#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৬)
মাথায় প্রবল যন্ত্রণা হচ্ছে। পুরোটা সময় ঝিলের হৃদয় ধুকপুক করছিল। অভিনব তখন হুট করেই কল কেটে দেয়! ছেলেটা কেমন যেন। ওমন বিচিত্র মুহূর্তে টেনে নিয়ে একাকী ফেলে চলে যায়। এটা খুবই যন্ত্রণা দিয়েছে ঝিলের মস্তিষ্কে। ত্রিশ মিনিট ধরে মাথা ধরে বসে আছে। অন্য দিকে মৌনতা সর্বোচ্চ আমোদে। সে নাচ গানে মেতে। ভুলে গেছে সকালবেলায় গড়ে উঠা মন খারাপ। ঝিলকে সবাই ডেকেছে। অথচ মেয়েটি উঠতে নারাজ। নিয়ন চটপটে। আর একটু পথ গেলেই মাওয়া ঘাট। অন্তত শেষ সময়টা সবার সাথে থাকুক ঝিল। নিয়নের জন্য উঠতে হয়। ঝিলকে ঘিরে আছে সবাই।
“তোরা কি শুরু করলি বল তো।”
“বেরসিক পানা বন্ধ করে একটু আমোদ করলেও তো পারিস। পাঁচ ভাইয়ের দম বন্ধ করা চাপে থেকে, মুক্তির স্বাদ নিতে ও ভুলি গেছিস।”
“আমার ভাইদের নিয়ে কিছু বলবি না নিয়ন। ওরা সব থেকে সেরা।”
“বাহ ভাইদের নিয়ে বলেছি বিধায় ওনার রাগ হলো। এখন সব বাদ,গান গাইতে হবে তোর।”
ঝিল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করে “ইম্পসিবল।”
“কেন রে ঝিলি? একটু গান গাইলে কি এমন হয়!”
“তোরা আছিস তো মৌন। আমার এসব গান গাইতে ইচ্ছে করে না।”
রুদ্রমের হাতে গিটার ছিল। সেটা সিটে রেখে উঠে এলো। ঝিলের মন খারাপটা খুব সহজেই অনুভব হয়।
“থাক বাদ দে। না চাইলে জোর করার দরকার নেই।”
সবাই সায় জানায়। যে যার মতো সিটে এসে বসে। মৌনতা ও লক্ষ্য করল ঝিলের কিছু হয়েছে।
“ঝিলি,তুই কি লুকাচ্ছিস কিছু?”
“কি লুকাব! আরে বোস তো তুই। আমি এমনিতেই গান গাইতে পারি না।”
“এটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমরা সবাই জানি তুই কত সুন্দর গান করিস।”
“অনেক দিন ধরে তো গান গাই না মৌন।”
মৌনতা আর কিছু বলল না। ঝিল বাইরে তাকিয়ে। এখন একটু ভালো লাগছে। এটা সত্য যে ওর মাথা ধরেছিল। তবে গান গাইতে না পারার মতো সমস্যা নয়। কিন্তু তখন থেকে অভিনবর কথা স্মরণ হচ্ছে। কিছুতেই মন বসছিল না। ছেলেটা ওকে বার বার এলোমেলো করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চয়ই সামনের দিনগুলো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
মাওয়াতে হোটেলের অভাব নেই। গাড়ি গুলো থামলেই চারপাশ থেকে লোক জন ডাকা শুরু করে। ওদের বেলাতে ও তেমনি হলো। একেক জন হুমড়ি খেয়ে নেমেছে। রুদ্রম ঠিক করল তিনটি টিম তিনটি হোটেলে যাবে। হলো ও তাই। প্রথম হোটলে গেল ঝিলদের টিম। আরাম করে বসল মেয়েটি। একটা শিরশির বাতাস এসে স্পর্শ করে যাচ্ছে। ভালো লাগছে। আবহাওয়া যেন একটু বেশিই রোমঞ্চকর। ঝিল সবে ফোন হাতে তুলেছে ওমনি চোখ যায় সামনের টেবিলে। বেশ আয়েশে চা পান করছে অভিনব। ছেলেটাকে দেখে অনেক বেশিই চমকে উঠেছে মেয়েটি। অন্যদিকে অভিনবর ডোন্ট কেয়ার ভাব। এ যেন হওয়ার ই ছিল।
“এই ঝিল, ইলিশ মাছ কেনা হবে চল।”
মৌনতা ওকে উঠিয়ে নিল। কিন্তু মাথা থেকে যাচ্ছে না অভিনবর চিন্তা। এমন কেন মানুষটা?
