সুখপাখি পর্ব-৬

0
332

সুখপাখি

৬.
শিমুর চুলে কারো স্পর্শ পাওয়ায় চোখ খুলে দেখলো আবির বসে আছি। আবিরকে ভালো করে দেখে খুশিতে কেঁদে দেয়। কান্না করতে করতে কখন যেনো চোখ লেগে এসেছিলো শিমুর। আবিরের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে যায়। শিমু উত্তেজিত হয়ে বললো,
— “কি হয়েছে আপনার বলুন? আপনার বন্ধু এসে বললো আপনার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। ঠিক আছেন আপনি?”

আবির কিছু বলছে না। শিমুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। অদ্ভুত সেই হাসি। যেই হাসি দেখলে শিমুর ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়। শিমু আবিরকে ধরে বললো,
— “কথা বলছেন না কেনো? কথা বলুন প্লিজ।”

আবির দাঁড়িয়ে যায়। শিমুও দাঁড়িয়ে যায়। আবির হেসে হেসে বললো,
— “আমায় মাফ করে দিও শিমু। আমি তোমার সাথে যা অন্যায় করেছি সব মাফ করে দিও।”

— “এভাবে বলছেন কেনো? কি হয়েছে আপনার?”

আবির আর কিছু বলছে না। শিমুর দিকে তাকিয়ে সেই কিলার হাসি হাসছে। শিমুও চুপ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির হাসতে হাসতে পিছিয়ে যাচ্ছে। আবিরের পিছিয়ে যাওয়া দেখে শিমুর মুখটা মলিন হয়ে যায়। কান্নার বেগ বাড়ে। আবির অনেকটা দূরে চলে গেলে শিমু চিৎকার দিয়ে বললো,
— “আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।”

নিমিষেই আবির যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। শিমু চিৎকার দিয়ে উঠে বসে। সে দরজার পাশে বসে ছিলো। দরজার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে থেকে কান্না করতে করতেই ঘুমিয়ে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। না, স্বপ্ন দেখেছে। খুবই ভয়ানক ছিলো। সবার জন্য সাধারণ কিছু শিমু জন্য ভয়ানক ছিলো স্বপ্ন।

এরই মাধ্যে একজন মহিলা এসে উপস্থিত হলো শিমুর সামনে। শিমু উনার দিকে তাকিয়ে আছে। শিমুর চাচি, দাদি এবং তাথই এসেছে। আরো মানুষজন আসছে। হসপিটালের কয়েকজন নার্স এসেছে। শিমুর দাদি সৈয়দা খাতুন শিমুকে রুমে এনে কাপড় পালটে দেন। শিমু বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। নিচে চেচামেচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শিমুকে নিয়ে মহিলারা সবাই সিড়ির উপরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ড্রয়িং রুমে সবাই জায়গা খালি করছে। এরই মাঝে তখনের আসা সেই বন্ধুটি এসেছে। শাকিল এসেছে। আবিরের সব বন্ধু চলে এসেছে। ঘরের মধ্যে ভিড় হয়ে গেছে। শিমুর চোখ শুধু আবিরকে খুজচ্ছে।

——————————
— “শিমু।”

আবিরের ডাকে শিমু পেছন ফিরে তাকায়। আবির কাছে এসে শিমুর কপালের চুপ সরিয়ে দিয়ে বললো,
— “শিমু আমাকে একটাবার সুযোগ দিবে?”

— “কিসের সুযোগের কথা বলছেন?”

— “তোমাকে যত কষ্ট দিয়েছি সব মাফ করে আমাকে একবার সুযোগ দিবে?”

— “হ্যাঁ। আমিতো আপনাকেই চাই।”

— “তাহলে এই কথা আগে কেনো বললে না শিমু?”

— “আগে বলিনি কারণ…। ”

আবির আবার হাসছে। রহস্যময় হাসি। শিমুর কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে বললো,
— “খুব দেরি হয়ে গেছে শিমু।”

শিমু আতকে উঠে। চোখ বড়বড় করে আবিরের দিকে তাকায়। শারা শরীরে কাপন ধরে গেছে। কেমন যেনো এক রকম লাগছে। আবির বললো,
— “শিমু।”

শিমু মুখ তুলে তাকালো। আবির কি বলে সেই আশায়।

— “প্লিজ আমায় মাফ করে দিও। আমার পিচ্চি বউ।”

শিমুর হাত ছেড়ে দিয়ে আবির পিছিয়ে গেলো। শিমু এসে ধরতে গেলেই কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো আবির। শিমু আশেপাশে ভালো করে দেখছে আর চিৎকার দিয়ে বলছে,
— “আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। প্লিজ ফিরে আসুন। আপনার উপর কোনো ক্ষোভ নেই আমার। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আবির।”

শিমু ধড়ফড় করে উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ওর দাদি, চাচি বসে আছে। তাথই কেঁদেই চলেছে। আরো অনেক মহিলা আছে যাদের শিমু চিনে না। মহিলাদের ফিসফিসানি থেকে এতটুকু শুনেছে,
— “ইশ্ রে, খুব অল্প বয়সে কপাল পুড়েছে মেয়েটার।”

শিমু ভাবলো হয়তো অন্য কাউকে বলছে। তার দাদি এবং চাচিও শব্দ ছাড়াই কাঁদছে। শিমু তার দাদিকে জিজ্ঞেস করলো,
— “দাদি আমার কি হয়েছে?”

