হিয়ার_মাঝে ১৪. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
687

#হিয়ার_মাঝে ১৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

ক্লাশটেষ্টের পেপার হাতে বসে আছেন ওবায়দুল স্যার। বিরস মুখে সব পেপারে চোখ বুলাচ্ছেন। সহসাই এক ঝলক তাকাল নুবাহর দিকে। ভীষণ অদ্ভুত চাউনি। নুবাহ অবাক হল। স্যারের দৃষ্টি এমন দেখাল কেন? সন্দিহান হল তার অন্তঃকরণ। স্যার নিভৃতেই টেবিলের মাঝে সাজিয়ে রাখছে সব পেপারস। নিরাবতাচ্ছন পুরো ক্লাস। সবার কৌতুহল দৃষ্টি স্যারের দিকে। আচমকাই মৌনতা ভেঙে স্যার ডেকে উঠল,

‘নিশাত নুবাহ।’

দৈবাৎ স্যারের ডাকে নুবাহ চমকে উঠল। তড়িঘড়ি দাঁড়িয়ে বলল, ‘জ্বী স্যার।’
স্যারের চাউনিতে কাঠিন্য ভাব। নুবাহর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, ‘ক্লাশ শেষে অফিস-রুমে দেখা করবে।’

নুবাহ বাকরুদ্ধ। মনটা ভীষণ খচখচ করল। তার প্রিয় স্যার আজ এত রুষ্ট গলায় কথা বলছে? কিন্তু কেন? পরীক্ষায় কি এবারও ফেইল করেছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব। সে তো ভালোই পরীক্ষা দিয়েছিল। নিজ ভাবনা ছেড়ে স্যারের দিকে তাকাল।
‘স্যার আমি কি পরীক্ষায় ভালো করেনি? কিন্তু আমি,,

আর কিছু বলার আগেই ওবায়দুল স্যার নুবাহকে থামালেন। উনার গম্ভীর স্বর ভেসে এল। ‘ক্লাস শেষে দেখা করতে গেলে বুঝতে পারবে। এখন বসো।’

নুবাহ ফের অবাক হল স্যারের এমন আচরণে। নিশ্চুপ বসে পড়ল। লিমা জেবা ফিসফিস করল, ‘নিশাত তোকে কেনো যেতে বলছে?’ নুবাহর জবাব আসার আগেই তমা বলে উঠল, ‘তুই যেখানে, নিশাতও সেখানে। তুই যা শুনেছিস, নিশাতও তাই শুনেছে। তাহলে সে কি করে জানবে, কি জন্য ডেকেছে?’

দু’জন মূহুর্তের মাঝে চুপ হয়ে গেল। লিমা তবুও বকবক করল, ‘আজকে স্যার তোর দিকে কেমন করে তাকাল? কিছু তো একটা আছে!’

নুবাহ লিমার কথায় ধ্যান দিল না। তার মাথায় ঘুরছে স্যারের সেই গম্ভীর স্বর। তাকে ছাড়া স্যার সবার ক্লাসটেষ্ট পেপার দেখালেন। সে এবার সন্দিহান। তার পেপার স্যার কেন দেখাল না। তাহলে তার খুব খারাপ রেজাল্ট এসেছে। এ জন্যই কি সবার সামনে ক্লাসটেষ্ট পেপার দেখায় নি। মাথা নিচু করে বসে আছে। হতাশা ঘিরে আছে তাকে। ভিতর’টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। হঠাৎই তমার পেপার নজরে এল। তমা ৫০ এর মধ্যে ৪৬ পেয়েছে। তমা ছাড়াও আরও তিনজন একই ফলাফল পেয়েছে। কিন্তু সে কত পেয়েছে? ফের একবার স্যারের দিকে কাতরভাবে তাকাল।
‘স্যার, আমার পেপার?’

নুবাহর দিকে না তাকিয়ে স্যারের সেই আগের গম্ভীর স্বর ভেসে এল। ‘ক্লাশ শেষে দেখা করতে বলেছি না তোমাকে।’
আর কিছু না বলেই স্যার গটগট করে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন।

ক্লাসের স্টুডেন্ট’রা নুবাহর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম ওবায়দুল স্যার তাকে এড়িয়ে গেছে। অথচ এই স্যারের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী সে। কেন স্যার এভাবে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল। নুবাহ জানে না।
__________________________

“রশিদ জামান”

ডাক শুনে রশিদ উঠে দাঁড়াল। পাশে রাখা অফিস চেয়ারে বসল। গলার স্বর মোলায়েম, ‘জ্বী, আমি রশিদ জামান।’

কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার আনিসুর রহমান। তিনি রশিদকে প্রশ্ন করলেন।
‘এর আগেও আপনি একটা কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিলেন কেন?’

