#মৃত_কাঠগোলাপ – ২৯

0
474

#মৃত_কাঠগোলাপ – ২৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
________________________________
থাপ্পড়ের বিকট শব্দে অলস বিকেল তটস্থ হল। অদূরের কৃষ্ণচূড়া গাছে বসে থাকা একটি শালিক পাখি ভয়ে ডানা ঝাপটে পালিয়ে গেল। আয়েশী তখন রাগে থরথর করে কাঁপছে। ইচ্ছে করছে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেয়াদব মেয়েটাকে ছুড়ি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলতে। রাগে আয়েশীর চোখ জ্বলছে। কান দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বের হচ্ছে। আয়েশী রেগে বলে,
‘ মৃদুলকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে, তোমার জিহ্বা আমি টে’নে ছিঁ’ড়ে ফেলব। ‘
মেয়েটা কান্না করতে থাকে। গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। হেঁচকি উঠে বেহাল অবস্থা। নাকের পানি, চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। তবুও আয়েশীর মেয়েটার প্রতি একবিন্দুও মায়া হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে, মেয়েটার সারা গা পিটিয়ে চা’মড়া তুলে ফেলতে। কতবড় সা’হস। যে মানুষটা আয়েশীকে ভালোবেসে মারা গেছে, তাকে নিয়ে এতবড় মিথ্যা অ’পবাদ। রা’গে, অপমানে আয়েশীর চোখে জল ভরে। মৃদুল তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আয়েশী কত ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছে। কিন্তু এবারের বিষয় সকল ঝড়কে ছাড়িয়ে গেছে। আর কত? হাঁপিয়ে উঠেছে আয়েশী। আর ভালো লাগছে না। এর শেষ কোথায়?

মেয়েটা কেঁদে অস্থির হয়ে বলল, ‘ আমি সত্যি বলছি। আপনি চাইলে মৃদুল ও আমার বিয়ের ছবি দেখতে পারেন। বিয়ের পরও আমি বাবার বাসায় থাকতাম। মৃদুল মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে হোটেলে থাকত। সেটুকু সময় শুধু আমি ওকে উপভোগ করতে পারতাম। আমি অনেকবার বলেছি, তার বাসায় আমাকে নিয়ে যেতে। মৃদুলের বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করাতে। কিন্তু সে বলেছে, বাবা মা আমায় দেখলে অনেক রাগ করবেন। তার পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করলে, তারপর আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবে। একদিন আমি গর্ভবতী হলাম। মৃদুল এত খা’রাপ লোক ছিল যে, আমার সদ্য অনুভব করা মাতৃত্বকে নিমিষেই চূ’র্ণ’বি’চূর্ণ করে ফেলে। মৃদুল বাধ্য করে, আমাকে এবোরশন করতে। তার নাকি ক্যারিয়ার সবে শুরু। সে এখন বাচ্চা পালতে পারবে না। আমিও ছিলাম তখন মৃদুলের হাতের পুতুল। ভালোবাসায় অন্ধ হয়েছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম সব কষ্ট। কিন্তু তখনও জানতাম না, আমার বাচ্চা নষ্ট করার পেছনে ছিলেন আপনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন পাড়ার লোকের কাছে শুনি মৃদুল নাকি আরেকটা বিয়ে করছে। বিশ্বাস করুন আপা, আমার মাথায় আস্ত এক আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি বিশ্বাস করতে চাইনি। করব কিভাবে? মৃদুল আমাকে এই দু বছরে এত ভালোবাসা দিয়েছে যে আমার কাছে এই দু বছর মনে হয়েছিল আমি স্বর্গে আছি। স্বর্গের সুখ মৃদুল আমার পায়ে ফেলেছিল। মৃদুল এমনই। সে যখন যাকে ভালোবাসে, তাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। মৃদুলের ভালোবাসা পেয়ে আপনার একসময় মনে হবে, তার চেয়ে শুদ্ধ প্রেমিক এই পৃথিবীতে বোধহয় দুটো নেই। অথচ যখন তার আপনার উপর থেকে মন উঠে যাবে, সে আপনার ভুলে যাবে। ভুলে যাবে, তাকে নিয়ে সাজানো আপনার সমগ্র দুনিয়া!
এমন নয় যে, আমি মৃদুলকে বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করিনি।বিয়ের কথা আমি মৃদুলকে জিজ্ঞেস করি, সে বলে পুরুষদের চারটে নিয়ে জায়েজ আছে। আমি এই নিয়ে তর্ক করলে সে আমায় ডি’ভোর্স দিবে। আপা, আমি কি করতাম তখন? স্বামীকে ছেড়ে দিতে পারিনি। মেনে নিয়েছে। তারপর….আমার ঘরে সতীন আসেনি। বরং প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষটা লাশ হয়ে ফিরেছে। ওরা আমায় তাকে শেষ দেখা দেখতে দেয়নি, আপা। আমি ওকে শেষবার ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। একটাবার ছুঁয়ে বলতে পারিনি, ‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি। দয়া করে আর ঠকাবেন না আমায়। একবার ফিরে আসুন।’
আমি পারিনি, আপা। ওরা আমার হাত, পা, মুখ বেঁধে রেখেছিল। আমি শুধু আপনাকে খুঁজছিলাম। আপনিই আমাকে এই মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবেন। আপা, আমি আপনার পায়ে পড়ি। তার কবরটা আমায় একবার দেখতে দিন। আমার তার কবরে একটাবার মাথা ঠুকতে চাই। দোহায় লাগে আপনার। ‘

