মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১) কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

0
688

“এক টুকরো মাছ ই তো ভাবি, এর জন্য তুমি এইটুকু বাচ্চার গায়ে হাত তুলবে?”

দশ বছর বয়সী আমিরাকে, জাপটে ধরে বাক্যটি বলল সায়রা। ও মাত্রই বাইরে থেকে এসেছে। আর তখনই আমিরার গায়ে হাত তুলে জুথি। মা হারানো আমিরা তখনো কেঁদে চলেছে। দুধে ভাতে বড়ো হওয়া তার ভাগ্য যে এমন হবে সেটা কেউ কি কখনো জেনেছিল?

জুথি সায়রার বাক্যের বিপরীতে জ্বলন্ত সুরে বলল,”এভাবে আদরে আদরে স্বভাব নষ্ট করছিস সায়রা। আর যথেষ্ট বড়ো ও। এই না কিছুই বুঝে না।”

“ভাবি,ঠিক আছে। আর কিছু বলা লাগবে না। এক টুকরো মাছ ই তো চেয়েছে, আমার ভাগেরটা দিতে।”

জুথি মুখ বাঁকিয়ে রইল। সায়রা নিজের মাছের টুকরাটা দিতেই আমিরা বলে ওঠল।

“আমি মাছ খাব না মিমি।”

কথাটি বলেই চোখের জল নিয়ে চলে গেল আমিরা। জুথি ভেংচি কেটে কাজ করতে লাগল। এদিকে সায়রার বুকের পাঁজর ভে ঙে আসার উপক্রম। বোনের মেয়েটিকে অসম্ভব ভালোবাসে সে।

আমিরা ছাদের এক কোণে বসে আছে। সে কাঁদছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। এক টুকরো মাছের জন্য মামি তাকে আ ঘা ত করেছে। সে কখনো এমন জীবন আশা করে নি। ছোট্ট সে অভিমানী খুব। সায়রা জানে সেটা। তাই ওর পাশে এসে চুপ করে বসেছে। দুজনেই চুপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। এমন নয় আমিরা সায়রার উপস্থিতি বুঝে নি। সে বুঝেছে। তবে কথা বলছে না। অনেক সময় পর আমিরার চোখের জল ফুরাল। সায়রা ওর গা ঘেঁষে বলল,”এখনো কষ্ট হচ্ছে?”

আমিরা দু দিকে মাথা কাত করে বোঝাল কষ্ট হচ্ছে না। সায়রা ওর বাহু টেনে বলল,”কী হয়েছিল? আমাকে বলতি। আমি তো মানা করতাম না। ভাবি কে কেন বলেছিস?”

আমিরা চুপ। সায়রা তার আদুরে হাতে মেয়েটির চোখ মুখ মুছে দিচ্ছে।

“মামি আমাকে মাছের সবথেকে ছোট পিস দিয়েছে। অনেক বেশি কাঁটা। আমি বদলে দিতে বলেছিলাম, তাই মে রে ছে।”

সায়রার বুকটা ভারী হয়ে গেল। আমিরার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বলল,”কষ্ট পাস না সোনা। মিমি সব কষ্ট দূর করে দিব।”

আমিরা বিড়াল ছানার মতন চুপ করে থাকে। সায়রার এত খারাপ লাগছে। এক টুকরো মাছের জন্য নাকি মেয়েটি মা’র খেয়েছে! এটা ওর জন্য খুবই যন্ত্রণার।

আমিরা ঘুমিয়ে আছে। ওর পাশেই বসে আছে সায়রা। পড়াশোনা করছে সে। মাঝে মাঝে ফোন চেইক করছে। না কোনো ম্যাসেজ আসে নি। ও একটু হতাশ হলো। সাঈদের সাথে তার ছয় বছরের সম্পর্ক। সেই স্কুল থেকে। অথচ আজকাল দুজনের বোঝা পড়াটা একেবারেই হচ্ছে না। কেমন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আগের মতন কথা হয় না।দেখা হয় না। কি এক আশ্চর্য শক্তি যেন ওদেরকে নিক্রিয় করে যাচ্ছে। সায়রার মন খারাপ হচ্ছে। ও ম্যাসেজ লিখল।

“কী করছো?”

