#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ২৫

0
372

#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ২৫
#Lamyea_Chowdhury

প্রহর নক্ষত্রকে আগেভাগেই কিছু বলল না। শায়েরীর আসবার কথা নিজের মনে চেপে রেখে উৎকণ্ঠা নিয়ে বাড়িময় পায়চারী করছিল সে। শায়েরীর ফোন পাওয়ার পর পরই গল্পের বইয়ের নেশা উবে গিয়েছিল। মালা বিকেলের নাশতা দিয়ে গেছে সেই কখন! কিন্তু এখনও নাশতা সেই টেবিলেই পড়ে আছে, একবার ছুঁয়েও দেখেনি। প্রহরের সেই অস্থিরতা নক্ষত্রের চোখ এড়ালো না। নক্ষত্র সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। প্রহরকে হলঘরে পায়চারী করতে দেখে নক্ষত্র থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “তোর পড়াশুনা নেই?”
প্রহর চোখমুখ কুঁচকে বলল, “নিজের কাজে যাও। আমাকে জ্বালাতন করতে এসো না।”
নক্ষত্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “রেজাল্টের দিন এমন ঝাঁড়ি কোথায় থাকে আমিও দেখে নিব। তখন আবার বিড়ালছানাটি সেজে থাকিস না যেন।”
প্রহর এবার উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলল, “যেতে বলেছি, যাচ্ছ না কেন? যার নিজের জীবন নিয়েই ভাববার কোনো মুরুদ নেই সে আবার আমার জীবনের চিন্তায় মরে যাচ্ছে! এসব দেখলে গা জ্বলে!”
চট করেই নক্ষত্রের মেজাজ বিগড়ে গেল। একবার ভাবলো এখনি প্রহরের গাল ফাটিয়ে কষে দুটো চড় মারবে সে। মেয়েটা দিন দিন বেয়াদবের চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে। তা নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে এক’পা এগুলোও কিন্তু, পরক্ষণেই মনে পড়ল, মা বাসায় নেই। এই মেয়ে চূড়ান্ত বেয়াদবের সাথে সাথে চূড়ান্ত মিথ্যাবাদী, নাটকবাজ এবং ঢঙ্গীও। পরে দেখা যাবে একটা মারলে কেঁদেকেটে মায়ের কাছে হাত পা দিয়ে লাগিয়ে সেটাকে এমন করে তুলবে যে মায়ের কাছে মনে হবে মায়ের মেয়েকে একা পেয়ে খুনই করে ফেলা হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিবারণ করল সে। তারপর আগুন চোখে প্রহরের দিকে তাকিয়ে তাকে বুঝিয়ে দিলো, আর একবার বেয়াদবি করবি তো আস্ত গিলে ফেলব। প্রহরও তা বুঝতে পারলো। বাসায় এখন মালা ছাড়া আর কেউ নেই তাই একটু ভয়ও পেল। নক্ষত্র রেগে গেলে অনেক বেশি মারবে তাকে। সেকথা ভেবেই মুখখানা আমসি হয়ে গেল। নক্ষত্র অবশ্য দাঁড়াল না আর। রাগ দমিয়ে তড়তড় করে সিঁড়িয়ে বেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। প্রহর ঝড়ের গতিতে ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। শায়েরী খানিক ইতঃস্তত করে ভিতরে ঢুকল। রুচিকে পড়িয়ে শায়েরী আরেকটা টিউশনে গিয়েছিল। সেটা শেষ করে নক্ষত্রদের বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেল। তবুও না এসে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না সে। তাছাড়া, ঢাকা শহরে এমন সন্ধ্যা কিছুই না। শায়েরীকে কিছু বলতে হলো না। প্রহর’ই নিজ থেকে বলল, “দাভাই উপরেই আছে, তুমি যাও।”
শায়েরী দ্বিধামিশ্রিত পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, “মামা কোথায়?”
প্রহর মিথ্যে বলল, “বাবা স্টাডিতে আছে। ভীষণ ব্যস্ত! কি একটা জরুরী ফাইল হারিয়ে ফেলেছে। সেই দুপুর থেকে তন্নতন্ন করে সেটা খুঁজে চলেছে। দুপুরের খাবারটা পর্যন্ত মুখে তুলেনি বাবা।”
প্রহরের এমন আত্মবিশ্বাসী মিথ্যে শুনে শায়েরী খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলল। সে বিনা সংকোচে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নক্ষত্রের ঘরের দরজায় কড়াঘাত করল। কিন্তু, মুখে কোনো শব্দ করল না। শায়েরী বেশ ভালো করেই জানে শায়েরীর কণ্ঠস্বর শুনলে নক্ষত্র কখনো দরজা’ই খুলবে না।

