই শুনিনি।’
ইমদাদের গলার স্বর বেশ করুণ।
‘সত্যিই! তুমি কিচেনে ছিলে? আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কতকিছু ভেবেছিলাম, তোমার সমস্যা হয়নি তো আবার। দয়া করে মোবাইল সাথে রাখ। অন্তত কলটা সাথে সাথে রিসিভ কর। জানো বুকটা এখনো কাঁপছে।’

নুবাহ বেশ বিরক্ত হল। বিরক্তির সুরে বলল,
‘আপনি অহেতুক চিন্তা করছেন। এর আগেও অনেকবার একা ছিলাম। তাছাড়া এমন নয়, একদম একা থাকব সারারাত। আম্মুরা তো চলেই আসবে। শুধুমাত্র রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর যদি আসতে দেরি হয় তাহলে রূম্পাকে নিয়ে আসব। রূম্পা যদি না আসে তবুও সমস্যা নেই। আমি তাদের বাসায় চলে যাব। তাও প্লিজ, অহেতুক চিন্তা করবেন না।’

‘রূম্পা কে?’

‘আমাদের বাড়িওয়ালার নাতনি। আমার বোনের বয়সী। তাকে ডেকে নিয়ে আসব, ঠিক আছে।’

‘ঐ রকম একটা ছোট বাচ্চা তোমার খেয়াল রাখবে। তোমার আম্মুর দেখছি কোন কান্ডজ্ঞান নেই। একটা কিশোরী মেয়েকে বাসায় রেখে যাই কেউ? দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তোমার আম্মুর কোন ধারণাই নাই দেখছি। কখন কি দুর্ঘটনা ঘটে। কেউ বলতে পারে।’

ইমদাদের কথায় রাগ সপ্তম আকাশে উঠল নুবাহর। কত সাহস তার মা’কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। কথায় বলে না, মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি। টিচার হিসেবে সাহায্যে করছে তার জন্য কৃতজ্ঞ সে। কিন্তু তাই বলে ব্যক্তিগত সব বিষয়ে নাক গলাবে কেন। কিছুটা রুক্ষস্বরে জবাব দিল সে।
‘দেখুন আমি কিন্তু আগেই নিষেধ করেছি, ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না। তাও আপনি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। আপনার ব্যবহার কিন্তু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে এখন।’

ইমদাদ স্তব্ধ। জবাব বিহীন দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত হল তার। নিশব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস উঠানামা করছে। দু’চোখ ছলছল। সে জানে তার কোন অধিকার নেই। কিন্তু তাও কেন এত অধিকারবোধ। তারও অজানা, হয়তো ওপাশের ব্যক্তিরও। ফোনকল চলছে। দু’জন দু’পাশে নিভৃতে বসে আছে। পিনপতন নীরবতায় আচ্ছন্ন দু’পাশের দু’জন। ইমদাদ কল কাটার দুঃসাহস করল না। নিরাবতা কাটিয়ে দীর্ঘসময় পর জবাব দিল।

‘আচ্ছা, যাও আর বলব না। বিরক্তও করব না। তবে তোমার একা যাতে মনে না হয় তাই ফোনকল এভাবেই চলুক। কথা বলব না শুধু ফোনকলই চলবে। কি এতটুকু পারব তো?’

নুবাহ দ্বিধান্বিত। আনন্দিত না বিরক্ত, বোধগম্য নয় তার। কল চলমান। বালিশের নিচে রাখল মুঠোফোন। পড়ার শব্দ যেন ইমদাদের কানে না পৌঁছায় তাই এই ব্যবস্থা। সময় গড়ালো, রাত বাড়ল। কিন্তু কল তখনও চলমান। নুবাহর মাঝে সন্দেহের উদয় হল। তাই ঘন্টা খানেক পর বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোন উঠাল। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। নরম সুরে ডাকল।
‘আপনি আছেন ‘স্যার?’

ওপাশ থেকে দ্রুতই জবাব এল।
‘কোথাও যাওয়ার কথা ছিল না’কি?’
সহসাই এমন জবাবে আমতা আমতা করল নুবাহ। ‘আ,,আসলে তা,,না।’

‘তো নকল’টা কি?’

‘আপনার অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এতক্ষণ ধরে কল ধরে আছেন। তাই বলছিলাম কি?’

নুবাহর কথা শেষ করার আগেই জবাব এল ইমদাদের।
‘আমি কি তোমার মত বোকা না’কি! টাকা খরচ করব অহেতুক। ছা-পোষা মানুষ এত টাকা আমি কোথায় পাব? তাই মিনিট কিনে ফেলছি আনলিমিটেড। বুঝলে ‘বোকা মেয়ে!’

