#রাঙিয়ে_দাও
#পর্ব_(২০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
আষাঢ়ে মেঘের ন্যায় মূহুর্তেই ঘন-কালো মেঘ জমলো প্রান্তির গোলগাল মুখশ্রীতে।ঝুমঝুমিয়ে বর্ষার ঘটঘটা টলমলালো তার সচ্চ কালোমনির টানাটানা হরিনী আঁখিদ্বয়ে।তবে সেই টানাটানা আঁখিদ্বয়ের কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকা লোনাজল কিছুতেই চোয়াল বেয়ে ঝরতে দিলো না প্রান্তি।নির্বাক নিশ্চল নজরে তাকিয়ে রইলো প্রহানের মুখের দিকে।তাকে না বুঝে কি করে কথাগুলো বলতে পারলো মানুষটা?কে বলেছে সে মানুষটার উপর অধিকার সচেতন নয়? মানুষটার উপর অধিকার সচেতন বলেই তো সে এই ঘরসহ মানুষটার সকল জিনিসের উপর অধিকার দেখাচ্ছে।খাটাচ্ছে অধিকার।যে মানুষটা এতোদিন ধরে তার পছন্দ অপছন্দ বুঝে আসছে সেই মানুষটা এই সামন্য বিষয়টা বুঝতে পারলোনা।তার ইদানীংয়ের কথাবার্তা চালচলনে একটুও কি পরিলক্ষিত হয়নি মানুষটা প্রতি তার আচার আচারনের পরিবর্তন?মানুষটা কি একটু হলেও সত্যিই বুঝতে পারিনি মানুষটার প্রতি তার দূর্বলতা?যদি বুঝে থাকে তবে কি করে নিজে মুখ বলতে পারলো,মানুষটা তার হতে চায়না।তবে কি সত্যিই কি মানুষটা তার হতে চায় না?বিয়েটা কি সত্যিই তারউপর…।
আর ভাবতে পারলোনা প্রান্তি।কান্নাটা গলায় দলা পাকিয়ে গলাটা ব্যাথায় চির চিরিয়ে যাচ্ছে তার।বুকের কোথাও সূচালো তীরা বিঁধে যাওয়ার মতো যন্ত্রনা
অনুভব করছে।মানুষটার এই সামন্য মুখে দূরে সরে যাওয়ার কথা তাকে এতো যন্ত্রণা অনুভব করাচ্ছে,এতো ব্যাথার অনুভূতি দিচ্ছে।সত্যি যদি মানুষটার মুখের কথা সত্যায়িত করে মানুষটা তার নাহয়?তবে সে কি করবে? কি করে মানুষটাকে ছাড়া চলবে তার?মানুষটাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নেবে কিকরে সে?নির্বাক নিশ্চলা নজর এবার অসহায়ত্বে পরিনত হলো প্রান্তির।মুখ ফুটে মনের কথা গুলো কিকরে বলবে সে?যদি মানুষটা ফিরিয়ে দেয়, তবে যে মরে যাবে সে?যে মানুষটার সাথে তার ভালোমন্দের কোনো লেনাদেনা ছিলোনা,সেই মানুষটার প্রতি এতোটা দূর্বল কবে হয়ে পড়লো সে।এতোটা আপন কবে হয়ে গেল মানুষটা?প্রান্তির হাজার ভাবনায় ডুবে থাকা মুখের দিকে শান্ত আর গভীর নজরে তাকে দেখে যাচ্ছিলো প্রহান।মেয়েটার গোলগাল ফর্সা মুখখানায় আষাঢ়ে মেঘের ঘনঘটা দেখতেই নজরজোড় কোমল হলো তার।প্রিয় নারীটির টানাটানা নজরজোড়া বর্ষার ভরা নদীর মতো জল জমে যেতে দেখতেই বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো সে।