#মৃত_কাঠগোলাপ -৩৪
লেখনীতে- #আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________________
প্যারিসে সেদিন ভীষন ঠান্ডা! গা জমে বরফ হয়ে যাওয়ার মত কনকনে শীতে আয়েশীর অবস্থা করুন! আয়েশী দুহাতে কাঁধের অংশ ঢেকে শীতে কাঁপতে লাগল। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে ‘ ঠকঠক’ শব্দে আয়েশী নিজে প্রচন্ড বিরক্ত! ধ্রুব পাসপোর্টের ঝামেলা মেটাচ্ছে। আয়েশীকে কাঁপতে দেখে ধ্রুব ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে আয়েশীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এত পাতলা সুয়েটার এনেছ কেন? বলেছিলাম না, এখানে ঠান্ডা বেশি। ‘
শীতে আয়েশীর গলা জমে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। অন্যথায় আয়েশী ধ্রুবকে কতক কটু কথা শুনিয়ে নিত। আয়েশীর রাগ হল। ধ্রুবর জ্যাকেট ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ল-লা-গ-গবে না। ‘
ধ্রুব কিছু বলল না। চুপচাপ জ্যাকেট আবার গায়ে দিয়ে পাসপোর্ট দেখতে লাগল। আয়েশী মুখ বাঁকাল। জ্যাকেট দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিল। খা’রাপ লোক!
ধ্রুব পাসপোর্টের ঝামেলা মিটিয়ে আয়েশীর কাঁধ ধরে হাঁটতে লাগল। এখন হোটেলে উঠবে তারা। ধ্রুবর স্পর্শে আয়েশীর ভীষন অস্বস্তি হল। হাসফাঁস করে উঠল সর্বাঙ্গ! ধ্রুব জানে, আয়েশীর ধ্রুবর এমন স্পর্শ পছন্দ নয়। তবুও সে ক্ষণে ক্ষণে আয়েশীকে নানাভাবে স্পর্শ করবে। কবে শুধরাবে এই খা’রাপ লোক? আয়েশী কাঁধ সংকোচিত করে নিভু কণ্ঠে বলল, ‘ ছাড়ুন। ‘
ধ্রুব যেন শুনেও শুনল না। ওসমানকে লাগেজ আনতে বলে সামনে এগিয়ে গেল। ওসমান পিছু পিছু হেটে আয়েশী ও ধ্রুবর কাণ্ড দেখছে। আয়েশীর ছটফট করা, ধ্রুবর শীতল কণ্ঠের রাগ, চোখ রাঙানি দেখে ওসমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, ‘ এত ভালো মেয়েটা শেষে কিনা এই হিংস্র মানুষের জালে ফেঁসে গেল। হায়রে নিয়তি! ‘
‘ হ্যালো ইয়াং ম্যান! ‘
ধ্রুবকে দেখে একজন ফরাসি লোক দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আচমকা আক্রমণে ধ্রুব কিছুটা হতভম্ব হল। লোকটা ধ্রুবকে ছেড়ে দিয়ে ফরাসি ভাষায় কিছু একটা বলল। ধ্রুব এবার একটু হাসল। হয়ত চিনতে পেরেছে ফরাসি লোককে। ধ্রুব ফরাসি ভাষায় লোকটার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। আয়েশী ফ্যালফ্যাল চোখে তাদের দুজনের কথা শুনে গেল। তাদের কথোপকথনের কিছুই আয়েশীর বোধগম্য হল না। ধ্রুব একসময় আয়েশীর কাঁধে হাত রেখে ফরাসি লোককে কিছু বলল। আয়েশী বুঝতে পারল, ধ্রুব লোককে আয়েশীর সাথে পরিচয় করাচ্ছে। আয়েশী মৃদু হেসে ‘ হ্যালো’ বলল। ফরাসি লোক আয়েশীর সাথে বকবক করে কিছুক্ষণ ফরাসি ভাষায় কথা বলল। আয়েশীর কান ভনভন করতে লাগল ফরাসি ভাষা শুনে। লোকটার বলা একটা কথাও আয়েশী বুঝতে পারল না। শুধু বোকার মত চেয়ে রইল। ধ্রুব সেটা বুঝতে পারল। লোকটার কাঁধে হাত রেখে শুধরে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ ম্যান, শি ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ। ‘
লোকটার মুখ চুপসে গেল। এতক্ষণ তাহলে সে অযথাই বকবক করে গেল। কতগুল কথা জলে ভেসে গেল। লোকটার বোধহয় আফসোস হল একটু। লোকটা আয়েশীকে ক্ষীণ কণ্ঠে সরি বলে ধ্রুবর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল। লোকটা চলে গেলে ধ্রুব ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘ কোথা থেকে আসে এসব পাগল! রাবিশ! ‘
আয়েশী অবাক হল। লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল ধ্রুবকে একটুও বিরক্ত দেখাচ্ছিল না, অথচ এখন বলছে সে বিরক্ত হয়েছে। ধ্রুব কিন্তু দারুণ অভিনয় করতে পারে!