অনেক গুলো মাছ। কোনটা রেখে কোনটা নিবে বুঝতে পারছে না রুদ্রম। নিয়ন এই দিকে সেরা। ছেলেটা একটু বেশিই হিসাব নিকাশ করতে পারে। ওরা পাঁচজন। তাই একটা মাছ ই নিবে। মাছ গুলো দেখে নিয়ে নিয়ন বলল “মামা মাঝারি মাছটা কত?”
“৮০০ মামা।”
“কি বলেন, এই মাছ ৮০০ টাকা। ৫০০ রাখেন মামা।”
“হবে না মামা। মাছ তো কাঁচা নিবেন না। একে বারে ভেজে দেওয়া হবে। ৭০০ টাকা রাখতে পারব।”
“না মামা ৫৫০ টাকা দিব।”
“হবে না মামা।”
“মামা ৬০০ দিব আর কোনো কথাই নয়।”
লোকটা তবু দিবে না। এবার নিয়ন চোখ মুখ আঁধার করে বলল “তাহলে ৬২০ টাকা কনফার্ম।” লোকটা বিস্মিত হয়ে গেছে। মায়রা নিয়নের পিঠে চিমটি দেয়। ছেলেটা ব্যথায় ককিয়ে উঠে।
“চিমটি মারছ ক্যান! বজ্জাত মেয়ে।”
“সর তুই, এভাবে দাম বাড়ালে আর মাছ খাওয়া লাগবে না।”
অবশেষে মাছের দাম ৭০০ টাকাই স্থির হতে যাচ্ছিল। কিন্তু নিয়ন আরও কয়েক মিনিট দর কষলো। লোকটা নিজের স্থানে স্থির ছিল। তবে ৫০ টাকার জন্য যখন নিয়ন বের হয়ে যাচ্ছিল তখন দিয়েই দিল। নিয়নের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। এই নিয়ে এক বিস্তর হাসাহাসি চলল বন্ধু মহলে। ওরা সবাই এক টেবিলে বসেছে। ঝিল চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখল অভিনব নেই। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে কি ওমনি অভিনব হাজির।
“হাই গাইস, আজকে আমার বন্ধুর জন্মদিন। সেই জন্য জুনিয়রদের ট্রিট দেওয়া হচ্ছে। অভিনন্দন তোমরাও তাদের একাংশ।”
তরুণ প্রায় ঝড়ের গতিতে অভিনবর দিকে তাকালো। অভিনব হাল্কা করে চোখ টিপে দেয়। নিয়ন উঠে এসেছে।
“হ্যাপি বার্থডে ব্রো।”
বিষয়টা ধরে রাখতে মুখে হাসি টানে তরুণ। জীবনে প্রথম বারের মতো বার্থডে ট্রিট দিবে সেটাও মিথ্যে বার্থডে! ঝিলের ভ্রু কুচকে আছে। তরুণের সাথে চোখাচোখি হতেই ছেলেটা মুখ লুকানোর চেষ্টা করল। মৌনতা নিশ্চুপ। দুইয়ে দুইয়ে চার করার চেষ্টায়। ওরা সবাই এক সাথে খাবার খেল। তরুণ সব থেকে অস্বস্তিতে। ঝিল মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে।
“বিষয়টা কি রে দোস্ত।”
“জানি না।”
“আমার মনে হচ্ছে এ ছেলে আমাদের ফলো করে যাচ্ছে। কাহিনী অনেক দূর চলে গেছে।”
উত্তর করল না ঝিল। মায়রা ওদের কথার ইষৎ শুনতে পেয়ে বলল “কি ফিস ফিস করছিস তোরা?”
“না দোস্ত তেমন কিছু না। খাবারটা মজা হয়েছে খুব। সেটাই বলছি।”
রুদ্রম অভিনবর সাথে কথা বলছে। ছেলেটার বিষয়ে ওর আগ্রহ যেন একটু বেশি।
“ব্রো আমি একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ কনফিউশনে।”
“কোন ব্যাপার?”