নুবাহ বাকরুদ্ধ। আপনা আপনি মুখের মাঝে তার হাত চেপে ধরল। বিড়বিড় করল নিজমনে, ‘ইয়া আল্লাহ’ এত অদ্ভুত কেন এই লোক! জবাব দেয়ার জন্য কোন বাক্যে খুঁজে পেল না। নিশ্চুপ বসে আছে। তার জবাব না পেয়ে ওপাশ থেকে কোমল সুর ভেসে এল।

‘আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে পড়। শুধু সমস্যা হলে বলিও।’

নুবাহ ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘আচ্ছা।’

আর কথা হল না তাদের মাঝে। এভাবে সময়ের সাথে সাথে রাতও বাড়ল। কিন্তু কল চলমান। মাঝে এক দু’বার কল কেটে গিয়েছিল। পরক্ষণেই আবার ফিরতি কল এসেছে। এভাবে চলছে বাক্যেবিহীন তাদের মাঝে ভাব আদান প্রদান।
_______________

এগারোটার জায়গায় রাত বারো’টায় রুকাইয়া ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরেন। সাথে রশিদও আছে। নিভান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রুকাইয়ার কাঁধে ঘুমাচ্ছে। নীলাভও তার সাথে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। সে রশিদের কাঁধে। নীলাভকে নুবাহর রুমে রাখতে আসল রশিদ। নুবাহ নিজের বাবাকে দেখে দ্রুত মাথায় ঘোমটা টানল। সালাম দিয়ে একপাশে দাঁড়াল। রশিদ নীলাভকে বিছানায় রাখতে গিয়ে নুবাহর দিকে কিঞ্চিৎ তাকাল। আচমকাই জিজ্ঞেস করল, ভাত খেয়েছিস? নুবাহ ঈষৎ মাথা নাড়াল। ‘নাহ, আব্বু এখনো খাইনি।’
রশিদ ধমক দিয়ে উঠল।
‘রাত বারোটা, এখনো উপোস বসে আছিস। যা ভাত খেয়ে নেয়। আর জেগে থাকার দরকার নেয়। জলদি শুয়ে পড়।’
নুবাহ ত্বরিত উত্তর দিল, আব্বু আপনি আর আম্মু খাবেন না।
‘নাহ খাব না, তোর মামার শাশুড়ী ভাত নিয়ে আসছিল। আবার তোর মামার শালাও রেষ্টুরেন্ট থেকে ভাত নিয়ে আসছে। তারা জোরাজুরি করে আমাদের খাইয়ে দিয়েছে।’

নুবাহ ফের বলে উঠল, মামা এখন কেমন আছে। রশিদ কিঞ্চিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আলহামদুলিল্লাহ’ এখন ভালো আছে। আল্লাহ রহমত করছে বড় কোন বিপদ হয়নি। শুধু বাম পায়ে আঘাত পেয়েছে। ডাঃ প্লাষ্টার করে দিয়েছে। কয়েকদিন পরে খুলবে। ততদিন নড়াচড়া করতে নিষেধ করছে। ইনশা’আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না, তোর আম্মুকে বলবি চিন্তা না করতে। সে তো অল্পতে কাতর হয়ে যাই। তুই একটু বুঝাইস, যাতে আজে বাজে চিন্তা না করে। নুবাহ আচ্ছা’ বলে মাথা নাড়াল।

রশিদ চলে যাওয়ার পর সে কিচেনে গিয়ে ভাত খেয়ে আসল। সত্যি বলতে ঐ নিরীহ টিচার ইমদাদের দীর্ঘ কলের জন্য খিদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। বিছানায় গিয়ে দপ করে শুয়ে পড়ল। শোয়ার পর হঠাৎই মনে পড়ল, আরে ঐ নিরীহ পাগলকে জানানো হয়নি এখনো। দ্রুতই বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোন নিল। ছোট্ট এক বাক্যে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ করল।

“আম্মুরা চলে এসেছে। এবার আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”

সাথে সাথেই একটা ফিরতি মেসেজ আসল।

“জ্বী ম্যাডাম, আমি জানি। তাই কল কেটে দিয়েছি। কিন্তু এতক্ষণ আপনার মেসেজের অপেক্ষায় ছিলাম। ম্যাডাম’ এবার ঘুমিয়ে পড়ুন।”

নুবাহ বিস্মিত হল। পুনরায় মেসেজ দিল।

“কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন। আমি তো আপনাকে জানাইনি, আমার আম্মুরা ফিরে এসেছে।”

আবারো টুং করে মেসেজ আসল।
“ম্যাডাম আপনি না বললেও আমি বুঝে গেছি।”

মুখে বিরক্তের সুর তুলল নুবাহ।

“আপনি আমাকে এতবার ম্যাডাম ডাকছেন কেন? আমি ম্যাডাম হলাম কখন?”

ফিরতি মেসেজ আসল দ্রুতই।
“এখনো হননি, তবে কোন একদিন হয়ে যাবেন কারও ম্যাডাম।”

নুবাহ কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। মেসেজের উত্তর দিল না আর। এ ছেলেটা তো ভীষণ ফাজিল। কিন্তু টুং করে আরও একটা মেসেজ আসল।

“শুভরাত্রি ম্যাডাম।”

মেসেজ দেখে সেও উত্তর দিল ‘শুভরাত্রি’। অধরকোণে ঈষৎ লাজুক হাসি। আরও কিছু বাক্যে মুখে আওড়াল। কিন্তু মেসেজে লিখা সম্ভব হল না তার। নিজমনে বিড়বিড় করল। থাক না কিছু কথা হিয়ার মাঝে। মুঠোফোন রেখে শুয়ে পড়ল।

কিছুসময় পর সহসাই তার মুঠোফোন কম্পিত হল। মাত্র চোখে তন্দ্রাভাব এসেছিল নুবাহর। মেজাজ চটে গেল মূহুর্তে। এত রাতে কে আবার কল দিল। স্ক্রিনে চোখ বুলাতে সেই অজানা আতঙ্কের আগমন। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকালো। বাধ্য হয়ে মুঠোফোন বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। নিজমনে গালি ছুঁড়ল। অসভ্য লোক।

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here