বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ১২,১৩

0
406

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১২,১৩

১২

নিস্তব্ধ প্রহরে দমকা হাওয়া এসে সেই ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে আরও এলোমেলো করে দিলো। হিমেলের কথাটা বজ্রপাতের মতো শোনালো কুমুর কাছে। চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। হুট করেই এমন তুমি সম্বোধনে পুরো শরীরে শিহরণ জেগে উঠলো। হিমেলের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই সে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলল
–এতো রাতে ছাদে? তাও আবার খোলা চুলে?

কুমু ঢোক গিলে নিচের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। কয়েক সেকেন্ডের মাথাতেই চুলটা শক্ত করে হাত খোপা করে নিয়ে মাথায় ওড়নাটা টেনে দিলো। হিমেল শান্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে আকাশের চাঁদের দিকে তাকাল। মন বলে উঠলো “কোনটা বেশী সুন্দর? আকাশের বুকে জ্বলে ওঠা আস্ত চাঁদটা নাকি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ রমণীর অসাধারণ চাঁদমুখটা।” আবারো দৃষ্টি ফেরাল সেই রমণীর মুখশ্রীর সর্বত্র। কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। তবে অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভুত হল মনের মাঝে। কুমু নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কি করবে। দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে। মাথার ওড়নাটা আরও টেনে দিতেই হিমেল বলল
–মেয়েদের এভাবে রাতে ছাদে ওঠা একদম ঠিক না। আর খোলা চুলে তো নয়ই।

কুমু নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে। আর আসবো না।

হিমেল পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–পায়ের ব্যাথা কমেছে?

কুমু আলতো করে মাথা নাড়ল। হিমেল কোন উত্তর দেয়ার আগেই কুমু সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলো। হিমেল কিছুই বলল না। তবে কুমু পুরোপুরি দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়েই থাকলো। কুমু চলে যেতেই তার মস্তিস্ক সজাগ হয়ে উঠলো। ভাবল এভাবে বলাটা কি ঠিক হল? মেয়েটা কিছু মনে করলো না তো?

————
হিমেল নিজের ঘরে বিছানায় বসে চেনা একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিল। এইসব গান তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। সে সব সময়ই এ ধরনের গান শুনতেই পছন্দ করে। বিশেষ করে যখন সে ছবি আঁকে। আজ অনেকদিন পর সে মনস্থির করেছে ছবি আকবে বলে। সব ধরনের ছবি আঁকলেও প্রকৃতির ছবিটা হিমেলকে অদ্ভুতভাবে ভেতর থেকে টানে। কেমন একটা প্রশান্তি অনুভব করে মনের মাঝে। তাই ঠিক করে ফেললো তার জানালা থেকে বাইরে যে ধানক্ষেত দেখা যায় তার ছবি আঁকবে। রঙ তুলি নিয়ে আর্ট পেপারের দিকে এগিয়ে গেলেও মন কিছুতেই সেদিকে স্থির করতে পারছে না। কারণ বাইরে থেকে গলার আওয়াজ আসছে। হিমেল ছবি আঁকার জন্য নিরিবিলি পরিবেশটা সব সময় বেছে নেয়। সে হিসেবে বলতে গেলে এই সময়টা এখন ছবি আঁকার জন্য উপযুক্ত নয়। বারবার বাধা গ্রস্ত হওয়ায় বিরক্ত চলে আসলো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ছবি আঁকা বন্ধ করে দিলো সে। ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে আবারো বসে পড়লো। কিন্তু হুট করেই মনে হল খোলা হাওয়ায় ছবিটা আঁকতে পারলে ভালো হতো। প্রকৃতির স্পর্শে প্রকৃতির ছবি। আর এই পরিবেশ এই মুহূর্তে ছাদের থেকে ভালো আর হতেই পারে না। মুচকি হেসে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে ছাদে উঠে গেলো। যেদিক থেকে ধান ক্ষেত স্পষ্ট দেখা যায় সেদিকেই দাঁড়ালো। ধান ক্ষেতটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে তুলি হাতে তুলে নিলো। আশ্চর্য জনকভাবে ধান ক্ষেতের ছবি আঁকতে শুরু করলেও মাথায় এলো গত রাতের দৃশ্য। আস্ত চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে আছে আরেক মায়াবী চাঁদ। সেই অপার্থিব দৃশ্যের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না। চোখে ভেসে উঠলো সেই সাধারণ রমণীর প্রতিচ্ছবি। প্রতিচ্ছবিটা স্পষ্ট হতেই আপনা আপনি রঙ তুলি নিজেই রুপ দিতে লাগলো। কিছুটা আঁকার পর এক পর্যায়ে থেমে গেলো হাত সজাগ হল মস্তিস্ক। এটা তো আঁকার কথা ছিল না। এমন কেন হল? কোমরে হাত রেখে সেদিকে স্থির তাকিয়ে ভাবল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই পেপারটা ক্লিপ বোর্ড থেকে খুলে মুড়িয়ে এক পাশে ছুড়ে ফেলে দিলো।