আয়েশী প্রশ্ন করল,
‘ আপনি ফ্রেঞ্চ জানেন? ‘
ধ্রুব গাড়িতে উঠে আয়েশীর পাশে বসল। চোখের সানগ্লাস খুলে শার্টে ঝুলিয়ে বলল,’ হ্যাঁ। ‘
‘ আপনি মোট কয়টা ভাষা জানেন? ‘
ধ্রুব ভ্রুতে ভাজ ফেলে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল,
‘ আনুমানিক পঁচিশটা। ‘
আয়েশী ভীষন বিস্মিত হল। এতটা ভাষা জানে সে? সে মানুষ নাকি রোবট? আয়েশী বাংলা, ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানে না। আর সে পঁচিশটা ভাষা কি সুন্দর বুঝে। আয়েশী নিজের কোমড়ে শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল খানিক। চকিতে নিজের কোমড়ের দিকে চেয়ে দেখল। ধ্রুব আয়েশীর কোমড়ে হাত রেখে এক হাতে ফোন দেখছে। আয়েশী হাফ ছাড়ল। এমনিতে শীতে মরে যাচ্ছে, তারমধ্যে ধ্রুবর ঠান্ডা হাত আয়েশীর সারা গায়ে যেন জ্বর তুলে দিচ্ছে। আয়েশী জোরপূর্বক ধ্রুবর হাত নিজের কোমড় থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। এবার দু হাত ব্যবহার করল। তবুও পারল না। আয়েশী রাগ হল। হাত না দানব! এত জোর তার হাতে? নিজের কাজে বিঘ্ন ঘটায় ধ্রুব বিরক্ত নিয়ে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ কি হয়েছে? এত নড়ছ কেন? ‘
আয়েশী তেতো কণ্ঠে বলল, ‘ হাত সরান। আমার শীত লাগছে। ‘
ধ্রুবর ঠোঁট হেসে উঠল। বাঁকা হাসিতে মুহূর্তেই ধ্রুবর সম্পূর্ণ মুখে ছড়িয়ে গেল। আয়েশী জানে, এ হাসি কেমন? একদম দুষ্টু, খারাপ হাসি। আয়েশী ভ্রু কুঁচকে চাইল ধ্রুবর দিকে। এখন নিশ্চয়ই ধ্রুব কয়েকটা বেফাঁস কথা বলে আয়েশীর কান জ্বালা করে দিবে। আয়েশী অস্বস্থিতে ভুগতে দেখে তার ভালো লাগে কি না!
ধ্রুব তাই করল। ধ্রুব আয়েশীর কানের কাছে ঠোঁট এনে মৃদু স্বরে বলল, ‘ ডোন্ট ওয়ারি! আমি আছি না? ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একদম গরম করে দেব। ‘
আয়েশী থতমত খেয়ে গেল। পেটের ভেতর গুড়ুম গুড়ুম করে উঠল। কান থেকে আগুন বের হওয়ার মত বোধ হল। হাঁসফাঁস করে ধ্রুবর দিকে রাগী নয়নে চাইল। অতঃপর ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে নিল। ধ্রুব হাসছে। আয়েশী রেগে বলল, ‘ মুখ সামলে কথা বলুন। ‘
ধ্রুব হেসে আয়েশীর নিজের দিকে টেনে নিল। আয়েশী ছুটার জন্যে ছটফট করে। ধ্রুব বলে, ‘ অনেক সামলে থেকেছি। আর না! প্রেমের শহরে এসেছি আমরা। তাই সামলে থাকার দিন শেষ। এখন যা হবে, সব নির্লজ্জ, বেসামাল! রক্তজবা, এবার থেকে তো তোমাকে আমি লজ্জা দিয়েই মেরে ফেলব! হা হা হা! ‘
আয়েশী হতভম্ব হয়ে পড়ল। ছিঃ, কথার কি ছিরি! মৃদুল আয়েশীর প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও এত অসভ্য কথা বলত না। কিন্তু এই ধ্রুব? অসভ্যতার সকল সীমা পেরিয়ে গেছে। আয়েশী রাগে ধ্রুবর গলায় নখ দিয়ে খামচে ধরল। ধ্রুব ব্যথা পেল। অথচ মুখে কোনোরূপ আর্তনাদ করল না। বরং বলল, ‘ তোমার ছোঁয়া আমাকে উন্মাদ করে দেয়, রক্তজবা! হোক না সেটা কোনো ব্যাথাতুর আঘাত! ‘
আয়েশী হার মানল। ধ্রুবকে পরাস্ত করা আয়েশীর কাছে অসম্ভব ঠেকেছে। ধ্রুব সকলকে যেমন ব্যথায় ঝাঁজরা করে ফেলতে পারে, তেমন নিজেও সহস্র ধারালো ব্যথা মুখ বুজে সহ্য করতে পারে। আয়েশী অবাক হয়। এমন লোকও হয় বুঝি?