মৃদুলকে নিয়ে এতসব জঘন্য কথা শুনে আয়েশীর মস্তিষ্ক স্তব্ধ হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রয় মেয়েটার দিকে। চোখ ছলছল করছে। ব্যথায় মাথা ফেঁ’টে চৌচির!
আয়েশীর আর সহ্য হয়না। মেয়েটার কথা কানের ভেতর তবলা বাজাতে থাকে। অস্থির হয়ে উঠে আয়েশী। দুহাতে কান চেপে ধরে বলে, ‘ চুপ করো তুমি। আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার মৃদুল এত খা’রাপ হতে পারেনা। আমি চিনি তাকে। সে এমন হতেই পারেনা। আমি তাকে বিশ্বাস করি। সে আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে পারেনা। কিছুতেই না। ‘

মেয়েটা নিজেও কাঁদে। হাউমাউ করে। কষ্ট জল হয়ে বেরুচ্ছে এ দুজন নারীর। উভয়েই ভালোবাসার কাঙাল। তারা একজীবনে কিছু চায়নি, শুধু ভালোবাসা ছাড়া। অথচ বিধাতার কি নিষ্ঠুর খেল। ভালোবাসা চেয়েও ভালোবাসা পাওয়া হলো না তাদের। মেয়েটা একে একে প্রমাণস্বরূপ আয়েশীকে তাদের নিয়ে সার্টিফিকেট দেখাল। মৃদুলের হাতের স্বাক্ষর নিমিষেই চিনে ফেলল আয়েশী। গাইনোকলোজিস্ট এর প্রেসক্রিপশন, স্বামীর নামের জায়গায় মৃদুলের নাম। এবোরশন রিপোর্ট, মৃদুল এবং মেয়েটার একসঙ্গে হাস্যোজ্বল ছবি।
সব দেখে আয়েশীর মাথা লাটিমের ন্যায় ঘুরতে লাগল। আয়েশীর ডান হাতে পাশে থাকা আম গাছকে আকড়ে ধরল। মাথা ঘুরছে তার। উজ্জ্বল চেহারা রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। অতঃপর, আয়েশী ধপ করে বসে পড়ল ময়লা ঘাসের উপর। কাপড় নোংরা হচ্ছে, আয়েশীর সেসবে লক্ষ্য নেই। আপাতত তার মনে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, তার মৃদুল তার কখনোই ছিল না। সে গোপনে অন্য কারো! আয়েশী শুধুমাত্র তৃতীয় ব্যক্তি ছিল। মৃদুল এতটা জঘন্য কাজ করতে পারে, আয়েশীর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মৃদুল এতটা নিচে কি করে নেমে গেল? একটা নিষ্পাপ বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মেরে ফেলল! ছিঃ!

