#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ৩৪
#Lamyea_Chowdhury
শায়েরী কি বলবে ভেবে পেল না। তাই চুপ করেই রইল। সায়াহ্ন’ই আবার বলল, “আপনি শুধু শুধু নিজেকে দোষী ভাববেন না। আপনার কথায় আমাদের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়নি। বরং, মৌন আপনার কথাকে ভর করে আমার কাছ থেকে স্বেচ্ছায় দূরে সরেছে। থাক সে কথা বাদ দিন। আপনার জন্য কিছু আনতে বলি। চা নাকি কফি?”
শায়েরী প্রায় সাথে সাথেই উঠে দাঁড়াল। বলল, “না না ঠিক আছে। ধন্যবাদ আপনাকে। আমার আবার তাড়া আছে।”
সায়াহ্ন মৃদু হেসে বলল, “আমার কথায় কি কষ্ট পেয়েছেন? বেশি রুড হয়ে গেলাম নাকি? স্যরি শায়েরী।”
শায়েরী তড়িঘড়ি করে বলল, “ছিঃ! ছিঃ! রাগ করব কেন? আপনি বরং দয়া করে আমার উপর কোনো ধরনের মনঃকষ্ট রাখবেন না। আর মৌনকে একটু বুঝবার চেষ্টা করবেন।”
সায়াহ্ন মাথা নাড়িয়ে বলল, “ব্যাপার নাহ্। তবে, আপনি খানিক বসলে ভালো লাগতো। খালি মুখে ফিরে যাচ্ছেন।”
“আরেকদিন আসব ভাইয়া।”
শায়েরী বের হয়ে গেল। সায়াহ্ন ভদ্রতার খাতিরে উঠে এসে শায়েরীকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো তারপর বলল, “ভালো থাকবেন।”
শায়েরী মৃদু হাসলো তারপর চলে গেল সকালের টিউশনিতে। টিউশনি শেষে ক্লাস তারপর আবার টিউশনি। শেষ টিউশনিটা ছিল রুচিদের বাসায়। রুচি আজও সেই পাগলটার খবর নিলো। শায়েরী চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলো, “পাগল আরও বেশি পাগল হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে এখন নগ্ন হয়ে চলাফেরা করে।”
শেষ কথাটা শায়েরী ইচ্ছে করেই বলল যেন নক্ষত্রের সেদিনের কর্মকাণ্ডের নিরব প্রতিবাদ। শায়েরী মনে মনে বলল, “খেচরের ঘরে খেচর তুই নগ্ন, আমি বাদে তোর পুরো চৌদ্দ গোষ্ঠী নগ্ন। তোর চোখে পোকা পড়ুক। দুনিয়ার সবচেয়ে কুৎসিত,কদাকার মেয়েটা তোর বউ হোক।” শায়েরীর কথা শুনে রুচির অবশ্য নিদারুণ কষ্ট হলো। পাগলটার অবস্হা বুঝি এতই খারাপ হয়ে গেছে!
সাধারণত শায়েরী সন্ধ্যার পর ভীষণ ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে। কিন্তু, আজ সে একটুও ক্লান্ত নয় বরং অনেকটাই উৎফুল্ল আর ফুরফুরা। তার নিয়মমাফিক জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। আর না এসেছে কোনো ধরনের ব্যত্যয়। তারপরেও একটা সুতীব্র সুঘ্রাণ পুরোটা সময় শায়েরীকে ঘিরে রেখেছিল। সেই সুঘ্রাণ আর সুবাস জুড়ে দুরুক মিশে ছিল। ছিল দুরুকের হাসি হাসি মুখের অবয়বটা। একটা মানুষের চেহারাবন্দি হাসিতে যে কারও পুরো মেঘলা দিনটাই ঝলমলে হয়ে উঠে পারে সেকথা শায়েরী আগে কখনও জানত না। দুরুকের অদৃশ্য পরশ শায়েরীর সকল ক্লেশবোধ পরম আবেশে ক্ষণে ক্ষণে মুছে দিয়ে গেছে। শায়েরীর দিনটাই বেশ ভালো গেল। শায়েরীকে দেখেই মৌন সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কি ব্যাপার এত খুশি খুশি কেন আজ?”