চট করেই উত্তর এল না। কিছু সময় অপেক্ষা করে পড়ায় মন দিল ও। ম্যাসেজের রিপ্লে আসল ত্রিশ মিনিট পর।

“অফিস থেকে ফিরছি। তুমি?”

“আমি পড়ছি।”

“ও।”

“হুম।”

তারপর দুজনেই চুপ। সাঈদ ম্যাসেজ সীন করেছে। সায়রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেশ কিছুটা সময় যাওয়ার পর সাঈদের রিপ্লাই এল।
“ফ্রি কখন আছ? আজ সন্ধ্যায় দেখা করতে পারবে?”

“পারব।”

“ঠিক আছে।”

ঐ অবধিই কথা হলো ওদের। এখন কিছুটা ভালো লাগছে সায়রার। ও দ্রুত পড়া শেষ করে বারান্দায় গেল। গাছ গুলো নেতিয়ে পড়েছে। সেগুলোয় পানি ছিটিয়ে এল রান্না ঘরে। সন্ধ্যার নাশতাটা সে বানায়। যেহেতু আজ বের হবে তাই বিকেল বেলাতেই তৈরি করে নিচ্ছে সব। ওর নাশতা বানানো শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। ও দ্রুত আলাদা বাটিতে কিছু ভাজা নিয়ে আমিরার জন্য রাখল। ছাদ থেকে ভেজা কাপড় এনে সেগুলো মেলে দিল। সব কাজ শেষ হতে হতে কিছুটা লেট হয়ে গেল। আমিরার ঘুম ভে ঙে ছে। ও দেখল, মিমি তৈরি হচ্ছে। ও চোখ কচলে বলল,”মিমি, কোথায় যাও?”

“একটু বাইরে বের হচ্ছি রে। তোর জন্য ভাজা এনে রেখেছি। খেয়ে নিস। কেমন?”

“ঠিক আছে।”

“বাইরে তো যাচ্ছি,কিছু খাবি?”

“না।”

“আচ্ছা, আমি গেলাম রে। দ্রুতই আসব।”

“আচ্ছা।”

ব্যস্ত পায়ে বের হলো সায়রা। জুথি পেছন থেকে ডেকে ওঠল।

“এই সায়রা বের হচ্ছিস?”

“হ্যাঁ ভাবি। লেট হয়ে গেল।”

“এই লিস্টটা নিয়ে যা। আসার সময় নিয়ে আসিছ।”

“ঠিক আছে।”

লিস্ট হাতে নিয়ে রীতিমতো ছুটতে লাগল সায়রা। আমিরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। সে এইটুকু বয়সেই নিজের সবটুকু হারিয়ে বসেছে। যদি মিমি না থাকত, তবে কোথায় জায়গা হতো তার?

রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পথ চলছে সায়রা। আসলেই লেট হয়ে গেল। মাঝে কত জ্যাম ঠেলে আসতে হয়েছে তাকে! সাঈদ এত দিন পর দেখা করতে চেয়েছে। অথচ সে কী না লেট করে ফেলল। ও একটু অনুশোচনায় ভুগছে। তবে কিছু করার ছিল না অবশ্য। সব কাজ না শেষ করে কেমন করে আসবে?

সাঈদ আর সায়রা বরাবরই একটি নির্দিষ্ট ক্যাফেতে আড্ডা দেয়। এটা হচ্ছে অনেক মাস ধরে। সেই ক্যাফেতেই এল সায়রা। সাঈদ আগে থেকেই বসে ছিল। সায়রা বসতে বসতে বলল,”সরি। লেট হয়ে গেল।”

“ইটস ওকে।”