–এই, তুমি ওটা ফেললে কেন? নোংরা যেখান সেখানে ফেলতে হয়না জানো না?

হিমেল ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। মৌ কোমরে হাত রেখে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে ভীষণ রাগ তার। এমন চেহারা দেখে হিমেল হেসে ফেললো। মৌ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল
–আবার হাসছ কেন?

হিমেল হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। মৌয়ের হাত ধরে বলল
–আমি নোংরা ফেলেছি বলে তুমি রাগ করেছো? আচ্ছা ঠিক আছে সরি। আর ফেলবো না। তবুও রাগ করো না প্লিজ!

মৌয়ের কপালের গভীর ভাঁজ কিছুটা শিথিল হল। তবুও রাগটা ধরে রাখার চেষ্টা করেই বলল
–আর এমন করবে না। নোংরা ফেললে পরিবেশ নোংরা হয়।

হিমেল মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। মৌ এদিক সেদিক তাকাতেই পেছনে চোখ পড়লো ক্লিপ বোর্ডের উপরে। সেদিকে আঙ্গুল তাক করে বলল
–ওটা কি?

হিমেল ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলল
–ওটা ছবি আঁকার বোর্ড। ওখানে কাগজ রেখে ছবি আঁকতে হয়।

মৌ মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকাতেই কোথা থেকে কুমু এসে তাকে হাত ধরে ঝাঁঝালো গলায় বলল
–ছাদে কেন আসছ? তোমাকে মানা করছি না একা একা ছাদে আসতে। কথা শোন না কেন? একটা থাপ্পড় দেবো।

মৌ মুখটা ভার করে নিচের দিকে তাকাল। এখনই কেঁদে দেবে এমন একটা অবস্থা। হিমেল পুরোটা এতক্ষন চুপ করে দেখছিল। কুমু থেমে যেতেই বলে উঠলো
–ছোট বাচ্চাদের সাথে এভাবে কথা বলে?

কুমু পাশ ফিরে তাকাল। অস্থির হয়ে উঠলো দৃষ্টি। এতক্ষন সে রাগের মাথায় হিমেলকে খেয়াল করেনি। হিমেল আছে জানলে এতো জোরে কথাই বলতো না। কুমু দৃষ্টি নত করে ফেলতেই হিমেল মৌকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–মন খারাপ হয়েছে?