মুখে ঈষৎ হাসি রশিদের। হতশার সুর ভেসে এল গলা থেকে।
‘স্যার, চট্রগ্রাম আমার দ্বিতীয় হোমটাউন। ষোলো বছর বয়সে প্রথমবার নিজের শহর ছেড়ে এখানে এসেছিলাম। প্রায় তিন বছর কাটিয়েছি এই বন্দর নগরীতে। হয়তো নাড়ীর টান। তাই আবার ফিরতে চাই।’

‘আপনার নিজের হোমটাউন কোথায় মি. রশিদ?’

‘নোয়াখালী, কোম্পানিগঞ্জ।’

‘আপনি বরিশাল কেন স্থায়ীভাবে থাকেন? নিজের হোমটাউনে থাকেন না কেন?’

রশিদের মুখে তাচ্ছিল্যর হাসি।
‘যেখানে নিজের আপনজনই নেই, সেখানে কার কাছে থাকব। ওখানে আমার জন্ম হয়েছে শুধু আর কিছু নয়।’

আনিস হঠাৎই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রশিদের দিকে তার তীক্ষ্ণদৃষ্টি। এই মুখ ভীষণ চেনা তার। কতগুলো বছর পেরিয়েছে, ঠিক হিসেব করে উঠতে পারল না সে। সহসাই দু’চোখে জল জমল। তৎক্ষনাৎ নিজের দু’হাত বাড়িয়ে রশিদকে জড়িয়ে ধরলেন। হু হু করে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠল সে। কান্নামিশ্রিত গলার স্বর।

‘রশিদ তুমি। ভীষণ লজ্জিত আমি! তোমাকে প্রথমে কেন চিনতে পারিনি। কত বছর পর তোমাকে দেখতে পেলাম। কেমন আছ তুমি? এতদিন পর চট্রগ্রামে, আমাকে প্রথমে কেন তোমার পরিচয় দাওনি।’

রশিদ জামান মৃদু হাসলেন। আনিসকে তিনিও দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। ভেজানো নরম গলায় বলে উঠলেন, ‘আমার কোন দুঃখ নেই, না অভিযোগ। কিন্তু প্রচন্ড ভয় হয় আত্মসম্মান হারানোর। আনিস এই চট্রগ্রামে সবচেয়ে বিশ্বস্ত তুমিই আছো। তাই তোমার কাছে ছুটে এসেছি। বড্ড বিপদে পড়েছি ভাই।’

আনিস অবাক হলেন। এত বছর পর কেন তার প্রিয় বন্ধু তার কাছে ছুটে এসেছে? হয়তো বড় কোন বিপদ। তার দু’চোখে জিগ্যেসু দৃষ্টি।
‘তোমার বিমর্ষ মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। তবে চিন্তা কর না। আমার কোম্পানিতে হোক বা অন্য কোম্পানিতে, আমি তোমার জন্য জবের চেষ্টা করব। কিন্তু আমাকে দুইমাস সময় দিতে পারবে।’

এইটুকু বলে থামলেন আনিস। ফের বললেন, ‘কিন্তু চাকরি কেন ছেড়ে দিয়েছো রশিদ?’

রশিদের মুখ থমথমে। মলিন গলায় বললেন,
‘চাকরি এখনো ছাড়ি নাই।’

আনিস বেশ চমকালেন। ‘তাহলে।’

‘কিন্তু ছেড়ে দিতে হবে। তাই তো ছুটে এসেছি তোমার কাছে আনিস।’

আনিস ফের প্রশ্ন ছুঁড়ল। ‘কারণ’টা কি বলা যাবে রশিদ।’

