#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ২৬
#Lamyea_Chowdhury
নক্ষত্র ভ্রুকুটি করে চেয়ার টেনে বসল। মাথার ক্যাপটা টেনে ঠিক করে চোখ মুখ কুচঁকে বলল, “আপনার কোন আশিক আপনাকে ক্ষত দিয়েছে?”
শায়েরী কান্না থামিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল, “তুমি যে এই পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম ভাই তুমি কি তা জানো?”
নক্ষত্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “শিকু কি মরে গেছে? ভাইয়ের কথা এতই যখন মনে পড়ছে তবে ভাইয়ের কাছেই যাও। দুনিয়াতে আমি ছাড়াও তোমার আরো শতশত ভাই আছে। তাদের গিয়ে বলো তাদের শায়েরী আপামণিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। দুনিয়াতে আমি ছাড়া তোমার আর ভাই নেই তাইনা শায়েরী আপামণি?”
শায়েরী অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল, “শিকুকে নিয়ে বাজে কথা বলতে তোমার একটু বুক কাঁপল না? আমার একমাত্র আদরের ভাইটা!”
নক্ষত্র তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “হ্যাঁ, তবে একমাত্র ভাইয়ের কাছেই যাও। আমি তোমার আপন ভাই না যে বসে বসে তোমার সকল নালিশ শুনব।”
শায়েরী রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভুলে এসেছিলাম মিস্টার দুইমাত্র ভাই।”
তারপর চলে যাওয়ার জন্য সামনের দিকে পা বাড়াল। নক্ষত্র ইচ্ছে করে পা টা বাড়িয়ে দিলো। শায়েরীর তখন মাথা গরম। রাগের চোটে তড়িঘড়ি করে যেতে গিয়ে নক্ষত্রের পায়ের দিকে খেয়াল করল না। উল্টো হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। নক্ষত্র ধরলও না। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমার সাথে কথা বলবে নমনীয় স্বরে। আমি রাস্তারলোক না।”
শায়েরী কনুইয়ে ব্যথা পেয়েছে। উঠে দাঁড়াতে তার বেশ সময় লাগল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াল সে। তারপর নক্ষত্রের দিকে এগিয়ে গেল। নক্ষত্রের হঠাৎ মনে হলো ভনভন করে তার মাথা ঘুরছে। হাঁটুও কাঁপতে শুরু করল। শায়েরী এভাবে এগিয়ে আসছে কেন? বেশি কাছাকাছি এসে পড়লে নক্ষত্র আর দম নিতে পারবে না। তার মাথা, মন দুটোই বিগড়ে যাবে। ঝামেলা হয়ে যাবে তখন! এই মেয়ের সমস্যা কি? এই মেয়েকে নক্ষত্র যত বেশি দূরে ঠেলতে চায়, এই মেয়ে তত বেশি তার কাছে ছুটে আসে। এমন চলতে থাকলে নক্ষত্র নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে। নক্ষত্র নিঃশ্বাস আটকে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। তারপর জ্বিহ্ব দিয়া ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “গেট লস্ট শায়েরী। এখনি ঘর থেকে বের হও।”
শায়েরী সে কথায় পাত্তা দিলো না। সে ধীর পায়ে হেঁটে এসে নক্ষত্রর ঠিক সামনে দাঁড়াল। তারপর চেয়ারে বসে থাকা নক্ষত্রের দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিল থেকে জগ তুলে নিলো। তারপর জগ থেকেই ঢকঢক করে পানি পান করতে লাগল। নক্ষত্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে বিমোহিত হয়ে সেই দৃশ্য দেখল। শায়েরীর সুউন্নত চিবুকে দু এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে সেই জলকণাদের মুছে দিতে নক্ষত্রের ভীষণ ভীষণ ইচ্ছে হলো। নক্ষত্র মাছি তাড়ানোর মতন হাত নাড়িয়ে মনে মনে বলল, “বাবা নক্ষত্র কাঁটাতারের দূরত্ব বজায় রাখুন। নতুবা, আপনার মা আর ফুফুর মাঝে আবারো সম্মুখসমর শুরু হয়ে যাবে। কিপ ডিসটেন্স ব্রো!”