মৌ নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ল। হিমেল একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–মন খারাপ করে না। তুমি একা একা ছাদে আসো যদি পড়ে যাও তখন? তুমি ছোট তাই বুঝতে পারো না। কিন্তু বড়রা বুঝতে পারে। তাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা করে। কথা না শুনলে তখন বকে। বড়দের কথা শুনতে হয়।

মৌ তার দিকে তাকাল। হিমেলের কথা সে বুঝতে পেরেছে। তার মন ভালো হয়ে গেছে। মুচকি হেসে বলল
–ঠিক আছে। আর আসবো না।

হিমেল অবাক হয়ে তাকাল। কাল রাতে কুমুও ঠিক এভাবেই বলেছিল। দুই বোনের কথার এমন মিল দেখেই কুমুর দিকে তাকাল। কুমু তার দিকেই তাকিয়ে ছিল চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি নত করে ফেললো। হিমেল মুচকি হেসে মৌয়ের দিকে তাকাতেই সে হিমেলের পেছনে গিয়ে তুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। বেশ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সে। হিমেল তার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে কুমুর দিকে ঘুরে তাকাল। বলল
–একটু কথা বলা যাবে?

কুমু ভীষণ অবাক হয়ে তাকাল। উত্তর দিতে পারলো না তৎক্ষণাৎ। কিছুটা সময় নিয়ে বলল
–জি বলুন?

–কাল রাতে ছাদ থেকে নেমে যেতে বলেছিলাম। তার জন্য খুবই দুঃখিত। কিছু মনে করো নি তো?

হিমেলের কথা শুনে কুমু আরেক দফা অবাক হল। কাল রাতের কথা বলার ধরণ আর এখন কার কথা বলার ধরনের মাঝে রাত দিন তফাৎ। কাল রাতে হিমেলের কথার মাঝে কোথাও একটা অধিকার বোধ খুঁজে পেয়েছিল কিন্তু আজ শুধুই ভদ্রতা। মনটা অজানা বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল
–না না। এতে মনে করার কি আছে?

হিমেল অবিশ্বাসের সুরে বলল
–সত্যি তো?

কুমু হাসল। তার হাসির অর্থ সে সত্যিই কিছু মনে করে নি। হিমেল কুমুর নত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল
–শুধু ছাদে কেন মেয়েদের রাতে একা একা চলফেরা করাই উচিৎ নয়। অনেক কিছুই হতে পারে। সাবধানে থাকতে হবে। আর এমনিতেই রাতে খোলা চুলে ঘোরাফেরা করতে হয় না।

কুমু অবাক হয়ে হিমেলের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো। মনে আসা কথাটা অজান্তেই বলে ফেললো
–আপনার কথা শুনে মনে হয়না আপনি বিদেশে পড়ালেখা করেছেন। এতো বছর বিদেশে পড়ালেখা করার পরও কি চমৎকার বাংলা বলেন।

কুমুর কথা শুনে হাসল হিমেল। বলল
–বিদেশে ছিলাম বলে কি আমি বাঙালী নই? আমার চেহারা, আমার ভাষা সবকিছুই আমার সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলে। আমি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। আমি শরৎচন্দ্রের প্রেমের উপন্যাস পড়ি। গ্রাম প্রকৃতির ছবি আঁকি।

থেমে যেতেই কুমু বিস্ময় নিয়ে বলল
–আপনি ছবি আঁকেন?

হিমেল তাকাল। মুচকি হেসে বলল
–হ্যা। আঁকি।

–কিসের ছবি আঁকেন?

হিমেল হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। গভীর দৃষ্টি ফেলে বলল
–সবকিছুর। অনুমতি পেলে তোমারও ছবি আঁকতে পারি।

কথাটা শেষ হতেই কুমুর মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। এতক্ষন সবকিছু ঠিক থাকলেও এখন পরিবেশটা কেমন অসস্তিতে ভরে গেলো। হিমেল খেয়াল করলেও কিছু বলল না। কুমুর উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো। কুমু লাজুক হেসে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আমার ছবি?

হিমেল হেসে ফেলে বলল
–আপনার ছবি। কবে অনুমতি পাবো?

কুমু মুচকি হেসে নত দৃষ্টিতে বলল
–আমার অনুমতি কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু?

–অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিনা অনুমতিতে কারো ছবি আঁকাটা অপরাধ। আর তোমার কাছে আমি অন্তত কোন অপরাধ করতে চাই না। সেই অপরাধের ভার আমি যে বইতে পারবো না।

চলবে…

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১৩

শুক্রবার মানেই অলস সময় কাটে শুভ্রার। হাত পা গুটিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তন্দ্রা ভাবটা মাথা ভারী করে তুলেছে। সারাদিন এভাবে বিছানায় গড়াগড়ি করলে হালকা ঘুমের রেশটা থাকা স্বাভাবিক। চোখটা মেলে ভারী মাথাটা বালিশ থেকে তুলল। বাথরুমে গিয়ে পানির ঝাপটা চোখে মুখে দিয়ে ঘুম কাটানোর চেষ্টা করলো। ঘুমটা কেটে গেলেও শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। ঘর থেকে বেরতেই তার মা বলল তার খালা নাকি ডেকেছে। এভাবে বাসায় শুয়ে না থেকে খালামনির বাসা থেকে ঘুরে আসলেও ভালো লাগবে। তাই আর দিরুক্ত করলো না। দুইটা বাড়ি পরেই তার খালার বাসা। তাই আলাদা করে রেডি হওয়ারও ঝামেলা নেই। ওড়নাটা ঠিক করেই বেরিয়ে গেলো। বাসা থেকে বেরতেই রোদের তেজে শরীর ঝাঁঝরা হওয়ার উপক্রম। মাথার মগজ সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মনে হল। তাই ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়েই দ্রুত হাটা শুরু করলো। কিছুদুর যেতেই হুট করে সামনে কেউ এসে দাঁড়াতেই চমকে পা থেমে গেলো তার। প্রথমে একটু ভয় পেলেও সামনে ভালভাবে তাকাতে ভয়টা বিরক্তিতে পরিণত হল। শ্রাবণ নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরক্তি ভাবটা স্পষ্ট করে বুঝাতেই ঝাঁঝালো ভাবে বলল
–হুট করে এভাবে সামনে এসে দাঁড়ানো টা কোন ধরনের ভদ্রতা?

শ্রাবনের দৃষ্টির পরিবর্তন হল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই ক্লান্ত গলায় বলল
–আমি ভদ্র নই সেটা জানি। তোমার কাছে অনেকবার শুনেছি। আমার মধ্যে এমন কোন গুন নেই যা হয়তো কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু আমার ভালোবাসার জোর আছে। আর সে জোর তোমাকে দুর্বল করতে পারছে না সেটা আমি মানতে পারছি না। শুনেছি প্রতি পক্ষের কাছে দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রকাশ করতে কোন সমস্যা নেই তো। আমাকে কেন খামাখা প্রতিপক্ষ ভাবছ শুভ্রা।

শুভ্রা ভ্রু কুচকে তাকাল। বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল
–আপনার কি মাথায় সমস্যা হয়েছে? কিসব বলেই যাচ্ছেন। আমি কখন বললাম আপনি আমার ভালোবাসার মানুষ?

শ্রাবণ হাসল। রোদের তেজে লাল হয়ে যাওয়া ঘর্মাক্ত মুখেও হাসিটা কি প্রানবন্ত দেখাল। শুভ্রা একদম সামনে দাঁড়ানোয় পুরো রোদটা শ্রাবণের মুখ বরাবর এসে পড়েছে। শুভ্রার মায়া হল। বলল
–দেয়ালের পাশে দাঁড়ান। রোদ লাগছে মুখে।

শ্রাবণ হাসিটা থামিয়ে দিয়ে বলল
–আমি দাঁড়াব না। বাসায় যেতে হবে। আজ শুক্রবার। মসজিদে যাবো। এদিকে একটা কাজ ছিল। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তোমাকে দেখে ভাবলাম একটু কথা বলি।