রশিদ হতাশার শ্বাস ছাড়ল। বলে উঠল,
‘আমি বড্ড আত্মসম্মানীয় ব্যক্তি। কিন্তু ওরা আমার সম্মানে হাত দিয়েছে। আমি বড্ড ভয় পাই সম্মান হারানোকে। কোম্পানির মালিকের বেপরোয়া বখে যাওয়া ছেলের জন্য আমার নিষ্পাপ ফুলের মত মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি তাতে রাজি হয়নি। যে ছেলে রাত-দিন ম,দে আর নারীতে ডুবে থাকে। সেই ছেলের কাছে কীভাবে আমি মেয়ে বিয়ে দিতে পারি আনিস? অত খারাপ বাবাও আমি নই। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছে।’

রশিদ কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফের বলে উঠল,

‘আনিস প্রত্যাখ্যানের বদলা নিতে ওরা আমাকে চোর অপবাদও দিয়েছে। এর জন্য একবার রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। বাড়িতে আজও কাউকে বলতে পারিনি। তোমার ভাবী শুনলে সহ্য করতে পারবে না। আমি খুব কষ্টে আছি। না পারছি চাকরি ছাড়তে, না পারছি সহ্য করতে। আমাকে নিম্নমানের পদ হলেও কিছু একটাতে দিয়ে দাও। পরে না হয় ভালো কোনো পদে দিও।’

আনিস সব কথা শুনে নির্বাক, হতবিহ্বল। বিচলিত হয়ে বললেন,

‘তোমার সাথে এতকিছু হয়ে গেছে। আরও আগে কেন আসো নি। তুমি আমাকে শুধু দুইদিন সময় দাও। আমি তোমার একটা ব্যবস্থা করছি, যেভাবে হোক। একদম কাঁদবে না রশিদ। তুমি আমার জন্য রুমমেট ছিলে না শুধু একজন ভাই বন্ধুর মতই ছিলে। তোমার জন্য যে আজ আমি এখানে। সে কথা কেউ না জানুক, আমি তো জানি। চিরকৃতজ্ঞ থাকব তোমার প্রতি। তোমার দুর্দিনে যদি সামান্য সাহায্য না করতে পারি, তাহলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না।’

রশিদ বিমূর্ত ঠাঁই বসে আছে। আনিস তার দু’হাত ধরে বলল, ‘চল এখন কিছু খেয়ে নাও। তারপর বাকি চিন্তা।’
___________________________

স্যারের অফিসের সামনে দাঁড়ানো। ভয়ে কাচুমাচু করছে নুবাহ। বার’কয়েক শুকনো ঢোক গিলল। এত ভয় আর কখনো পায়নি। খারাপ রেজাল্ট কতবার করেছে কিন্তু কোনদিন অফিস রুম তাকে আসতে হয়নি। না স্যার’ কখনো আসতে বলেছে। তার জানা মতে সে পরীক্ষা ভালই দিয়েছিল। কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকল না। কি এমন হয়েছে? যার জন্য সোজা অফিস রুমে তার তলব পড়েছে। ত্রস্ত পায়ে দরজায় নক করল।

‘আসসালামু আলাইকুম স্যার, ভিতরে আসব।’

ওবায়দুল স্যার নিশ্চুপ পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাচ্ছেন। না তাকিয়েই বলল, ‘এসো।’

সালাম দিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল নুবাহ। স্যার তাকে ইশারায় বসতে বললেন। সেও চুপচাপ বসে পড়ল। কম্পিত গলায় বলল, ‘স্যার কেন আসতে বলেছেন?

ওবায়দুল স্যার ড্রয়ার থেকে টেস্ট পরীক্ষার পেপার নিলেন। তারপর সেটা নুবাহর সামনে মেলে ধরলেন।
‘এই নাও তোমার পেপার।’

ক্লাসটেষ্ট পেপার দেখে নুবাহর চক্ষু চড়কগাছ। ঠিক পেপারের উপরে বাম পাশে লাল কলমের কালিতে বড় অক্ষরে ৫০ এর মধ্যে ৪৮ নাম্বার দেয়া। তাহলে স্যার তাকে অফিস রুমে কেন ডাকল। সে ‘তো ভালোই করেছে। উদগ্রীব দৃষ্টি স্যারের দিকে।

স্যার নুবাহর দৃষ্টি বুঝলেন। মুখের কোণে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠল তার। নমনীয় সুরে বললেন, ‘তুমি হয়তো ভাবছো, রেজাল্ট ভালো হওয়া সত্ত্বেও কেন তোমায় ডাকলাম। তাই না নিশা ‘মা।’

নুবাহ ঘাবড়ে গেল। সত্যিই তো! কেন ডেকেছে তাহলে? মাথা উপর নিচ করে বলল, ‘জ্বি, স্যার। আসলে ভয়ের থেকেও বেশি অবাক হয়েছি। কেনো ডেকেছেন আমাকে?’

