#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৫)
বাড়ির সামনের গেইট থেকে পেছনের গেইট পর্যন্ত লাবিবার বিচরণ। ছাদের দোলনায় বসে শুয়ে চলে তার দিনের অর্ধকাল। ঘরে তার মন টিকে না। শুন্য লাগে। লম্বা বেড, ডেস্ক,ড্যাসিন, আলমারি, শো পিস ফিল করলেও মনে হয় কোথায় যেনো কি নেই। বই খাতা প্রায় সব তার চিলেকোঠায় থাকে। নিচ থেকে ডাক আসতেই ছাদ ছাড়ে। দুপুর দুটো বেজে গেছে। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। টেবিলে ডিমের কোরমা,ডাল, সবজি দেখেই মুখটা আমরে ফেলে। এসব সে ভুলেও খাবে না। খাবে তো শুধু ঝাল মাংশ, ইলিশ চিংড়ি আর ভাজা পোড়া। শুঁটকি ও বাদ যায় না। সাবিনা জানে লাবিবা এসব কিছুই খাবে না। তবুও জোড় করা যায়। যদি একটু খায়! ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরে। লাবিবা নাক উপরে তুলে নেয়।
” ইসসসস না, এগুলো কি?”
“ডিমের কোরমা। নে মুখে দে এক লুকমা।”
” এ মা! না। এগুলো কি মানুষ খায়?”
” না। এগুলো গরু ছাগলে খায়। তুই গরু তাই খাবি। নে হা কর।”
” না। খাবো না।”
” লাবি মা হা কর। একদম জ্বালাবি না।”
” উহু না।খাবো না।”
ঘাড় ধরে জোর করে খাওয়াতে গেলে সরে যাওয়ার জন্য লাফালাফি করতে গিয়ে লাবিবা চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। ইসমাইল খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
” আহ! করছো টাকি? জানোই তো খাবে না।”
” একটা ডিম অন্তত খা। ” ইসমাইলের ধমককে পাত্তা না দিয়ে
” আর কতো খাবো? খেতে খেতে তো পরেই গেলাম। তাও তোমার হলো না?”
ইসমাইল হাত ধরে লাবিবাকে টেনে উঠায়। সাবিনা রাগে গজগজ করতে করতে হাত ধরে কিচেনে চলে যায়। ফিরে আসে ফেফি মাছের শুঁটকি পোড়া নিয়ে। সাথে দুটো কাচা মরিচ পোড়া। লবণ দিয়ে কচলিয়ে গরম ভাতে ঠান্ডা করে মাখায়। লাবিবা শুঁটকিতে কামড় দিয়ে লোকমা খায়। তাও চার পাঁচ লোকমাতেই খাওয়া শেষ। সাবিনা চেঁচায়।
” আর দু লোকমা খা।”
” উহু। আর খাবো না।”
” মেয়েটা একদমই ভাত খেতে চায় না। তুমি কিছু কেন বলো না?”
” আহা! ভাত খেতেই হবে এমন তো কোন কথা না। অন্যকিছু খেয়েই তো পেট ভরায়। সুস্থ থাকলেই হলো আর কিছু লাগবেনা। ”
লাবিবা ফ্রিজ খুলে আইস্ক্রিম নেয়। সারা বাড়ি ঘুর ঘুর করবে আর খাবে। মন চাইলেই মুখে এটা ওটা ঠুসে চিবুতেই থাকে। ভাতের অভাব এটা ওটা খেয়েই মেটায়। ইসমাইলও বুদ্ধি করে ফলমূল, আইস্ক্রিম এবং ভালো চকলেট দিয়ে ফ্রিজ ভরিয়ে রাখে। প্রতিদিন রাতে বাসি ফেরার সময় এটা ওটা আনতে ভুলে না। একটা মাত্র মেয়ে তার! কলিজা টুকরা।
ডাইননিং এ না বসে আইস্ক্রিমের বাটি সহ রুমে যেতে নিলেই ইসমাইল পিছু ডাকে। লাবিবাকে বলে,
” সোফায় বসো। আব্বু খাওয়া শেষ করে আসছে। ”
লাবিবা মাথা হেলিয়ে গিয়ে সোফায় বসে। টিভিটা অন করে গোপাল ভাঁড় দেখতে দেখতে আইস্ক্রিম খায়। ইসমাইল খাওয়া শেষ করে লাবিবার পাশে এসে বসে। হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ইসমাইলের বুকে মাথা সেঁধিয়ে দেয় লাবিবা। ইসমাইল মেয়েকে আগলে নেয় বুকের মাঝে। সাবিনাকে ডাক দেয়। তাদের সাথে বসতে বলে। সাবিনা আপত্তি জানায়।
” তোমরা বসো। কাজ গুলো শেষ করে আসছি।”
” পরে করো। এখন এখানে বসো। কথা আছে তোমাদের দুজনের সাথে।”
” কি কথা?”