শুভ্রা এমন লাইন ছাড়া কথা শুনে বিরক্ত হল। যতবার ছেলেটার সাথে কথা বলতে যায় ততবারই তার বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটা একদম গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কিন্তু সে কি জানে না মেয়েরা গুছিয়ে কথা বলা বেশী পছন্দ করে। দূর থেকে তার কাজ কর্ম শুভ্রাকে যতটা না আকৃষ্ট করে কাছ থেকে তার কথায় ঠিক ততটাই বিরক্ত হয় সে। এভাবে এই ছেলের সাথে তার জীবনেও প্রেম হয়ে উঠবে না। একবারেই অসম্ভব। রাগে তেতে উঠে বলল
–তাহলে যাচ্ছেন না কেন? অযথা রাস্তা আটকে আমার দেরি করাচ্ছেন?

শ্রাবণ তার কথার জবাব না দিয়ে বলল
–তুমি কোথায় যাচ্ছ এই সময়?

শুভ্রা আবারো বিরক্ত হল। সে যে রাগ করেছে সেটাও কি বুঝতে পারছে না? এ কেমন ভালোবাসা যে তার কথাই বুঝতে পারে না। অদ্ভুত মানুষ! শুভ্রা তীক্ষ্ণ ভাবেই জবাব দিলো
–খালামনির বাসায়।

শ্রাবণ কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই বলল
–ওহ আচ্ছা যাও।

শুভ্রা ভীষণ আহত দৃষ্টিতে তাকাল। বিরক্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে সে খেয়াল করলো তার আর বিরক্ত হওয়ারও ইচ্ছা নাই। ক্লান্তিতে শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলো। মনে মনে আওড়াল বাবা মা এরেঞ্জ ম্যারেজ করিয়ে দিলেও এই ছেলের বউ টিকবে না আর প্রেম তো দূরের কথা। হতাশ শ্বাস ছেড়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ভাবল শ্রাবণ হয়তো একবার তাকে ডাকবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। বাড়ির সামনে গিয়ে পেছন ঘুরে তাকাল। শ্রাবণ বড় ধাপ ফেলে হেটে অনেক দূর চলে গেছে। অসহায়ের মতো তাকাল সেদিকে শুভ্রা। শেষমেশ এই ছেলেটাকেই তার প্রেমে পড়তে হল? মনের মাঝে এক রাশ অভিযোগ আর অভিমান নিয়েই ভেতরে চলে গেলো।

———–
দুপুরে খেয়ে জরুরী কাজে বাইরে বেরিয়েছে হিমেল। বাড়ির পাশেই একটা দোকানে বসে অপেক্ষা করছে একজনের জন্য। নামাজ পড়ে এসে পাঞ্জাবিটাও বদলাবার সময় পায়নি। এই দুপুরে তার ইচ্ছা করছে বাসায় গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে। কিন্তু কাজটা যে অনেক জরুরী। তাই সে ইচ্ছাটা পুরন করা সম্ভব নয়। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বেশ বিরক্ত ভঙ্গীতে ধোঁয়া ছাড়ছে সে। বেখেয়ালিভাবে সামনে তাকাতেই দেখল কুমু মাথায় ছাতা ধরে হেটে যাচ্ছে। লম্বা বিনুনিটা মাথায় দেয়া ওড়না ভেদ করে নীচে দিয়ে অর্ধেকটা বের হয়ে গেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে শ্যাম বর্ণের মুখে। হিমেল ভাবল এই দুপুর বেলা রোদের মধ্যে কোথায় যাচ্ছে সে। তাও আবার শুক্রবারে। অবচেতন মন হুট করেই অদ্ভুত একটা কাজ করে বসলো। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে উঠে গেলো। এগিয়ে গিয়ে ডাকল
–মিস কুমুদিনী?

থেমে গেলো কুমু। তার পুরো নাম তেমন কেউ জানে না। আর এই এলাকায় নতুন এসেছে। এভাবে রাস্তায় নাম ধরে কে ডাকবে। ঘুরে তাকাতেই হিমেলকে দেখে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো। ক্লান্তিটা প্রশান্তিতে পরিণত হল। পরক্ষনেই হিমেলের মুখে নিজের নাম শুনে কিছুটা অবাক হল। অবাক হয়েই বলল
–আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে? আমি তো কখনো বলিনি?