মেয়েটাকে সামন্য ক্ষেপাতে চেয়েছিলো সে।কিন্তু একটু ক্ষেপাতে গিয়ে তাকে কষ্ট দিয়ে ফেললো কি সে?কথার ছলটা বেশী বলে ফেললো বোধহয়? ঈশ তার পাগলিটা কেমন করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।দেরী করলো না প্রহান।হাত জোড়া বাড়িয়ে দিয়ে কোমল স্পর্শে প্রান্তির মুখখানা দু’হাতে আজলে নিলো।বুড়ো আঙুলের আলতো স্পর্শে প্রান্তির চোয়ালে মোলায়েম স্পর্শ আকল।নিজের মুখটা আরও নিচু করে প্রান্তির মুখের কাছাকাছি নিয়ে ফের কোমল কন্ঠে বললো।
—যে মানুষটাকে তোর চাইনা সেই মানুষটার জন্য চোখ উপচে জল।এটা তো মানা যাচ্ছে না।সেই মানুষটা যে এই মায়াবী চোখের জ্বল পড়াটা মানতে নারাজ।
মুখ আরও নিচু করলো প্রহান।মুখের খুব কাছে গরম নিঃশ্বাসটা পড়তেই চোখ বন্ধ করে নিল প্রান্তি।সঙ্গেসঙ্গে দুচোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজলের স্রোত।সেটা দেখলো প্রহান।আজলে রাখা হাত-জোড়া সরিয়ে প্রান্তির চোখের কার্নিশে নিজের বুড়ো আঙুল জোড়া দিয়ে বাঁধ সাধলো সেই নোনাজলের স্রোত।ফের বেশ নরম আদূরে কন্ঠে বললো।
—তবে যে মানুষটার জন্য এই মায়াবী হরিনী আঁখিদ্বয়ে উপচে জল পড়ছে,সেই মানুষটা তোকে কথা দিচ্ছে।যাই হয়ে যাক মানুষটা কখনো আর দ্বিতীয় কার-ও হবে না।শুধু তোরই থেকে যাবে।সেই মানুষটার মৃত্যুর আগপর্যন্ত শুধু তার প্রানেরই হয়েই থাকবে।এটা মানুষটার তার প্রানের কাছে ওয়াদা।মানুষটার উপর সেই ভরসা করতে পারিস,বিশ্বাসটাও রাখতে পারিস।যদিও বিশ্বাস রাখাটা একান্ত তোর দ্বায়…
আষাঢ়ে মেঘ সরে গিয়ে ঝলমলে রোদ উঁকি দিলো প্রান্তির চোখেমুখে।কোমল ঠোঁটের কোণে ছুটলো মৃদু হাসি।মানুষটার কথায় খুশীর শীতল স্রোত বয়ে গেলো শরীরের প্রতিটি রোমে রোমে।তবে নজর জোড়া খুললো না।খুশিতে নোনাজল রোধ হওয়ার বদৌলে আরও ঝুমঝুমিয়ে বর্ষন হলো আঁখিদ্বয়ে।তবে সেই নোনা জলের অশ্রুকণা যে তার মসৃণ চোয়াল বেয়ে নামছে না এটা বেশ বুঝলো প্রান্তি।সামনে দাঁড়ানো পুরুষটা সেই অশ্রুকণাগুলো যে বারংবার তার পুরুষালী দু’হাতের আঙুল দ্বারা কোমল স্পর্শে মুছে চলেছে সেটা সদর্পে বুঝতে পারলো সে।প্রান্তিকে শীতল নজরে নিষ্পলক দেখে যাচ্ছিলো প্রহান।মেয়েটা তার সামন্য কথায় কেঁদে কেটে কি একটা অবস্থা করে ফেলেছে।সকাল সকাল ইচ্ছাকৃতভাবে মেয়েটাকে কাঁদানো একদম ঠিক হয়নি ভেবে হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টে প্রহান বললো।
—ঘুরতে যাবি?সাথে শপিংয়েও যাবো?