“আগে বসো।”
সাবিনা বসে। ইসমাইল একটু সময় নিয়ে বলে,
” আমি লাবিবার বিয়ে দিতে চাই।”
শোনা মাত্রই লাবিবা ইসমাইলের থেকে দূরে সরে বসে। ভয়ঙ্কর মুখে ইসমাইলের দিকে তাকায়। সেদিনকার প্রিন্সিপালের রুমের ঘটনা মনে পড়ে যায়। জোড় গলায় বলে,
” আব্বু আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই । বিয়ের কথা মুখেও আনবেনা।”
” বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যায় মা। আজকাল অনেক মেয়েই বিয়ের পর পড়াশোনা করে বড় বড় চাকরি করছে। তাছাড়া আমি যে ছেলেকে তোমার জন্য চয়েজ করেছি ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার। উচ্চবিত্ত। তাদের ফ্যামিলির প্রত্যেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ওসি, ব্যাংকার। এরকম একটা ফ্যামিলিতে তোমাকে না দিলে আমার আফসোস থেকে যাবে। সেখানে বিয়ে হলে তোমার সুখের সীমা থাকবে না। ”
“আমি আমার এই জীবনেও অনেক সুখী আব্বু। দুই নৌকায় পা দিয়েছে আমাকে চলতে বলো না। স্টাডি আর সংসার একসাথে আমার পক্ষে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব না। আমি কোন সুপার ব্রিলিয়ান্ট না যে সব জায়গায় স্টার হবো। নেহাত এতো পড়ার চাপ। তার উপর মাস্টার্স শেষ করেই জবের জন্য দৌড়াতে হবে। আর তুমি আমাকে সংসারে ঢুকে যেতে বলছো?”
” আমি জেনে বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশ যতই উন্নত হোক তুমি যেভাবে চলতে চাও সেভাবে চলার এখনও সময় হয়নি। বিয়ে হয়ে যাক তারপর তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই হবে। চাকরী করতে চাইলে তাই করবে। শ্বশুড়বাড়ি না যেতে চাইলে যাবে না। ছেলেটা ঢাকায় চাকরি করে। যখন ছুটিতে আসবে তখনই শ্বশুড় বাড়িতে যাবে। সে চলে গেলে আবার এখানে চলে আসবে। ”
” তুমি যতটা সহজে বলছো ততোটা সহজ নয় আব্বু। আজকাল কোন ছেলেটা বিয়ের পর বউ বাপের বাড়ি ফেলে রাখে? ”
” কেউ না রাখলে তারা রাখবে। সেই পরিবার জেনে বুঝেই এগিয়েছে। আর পাঁচটা মেয়ের বাপের বাড়ি হলেও তোমার ক্ষেত্রে তা নয়। এটা তোমার নিজের বাড়ি। ”
” বিয়েতো যখন তখন করা যায়।স্টাডির সময় চলে গেলে আর পাওয়া যায়না। আমি জব পাওয়ার পর বিয়ে করতে চাই আব্বু। আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না।”
” তোমার বিয়ে আটকে রাখাও আমার পক্ষে সম্ভব না।চারদিক থেকে যেভাবে মানুষ উঠে পরে লেগেছে কখন না জানি কি ঘঠিয়ে ফেলে। বড় হয়েছো। তোমার সিকিউরিটি নিশ্চিত না করা অব্দি আমি স্বস্থি পাচ্ছি না।”
” আমি ঠিক আছি আব্বু। বিশ্বাস করো আমার কলেজে কোন প্রব্লেম হয় না। আমি কলেজের বাইরে একদমই যাই না। তুমি কেন দুশ্চিন্তা করছো?”