“তোমার সাথে ট্রাভেলার ইহানের অনেক বেশি মিল।”
তরুণ হেসে উঠল। অভিনব ও মৃদু হাসছে।
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। বিশ্বাস কর, এটা আমার কাছে খুবই জটিল লাগছে।”
খাওয়া শেষ হলো সবার। বিল মিটিয়ে দিয়েছে তরুণ। রুদ্রম অফার করল অভিনব রা যেন ওদের সাথে ঘুরে। এ সুযোগটাই চাচ্ছিল অভিনব। প্রথম দিকে ভাব এমন করল যাতে ওদের মনে সন্দেহ না জাগে। তবে ইষৎ জোর করতেই রাজি হয়ে গেল। তরুণের কপাল বেয়ে ঘাম নামছে। ঝিলের দুটি চোখ যেন জ্ব ল ন্ত দাবানল। মেয়েটির এই রূপ সেদিন ওর চোখে না পরলেও আজ যেন ভস্ম করে দিচ্ছে!
ঝিলকে চা দেওয়ার বাহানায় অভিনব বলল “অবাক হলেন প্রজাপতি?”
মেয়েটি চমকে তাকালো। গলা শুকিয়ে এসেছে। তবু কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল “এই নামে আমায় ডাকবেন না।”
“কেন? ভালো লাগছে না। তবে কি বলব, ফড়িং?”
“অসহ্য।”
“উম এটা তো অদ্ভুত হয়ে গেল। অসহ্য নামের থেকে প্রজাপতি ডাকটাই সুন্দর।”
“আপনি কি শুরু করেছেন বলেন তো। এই সব আমার কাছে জঘন্য লাগে। সরে যান বলছি।”
“আসলেই?”
ঝিল উঠে গেল। মায়রা আর মৌনতা ছবি তুলছিল। ওদের সাথে যোগ দিতেই মায়রা বলল “কি বলল রে তোকে?”
“কে কি বলল?”
“ওমা, ঐ যে অভিনব নামের ছেলেটার সাথে কথা বলছিলি।”
“কোথায় কথা বলছিলাম। এমনিই চা দিতে এসেছিল। বললাম চা খাওয়ার ইচ্ছে নেই।”
মায়রা ফের প্রশ্ন করল না। ঝিলের সাথে ছবি তুলল কিছু। অথচ ঝিলের নজর অন্য কোথাও। এসব অভিনবর দৃষ্টির বাইরে যেতে পারল না। সবটাই দেখল সে আর নীরবে তুলে রাখল এক চিলতে বাহারি হাসি।
ওরা ঘাটে নামতে যাচ্ছিল। ওমন সময় এক রাশ হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল। আকাশ ডেকে উঠল। মেঘেদের গর্জন নিরালায় বসে বৃষ্টিকে কাছে ডাকছে। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নেমে আসে। টিপ টিপ বৃষ্টি। সাথে শীতল সমীরণ। সব কিছু ঝিল কে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। সবাই ভেতরে চলে গেলেও মেয়েটি গেল না। একটু আগের বিরক্তি ভুলে মিশে গেল প্রকৃতিতে। চোখ দুটি ইষৎ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগল তুলতুলে বৃষ্টির ছোঁয়া। অভিনব একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ঝিলকে দেখে চলেছে দু নয়নে। মেয়েটির মাঝে নতুনত্ব দেখা যায়। কোমল তুলতুলে হয়ে উঠে হৃদয়। গভীর থেকে গভীর হয় এক একটা অনুভূতি। শিরশির বাতাস আর ভেজা মাটির গন্ধ ওকে এলোমেলো করে দেয়। ইতোমধ্যেই ঝিলের খুব নিকটে চলে এসেছে। মেয়েটির বন্ধ করে রাখা চোখ, কম্পমান ঠোঁট সব কিছুই কাছে ডাকে। ঝিল তখনও প্রকৃতিকে অনুভব করে নিতে ব্যস্ত। অথচ অভিনবর চিত্তে ঝড় উঠে গেল। মেয়েটির কানের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। উত্তপ্ত নিশ্বাস মেয়েটির ঘাড়ে লাগতেই জেগে উঠে নিউরন। ঝিল ফট করে চোখ মেলে।
“হুস,কথা বলবেন না। অনুভব করতে থাকুন প্রজাপতি। বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, কোমল পাতার দাপাদাপি আর এলোমেলো সব অনুভূতি। অনুভব করুন ঝিল।”
ঝিলের নিশ্বাসে তপ্ততা। অনেক কথা বলতে চায় মন। তবে অদৃশ্য এক শক্তি গলার স্বর বন্ধ করে দেয়। অভিনব আরও নিকটে চলে এসেছে বোধহয়। ছেলেটার সরু নাকের ছোঁয়া লাগে ঘাড়ে। ঝিলের চিত্ত কাঁপে। মোচড় দিয়ে উঠে শরীর।
“সরে দাঁড়ান প্লিজ।”
আকুতিতে নুইয়ে আসে ঝিলের গলা। অভিনব সরে নি এক চুল। বরং আরেকটু কাছে আসার জন্য মন হয়েছে ব্যকুল। অনুভূতি গুলো সর্বাঙ্গে জুড়ে দিয়েছে এক নতুন পাঁয়তারা।
“ঝিল,আপনি আমায় অপছন্দ করেন?”