স্যারের হাসি আরও প্রশস্ত হল। বিস্মিত নয়নে তার দিকে তাকাল। ফের বলে উঠল,

‘নিশা মা’ আমি তোমার ভালো রেজাল্ট দেখে অবাক হয়নি। ভেবেছি তুমি খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েছে। বাড়িতে যথেষ্ট পড়াশোনা করছো। সেজন্য হয়ত ভালো করতেই পারে। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি, তোমার ম্যাথের ভিন্নতা দেখে। এ নিয়মে আমি স্কুলে কখনো ম্যাথ করাইনি। আমি যতদূর জানি, তুমি বাড়িতে কারো কাছে টিউশন করো না। এরকম ভিন্ন নিয়মে কোথায় ম্যাথ শিখেছো। এমন ভিন্ন নিয়ম তোমার মাথায় যে আসবে না, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমাকে বলবে কোথায় শিখেছো?’

নুবাহ বাকরুদ্ধ, হৃদকম্পনের ধ্বক ধ্বক শব্দ অনায়াসে তার কর্ণদ্বয়ে বাজতে লাগল। ভয়ে আমতা আমতা করল। কি বলবে স্যারকে। সত্যি বলবে না’কি মিথ্যা বলবে।

ওবায়দুল স্যার তার অবস্থা বুঝল। তাকে অভয় দিয়ে বলল, ‘এভাবে কাঁপছো কেনো নিশা ‘মা? আমি শুধু কৌতুহলবশত জানতে চেয়েছি। ভয় নেই, তুমি নিঃসংকোচে বলতে পার।’

নত মস্তকে নেত্রপল্লব কয়েকবার ঝাঁপটাল। শুকনো ঢোক গিলল নুবাহ। ধীর গলায় বলল, ‘স্যার, আমার একজন অনলাইন টিউটর আছে। সে আমাকে পড়ায়। সাজেশনও তৈরি করে দিয়েছে। আমার ভুলগুলোও খুব সুন্দর করে ধরিয়ে দেয়। রোজ আমার থেকে পড়া নেয়। কোন বিষয় কখন পড়ব সেটার জন্য আলাদা রুটিন তৈরি করে দিয়েছে। সাবলীল আর সহজ নিয়মে সব বিষয়ের উত্তর তৈরি করে দিয়েছে। আর সে আমাকে…

কথার মাঝেই স্যার নুবাহকে থামিয়ে দিলেন। ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় থাকে তোমার অনলাইন টিউটর?’

কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল, ‘ঢাকায় থাকে।’

‘কীভাবে পরিচয় হল?’

নুবাহ নিচু মাথায় নিষ্পলক টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজমনে উত্তর খুঁজচ্ছিল। কি বলব স্যারকে? ওবায়দুল স্যার নিজমনে হাসলেন। হুট করে বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও এখন। পরে কোনো একদিন তোমার বাকী গল্প শুনব।’

নুবাহ হতভম্ব। বেশ দোটানায় পড়ল। স্যার কি ভাবছে এখন তাকে নিয়ে, খারাপ কিছু নয়তো। সালাম দিয়ে অফিসরুম থেকে বের হয়ে এল। ভিতর থেকে হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। কিন্তু মন খারাপ হলেও ঠোঁটের কোণে উচ্ছ্বসিত হাসি। ব্যাগ থেকে বোটাম ফোনটা বের করল। সুন্দর করে একটা মেসেজ দিল তার প্রিয় পুরুষকে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজমনে আওড়াল।

~অভিবাদন~
‘হে, প্রিয়’ তুমি এলে তাই,
জীবনটা সুনীল।
আঁধার ছাড়িয়ে আলোকছটায়
করেছো স্বপ্নীল।

কৃতজ্ঞতায় নতজানু হই শততম।
বড্ড প্রিয় তুমি ও ‘প্রিয়তম।
বেঁচে থেকো অজস্র দিন,
আমার জীবন করে রঙ্গিন।’
~ মেঘা সুবাশ্রী ~

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here