হিমেল হেসে ফেললো। বলল
–তুমি না বললে কি জানা সম্ভব নয়? আমাদের বাড়িতে উপর থেকে নীচের তলা পর্যন্ত সবাই তোমার নাম জানে। যা অদ্ভুত নাম তোমার।

এমন কথা শুনে কুমু ভ্রু কুচকে তাকাল। হিমেলের কথাটা কেমন যেন শোনালো। কিছুটা রেগে গেলো কুমু। রাগ নিয়েই বলল
–অদ্ভুত মানে? নামের আবার অদ্ভুতের কি আছে?

কুমুর কণ্ঠের তেজ শুনেই হিমেল আন্দাজ করে ফেললো সে রাগ করেছে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–আরে রাগ করছ কেন? অদ্ভুত বলতে খারাপ কিছু বোঝাই নি। অদ্ভুত বলেছি কারণ এমন নাম সাধারণত কেউ পছন্দ করে না। তবে আমার কিন্তু ভালই লাগে। সাহিত্যের স্পর্শ আছে এই নামের মাঝে। ‘কুমুদিনী চৌধুরী’! রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের মধ্যে কেউ বেঁচে থাকলে তোমাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখে ফেলত নির্দ্বিধায়। তোমার চরিত্র হতো কোন জমিদার বাড়ির বউয়ের। বাইরে থেকে ভীষণ কঠিন কিন্তু ভেতর থেকে একদম কোমল। যাকে পড়ে ফেলা খুব সহজ নয়।

কুমু অদ্ভুত ভাবে তাকাল। সে কি ভেবেছিলো আর হিমেল কি বলল। তার নাম নিয়ে এতো সুন্দর কথা এর আগে কখনো শোনে নি সে। তাকে বিস্ময় নিয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিমেল আবেগি কণ্ঠে বলল
–তুমি দেখতেও ঠিক সেরকম। উপন্যাসের কোন নায়িকা।

হিমেলের কথা শুনে কুমুর হৃদপিণ্ডের শব্দ তরঙ্গ সুর তুলল। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো ঘর্মাক্ত মুখশ্রী। এলোমেলো অনুভুতিতে হাওয়া লাগতেই চোখ নামিয়ে আলতো করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। হিমেল মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করছে। তার হাতে ধরে থাকা ফোনটা বেজেই চলেছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই।

———–
সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দিগন্তে গাড় কমলা বর্ণের ছটা। সৌরভ এসেছে বাসায়। হিমেল শ্রাবণ আর সৌরভ ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ভ্যাপসা গরমে বাড়ির ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে তারা। তাই বিকেলের চা টা ছাদে বসেই খাওয়ার চিন্তা করেছে। ফুরফুরে হাওয়ায় তিনজনে গল্পে মেতে উঠেছে। ঘেমে যাওয়ায় বাতাসটা শরীরে শীতল অনুভূতি ছড়াচ্ছে। পরিবেশটা বেশ আরামদায়ক। হিমেল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রেলিঙ্গে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। দূর আকাশের আলোকসজ্জা দেখছে সে। মনে হচ্ছে রঙ তুলিতে আঁকা কোন স্থিরচিত্র। হিমেল ঠিক করে ফেললো দিনের শেষ বেলার একটা ছবি আকবে সে। মনের মাধুরি মিশিয়ে আঁকবে। আরেকবার চায়ে চুমুক দিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। সেদিকে তাকিয়েই হিমেলের ফুরফুরে মেজাজটা আচমকাই খারাপ হয়ে গেলো। স্নিগ্ধতায় ঘেরা পরিবেশটা পাল্টে গেলো। বিরক্ত এসে গেলো সবকিছুতেই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here