#মৃত_কাঠগোলাপ – ৪২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
___________________________
কদিন ধরে আয়েশীর মন খারাপ! আকাশ বাতাস মিথ্যা করার মত তীব্র এক মন খারাপ ঝেঁকে বসেছে তার ছোট্ট হৃদয়ে। সেই মন খারাপের রেশ ধরে মনের ভেতর গুমড়ে কেঁদে কেঁদে উঠছে। নিজেকে ধ্রুবর এই বিশাল বাড়িতে ভীষন একা একা লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। একলা মনে বিবশ হয়ে চেয়ে রয় জানালার দিকে। জানলার ওপারে পিচঢালা সড়ক। সড়কের উপর হেঁটে যাচ্ছে শত পথিক। ব্যস্ত গাড়ির চাকা। সবাই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মন খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। অথচ আয়েশী পারছে না। আয়েশীর যে সে সাহস নেই। ধ্রুব আয়েশীকে একপ্রকার বন্দী করে রেখেছে এই বিশাল বাড়িটিতে। ধ্রুবর বাড়ি কেউ বাইরে থেকে দেখে অবশ্যই বলবে, বাড়িটির ভেতরে থাকা মনুষ্যরা কি ভীষন সুখী। অথচ আয়েশী জানে, এই চার দেয়ালের মধ্যে আটকে থেকে আয়েশী ক্লান্ত। শিকলে আটকে থাকা চড়ুইপাখির ন্যায় ছটফট করে আয়েশী। দিনশেষে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। অথচ কাঁদাও যে তার নিষেধ। আয়েশী চাইলেও চোখের জল ফেলতে পারে না। চাইলেও ঘর ছেড়ে দু পা ফেলে দেখতে পারে না, পৃথিবীর সৌন্দর্য্য, বসন্তের রঙ, বর্ষার থইথই জল, গ্রীষ্মের দাবানল। আয়েশী পারে না, কিছুই পারে না। কারণ ধ্রুবর কথা অমান্য করে আপন মর্জি মত চললে ধ্রুব নিজেকে আ’ঘাত করে বসে। র’ক্তাক্ত করে নিজের দেহ। আয়েশী তখন কষ্টে শেষ হয়ে যায়। বুকের ভেতর র’ক্তক্ষরণ হয়। ধ্রুবকে ভালো রাখতে আয়েশী নিজের সমস্ত শখ আহ্লাদ নদীর অতলে ভাসিয়ে দিয়েছে। আয়েশী ভুলে গেছে, নিজের মধ্যে থাকা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তাকে!
মন খারাপকে পুঁজি করে আয়েশী বাগানে এসে দাঁড়ায়। কাঁধের শাল দুহাতে গায়ের সাথে চেপে ধরে দূরে চোখ রাখে। অদূরের একটা খাঁচা রাখা। খাঁচার ভেতর দুটো বাঘ আরামে শুয়ে আছে। বৈকালিক ঘুম বোধহয়! আয়েশী ধ্রুবর বাড়ি আসার পর থেকে এই বাঘদের দেখে এসেছে। ধ্রুব অবসর সময় এই বাঘদের সাথে কাটায়। সাধারণ মানুষ যেমন বিড়াল, কুকুর পুষে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। ঠিক তেমন ধ্রুব এই বাঘদের নিজের সন্তানের মত আদর করে। ধ্রুবর মধ্যে আদৌ কি কোনো ভয়-ডর আছে? না, নেই। তাই দুটো বন্য বাঘকে পুষছে। ধ্রুব অনেকবার চেয়েছে, আয়েশীও ধ্রুবর মত তার পোষা বাঘদের আদর করুক। আয়েশী করে নি। বাঘদের দেখলে আয়েশী ভ’য়ে চেঁচিয়ে উঠে। আয়েশীর পশম কেঁপে উঠে। মনে হয় বাঘেরা আয়েশী আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আয়েশীর ভয় নিয়ে ধ্রুবর সে কি টিটকারী! সারাক্ষণ আয়েশীকে এ নিয়ে ক্ষেপায়। ধ্রুবও না? আস্ত এক খারাপ লোক। অকারণে আয়েশীকে শুধু ক্ষেপায়।