শায়েরী ঘর কাঁপিয়ে হেসে বলল, “তোর কি মনে হয়?”
মৌন পড়তে বসেছিল। টেবিলে রাখা বইখানা বন্ধ করে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি গেস করব?”
“দেখি কর তো। শুনেছি তোর নাকি অনেক বুদ্ধি।”
মৌন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শায়েরীকে পরখ করে বলল, “তুই কি সায়াহ্ন ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?”
“আসলেই তো তোর দেখি দারুণ বুদ্ধি।”
মৌন মুখ দিয়ে চ এর মতন শব্দ করে বলল, “ধুর! কচুর বুদ্ধি আমার। তোর শেষের কথাটা শুনে যে কেউ আন্দাজে বলে দিতে পারবে যে তুই সায়াহ্ন ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি। তাছাড়া, আমি তো তোকে চিনি। আমি জানতাম তুই যাবি’ই যাবি।”
শায়েরী আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, “শেষের কোন কথাটা?”
“ঐ যে শুনেছিস আমার নাকি অনেক বুদ্ধি।”
শায়েরী হাসতে হাসতে বলল, “সায়াহ্ন ভাইয়া ঠিক বলেছেন। তোর আসলেই অনেক বুদ্ধি। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোর সারা অঙ্গে এত বুদ্ধির ভার যে হৃদয়খানা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। বুদ্ধির ভারে নুয়ে পড়তে পড়তে তুই তোর হৃদয়ের অনুভূতিগুলো ঝেঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের বোঝা হালকা করতে চাইছিস।”
মৌন কণ্ঠে বিরক্তি ঢেলে দিয়ে বলল, “এত ভারি ভারি কথা না বলে সোজাসাপ্টা কথা বল দেখি।”
“আমি বলতে চাইছি সায়াহ্ন ছেলেটা ভীষণ ভালো। এত ভালো একটা ছেলেকে হাতছাড়া করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলি।”
“এত তাড়াতাড়ি তোকে ইম্প্রেস করে ফেলল! ওয়াও!”
“ইয়াহ্ হি ইজ ইম্প্রেসিভ। যথেষ্ট বিনয়ী এবং ভদ্র। আমাকে দরজা পর্যন্ত নিজে উঠে এসে এগিয়ে দিয়ে গেছেন। একদম চোখে চোখ রেখে কথা বলেন তবে সে চাহনী শালীন এবং রুচিশীল। কণ্ঠ দৃঢ়, বুদ্ধিদীপ্ত তবে বলার ভঙ্গিটা নমনীয়। দেখতেও টিপটপ, ফরমাল লুক আছে।”
“বাব্বাহ্ তোর এত ভালো লেগেছে?”
শায়েরী কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল, “অবশ্যই। সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লেগেছে তা হলো উনি নিজের রাগ দমিয়ে রাখতে জানেন। মানুষ হিসেবে সবার’ই কম বেশি রাগ, ক্রোধ,আক্রোশ থাকে। তবে যারা আক্রোশে ফেটে না পড়ে সেই ক্রোধটা গিলে ফেলতে পারে তারাই মানুষ হিসেবে ভালো।”
মৌন দ্বিমত পোষণ করে বলল, “কচু, তারা মানুষ হিসেবে আরও বেশি ইবলিশ হয়। সময় মতন ঘ্যাচাং করে টিকিটা কেটে দেয়।”
“সবাই তো আর এক হয় না। তাছাড়া, আমি গিলে ফেলা বলতে ক্ষমা করবার কথাটাও বুঝিয়েছি।”
মৌন দায়সারাভাবে বলল, “ওহ্। তাই বল।”
পরক্ষণেই মৌন আবার বলল, “আচ্ছা তোর সাথে সায়াহ্ন ভাইয়ার বিয়েটা হলে কেমন হয় বলতো? বেশ ভালো হবে না?”
শায়েরী চমকে উঠে বলল, “কি যা তা বলিস। আমি তো তোর জন্য….”