নক্ষত্র জগ থেকে পানি ঢালছিল। একটু আগেই মালাকে চায়ের কথা বলে এসেছিল। তাই ভাবলো মালা বুঝি চা নিয়ে এসেছে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতেই দরজা খুলল সে এবং প্রায় সাথে সাথেই শায়েরীকে দেখতে পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে মুখ থেকে পানি ছেড়ে দিলো। সেই পানি গিয়ে ছিটকে পড়ল শায়েরীর হিজাব, ওড়না আর কামিজের উপর। শায়েরী চোখ ছানাবড়া করে নিজের দিকে তাকালো একবার। তারপর কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে বলল, “ছিঃ! ইয়াক? বমি আসছে আমার। ইউ!!!!”
আরো অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো। বেশি বলে ফেললে বিপদ। খেচর ভাইকে এই মুহূর্তে কিছুতেই রাগানো যাবে না। যদিও গা গুলিয়ে আসছে তবুও শান্তস্বরে বলল, “ভাই, তোমার সাথে কথা ছিল আমার।”
নক্ষত্র স্যরি বলবে তো দূরের কথা, সে উল্টো শায়েরীর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে নিলো। শায়েরী কেমন করে যেন বুঝে ফেলল। নক্ষত্র দরজা বন্ধ করার আগেই শায়েরী ঘরে ঢুকে পড়ল। নক্ষত্র গমগমে গলায় বলল, “এক্ষণি বের হও শায়েরী।”
শায়েরী আকুতিমিনতি করে বলল, “প্লিজ, প্লিজ ভাই। একটাবার আমার কথা শুনো। অনেক বড় বিপদে পড়েছি আমি।”
নক্ষত্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “মরো তুমি।”
শায়েরী অস্থির গলায় বলল, “ভাই প্লিজ একটু সময় দাও আমায়।”
নক্ষত্র একরোখার মতন বলল, “আমি তোমার মতন এত আজাইরা না আজু।”
শায়েরী কিছু বলতে যাবে তার আগেই নক্ষত্র হাত দেখিয়ে থামিয়ে আক্রোশে বলল, “তুমি তো আচ্ছা বেহায়া! রাত দুপুরে ছেলেদের বেডরুমে ঢুকে পড়ো।”
শায়েরী চরম হতভম্ব হয়ে বলল, “আশ্চর্য! তুমি আমার ভাই, আমি তোমার ছোট বোন। তোমার ঘরে আসতে হলে আমাকে এত আকাশপাতাল ভাবতে হবে কেন? এত বাজে কথা কোথা থেকে পাও তুমি?”
শায়েরীর এমনতর ভাই-বোন পাতানো কথা শুনে নক্ষত্র তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তেঁতে গিয়ে দরজার দিকে ইশারা করে আঙুল তুলে বলল, “জাস্ট লিভ।”
শায়েরী অসহিষ্ণু গলায় বলল, “উফ ভাই প্লিজ।”
নক্ষত্র বাজখাঁই গলায় বলল, “কানে শুনতে পাওনি? আমি কিন্তু তোমায় টেনে হিঁচড়ে বের করে দিতে বাধ্য হব।”
নক্ষত্রের কথায় পাত্তা না দিয়ে শায়েরী এলোমেলো পায়ে নক্ষত্রের অগোছালো, এলোমেলো, চিরজীবনের মশারী টানানো বিছানাটায় পা তুলে বসল। নক্ষত্র রেগেমেগে শায়েরীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “বসে আছেন কেন আজু সাহেবা? একদম ল্যাটে যান। ছেলে মানুষের বিছানায় টুপ করে বসে পড়ে! সাহস কত বড়! অশালীন মেয়ে কোথাকার! বেহায়া, নির্লজ্জ!”
নক্ষত্র আরো কিছু বলতে চাইল কিন্তু খেয়াল করল শায়েরীর নাকের পাটা কেমন ফুলে ফুলে উঠছে, চোখজোড়া টকটকে লাল। কেমন ভেঙে পড়া মানুষের মতন লাগছে তাকে। নক্ষত্র হঠাৎ কি মনে করে যেন জিজ্ঞাসা করল, “বেশি সিরিয়াস কিছু?”
শায়েরী যেন নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। একসময় দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here