অথচ, আফসোস আয়েশী এখনো মৃদুলকে ঘৃনা করতে পারছে না। এখনো ভালোবেসে যাচ্ছে মৃদুলকে। কিন্তু আয়েশী ঘৃনা করতে চায় মৃদুলকে। অথচ…পারছে না। ভীষন ভীষন ভালোবাসে যে মৃদুলকে। আয়েশী চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা তখন কেঁদে যাচ্ছে। একটা নিষ্পাপ নারীর মুখ থেকে হাসি কেড়ে গেছে মৃদুলের জন্য। আয়েশীও তাতে সমান দোষী। সে মৃদুলের জীবনে না এলে,মেয়েটা সুখী হত। অথচ আয়েশী নিজের অজান্তে মেয়েটার জীবন থেকে সকল সুখ কেড়ে নিয়েছে। মেয়েটার জীবনের অহংকার কেড়ে নিল। নিজের প্রতি ঘৃনা অনুভব হচ্ছে আয়েশীর। আজকের পর থেকে আয়েশী বোধহয় আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পারবে না। আজকের পর আয়েশী আর নিজের চোখে চোখ মেলাতে পারবে না। কেন এমন হচ্ছে? এই ক মাসের মাথায় সব কেন উল্টে পাল্টে যাচ্ছে? এসব কিছুর মূল হোতা কি?

আয়েশী কোনরকম অস্ফুট সুরে মেয়েটাকে মৃদুলের কবরের ঠিকানা বলে দিল। মেয়েটা কিছুক্ষণ আয়েশীর দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। তারপর আয়েশীর পাশে হাঁটু গেরে বসে আয়েশীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ আমিও ভালোবেসেছি, আপনিও ভালোবেসেছেন। আমাদের দুজনের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। কিন্তু আমরা ঠকেছি। এই ধরায় ভালো মানুষেরাই প্রতি পদে পদে ঠকে। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে, খা’রাপ হতে হবে। প্রচুর খা’রাপ। আমিও খা’রাপ হয়েছি। এবার আপনার পালা। ‘

মেয়েটা চলে যাচ্ছে। আয়েশী ছলছল চোখে মেয়েটার পথের পানে চেয়ে। মেয়েটা তার অভিযোগ শুনিয়ে চলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আয়েশীর মনের মধ্যে যে কষ্টের সূচ ফুটিয়ে গেছে, তা সে বুঝতেই পারল না। আয়েশী কি যে মরণ যন্ত্রণায় ভুগছে, সে তা জানলো না। আয়েশী আর টিকে থাকতে পারল না। আয়েশী চিৎকার করে কেঁদে উঠল। দুহাতে চুল খামচে ধরে চুল ছিঁড়ে ফেলল। সার্ভেন্ট আয়েশীকে সামলানোর চেষ্টা করল, সফল হলো না। আয়েশী গলা ফেঁটে যাচ্ছে, কান্না করতে করতে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এমন কেন হল? আয়েশী এখন কেমন করে বাঁচবে? আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।তার এত সুন্দর জীবনকে মৃদুল কেন এভাবে নষ্ট করে দিল। কি দোষ ছিল তার? মৃদুলকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসাটা দোষের ছিল। অত্যাধিক কষ্টে, চিন্তায়, আতঙ্কে আয়েশী মৃদুলের নাম দুবার জপ করে সেখানেই জ্ঞ্যান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
সার্ভেন্টসহ সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আয়েশীকে ধরাধরি করে তার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। ধ্রুবকে জানানো হল। সাধারণত এখন ধ্রুবর এখন সার্ভেন্টদের বকাঝকা করার কথা। কিন্তু সে শান্ত সুরে বলল, ‘ আমি আসছি। ‘
সবাই অবাক, বিস্মিত, হতভম্ব। এমন শান্ত ধ্রুবকে তারা কখনোই দেখে নি। এ যেন এক নতুন ধ্রুবর সত্তা।

#চলবে( শব্দসংখ্যা- ১১০০+ )
গল্প পড়ে চুপচাপ চলে যাবেন না। যারা গল্পটা পড়বেন কষ্ট করে রেস্পপন্স করবেন প্লিজ। পেইজের রিচ অনেক কমে গেছে।
সেরা কমেন্টকারীদের নাম তাদের কমেন্টসহ লেখিকার গ্রুপে পোস্ট করা হবে।

লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here