আয়েশী চোখ সরায়। বাগানে নতুন কালো গোলাপ ফুটেছে। বাগানের একপাশ কালো রঙের গোলাপে কি সুন্দর করে সেজে উঠেছে। সম্পূর্ন বাগান গোলাপের ঘ্রাণে ম-ম করছে। আয়েশী একটা ফুল হাতে ধরে নাক দিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে। ইশ, কি আদুরে ঘ্রাণ! নাকের মধ্যে প্রবেশ করে মস্তিষ্ক অব্দি শীতল করে দিচ্ছে। আয়েশী চোখ বুজে ফেলে। ফুলের পবিত্র সুঘ্রাণে আয়েশীর সমস্ত মন খারাপ হু হু করে পালিয়েছে।
‘ কি করছ এখানে? ‘
ধ্রুব এসে আয়েশীর পাশে দাঁড়ায়। আয়েশী হাতে ধরা ফুলটির দিকে ধ্রুবকে ইশারা করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,
‘দেখো ধ্রুব, গোলাপ ফুলটা কত সুন্দর!ঘ্রাণ শুঁকে দেখো। ভীষন সুন্দর। ‘
আয়েশী ফুলের কাছে ঝুঁকে এল। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ শুষে নিল নিজের ভেতর। সঙ্গেসঙ্গে শরীর যেন কাঁপুনি দিয়ে উঠলো তার। মনে হলো, একঝাঁক ঠান্ডা বাতাস তার গলার কাছে সুরসুরি দিয়ে গেল। আয়েশী উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ আমায় এই ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজে দেবে , ধ্রুব? ‘
ধ্রুব এতক্ষণ আয়েশীর কারণে রাগে অঙ্গার হচ্ছিল। একটা সামান্য গোলাপ ফুলের প্রতি আয়েশীর এত মুগ্ধতা ধ্রুবের সহ্য হচ্ছে না। আয়েশীর চোখে শুধুমাত্র একজনই মুগ্ধ হয়ে রবে! সে হলো, ধ্রুব স্বয়ং! অন্যকিছু আয়েশীকে মুগ্ধ কেন করবে? ধ্রুব সবকিছু ভে’ঙে গু’ড়িয়ে দেবে তবে!
‘ কথা বলছ না কেন, ধ্রুব? দেবে কালো গোলাপ নিজ হাতে কানে গুঁজে?’
ধ্রুব এবার হাসার ভান করল। আয়েশীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থুতনি রাখলো তার ঘাড়ের ভাঁজে। ঠোঁট উল্টে বললো,
‘ ক্ষুধা লেগেছে খুব। খাবার কি পাওয়া যাবে আজ, রক্তজবা?’
ধ্রুবের কথায় আয়েশী সব ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ধ্রুবকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
‘ আমি তো ভুলেই গেছি দুপুরের খাবারের কথা। তুমি পাঁচ মিনিট বস, আমি টেবিলে খাবার বাড়ছি। ‘
আয়েশী চলে গেল। ধ্রুব এবার আগুন চোখে গোলাপ ফুলের দিকে তাকাল। আয়েশীর ছুঁয়ে দেওয়া গোলাপ ফুল একটানে ছিঁ’ড়ে ফেলল গাছ থেকে। অতঃপর সেই সুন্দর গোলাপ ফুলটা অত্যন্ত হিং’স্র ভাবে পায়ের তলায় জুতো দ্বারা পি’ষে ফেলল। গোলাপ ফুলের বোধহয় অনেক কষ্ট হলো! মন ভাঙার ন্যায়, ক্যাক ক্যাক আওয়াজ হল যেন। অভিশাপ দিল কি, ধ্রুব নামক এই পা’ষন্ডকে? কেমন নি’ষ্ঠুর ভাবে পবিত্র এক ফুলকে খু’ন করে ফেলল! হায়, ধ্রুবর হৃদয় যে পাথরের তৈরি!