— “তুই জ্ঞান হারিয়েছিলি।”

— “ঘরে এতো মানুষ কেনো? আর উনি কোথায়? উনি এখনো এলেন না কেনো?”

শিনুর দাদি শিমুকে ধরে দাড় কথায়। গায়ে বড় একটা ওড়না পেচিয়ে দিয়ে নিচে নিয়ে যায়। এখানেও অনেক মানুষ। কান্নার আওয়াজ। শিমু চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কিছুই বুঝে আসছে না। শিমুকে তার দাদি থামিয়ে দিলে সে নিচের দিকে তাকায়। একজন ব্যাক্তিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। শিমু কাছে বসে মুখের উপর থেকে কাপড় সরাতেই আতকে উঠে। মুহূর্তেই তার দুনিয়া ঘুড়ে উঠে। আবারো লুটিয়ে পড়ে শুয়ে থাকা ব্যাক্তির বুকেই।

চারপাশে কোলাহল শুরু হয়। কেউ কেউ বলছে, “জ্ঞান হারিয়েছে”। কেউ বলছে, ” স্বামীর শোকে বউটাও চলে গেলো”। কেউ আহাজারি করে বলছে, “খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। এখনো তো বাচ্চা কাচ্চাও হয়নি”। আরেকজন বললো, ” আরে বিয়ে হয়েছে মাত্র এক মাসও হয়নি। বাচ্চা কিভাবে হবে?” এতো এতো মানুষের কথা শুনে শিমুর চাচি শিমুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। শিমুর দাদি চেচামেচি করে বললো,
— “কেউ পানি দাও। আমার নাতনির মুখে একটু পানির ছিটা দি।”

কিছুক্ষণ পর বড় মগে করে পানি এনে শিমুর দাদির হাতে দেয়া হলো। শিমুর দাদি হাতে পানি নিয়ে মুখে ছিটকা দিলেন। শিমুর জ্ঞান ফিরে এলো। সে তার দাদিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বললো,
— “দাদি আমি দেখেছি উনি এসেছিলো একটু আগে আমার কাছে। এখন কিভাবে উনি চলে গেলো? আমি একা কিভাবে থাকবো দাদি? উনি কেনো চলে গেছে?”

শিমুর দাদি কিছু বলতে পারলেন না। দাদি বেঁচে থাকতেই নাতনি বিধবা হলো সেটা মানতে তাঁরও কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। কিন্তু কি করবে? নিয়তির খেলা এটা। নিয়তির খেলা থেকে কেউই বাঁচতে পারবেন না। চাচি শিমুকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে গেলে। শিমু তার চাচিকে ধরেও কাঁদছে। শিমুর চাচি বললো,
— “সবাইকেই একদিন না একদিন আল্লাহর কাছে ফিরতে হবে। আজ হোক বা কাল। এটা যে আল্লাহর নির্দেশ। কেউ মালাকুল মউত থেকে বাঁচতে পারবে না। তুই আরেকবার দেখে নে আবিরকে। একটু পর ওকে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে।”

শেষের কথায় শিমু শক্ত হয়ে গেলো। কান্নার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু চোখের নোনাপানি থামছে না। শিমু আবিরের মাথার কাছে বসে আরেকবার ভালো করে দেখে নেয়। কি মায়া এই চেহারাতে। হাসলে যেনো চোখের মনি ঝিলিক মারতো। সেই মানুষটা আজ নিরলস ভাবে শুয়ে আছে জমিনে। একটু পর থেকে আর কোনোদিন দেখা হবে না তার সাথে। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে এতো ভালোলাগা শিমুর মনে কিভাবে জন্ম নিয়েছে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কিশোরী মনের ভালোলাগা এবং শিমুর জীবনের প্রথম পুরুষ তার স্বামী। যে কিনা এখন সাদা কাপড়ের ভেতরে নিজেকে মুড়য়ে শুয়ে আছে।

বয়স যতই কম হোক। কিশোরী মনের ভালোলাগা কি এতো সহজে ভুলা যায়? এতোই কি ঠুকনো সেই ভালোলাগা? জীবনে যতই সুদর্শন পুরুষ আসুক জীবনের প্রথম পুরুষকে কি ভুলা যায়? ভুলা যায় না। তবে ভুলে থাকতে হয়। কিন্তু যদি সে স্বামী হয় তাহলে কিভাবে সম্ভব ভুলে থাকা?