মৌন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে শায়েরীর কাছ ঘেঁষে বসল। তার চোখ মুখ ইঁদুরের মতন চকচক করছে। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে সে বলল, “সায়াহ্ন ভাইয়া যেমন ভালো মানুষ টাইপ তুইও তেমন। সায়াহ্ন ভাইয়া আবার হেল্পফুলও। তোকে আর তোর পরিবারকে অাগলে রাখবে। তোকে কোনো কষ্টই করতে দিবে না।”
শায়েরী চোখ উল্টে বলল, “আমার আম্মা সাজতে আসিস না দয়া করে।”
মৌন মুখখানা বাংলার পাঁচের মতন করে বলল, “কেন সমস্যা কোথায়? বিয়ে তো করবিই। আজ হোক আর কাল হোক বিয়ে করতে হবে না?”
শায়েরী বিরক্তভাবে বলল, “হ্যাঁ বিয়ে করব তাই বলে তোর কাজিনকেই কেন বিয়ে করতে হবে? দুনিয়াতে কি ছেলের কম পড়েছে?”
মৌন মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তাহলে কি তোর নিজের কাজিনকে বিয়ে করবি নাকি?”
শায়েরী খ্যাক দিয়ে উঠল। বলল, “তোরা এত্ত খারাপ মৌন? তোরা আমার বন্ধু না শত্রু বুঝি না। কি করে তোরা আমাকে ঐ খেচরটার সাথে ভাবতে পারিস? সে কতটা অসভ্য আর বেয়াদব তোরা কল্পনাও করতে পারবি না। মুখখানা দেখে মনে হবে ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারে না। অথচ, এক নাম্বারের একটা মিচকা শয়তান। তাছাড়া, যা শ্রী ওই বদের। আমি কি এতই ফেলনা নাকি যে উনাকে বিয়ে করব? তাছাড়া, উনাকে ভাইয়ের চোখেই দেখি। কোনোদিন অন্য ধরনের কোনো চিন্তা আমার মাথায় ভুলেও আসেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা মামী যা জল্লাদীয় শাশুড়ি হবেন ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।”
মৌন এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে শায়েরীর মনে নক্ষত্রের জন্য কিছু নেই। এক ঢিলে তার দুই পাখি মারা হয়ে গেল। কথা ঘুরিয়ে বলল, “থাক আপাতত তোর কথা রাখি। তোকে নিয়ে পরেও ভাবা যাবে। এখন সবার আগে আদুরীর কথা ভাবতে হবে।”
শায়েরী অস্থির হয়ে বলল, “তাই তো। আদুরী কোথায় আজ?”
“পার্লারে গেছে।”
“কখন আসবে?”
“দেরি আছে ফিরতে। চুলে প্রোটিন ট্রিটমেন্ট করাবে, তারপর ফেশিয়াল করাবে, স্ক্রাব করাবে, মেনিকিউর, পেডিকিউরও করাবে।”
শায়েরী মৌনর কথায় বাগড়া দিয়ে বলল, “হয়েছে হয়েছে এত বড় লিস্ট আর আমাকে শুনাতে হবে না। এসবের আধা জিনিস আমি বুঝি, আধা বুঝি না। আমাকে বরং এই মেয়েকে কীভাবে কি বুঝাবি সেকথা বল।”
“আপাতত ওকে ভয় দেখাব আবারও একই কাজ কন্টিনিউ করলে তার বাবাকে সব বলে দিব। আর বাদ দিলে কিছু বলব না। তবে আমার মনে হয়না খুব একটা কাজ হবে।”
“তো?”
“তো সবার আগে যে কাজটা করব তৈমুরকে ভালো করে জানতে হবে আমাদের। ওর পাত্তা পাত্তা সব খবর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কিংবা ওকে নিয়মিত নজরে রাখতে হবে।”
শায়েরী অবাক হয়ে বলল, “সে কি করে সম্ভব?”
“সায়াহ্ন ভাইয়াকে বললেই সহজে সম্ভব হতে পারত। কিন্তু, ভাইয়ার কাছে আমি এখন বেহায়ার মতন যেতে পারব না।”
শায়েরী জীজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তাহলে কি করবি আর?”
“নক্ষত্রকে ধরতে হবে।”
শায়েরী ফণা তোলা বিষধর সাপের মতন ফোঁস করে উঠে বলল, “অসম্ভব। আমি কোনোদিনও ওই মিচকা ইবলিশের কাছে যাব না।”
চলবে…
*আমার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাসের বই “সেদিন” এর প্রি- অর্ডার চলছে।