‘ ধ্রুব, আমি আজ বাবার বাসায় যাব। ওদের খুব মনে পড়ছে। ‘
ধ্রুব খাবার খাওয়ার ফাঁকে চোখ তুলে আয়েশীর দিকে তাকাল। আয়েশী একবুক আশা নিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে। বাবার বাসায় যেতে নিশ্চয়ই ধ্রুব আপত্তি করবে না। ধ্রুব নিশ্চয়ই অতটা নি’ষ্ঠুর হবে না! ধ্রুব মাথা নত করে খাবার খেতে শুরু করে। আয়েশীর সমস্ত আশ্বাসকে দু’মড়ে মু’চড়ে দিয়ে বলে, ‘ প্রয়োজন নেই। বেশি দেখতে ইচ্ছে হলে, ওদের এখানে আসতে বল। ‘
আয়েশী কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়। বলে, ‘ এটা কেমন কথা, ধ্রুব। ওরা কেন এখানে আসবে? বাবা কখনো এ বাড়ি আসতে রাজি হবেন না। ‘
‘ তাহলে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে বসে থাকো। ‘
আয়েশী এবার জেদের সুরে বলে, ‘ আমি যেতে চাইছি। ‘
ধ্রুব কঠিন চোখে আয়েশীর পানে চোখ রাখে। রাগ প্রকাশ করে বলে, ‘ আমি মানা করেছি। ‘
আয়েশী একটু থেমে বলে,’ তুমি কি আমাকে বন্দী করতে চাইছ? ‘
ধ্রুব মিহি হেসে মাথা নিচু করে খেতে খেতে বলে, ‘ খানিকটা তাই। ‘
আয়েশী থমকে যায়। চারপাশে যেন ভূ’মিকম্প অনুভব করে। মাথার উপর আস্ত এক পাহাড় ধ্ব’সে পড়ে। ধ্রুব কি তবে….আয়েশী বলে, ‘ কেন? ‘
ধ্রুবর স্পষ্ট উত্তর,
‘ কারণ তোমার সম্পূর্ন দুনিয়া জুড়ে শুধু আমার বসবাস হবে। তোমার দিবস শুরু হবে আমায় ঘিরে, রাতের অন্ধকার কাটবে আমার বুকের উষ্ণ ছোঁয়ার স্পর্শে! তোমার সবটা হবে আমিময়! আমায় ভালো রাখতে যদি তোমার প্রিয়জন বি’সর্জন দিতে হয়, তবে তাই করবে। ‘
ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। আয়েশী শুধু চেয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। এ কোন ধ্রুবকে দেখছে সে? এই ধ্রুবকে কি আদৌ আয়েশী চেনে? না, চেনে না! এ ধ্রুব তো কোনো অন্য। এই ধ্রুব আয়েশীর থেকে সবকিছু কে’ড়ে নিতে জানে। আদৌ ভালোবাসতে জানে কি? ভালোবাসার অর্থ কি কেড়ে নেওয়া নাকি প্রিয় মানুষের জন্যে নিজের সমস্ত স্বার্থকে ছেড়ে যাওয়া?
#চলবে
মৃত কাঠগোলাপের সমস্ত রহস্যের জট খুলবে এখন থেকে।
গল্পটা যারা পড়বেন, রেসপন্স করবেন প্লিজ। আর হ্যাঁ, অনেকদিন ধরে আপনারা কোনো গঠনমূলক মন্তব্য করেন না। আশা করি, আজ আপনাদের বিশাল, সুন্দর সুন্দর মন্তব্য দ্বারা আমার মন ভালো করে দেবেন। ভালোবাসা!
গত পর্বের কমেন্ট বিজয়ী,
@এলোমেলো স্বপ্নকন্যা
@miftahul mun
@maksuda ratna
@triyasha roy sreya
@reha zaman
@arisha imroj mishra
@tasin jannat
@najeat anjum jasy
লেখিকার গ্রুপ,
কল্পনা-কলমে ~ ‘আভা ইসলাম রাত্রি’