আষাঢ়ে মেঘ সরে গেলেও গাঢ় অভিমান জমল প্রান্তির।কি করে তাকে কথাগুলো বলতে পারলো মানুষটা?বুক কাঁপলোনা একবারও তার,মজা নেওয়া হচ্ছিলো তারসাথে?এখন ঘুরতে নিয়ে যাবে বলে আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে।যাবেনা সে।গাঢ় অভিমানে সামনের মানুষটার সাথে কথা বললো না সে।শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দিলো।অর্থাৎ সে যাবেনা।প্রান্তিকে মাথা নাড়িয়ে না জানাতে দেখে কপাল কুঁচকে গেলো প্রহানের।অবশ্যই প্রান্তির অভিমানটা বুঝতে সময় লাগলো না তার।তবুও বললো।
—ভেবে বলছিস তো?যাবি কি না।
ধুপ করে নজর জোড়া খুলে ফেললো প্রান্তি।সামনের অসভ্য লোকটা এক কথার মানুষ।এই যে সে অভিমানে রাগে ক্ষোভে মানুষটাকে বলেছে যাবে-না।মানুষটা দ্বিতীয়বার আর তাকে সাধবে না।তার রাগ অভিমান ও ভাঙার চেষ্টা করবেনা।সে না বলেছে মানে দ্বিতীয়ত আর কোনো প্রচেষ্টায় চালাবে না মানুষটা।তাই রাগ জেদ ভুলে পুনরায় তড়িৎ গতিতে মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানালো প্রান্তি।অর্থাৎ সে যাবে।
প্রান্তির এলোমেলো ভাবনা দেখে মনেমনে হাসলো প্রহান।তবে মুখাবয়বে সেটা মোটেও প্রকাশ করলো-না।প্রান্তির থেকে সরে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।ফের বললো।
—যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
প্রহান তাড়া দিতেই উঠে দাঁড়ালো প্রান্তি।মানুষটা আজ নিজ থেকে বলেছে ঘুরতে নিয়ে যাবে।আর সে যে মানুষটার সান্নিধ্যে পেতে চায়। রাগ অভিমান পুষে বসে থাকলে যে সেই সান্নিধ্যেটা পাওয়া সম্ভব নয়।এমনটা সে ছিলোনা,কিন্তু মানুষটার প্রতি তার দূর্বল মন যে তাকে বড়ো বেহায়া আর অবাধ্য করে দিয়েছে।মন যে সব ভুলে শুধু ওই মানুষটাকে পেতে চায়।
—এই প্রান, দাঁড়া।
দরজার সামনে পর্যন্ত গিয়েছিলো প্রান্তি।প্রহানের কথায় ফের দাঁড়িয়ে পড়লো।উৎসুক নজরটা প্রহানের নজরে পড়তেই প্রহান বললো।
—ভুলেও কাওকে পিছে লাগাবি না।তাহলে কিন্তু তোকে ও নিয়ে যাবো না।কাওকে বলতে পুতুল,আদ্রনিদ্র এমন কি পূর্ণকেও না, কাওকেই না।আর অবশ্যই বোরকা হিজাব পরেই তারপর বের হবি।
উৎসুক নজরজোড়া মূহুর্তেই অসহায় ভঙ্গিমায় পরিণত হলো প্রান্তির।ছেলেমেয়ে সবগুলো তার পাগল।সে কলেজ বাদে বাড়ি থেকে বের হলেই মুখিয়ে থাকে।সে কোথায় যাচ্ছে, কেনো যাচ্ছে?জেনে-বুঝে পিছে লাগে।বাধ্য হয়ে বা নিজ ইচ্ছেতে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়।সবাই কে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখা গেলেও, পুতুলকে কিকরে বুঝিয়ে রেখে যাবে সে?মনি আম্মা বলতে সে পাগল।অথচ মনি আম্মা ঘুরতে যাবে আর তাকে নিয়ে যাবেনা।মেয়েটা কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দেবে তো।
—ওদেরকে রেখে আমি একা ঘুরতে যাবো কি-করে? তবে আমি যেতে চাইনা?