” তুমি এসব মাথায় নিও না মা। তুমি ততোক্ষন সেফ আছো যতক্ষন আমি তোমার সেফটি দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। আমার তোমার পেছনে থাকলেই আমার এবার চলছে না। তোমার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য আমাকে এবার ব্যবস্থা করতে হতে হবে। বিজনেস টাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমার পৈতৃক সম্পত্তি ভাইদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে হবে। তোমার জন্য সদরের বাড়িটাও কমপ্লিট করে দিতে হবে। জীবনে চলার পথে কোন স্থানে যদি ঠেকে যাও নিজের টা দিয়েই যেনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারো,অন্যের মুখাপেক্ষী না হতে হয় সেই সব ব্যবস্থায় আমি এখন করে যাবো। তুমি আমার জীবন মা। তোমার প্রতি সকলের লোভ। আশা করি তুমি যথেষ্ট বোঝদার আর আমার কথাটা মেনে নিবে।”
” আমি তোমাকে সমর্থন করি কিন্তু আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর কেন নয়? এখনিই বা কেনো? আমার সপ্ন এখানেই শেষ হয়ে যাবে আব্বু। আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না।”
” তুমি বিয়ে করবে আর এখনি করবে। আমি কিছু শুনবো না। যাও রুমে যাও।”
“আব্বু।”
“নো মোর ওয়ার্ডস।”
হুটহাট বিয়ের সিদ্ধান্ত লাবিবা মেনে নিতে পারে না। কলেজে ক্লাস শেষে একান্তেই কথা বলার জন্য প্রিন্সিপালের কেবিনের সামনে আসে। পিয়ন কে দেখে জিজ্ঞেস করে,
” প্রিন্সিপাল স্যার আছেন? দেখা করতে চাই।”
“ভেতরে বাইরের লোক আছেন। আধঘন্টা পর আসো।”
লাবিবা বেরিয়ে আসে। সবুজ ঘাসের উপর ব্যাগ রেখে বসে থাকে। আধ ঘন্টা পর খোঁজ নেয় এখনও মিটিং শেষ হয়নি। দশ টাকার বাদাম কিনে আনে। বসে বসে বাদাম খায়। আরও কিছুক্ষণ পর গিয়ে জানতে পারে স্যার এখনি বেরিয়ে যাবেন। লাবিবা তাড়াতাড়ি করে দরজা ঠেলে ঢুকে যায়। ভেতরে গিয়ে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করে,
” ম্যা আই কাম ইন স্যার?”
তানভীর উঠে যাচ্ছিলো। লাবিবাকে দেখে দাঁড়ায়। লাবিবাকে একবার দেখে নিয়েই গিয়ে আবার চেয়ারে বসে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে টেবিলে রাখে। লাবিবার দিকে এবার মনোযোগ দেয়।
” জুতো পরে আসো।”
” জি স্যার?”
” সেদিনও জুতো খুলে এসেছিলে। লুক! ফ্লোর ইজ সো ডার্টি।”
লাবিবা লজ্জা পায়। কেউই জুতো খুলে আসেনা। লাবিবাই একমাত্র এই কাজটি বার বার করে। আবার স্যারের নজরেও পরে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে জুতো পরে নেয়। সে কিভাবে জানবে সবাই জুতো পায়েই ঢুকে! কোন দিন প্রিন্সিপালের রুমে এসেছে নাকি? তানভীর ইশারায় বসতে বললে লাবিবা চেয়ার টেনে বসে। সমস্ত সংকোচ বোধ একপাশে রেখে বলে,
” স্যার সেদিন যে পিক নিলেন। তারপর আপনি কথা বলতে চেয়েছিলেন। ”
” বাসায় কি কেউ কিছু জানায়নি?”
” স্যার আব্বু আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু স্যার আমি এই মুহূর্তে বিয়েটা করতে চাইছি না। আমি নিজেকে নিয়ে অনেক আশাবাদী স্যার। আমার উপর অনেক দায়িত্ব। আমি আগে আমার ক্যারিয়ার গড়তে চাই। তারপর বিয়ে করতে আমার কোন সমস্যা নেই।”
“তোমার গার্ডিয়ান কে জানাও।”
” আব্বু শোনেননি। বিয়ের পর ক্যারিয়ার গড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু স্যার আমার কাছে এটা খুবই ট্রাফ ব্যাপার। পসিবলই না।”
” তোমার আব্বু যেহেতু ডিসিশন নিয়েছেন অবশ্যই ভেবে চিন্তে নিয়েছেন। তবুও আমি কথা বলবো এই আশ্বাস দিচ্ছি। আর পরিস্থিতি যতই খারাপ থাকুক লেখাপড়ায় কখনও কম্প্রোমাইজ করবেনা।”
” জি স্যার।”
” এবার তুমি আসতে পারো। আমি উঠবো।”
কলেজ একদম ফাঁকা। তানভীর ভাবলো লাবিবাকে পৌঁছে দিতে হবে। কিছুদূর এগিয়ে গেলো ডাক দেবার জন্য। তার আর প্রয়োজন হলো না। লাবিবাকে নিতে ইসমাইল এসে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তানভীর মুচকি হাসে। কেমন যেনো শান্তি লাগে তার সম্পর্কের টান গুলোতে। নি:শ্বার্থ ভালোবাসা গুলো সবার মাঝেই শান্তি ছড়াতে সক্ষম। সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রয়োজনে জীবনের একটি স্থান এখনো শূন্যের কাতারে পরে আছে।
চলবে__
®লাবিবা তানহা এলিজা