ওয়েটারকে কফি আনতে বলে সাঈদ সায়রার দিকে তাকাল। সায়রা আর সাঈদের প্রেমটা খুবই সাদামাটা। সায়রাকে প্রথম দেখেছিল মেলাতে। তারপর মেয়েটির খোঁজ খবর নিয়েছিল। ক্লাস টেনের একটি বাচ্চা মেয়ে। এদিকে সাঈদ তখন ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। দুজনের বয়সের একটা গ্যাপ আছে। মন মেজাজের মিল না ও হতে পারে। এই ভেবে ভেবে সাঈদের দিন কাটছিল না। তবে সায়রা ও মাথা থেকে যাচ্ছিল না। মেয়েটিকে যখন মনের অনুভূতি জানাল তখন কী যে একটা অবস্থা। সায়রা তো রেগেমেগে আগুন। তবে দুদিন পর ই জবাবটি এসেছিল। সায়রা নিজের জীবনের প্রথম প্রেমটি বেছে নিয়েছিল। সেই অতীত, সেই সায়রা। সবটা একবার স্মরণ করল সাঈদ। আজ তার বয়স আটাশে ঠেকেছে। সায়রার বয়স বাইশ। দুজনেই বিয়ের বয়সে এসেছে। প্রেমের বয়স ও হলো ছয়। সব মিলিয়ে বলা যায় সুন্দর একটি সময়। সায়রা কফি কাপে চুমুক দিয়ে বলল,”আজকাল বেশ ব্যস্ত থাকো।”

সাঈদ কয়েক সেকেন্ড পরে বলল,”কাজের চাপ বেড়েছে। কিংবা বাড়িয়ে নিয়েছি।”

“বাড়িয়ে কেন নিয়েছ?”

“রোজকার ঝামেলা ভালো লাগে না।”

“কী ঝামেলা?”

“বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে। বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে।”

বিয়ের কথা ওঠতেই শুকনো একটি ঢোক গিলল সায়রা। সাঈদ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,”আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

“আমার তো বিয়েতে অসুবিধা নেই সাঈদ। আমিও চাই বিয়ে করতে। তবে আমিরাকে ফেলে নয়। ও বাচ্চা একটা মেয়ে। সবে মা হারিয়েছে। বাবা থাকতেও হারিয়েছে বাবার ভালোবাসা। তুমি কেন বুঝতে চাইছো না?”

সায়রার হাতটি নিজের হাতে নিয়ে নিল সাঈদ। দুজনই একে অপরের দিকে চেয়ে আছে।

“সবটা বুঝতে পারছি সায়রা। তবে বাসায় এভাবে মানছে না।”

সায়রার গলাটা শুকিয়ে এসেছে। ওর চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে। দুজনের কেউ ই আর কথা বলল না। সাঈদ লম্বা একটি শ্বাস ফেলে বলল,”এবার সত্যিই আমার হাতে কিছু নেই সায়রা। আমি তোমায় ভালোবাসি। কেন বুঝতে চাইছো না?”

সায়রার কান্না পেল। তবে ও কাঁদল না। বরং কঠিন সুরে বলল,”তুমি চাইলে বিয়ে করে নিতে পারো সাঈদ। আমিরা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। ওকে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না।”

সাঈদের দৃষ্টিতে অসহায়তার ছাপ। সায়রা ওঠে পড়ল। ব্যাগ নিয়ে বলল,”সম্ভবত এই কথাটা শোনার জন্যই আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলে। আমি সব ক্লিয়ার করে দিয়েছি। হয়তো আমাদের পথচলাটা দীর্ঘ হলো না।”

একরাশ দুঃখ, কষ্ট বুকে চেপে রেখে সায়রা চলে এল। পথ চলতে চলতে ওর মনে হলো, মাথাটা ঘুরাচ্ছে। যখন তখন পড়ে যেতে পারে। তবে ও শক্ত থাকতে চাইছে। কিন্তু এই জীবন, এই পরিস্থিতি ওকে শক্ত থাকতে দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে গলার কাছটা ভীষণ জ্বলছে। আর কতক্ষণ কান্না আটকিয়ে রাখবে সে?

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১)
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
চলবে…..

পর্ব (২)
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=394930029734564&id=100076527090739&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here