একটু আগের পড়া বইগুলো গুছিয়ে রাখ ছিলো প্রহান।প্রান্তির বলা কথাটা কর্ণগোচর হতেই বললো — সেটা তোর ইচ্ছে তুই যাবি কি যাবিনা।তবে শর্ত একটাই তুই একা ছাড়া আমার সাথে যেতে পারবি না।সময় এখন থেকে দশ মিনিট। রেডি হয়ে আসলে নিয়ে যাবো না আসলে নয়।
বই গুছাতে গুছাতে শান্তস্বরে কথাগুলো বললো প্রহান।কথাগুলো শুনতেই প্রান্তির মুখটা আরও ছোটো হয়ে গেলো।ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোর সামনে দিয়ে সে কিকরে মানুষটার সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরতে চলে যাবে।ওই অসভ্য লোকটা আবার এক কথার মানুষ।বলেছে যখন কথার নড়চড় হবেনা। তার হয়েছে জ্বালা।এখন সে কি করবে?রাগে জেদে প্রহানকে উদ্দেশ্য করে বললো।
—আপনি খুব একটা খারাপ মানুষ।সাথে নিষ্ঠুরও।
কথাগুলো বলে দাঁড়ালো না প্রান্তি।দূরন্ত পায়ে ধপাধপ্ পা ফেলিয়ে চলে গেলো।প্রান্তি চোখের আড়াল হতেই শূন্য দরজার পানে তাকালো প্রহান।পুরুষালি ঠোঁটজোড়া মৃদুমন্দ প্রসারিত হলো তার।ফের মৃদুস্বরে বললো—তুই রেগে গেলে যে আমার বড়োই বেখেয়ালি হতে ইচ্ছে করে।নিয়ন্ত্রাধীন ধরেবেঁধে রাখা মনটা যে তখন তোকে সর্বোচ্চ ভালোবাসার জন্য অবাধ্য শিকলে বাঁধা পাখির মতো ছটফটিয়ে বেড়ায়।আরও রেগে যা।যতো মিষ্টি মিষ্টি রেগে যাবি আমার উপর ততোই তোর লাভ।তুই রেগে গিয়ে অভিমান করলে যে আমার আদর ভালোবাসার সিক্ততা তোর প্রতি আর-ও শতগুণ হয়ে আসক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে।ভয়ংকর নেশাময় হয়ে উঠে।
.
—হাবিব,আকাশকে একবার ফোন দিয়ে আসতে বলো তো।প্রান্তির রুমের ফ্যানটার কি জেনো সমস্যা হয়েছে।চলছেই না।একটু এসে ঠিক করে দিয়ে যাক।আর বাড়িতে আরও একটু ইলেক্ট্রনিকের কাজ আছে।সেটাও একেবারে করিয়ে নেবো।
বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলো হাবিব।বড়ো ভাবির কথায় থেমে গেলো।আচ্ছা ঠিক আছে বলে সে বেরিয়ে যেতেই ড্রয়িংরুমে বসা প্রজ্ঞা মায়ের উদ্দেশ্যে বললো।
—ওর রুমের ফ্যানটা আপতত ঠিক করতে হবে না,মা।
মেয়ের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে টুকটাক কথা বলছিলেন মাহবুবা বেগম।হাবিবকে বাহিরে যেতে দেখে কথা ছেড়ে তিনি হাবিবকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেন।হাবিব চলে যেতেই মেয়ের মুখে ফ্যান ঠিক না করার কথা শুনে কপালে ভাজ পড়লো উনার।ফের বললেন।
—কেনো ঠিক করবো না?মেয়েটা তাহলে এই গরমে ঘুমাবে কি করে?রোজ রোজ কি নিজের রুম বাদে অন্য কোথাও গিয়ে ঘুমাবে।এটাতে মেয়েটার ঘুম হয় না।জেনেও একথা কেনো বলছিস?
মাহবুবা বেগম জানেনা কাল ফ্যান খারাপ হয়ে যাওয়ায় প্রান্তি কোথায় ঘুমিয়েছিলো।সকাল বেলা শুধু জানতে পারলো প্রান্তির রুমের ফ্যানটা নষ্ট হয়ে গেছে,চলছেনা।তিনি সেই অনুপাতেই কথাগুলো বললেন।প্রজ্ঞাও বেশ বুঝলো মা কিছুই জানে না।মায়ের সামনে কথাগুলো বলতে বিব্রতবোধ করলেও কথাগুলো বলা উচিত ভেবে সহজ গলায় বললো।
—ও কালরাতে অন্য কোথাও গিয়ে ঘুমাইনি।ভাইয়ের রুমে গিয়েই ঘুমিয়েছিলো।আমি বলেছিলাম সেখানে গিয়ে ঘুমাতে।নিজের রুমের থেকে এখন ভাইয়ের রুমে থাকার অধিকার ওর বেশি।থাকা উচিতও।বিয়ে হয়ে গেছে কতোদিন হয়ে যাচ্ছে অথচ এখনো ওরা আলাদা আলাদা থাকছে।কেনো?