নক্ষত্র নিজেকে সামলে নিলো। শায়েরীও পানি খাওয়া শেষ করে জগ টেবিলে রেখে দিলো এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখ ভরতি পানি নক্ষত্রের উপর ছেড়ে দিলো। শায়েরীর মুখের পানি সরাসরি এসে নক্ষত্রের কুঞ্চিত মুখশ্রী এবং কুঁচকে থাকা শার্ট স্নান করিয়ে গেল। নক্ষত্র আকস্মিকতায় স্হিরচিত্র হয়ে গেল। হতবুদ্ধি, বিস্মিত এবং হতভম্ব নক্ষত্র চোখ ছানাবড়া করে শায়েরীর দিকে তাকিয়ে রইল। শায়েরী নক্ষত্রের দৃষ্টিকে কটাক্ষ করে বাঁকা হাসি হাসল। তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “কে বলেছে তুমি রাস্তারলোক? তুমি তো তোমার বড় লোক মায়ের বখে যাওয়া বেয়াড়া ছেলে। বাপ-মায়ের টাকায় আয়েশ করা মায়ের বিড়ালছানা। যেই ছেলে মায়ের ভয়ে ক্লাস টেনে পড়বার সময়ও বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছিল, যে ছেলে মায়ের ভয়ে নিজের শখের আঁকাআঁকিটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল, চারুকলায় পড়বার ইচ্ছা বাদ দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, যে ছেলে অনার্স এর ফাইনাল ইয়ারে এসেও এক টাকা এখনও রোজগার করার মুরোদ হয়নি তার এত ত্যাজ ভালো না।”
শায়েরী নিজের চোখের দিকে আঙুল দিয়ে একবার ইশারা করল, আরেকবার ইশারা করল ঠিক নক্ষত্রের চোখে দিকে। তারপর স্হির গলায় বলল, “ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার হিসাবটা আরেকদিনের জন্য তোলা রইল। ভালো থাকুন আর বসে বসে মায়ের টাকায় কেনা ফিডার চুষুন।”
শায়েরী আর দাঁড়াল না। হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ দিয়ে নক্ষত্রের মুখ বরাবর আঘাত করে গটগট করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আর তখনই সে ভয়ানক একটা বিষয় আবিষ্কার করল। ভয়ানক বিষয়টা হলো দরজা সে কোনোভাবেই খুলতে পারছে না, হাজার চেষ্টা করেও না! বারকয়েক আরে চেষ্টা করল সে। তারপর গলা চড়িয়ে প্রহরকে ডাকল। ডাকল মালা এমনকি মামাকেও। কিন্তু, কেউ’ই কোনো জবাব দিলো না। শায়েরী ব্যাগ থেকে ফোন বের করে প্রহরকে কল করল কিন্তু প্রহর ফোন ধরল না। বারংবার চেষ্টা করল সে কিন্তু প্রতিবারই বিফল হলো। শায়েরী না পেরে মামাকেও ফোন করল। মামা অবশ্য ফোন ধরলেন। শায়েরী আশ্বস্ত হয়ে বলল, “মামা আপনি কোথায়?”
সামজিদ হোসেন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, “আমি তো গাড়িতে আছি। জরুরি কাজে সিলেট যাচ্ছি। কেন কিছু হয়েছে? নায়লা ভালো আছে তো? আর তোমার বাবা?”
শায়েরী নিঃশব্দে ফোন কেটে দিলো। খুব ভালো করেই সে বুঝতে পারল প্রহর তাকে মিথ্যে বলেছে। এরচেয়েও বেশি ভালো করে বুঝে গেল যে আজকে তার আর নিস্তার নেই। নক্ষত্র ভাইয়ের কাছে পুরোপুরিভাবে ফেঁসে গেছে সে। একটু আগে সে যা করেছে তাতে করে নক্ষত্র ভাই তাকে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। বরং বাগে পেলে তাকে কড়ায়গন্ডায় তা বুঝিয়ে দিবে। সে অবশ্য তা জেনেও ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে। চুপচাপ সব সহ্য করতে করতে মানুষটা মাথায় উঠে গেছে। এখনই টেনে হিঁচড়ে নীচে নামাতে না পারলে সবসময় এমন অপমান আর অপদস্তই করে চলবে! তার টাকায় খায় না পড়ে যে সে এমনতর ব্যবহার করবে? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কাজটা করে বড্ড বেশি ভুল হয়ে গেছে। তাকে এখন গলা টিপে মেরে না ফেলে। নক্ষত্রর জন্য অসম্ভব কিছু না। কিন্তু, শায়েরী মরে গেলে তার বাবা- মায়ের কি হবে? শিকুর কি হবে? শায়েরী এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে নক্ষত্রকে বলল, “নক্ষত্র ভাই, তোমার কাছে কি এক্সট্রা চাবি আছে? প্রহর হয়তো দুষ্টুমি করে বাইরে থেকে লক করে দিয়েছে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। শিগগির বাসায় ফিরতে হবে।”
নক্ষত্র যেমন করে বসেছিল ঠিক তেমনভাবেই বসে রইল। নড়ল না অবধি, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালও না। তবে হিমশীতল কণ্ঠে বলল, “চাবি আছে।”
শায়েরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর তাড়া দিয়ে বলল, “কষ্ট করে চাবিটা একটু দাও না।”
নক্ষত্র ভরাট গলায় বলল, “আমার কাছে আছে কিন্তু আমি চাবিটা তোমায় দিব না। তোমার পাখা গজিয়েছে তাইনা? সেই পাখা আমি আজ কাটব। কাঁচি দিয়ে কাটব নাকি চাপাতি দিয়ে কোপাব বলে দাও তো আজু?”
চলবে…