চমকায় মেয়েটি। নিজেকে প্রশ্ন করে যোগ্য কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তবে অভিনবর ভীষণ তাড়া। সে ফের জানতে চাইলেই মেয়েটি টনটনে কণ্ঠে জবাব দেয়।
“পছন্দ করার মতো কোনো কারণ তো নেই। আপনার লাগামহীন অসভ্য আচারণ সত্যিই আমার পছন্দ নয়।”
একটি কথাও কানে গেল কি অভিনবর? ঝিল কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে পেছনে ঘুরে। অভিনব ওর থেকে অনেকটা দূরে। চোখ বন্ধ করে কেবল লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। সুযোগটা গ্রহণ করতে চাইল ঝিল। তবে থেমে গেল অভিনবর কণ্ঠে।
“বৃষ্টি ভেজা সোঁদা মাটির ঘ্রাণ আপনার খুব ভালো লাগে তাই না প্রজাপতি? আমার ও ভীষণ প্রিয়। তবে জানেন এর পেছনের কারণ? কেন শুধুমাত্র বৃষ্টি হলেই সোঁদা ঘ্রাণ পাওয়া যায়?”
ছেলেটার কথায় আগ্রহ পেল ঝিল। তবে মুখে কিছুই বলল না। অভিনব বুঝতে পেরেছে মেয়েটি চাচ্ছে শুনতে। নীরবে ঠোঁট প্রসারিত করে ফের বলল “গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বেশি থাকে। আবহাওয়াটা ও আবার ভীষণ শুষ্ক। এমতাবস্থায় বৃষ্টির পানি উদ্ভিদের শরীরে লাগতেই উদ্ভিদ এক ধরনের উদ্বায়ী তেল নিজেদের শরীর থেকে বের করে বাতাসে মিশিয়ে দেয়। এর সাথে প্রকৃতিতে আরেকটি ঘটনাও ঘটে। তপ্ত শুষ্ক মাটি বৃষ্টির পানি পেতেই মাটিতে থাকা এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া ‘অ্যাকটিনোমাইসেটিস’ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে, বিশেষ এক রাসায়নিক ‘জিওসমিন’ বাতাসে মিশিয়ে দেয়। জিওসমিন আর উদ্ভিদের শরীর থেকে নিশ্রিত তেল একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে দারুণ এই ঘ্রাণটি তৈরি করে। কেবল বৃষ্টি নামলেই এটি আমরা অনুভব করে থাকি। যাকে পেট্রিকর বলা হয়। কি অপূর্ব সৃষ্টি তাই না?”
বিস্ময়ে চোখ ধাঁধিয়ে এসেছে ঝিলের। মেয়েটি বাকহীন চেয়ে। অভিনব আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওমন সময় মায়রা এলো।
“এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস ঝিল? আয় ভেতরে আয়।”
সম্ভিৎ ফিরে ঝিলের। যাওয়ার সময় মায়রা দেখল অভিনবকে। লম্বা হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল “ভাইয়া চলেন, লেট হয়ে যাচ্ছে।”
মায়রার মনের সন্দেহটা আরও জোরদার হলো। অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্কে। ভেতরে যেতেই রুদ্রমের মুখোমুখি। ওর দু চোখে অবিশ্বাস। অভিনব কিছু একটা আন্দাজ করে হাসল। রুদ্রমের গলা কাঁপছে। “তুমি, মানে আপনিই সেই বিখ্যাত ট্রাভেলার ইহান!”
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
পাঠকমহল :https://facebook.com/groups/2944711092471263/