আবিরের মাথায় ব্যান্ডেজ করা। মাত্র একটা এক্সিডেন্ট আবিরের প্রাণ নিয়ে গেছে। শিমু একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। জীবনের শেষ দেখা এটা। আর কোনোদিন চাইলেও দেখা হবে না। চাইলেই আর ছোয়া যাবে না। শেষবারের মতো মন ভরে দেখে নিলো আবিরকে। একটু পর মসজিদে নামাজ শুরু হবে তাই লাশের খাটি এনে রাখা হয়েছে দরজার সামনে।

শিমুকে তার দাদি সরিয়ে নিয়ে গেলো। আবিরের বন্ধুরা এসে তাকে ধরে লাশের খাটিতে শুইয়ে দিলো। চারজন লাশের খাটি ধরে বের হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বাকিরা সবাই তাদের পেছনে আস্তে আস্তে করে বের হয়ে যাচ্ছে। শিমু শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

প্রাণ ভমরা চলে যাচ্ছে একেবারের জন্য। বাড়িটা শূন্য করে দিয়ে। জীবনটা রাঙিয়ে দিয়েছিলো আবার সে সাথেই করেই সব রঙ নিয়ে একেবারের জন্য চলে যাচ্ছে। আর কোনোদিন ফিরবে না। শিমুকে তার দাদি এবং চাচি দুইজন দুই পাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। শিমু পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।

বাকি মহিলারা শিমুকে এনে গোসল করিয়ে দেয়। সাদা কাপড় পড়িয়ে দিয়ে নামাজে দাড় করিয়ে দেয়। শিমু নামাজ শেষে জায়নামাজ এর বিছানায় বসে থাকে। কি করবে সে বুঝতে পারছে না। বারবার শুধু আবিরের শেষ হাসিটা চোখের সামনে ভাসছে। চারপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে আসছে। শিমুর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। বুকের উপর চেপে ধরে পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়ায়। এদিকে কেউ শিনুর দিকে খেয়াল করছে না। যে যার যার মতো করেই আছে। শিমু কোনোরকম এসে পানির গ্লাস হাতে নিতে গেলে দেখলো আবির তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। শিমু পানি না খেয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। শিমু বললো,
— “আপনি আমাকে ফেলে কেনো চলে গেলেন? দেখুন আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”

আবির মৃদু হাসছে। শিমু আবার বললো,
— “প্লিজ ফিরে আসুন। আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি। আমার কোনো অভিযোগ নেই আপনার প্রতি প্লিজ ফিরে আসুন।”

— “শিমু এটা আগে কেনো বললে না? সময় থাকতে কেনো বললে না?”

— “আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভাবতেও পারিনি আপনি আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন।”

আবির আর কিছু বললো না। শিমুর দিকে শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে ছিলো। শিমুর হেচকি উঠে। চোখ জলা শুরু হয়। চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। শিমু আবারো চোখ খুলে তাকায়। নেই। আবির নেই। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আবির নেই। কোথাও নেই। শিমু চিৎকার করে কেঁদে উঠে। বলল,
— “প্লিজ এতোবড় শাস্তি আমাকে দিয়েন না। আমার কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। আমি পারছি না শ্বাস নিতে।”

শিমুর মনে হলো কেউ তাকে ধাকাচ্ছে। কিন্তু কাউকে খুজে পাচ্ছে না। পরিচিত কণ্ঠে কেউ তাকে ডাকছে। শিমু! শিমু! বলে ডাকছে। শিমু ভালো করে খেয়াল করে দেখলো তার দাদি তাকে ডাকছে। শিমু দাদি দাদি বলে উঠতেই মুখের উপর পানির ছিটকা পরে।

সজ্ঞানে ফিরে আসে শিমু। তার বুক ভারি হয়ে আসছে। শিমুর দাদি বললো,
— “পানি খা বইন।”

শিমু ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নেয়। তার দাদিকে বললো,
— “দাদি উনি কি আমাকে সত্যি ছেড়ে চলে গেছেন? নাকি ফাজলামো করছে? দাদি বলোনা।”

শিমুর দাদি কান্না আটকে বললেন,
— “সে আর আসবে না কোনোদিন।”

কথা শেষ করার আগেই ঢুকরে কেঁদে উঠে। শিমু চিৎ হয়ে শুয়ে পরে মেঝেতে। আস্তে আস্তে মানুষজন কমতে থাকে বাড়িতে। শিমু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একসময় শুধু তারা চারজন থাকে এই বিশাল বাড়িতে।

রাত তিনটা, শিমু এখনো শুয়ে আছে মেঝেতে। মনে মনে একটা কথা বাজতে লাগলো, “সে আর ফিরবে না। কোনোদিনই ফিরবে না।”

চলবে,,,
® নাহার।

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here