মাহবুবা বেগম কপালে ভাজ ফেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।হঠাৎই প্রজ্ঞার বলা কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হলো উনার।ছেলেমেয়ে দুটোর একসুতোয় বেঁধে দিলেও এসব তিনি ভাবেন নি।আর ফ্যানে সমস্যা হওয়াতে কাল প্রান্তি প্রহানের রুমে গিয়ে ঘুমিয়েছিলো।ছেলে মেয়ের দুটোর সম্পর্ক যে সহজ হয়ে এসেছে।এটা তিনি বেশ আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন।তবে… প্রজ্ঞার কথায় ভাবনা সেখানেই স্থির হয়ে গেলো।
—তোমরা তো বিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত।ওদের মধ্যে যে আগে থেকে ভালো সম্পর্ক ছিলো-না।সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।যেখানে ওদের মধ্যে বনিবার সম্পর্ক আগে থেকে ছিলোনা সেখানে এভাবে আলাদা থাকলে ওদের সম্পর্ক সহজ হবে কি করে?একে অপরের প্রতি ভালো লাগা,টান তৈরী হবে কিকরে?সম্পর্ক একটা তৈরী করে ছেড়ে রেখে দিলাম।এটাতে সম্পর্ক ভালো থাকে নাকি টিকে থাকে?ছোটো চাচ্চু আর হিমানীর বিয়ে হয়েছে ওদের কতো পরে অথচ তাদের সম্পর্কটা অল্প দিনের তুলনায় বেশ সহজে পরিনত হয়ে গেছে।তাদের ভিতরের সম্পর্ক কেমন সেটা আমার জানা নেই।তবে বাহিরের আচারআচরণ দেখলেতো মনেহয় তাদের সম্পর্কটা অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে।একে অপরের প্রতি টান হয়েছে,মায়া হয়েছে।যেখানে ছোটো চাচ্চু কেমন ছিলো সেটা আমাদের সবারই জানা।কাছাকাছি না থাকলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সহজ হয়না,বরংচ আরও
বিগড়ে যায়।সেখানে মায়া টানটা তৈরী হওয়ার বদৌলে আরও দূরত্ব তৈরী হয়।এক সময় কথাগুলো তো তুমি আমাকে বলতে।দাদিআম্মাও সবসময় আমাকে বলতো।সংসার জীবনে তোমাদের কথাগুলো সেভাবেই মেনে আসছি।তবে মেয়েটার বেলায় সেদিকে কেউ নজর দিচ্ছো না কেনো?এখনো তাদের আলাদা থাকতে দিচ্ছো কেনো?রেখেছো কেনো ভিন্ন ভিন্ন রুমে?এভাবে একসুতোয় গেঁথে, দু’জনের মতো ছেড়ে দিয়েছো তাদের কে।কেনো?
প্রজ্ঞার প্রতিটি কথায় যথাযথ যুক্তি আছে।মেয়েটা তার বরাবরই এমনই।বুদ্ধিমতি,জ্ঞানী।ছোটোখাটো সববিষয়ে চারদিকে নজর থাকে তার।ভেবেচিন্তে কথা বলে সে।
তবে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হওয়ার প্রান্তি আর বিষয়টা তিনি গভীরভাবে নেননি।বিধায় প্রজ্ঞার কথা গুলো যথাযথ মনে হলেও,প্রান্তির বিষয়ে তিনি বরাবরই সেনসেটিভ। বিধায় সেই ভাবনা মতে বললেন।
—মেয়েটা এখনো ছোটো।তোর দাদিআম্মা চেয়েছিলেন বলেই কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তাদেরকে সম্পর্কের বাঁধনে বেঁধে দিতে হয়েছে।আর দ্বিতীয়ত আমরা চাইছি ওরা নিজেরা নিজেদের সম্পর্কটস ঠিক করে নিক।নিজ থেকে একে অপরের মায়ায় জড়াক, কাছে আসুক।
—ওরা কিন্তু নিজেরা নিজেরা বিয়ে করেনি, মা।ওদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিলো না বা প্রান্তি ভাইকে পছন্দ করতো-না জেনেও কিন্তু ওদের বিয়েটা দেওয়া হয়েছিল।আমরা সবাই ভেবেছিলাম,বিয়েটা হয়ে গেলে দুজন দু’জনের প্রতি মায়ায় জড়িয়ে যাবে।ঠিকই তাদের মধ্যে ভালোবাসা তৈরী হয়ে যাবে।ভাইয়ের দিক থেকে সব ঠিক থাকলেও প্রান্তির দিক থেকে কথা গুলো ভাবা হয়েছিলো।তবে তৃতীয় পক্ষ হয়ে যখন প্রান্তির ভালোটা বুঝে সবাই ওদের বিয়েটা দিয়েছিলে।সেরকম তৃতীয় পক্ষ হয়ে ওদের সম্পর্কটা সহজ করে দেওয়া তোমাদের বা আমাদের দায়িত্ব।উচিতও।ওরা কি করে নিজেদের সম্পর্ক ঠিক করে নিয়ে এগোবে।যেখানে ছেলেমেয়ে দুটোকে তুমি বা আমারা ভালো করে জানি,চিনি।নিজ থেকে নিজেরা কখনো একে অপরের দিকে এগোবে না।সে যতোই দুজনের প্রতি মায়া টান আর দূর্বলতা অনুভব করুক না কেনো।তৃতীয় পক্ষ হয়ে আমাদেরই তাদের সম্পর্কটা সহজ করার জন্য সাহায্য করতে হবে।কেননা আমরা সবাই চাই ওরা খুব ভালো থাকুক।সুখে শান্তিতে থাকুক।আর সেটার জন্য আমাদেরই ওদের সম্পর্ক সহজ করে দিতে হবে।আর প্রান্তি একেবারে এতোটাও ছোটো নয়।ওর বয়সী মেয়েরা বাচ্চা নিয়ে-ও সংসার করছে।তবুও সে আমাদের আদরের।সংসার গুছিয়ে না করতে পারলেও ভাইয়ের কাছাকাছি থাকুক।তাদের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরী হোক, মায়া হোক,ভালোবাসা গড়ে উঠুক এটাই আমি সবসময় চাই।আর সেই সুন্দর সম্পর্কটা দুজনের মধ্য গড়ে উঠার জন্য দু’জনের একে অপরের কাছাকাছি থাকাটা খুবই প্রয়োজন।
মাহবুবা বেগম চুপচাপ মেয়ের কথাগুলো শুনে গেলেন।সত্যি বলতে ছেলেমেয়ে দুটোর সম্পর্ক নিয়ে তিনি এতোটাও গভীরভাবে ভাবেন নি।তবে প্রজ্ঞা ভুল বলছে না,তাদের মধ্যে সম্পর্কটা সুন্দর হওয়ার জন্য কাছাকাছি থাকা দরকার।কিন্তু তিনি চাইছিলেন প্রান্তি নিজ ইচ্ছেতে প্রহানের দিকে এগোক।তার মায়ায় জড়াক,ছেলেটাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিক।সেদিন দু’জনকে ড্রয়িংরুমে ওভাবে দেখে ভেবেছিলেন,যাক ছেলেমেয়ে দুটো পিছনের সবকিছু ভুলে একে-অপরের সান্নিধ্যে এসেছে।এভাবেই সম্পর্কটা আস্তে আস্তে সহজ হয়ে যাবে।তাই তিনি আর ওদের সম্পর্কটা নিয়ে এতো গভীরভাবে ভেবে দেখেন নি।তবে প্রজ্ঞার কথা অনুযায়ী এখন কাছাকাছি থাকাটা যদি ছেলেমেয়ে দুটোর ভালো হয় তবে তাই হোক।তাদের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরী হয়,ভালোবাসা গড়ে উঠে।তবে সেটাই হোক।
মেয়েটা যখন নিজ ইচ্ছেতে প্রহানের কাছে গিয়েছে,তার রুমে নিয়ে ঘুমিয়েছে।তবে এগিয়ে যাক সম্পর্ক।এখানে উনারাও কোনো বাঁধা নেই।
মাহবুবা বেগম আর প্রজ্ঞার মধ্য দ্বিতীয় আর কথা হলো না।মাহবুবা বেগম নিশ্চুপ উঠে চলে গেলেন।মায়ের মৌনসম্মতি বুঝতে অসুবিধা হলোনা প্রজ্ঞার।মুখে মৃদু হাসি ফুটলো তার।সে সবসময়ই চেয়ে আসছে, প্রান্তির সাথে সাথে তার ভাইটাও ভালো থাকুক।শুধু ভালো নয়, অনেকটা বেশি ভালো থাকুক।এটাই সবসময়ের প্রার্থনা তার।
.
গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমে জনজীবন ওষ্ঠাগত হলে-ও প্রান্তির মনে হচ্ছে সে শরতের মনখোলা দক্ষিণা হওয়ায় গা ভাসিয়ে উড়ে চলছে।কালো আর এ্যাশ কালারের চেক শার্ট টায় হলুদ হলুদ শ্যামবরন পুরুষটাকে দারুন মানিয়েছে।দারুন বলতে,একবারে নজরের তৃপ্তি, তৃষ্ণা পরিপূর্ণ করার মতো।নজর জেনো আজ নির্লজ্জতার সীমা পার করে বেহায়াপনা হয়ে পড়েছে প্রান্তির।এক হাত দিয়ে প্রহানের পেটের কাছের শার্টটা আলতো হাতে চেপে তারই বাইকের পিছনে বসে আছে সে।অসম্ভব্য গরমের মধ্যে মৃদু হাওয়া।মানুষটার গায়ের মাতাল করা সুগন্ধ।তাকে মানুষটার প্রতি আরও মোহনীয় করে তুলছে।তবে প্রহানের গা ঘেঁষে নিশ্চুপ বসে আছে সে।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মানুষটা আর কোনো নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে সামন্য বাকবিতন্ডায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই।শুধু মানুষটার সঙ্গ চাই তার।যারজন্য তখন মন খারাপ করেও মানুষটার সঙ্গ পেতে রেডি হয়ে নিয়ে স্বার্থপরের মতো চলে এসেছে সে।তবে সত্যি বলতে,বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় একটা ছেলেমেয়ে-ও তার পিছে লাগেনি।যেখানে তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেখলেই বাচ্চাগুলো হামলে পড়ে।আশ্চর্য হয়েও মনেমনে আবার ছেলেমেয়েগুলোকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়েছিলো প্রান্তি।কেননা তারা যে কেউ যদি তার সাথে আসতে চাইতো তবে সে কি বলতো?আর মানাও করতো কিকরে?প্রচন্ড খারাপ লাগতো তো তার।
— মুখ ওরকম কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো এলোমেলো করে রেখেছিস কেনো?যেতে ইচ্ছে করছেনা বুঝি?তবে বল বাড়িতে রেখে আসি তোকে।
মেজাজ খারাপ হলো প্রান্তির।ফাজিল লোকটা তার সাথে আবারও মজা নিচ্ছে।একটা কথাও বললো না প্রান্তি।চুপচাপ বসে থাকলো।তবে প্রহানের পেটের কাছে রাখা হাত খানা দিয়ে প্রহানের পেটে খামচি দিতে ভুললো না।পেটে কোমল হাতের মৃদু খামচি পেয়ে মুখে হাসি ফুটলো প্রহানের।মেয়েটা তো এতো বছর তাকে কম জালায়নি, তবে সময় এসেছে তার।এখন নাহয় সে একটু জ্বালাক।পিছনের মুখ ভার করে থাকা প্রিয় নারী টিকে সামনের মিররে একবার দেখে নিলো প্রহান।ফের কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন বেজে উঠল তার।ফোন ধরার আগ্রহ দেখালোনা প্রহান।তবে একবার নয় অনবরত ফোন বেজে যাওয়ায় বাইক রাস্তার সাইডে থামিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে।ফোনের স্কিনে নামটা দেখে কপাল কুঁচকে গেলো তার।বেশ বিরক্তও হলো।পুনরায় ফোনটা বেজে উঠতেই কলটা রিসিভ করে কানে দিতেই উচ্ছ্বসিত পুরুষালী কন্ঠের বার্তা এলো।
—বাচ্চা বউটাকে বুকের খাঁচায় করে নিয়ে দেখি ঘুরে বেড়াচ্ছো,বন্ধু..।ব্যাপার স্যাপার কি?তোমার বাঁধনহারা পাখিটা বুঝি তোমার ভালোবাসায় বশ মেনেছে?আদর ভালোবাসাটা বুঝি একটু বেশি বেশি দিচ্ছো….
চলবে….