অতঃপর সম্পূর্ণ পথ ধ্রুব আয়েশীকে তার নির্লজ্জ্ব কথা দ্বারা জ্বালিয়ে গেল। হোটেলের সামনে যখন গাড়ি থামল, আয়েশী ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে হাফ ছাড়ল। তার কান এখনও ধপধপ করছে। গাল লাল হয়ে গেছে। মাথা ভনভন করছে। ধ্রুব আয়েশীর এহেন করুন অবস্থা দেখে মৃদু হাসল। তার লজ্জাবতী লতিকা!
হোটেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কক্ষ ধ্রুব নিজেদের জন্য বুক করল। আয়েশী-ধ্রুব ক্লান্ত পায়ে কক্ষে প্রবেশ করল। কক্ষটা পর্যবেক্ষণ করে আয়েশীর চোখ কপালে উঠল। কক্ষটা হানিমুনে আসা কাপলদের জন্যে সাজানো হয়েছে। বিছানা ভালোবাসার আকারের, চারদিকে গোলাপের পাঁপড়ি ছড়ানো, মোমবাতির আলো জ্বলজ্বল করে চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে। আয়েশী এসব সাজ দেখে রেগেমেগে আগুন হল। ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল, ‘ এসব কি কক্ষ নিয়েছেন? ‘
ধ্রুব হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখল। হিটারের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিল। জ্যাকেট খুলে বলল, ‘হানিমুনের! ‘
‘ হানিমুন? আমরা কি হানিমুনে এসেছি? ‘
‘ হ্যাঁ! ‘
‘ মানে? দেখুন আমার এসব সাজ অসহ্য লাগছে। শীঘ্রই কক্ষ বদলান। নাহলে আমি এই কক্ষে থাকব না। ‘
‘ থেকো না। বেরিয়ে যেতে চাইলে বেরিয়ে যাও। ‘
আয়েশী হতভম্ব হল। ধ্রুব তাকে বেরিয়ে যেতে বলেছে? হ্যাঁ, বলবেই তো। হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লা’থি মারে। আয়েশী এই শহরের কিছু চেনে না, আয়েশী বেরিয়ে যেতে চাইলে বেরিয়ে যেতে পারবে না। হারিয়ে যাবে এই বিশাল শহরের ভিড়ে! ধ্রুব এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। আয়েশী পা দিয়ে মাটিতে লা’থি দিল। তারপর হনহনিয়ে বাথরুমে চলে গেল। ধ্রুব পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসল। আয়েশীকে রাগতে দেখে ধ্রুবর ভীষন ভালো লাগে। আয়েশী রাগলে, মুখ রক্তিম হয়ে যায়। নাকের ডগা কাঁপে। ধ্রুবর তখন ইচ্ছে হয়, আয়েশীর নাক কামড়ে লাল করে দিতে। আয়েশীর ঠোঁট স্পর্শ করতে। আফসোস, ধ্রুব এখন তার শেষ অদম্য ইচ্ছা পূরণ করতে পারছে না। তবে পারবে। একদিন পারবে! ধ্রুব সেদিন আয়েশীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিবে। আয়েশীর সাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটাবে। সেদিন হবে ধ্রুবর জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন! সে দিন আসবে! খুব শীগ্রই আসবে!
#চলবে ( শব্দসংখ্যা – ১১০০+ )
প্রায় ১৪০০ মানুষ গল্প পড়েন, অথচ রিয়েক্ট করতে চান না। যারা গল্পটা পড়বেন কষ্ট করে রিয়েক্ট, কমেন্ট করবেন প্লিজ।
গত পর্বের কমেন্ট বিজয়ী,
@najeat anjum jasy
@farhana tabassum
@miftahul mun
@ojanti nushi mumu
বাকিদের নাম গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছে।
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri