মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ২৩,২৪

0
372

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ২৩,২৪
সায়লা সুলতানা লাকী
২৩

সকালে রুশকে নিয়ে বের হতেই লাবন্য পড়ল দোতলার ওই আংকেলের সামনে। লোকটা ইদানীং খুব বেশি বাড়ছে বলে মনে হল লাবন্যের। একটা পঞ্চাশার্ধ বয়স্ক লোক এতটা হ্যাংলা প্রকৃতির হয় কী ভাবে তাই ওর মাথায় আসে না। দাঁত মুখ খিঁচে একটা গালি দিতে ইচ্ছে করছে ঠিক সেই সময়তেই লোকটা দাত ক্যালিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠল

” জানতাম ইয়াং লেডি তুমি এখনই নামবা! তা কেমন আছো তুমি?”

লাবন্য উত্তরে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে ওর নানি চিৎকার করে উঠলেন। তিনিও পেছন পেছন নামছিলেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন
“এই তোরা এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কি আশ্চর্য, এখনও রিকশা ডাকিসনি কেন? এভাবে চললেতো লেট করবি, সেই জ্ঞান আছে কি ইডিয়টগুলোর?”

“ইয়ে মানে নানি উনি, ইয়ে..” লাবন্য একটু হতচকিয়ে আংকেলকে দেখিয়ে এটুকুই বলল, হঠাৎ নানির স্বরের এমন পরিবর্তনের কারনটা বুঝতে পারছিলো না।

“উনি? উনি কে? কে আপনি” বেশ শক্তভাবেই বিরক্ত চোখেমুখে ফুটিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন নানি।

“জি, মানে আমি একরাম, একরামুল হক। ”
“কোথায় থাকেন?”
“নানি উনি… ”
“চুপ, একদম চুপ বেয়াদব মেয়ে।দেখছিস না দুইজন মুরুব্বি কথা বলছি, তুই মাঝখানে কথা বলছিস কেন? ”
নানির ধমকে লাবন্য একেবারে চুপ হয়ে গেল। এত জোরে ধমকের স্বরে এর আগে কখনও দেখে নাই নানিকে। চুপ করে দাঁড়িয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগল নানি কি করেন লোকটার সাথে। কারন ততক্ষণে একরাম মিয়ার চেহারাটা দেখার মত হয়েছিল।

“জি মানে খালাম্মা, আমি দোতলায় থাকি।”
” এই বিল্ডিং এর দোতলায়। তা কি করেন আপনি?”
“বিজনেস, মানে টাইসের বিজনেস আছে আমার। ”
“ওওও, একা থাকেন না কি ওয়াইফ আছে? ”
“জি আছে।”
“ছেলেমেয়ে?”
“জি আছে।”
“কয়টা?”
“এক মেয়ে আর এক ছেলে আআআ…”
“তা এই সাতসকালে ওদের কাছে আপনার কি কাজ?”
“না মানে এমনি কুশলাদি জানতে চাইছিলাম আর কি।”
“আপনার ওয়াইফ জানে যে আপনি সিড়ির চিপায় চাপায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন জনের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন?”
“ইয়ে মানে…”
“মেয়ে কত বড় আপনার ?”
“ইয়ে মানে.. খালাম্মা…আমার একটা কাজ…”
“নানি একটা কথা….” লাবন্য হাত উঠিয়ে বলল
আবার? কি কথা তোর? নানি চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“আংকেল কিন্তু খুব পরোপকারী। আমাকে বলেছিলেন রাতে বাসায় আসবেন, বাজারের কি কি লাগবে তা জানতে। আংকেল পরে বাজারটা করে দিবেন বলেছিলেন। তাই না আংকেল?” একরাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে লাবন্য হাসতে হাসতেই বলল।
“তাই নাকি? খুব ভালো, কি নাম যেনো বললেন? একরাম, হ্যা একরাম সাহেব আপনার নাম্বার বা কার্ডটা দিয়েন আমাকে আমি দরকার হলেই ডেকে নিব। আর নয়তো দোতলায় খবর পাঠাবো। আপনাকে আর কষ্ট করে খবর নিতে আসতে হবে না।”

“না মানে খালাম্মা আমিতো অধিকাংশ সময় বাসায় থাকি না। খবর পাঠানোর …..”

“অসুবিধা কি আপনার ওয়াইফকে জানাবো। আপনি এতো পরোপকারী, নিশ্চয়ই আপনার ওয়াইফও ভালোই হবেন। সমস্যা নাই এখন যাই তাড়া আছে। দরকারে ডাকবো তখন রেডি থাকবেন কাজের জন্য ।” কথাটা শেষ করেই রুশের হাত ধরে টেনে টেনে এগিয়ে গেলেন আর লাবন্যকে জোরে ধমকের স্বরে বলতে লাগলেন
“অযথা সময়টা নষ্ট করলি এখানে বকবক করে, যা অটো বা সিএনজি ডাক। ওকে স্কুলে দিয়ে তোর সাথে যাব।”
আড় চোখে গার্ডকে একবার দেখে নিলেন নানি। একরাম সাহেবকে যখন একহাত নিচ্ছিলেন তখন গার্ড জায়গায় বসে সবটা গিলছিল। যখনই নানি ওদের সাথে গেইটের কাছে আসলেন সাথে সাথে গার্ড দাঁড়িয়ে সালাম ঠুকে গেইট খুলে দিয়ে নিজেই রাস্তায় বেড়িয়ে গিয়ে একটা সিএনজি ডেকে আনল। লাবন্য পুরো বিষয়টা খুব মজা নিয়ে উপভোগ করতে লাগল কিন্তু কোন রিয়েক্ট করল না গার্ডের সামনে। সিএনজিতে উঠে একটু এগিয়ে যেতেই লাবন্য ফিক করে হেসে উঠল। ওর হাসি দেখে ওর নানি একটু আড় চোখে ওর দিকে তাকালেন। এরপর বললেন
“বোকার মতো হাসছিস কেন?”
“ঠিকই বলছো আমি বোকা। বস আমিতো তোমার কাছে পুরাই বাচ্চা। ওরে আল্লাহ তুমি এত সব কীভাবে কি করলা? এত এনার্জি কোথা থেকে পাও? কি দারুন পার্ফরমেন্স ছিল তা তুমি বুঝতেও পারবে না বস। অসাম নানি অসাম। ইউ রক। জিনিয়াস। ব্যাটার চেহারাটা ছিল দেখার মতো। ওয়াও অমেকদিন পর একটা উপভোগ্য বিনোদন পেলাম।” লাবন্য হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল।রুশ এতক্ষণ চুপ ছিলো।এবার সরব হলো, “নানুমনি আমিও কিন্তু তখন তোমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিলাম ওই আংকেলের মতো।”

“চুপকর তোরা৷ আর হাসি বন্ধ কর। এই যে তুই যতসব ঢং করে বেড়াস, এগুলো কি এমন এমনি বের হয় তোর থেকে? মোটেও না। এগুলো তুই পেয়েছিস তোর মায়ের কাছ থেকে। আর তোর মা পেয়েছে আমার থেকে। তাহলে বল আমার ক্ষমতা নিয়ে তোর এত প্রশ্ন কেন?”

“ইশশশশশ আমার এখন তোমার মা, নানিকে দেখতে ইচ্ছে করছে, না জানি তারা কেমন বারুদ ছিলেন। আর তার চারপাশে অন্য সব কেমন ছিলো?” বলে আরও জোরে হাসতে লাগল।ওর সাথে বুজেই হোক আর না বুঝেই হোক রুশও হাসতে শুরু করল।

রুশকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার লাবন্যের সাথে ওর ইউনিভার্সিটিতেও চলে যান ওর নানি। লাবন্যের ডিপার্টমেন্ট ঘুরে ফিরে দেখে আবার ফিরে আসবেন রুশের স্কুলে তেমনটাই কথা হল। যদিও তার লাবন্যের সাথে যাওয়ার কোন দরকার ছিলো না। কিন্তু না গিয়েও তেমন একটা উপায় ছিলো না। লাবন্যের বর্তমান যে মানসিক অবস্থা তাতে ওকে পুরোপুরি গাইড করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই বলেই তার বিশ্বাস । নানি যখন ফিরছিলো তখন লাবন্য প্রচন্ড টেনশনে পড়ে গেল এইভেবে যে নানি ঠিকঠাক মতো ফিরতে পারবেনতো! কিন্তু নানি বারবার আশ্বস্ত করলেন তিনি পারবেন আর ফিরে কল দিয়ে জানাবেনও । তার কনফিডেন্স লেভেল দেখে লাবন্য আর বাঁধা দিলো না। নিজে বন্ধুদের সাথে পড়াশোনা নিয়ে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল আর নানি বেড়িয়ে এল রাস্তায়।

একটু পরই একটা রিকশা নিয়ে এগিয়ে এসে থামলো নানির সামনে।
“আসো উঠো। ”
“কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলি?”
“বেশিক্ষণ না। কি বুঝলা? পাগল লাইনে আসবেতো?”
“পাগল বলছিস কেন? ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখ। এই বয়সে কত কিছুর যে সম্মুখীন হতে হচ্ছে ওর।”
“কোনকিছু পজেটিভ দেখতে চাচ্ছে না। সব কিছুই ওর কাছে এখন নেগেটিভ। এটা কি স্বাভাবিক কোনো আচরন হলো বলোতো ? ”
“হইছে, যারটা শুধু সেই বোঝে। তুই ওরটা বুঝবি না।”
“ওও কিন্তু আমারটা বুঝতে চায় না। বুঝবে কি শুনতেইতো চাইলো না একবার, কীভাবে যে এত বড় একটা ধাক্কা আমি একা একা মোকাবিলা করলাম তা আমি জানি আর জানে আল্লাহ।”
“এখন এসব ওর কাছে আশা করাটা কিন্তু বড়ই অমানবিক। আজ দোতলার ওই ব্যাটারে শুধু জুতা পেটাটাই বাকি রেখেছি। রাগে গা জ্বলতেছিলো। একা একটা মেয়ে পেয়ে যা ইচ্ছে তাই আচরণ করছে। বাপ বয়সি একজন লোকের এমন আচরন সহ্য করা কিন্তু সহজ না।”
“নানু ইউ আর দা রক”।
“হুমম রক, আরও কিছু বল।”
“কি বলবো, বাসার অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। কত কষ্টে একটু ভালো করেছিলাম আবার যা ছিলো তাই বুঝি হয়ে গেল।”
“মন খারাপ করিস না। সময়ের হাতে ছেড়ে দে। তোর মায়ের কানে যে বিষ ঢালা হয়েছে তার রেশ কাটতে সময় লাগবে। আগে ওর ভুলটা ও নিজেই উপলব্ধি করুক।তাহলে দেখবি সমস্যা সমাধান হতে সময় লাগবে কম। আশা ছাড়িস না।”

“না ছাড়ছি না। বড়পু আজ শ্বশুর বাড়ি গেল। দুলাভাইকে দেখলাম খুব খুশি। এত খুশি মুখ তার এর আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না।”

“এই রকম মেন্দা মার্কা পুরুষ আমার দুই চোক্ষের বিষ। শ্বশুরকে কেন এসব বলতে হলো, নিজে কেন শক্ত হয়নি আগে? নিজের মেরুদণ্ড শক্ত না, এটা কোন দোষ না। দোষ সব বৌয়ের, এক কথা- বৌ ভালো না। হোমার শশুর বাড়িতেতো সবাই একডাকে বলবে হোমা খারাপ।কেউ তো আর বলবে না, ভাই নিজেই ভালো না। সে নিজেই বৌয়ের ভয়ে কাপড়ে প্রসাব করে।”

“উফফ নানু তুমি এসব কি বলছো? এসব কি ভাষা তোমার ?”
“হুমম, সত্য বললাম। সত্য এমন কঠিনই হয় অপ্রিয় হয়, তিত হয়। তুইও কান খাঁড়া করে শুনেনে। নিজের ঘর ঠিক না করে ঘরে বৌ তোলার কথা আমাকে বলবি না। তোর বৌ শুধু তোর সাথে থাকবে না তোর পুরো পরিবারের সাথেই থাকতে যাবে। কথাটা মনে রাখিস। আমার বড় মেয়ে যেনো কখনওই ওর ছেলেকে না হারায়। ছেলে যেনো কখনোই মা’কে কষ্ট না দেয়।”
“তাহলে ধরে নাও, এ জীবনে আর বিয়ে করতে হবে না নানু। অবশ্য আমিও চাই না আম্মুকে কষ্ট দিতে, আর বৌকে কষ্ট পেতে দেখতে। আম্মুকে ছাড়া থাকতে আমিও পারব না। আর….. ওকে ছেড়ে অন্য কিছু চিন্তাও করিনি কখনো। ”

“এসব এখন বাদ দে। নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত কর। সব কিছুর একটা সময় আছে। এসবের জন্য এটা কোন ভালো সময়, না।”

“হুমম, তুমি এখন ওর পাশে আছো এখন আমি নিশ্চিন্ত। দেখো এই বিয়েটা যখন থামাতে পেরেছি তখন বাকি যুদ্ধটাও পারব। তবে আমি একা লড়ব এই যুদ্ধ এটাই কষ্ট ।”

“নাজমুল আছে তোর সাথে। তুই একা না। শুধু লাবুকে ডাকবি না এসবে। ওকে ওর মতো করে গোছাতে দে নিজেকে। এখন তুই যা। রুশের সামনে এখনই পড়িস না। লাবু একটু স্থির হোক পরে দেখা যাবে সবটা।”

“আচ্ছা বাই। টেক কেয়ার। কিছু লাগলে আমাকে জানিও।” বলে হিমেল চলে এল নানুকে স্কুলের গেইটের কাছে রেখে।

লাবন্য বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। বুয়াখালা দরজা খুলে দিতেই দেখল বাসাটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে। কারো কোন সাড়া নাই। ব্যাগটা রেখেই জিজ্ঞেস করল
“রুশ কোথায় খালা?”
ঘুমায়, খালাম্মার রুমে।
লাবন্য কিছুটা অবাক হয়ে গেল। এই সময়তে রুশ বসে ভিডিও গেইমস খেলে এরপর আসরের শেষে যায় ঘুমাতে। আজ এত টাইম মেইনটেইন করছে তাও আবার নিজের রুম রেখে নানির পাশে যেয়ে ঘুমাচ্ছে শুনে একটু কৌতুহল হল দেখার। তাই দৌড়ে গিয়ে উঁকি দিল নানির রুমে। দুচোখ যেনো জুড়িয়ে গেল। রুশ নানির গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। যেমনটা ও আম্মুর পাশে ঘুমাতো। ভাইটা আবার ওর আগের আদর ভালোবাসার দেখা পাচ্ছে এটা ভাবতেই চোখদুটো ঝাপায় হয়ে উঠল। নজর লাগার ভয়ে সরে এল। ঢুকে গেল নিজের রুমে ফ্রেশ হতে। খসলাকে বলে হেল খাবার দিতে টেবিলে। এই ওল্ড লেডিকে না রাগিয়ে, তার তালে তালেই চলতে চাচ্ছে যে ওর মন।

রাতে লাবন্য পড়ছিলো ঠিক তখন ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখল ওর আব্বুর। সাথে সাথে সুইস বন্ধ করে দিল। এর আগেও বিভিন্ন সময় কল দিয়েছে কিন্তু ও ধরেনি। শুধু শুধু সম্পর্কের তিক্ততা ও চায় না। যে গেছে সে গেছেই তাকে নিয়ে আর ভাববে না। এমনটাই ভাবছিলো এরই মধ্যে লেন্ড ফোন বেঝে উঠল।
একটু পর বুয়া খালা কলটা ধরল।
লাবন্য ওর এটেনশন সরাতে পারলো না ফোন থেকে। অপর প্রান্তে কে কি বলছে তা শুনতে পাচ্ছে না।কিন্তু খালার কথা শুনছিলো ঠিকই।
“রুশ বাবা তার নানির সাথে টিভি দেখে।”
“হ, গতকাইল রাইতে আইছে।”
“আমাগো কত কত সমস্যা হয় তা আপনে জানেননি?”

লাবন্য বুঝলো অপর প্রান্তে যে আছে সে কোন পক্ষ। হঠাৎ করেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বিরবির করে বলে উঠল, “আমাদের বাসায় কে আসবে কে থাকবে তা নিয়ে তাদের এত সমস্যা কি? কি পাইছে তারা?” বলতে বলতে রেগে ডাইনিংএ আসল তখনই দেখল খালা রিসিভার টা নামিয়ে রাখল।
“কে ছিলো খালা?”
“ভাইয়ের ছোড বইন”।
“কি বলে সে?”
“বাদ দেন খালাম্মা। হেগো কথা শুইন্যা নিজেগো সময় নষ্ট করনের কাম নাই। আপনে পড়তে যান। কতদিন পর আবার বাসাডা আগের মতো হইছে এর মধ্যে আর ঝামেলা বাড়ানের দরকার নাই। ” খালা কথাটা বলে কিচেনে চলে গেল।
লাবন্য নিজেকে একটু স্থির করে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
নানি নাতি মিলে বেশ মজা করে টিভি দেখছিলো। লাবন্যের কেনজানি এই দৃশ্য দেখে মনটা নরম হয়ে এল।

“কিরে রুশ তুই এখন টিভি দেখছিস? পড়া কখন করবি?”
“পড়া শেষ।” রুশ জলদি করেই উত্তর দিল।
“তুই উঠে এলি কেন? খবরদার বলছি এখন টিভির সামনে বসবিতো তোর কপালে খারাপ আছে অনেক।”
“রিল্যাক্স ডিয়ার। আমি টিভি দেখতে আসিনি। আসলাম রুশের খবর নিতে।”
“রুশকে আমিই দেখব তুই তোর কাজে যা। এমন রুশকে দেখতে দেখতেই চুল পাকিয়েছি”।
“না মানে যদি কিছুর দরকার পড়ে…”
“সমস্যা কি দোতলায় খবর পাঠাবো, একরাম সাহেবকে বলব, তার মতো হেল্পকারী প্রতিবেশী থাকতে চিন্তা কি?”
নানির কথাটা শেষ হতেই লাবন্য হোহোহো করে হেসে উঠল। রুশও যোগ দিল সেই হাসিতে। আর ওর নানি ওদের সেই হাসি তৃপ্তি সহকারে দেখতে লাগলেন।

চলবে

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ২৪)
সায়লা সুলতানা লাকী

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রৌশন ওর নিজের রুমেই ঘুমিয়ে পড়ল। রেশমার রুমটাতে বসে ছিল ওর মা। লাবন্য নিজের রুমে বসে পড়ছে। তাসলিমা এখন ওর খালাম্মার সাথেই ঘুমায়। ফ্লোরে নিজের তোশক বেডিং বিছিয়ে নেয়। খালাম্মার সাথে থাকতে ওর খুব ভালো লাগে, ঘুম না আসা পর্যন্ত গল্প করা যায় তার সাথে, এতদিনে এ বাসায় মন খুলে কথা বলার একজন মানুষ পাওয়া গেছে।তাকে বড় আপন বলে মনে হয় ওর।
হঠাৎ করেই নানির মোবাইলটা বেজে উঠল, নিস্তব্ধ বাসায় রিংএর শব্দটা সবারই কানে বাজল।
“হ্যালো”
“আসসালামু আলাইকুম আম্মা।”
“ওয়ালাইকুম আস সালাম। ”
“আম্মা আপনে রেশমার বাসায় কি করেন? আমিতো শুনেই তাজ্জব হয়ে গেছি। আপনে ওই বাসায় কেন?”
” তাজ্জব হওয়ার কি আছে? আমার ইচ্ছেতেই আমি আছি।”
“এটা আবার কেমন ইচ্ছা আপনার, আম্মা?”
“আমার মনে হয় এতটা তোর না জানলেও চলবে।”
“আম্মা আপনে জানেন যে রেশমার কারনে আমরা আমাদের আব্বাকে….”
“আহ! রেহেনা, পুরোনা সুরটা আর তুলিস নাতো! একই সুর আর শুনতে ভালো লাগে না।”
“আম্মা আপনের হইছেটা কি? আমারতো এসব ভালো ঠেকতেছে না।”
“তোর ভালো ঠেকা আর না ঠেকাতে তো আর আমি চলব না। আমি আর তুইতো এক না।”
“আম্মা আপনার তিনটা ছেলে থাকতে আপনে এখন মরা মেয়ের বাসায় থাকবেন এটা মানুষ শুনলেই বা কি বলবে?”
“মানুষের বলা আর না বলা এখন আর আমার মনকে প্রভাবিত করে না। আমি এখন এগুলোর থেকে অনেক দূরে আছি।”
“বুঝি না এই পুচকা মেয়ে কি এমন যাদু জানে যে একে একে সবাইরে নিজের মতো করতাছে। আপনে এখন পুরাই লাবন্যের সুরে কথা বলতাছেন।”
“রেহেনা তোর মাথাটা একটু নিজের সংসারে খাটা। আমার কিংবা লাবুর দিকে তাকিয়ে অযথা সময় নষ্ট করিস না। নিজের বুদ্ধিটুকু নিজের সংসার গোছাতে কাজে লাগা। অন্তত নিজের বুদ্ধিতে সংসারটা চালাতে পারলে আর অন্যের বুদ্ধি নিয়ে সংসারে অশান্তি বাড়াতে হবে না বলেই মনে হয়। দেখ নাজমুল কি বলে, ও কি চায়। তোর ছেলের মনকে বোঝার চেষ্টা কর। ভবিষ্যতে কাজে আসবে তাতে। অহেতুক এদিক ওদিক বুদ্ধি অপচয় করিস কেন?”
“ছেলের মন বোঝতে বললেন পরে বুঝলাম ঘটনাটা কি? এই হল তাহলে মেয়ের বুদ্ধি! ”
“মাথা মোটা মেয়ে তুই আমার। অসুবিধা নাই তোর যা বোঝার তাই বুঝে নিজের মধ্যেই থাক। আমার কোন বিষয়ে নাক গলাতে আসিস না। ভালো থাক, সুখে থাক নিজের সংসার নিয়ে। রাখি অনেক রাত হয়েছে, ঘুমোবো।” কথাগুলো বলে কলটা কেটে দিলেন তিনি।

লাবন্য বাহিরে দাঁড়িয়ে অপর প্রান্তের কথাগুলো শুনতে পারে নাই ঠিকই কিন্তু এপ্রান্তের কথাগুলো শুনে বুঝতে পারলো নানি বড় চাপে আছে এখানে চলে আসায়। আগ বাড়িয়ে নানিকে কিছু বলা উচিৎ হবে কি না, ভাবতেই দেখল তিনি রুম থেকে বের হয়ে এলেন।

“কি হল তুই এখানে কি করছিস?”
“কিছু না পানির জন্য এসেছিলাম। ”
“কাল থেকে এক বোতল পানি রুমে নিয়ে যাবি।
পড়া রেখে বারবার উঠবি না।” কথাটা বলেই তিনি নিজের রুমে চলে গেলেন। লাবন্য আর কোন কথা না বলে নিজের রুমে চলে এল।

“খালামনি কি কারনে আমাকে পছন্দ করেন না?” প্রশ্নটা একবার নিজের মনকে করে আবার মাথা ঝাড়া দিয়ে বসল। “বাদ এসব চিন্তা বাদ। এখন ইজ্জত বাঁচাতে লড়তে হবে। ফেল করলে ওল্ড লেডি আমার ব্যান্ড বাজাবে।” বলে আবার পড়ায় মনোযোগ দিল।

দুদিন যাবৎ রাতে ঘুমটা ভালো হয়। যখনই বালিশে মাথা রাখে সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর তাই সকালে নিজেকে বড় ফ্রেশ লাগে লাবন্যের। রুশকে এখন নানিই রেডি করান। ফযরের নামাজের সময় ওঠে আর ঘুমান না তিনি। কোরআন নিয়ে বসার আগেই রুশকে উঠিয়ে দেন। তাই সকালে রুশ বেশ ভালো সময় পায় রেডি হতে।
সকালে নাস্তা শেষ করে নিজের ব্যাগটা নিয়ে নানির রুমের দিকে গেল তাকে ডাকতে। নানি নিজের রুমে গিয়েছিল শাড়ি চেঞ্জ করতে, কিন্তু এখনও বের হননি। দরজার কাছে যেতেই শুনতে পেল নানি কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলছেন খুব মিনমিনা স্বরে

“তোমাকে না আমি বারন করেছি আমাকে কল দিতে, তবে কেন কল দিচ্ছো বারবার? দেখছো যে রিসিভ করছি না, তারপরও দিয়েই যাচ্ছো দিয়েই যাচ্ছো।তুমি জানো না এই সময়তে কি কাজ থাকে?”

অপর প্রান্তে থেকে কি বলল তা শুনতে পেলো না তবে নানি তার কথা শুনে এবার একটু রেগে গিয়ে বললেন
“খবরদার, এসব সরি টরি আমাকে বলবে না। আমি এসব শুনতে চাই না। আর কান খাঁড়া করে শুনে নাও আমি কোনো দিনও তোমাকে ক্ষমা করব না। তুমি বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক। তুমি ইচ্ছে করেই আমার মেয়েকে অনেক কষ্ট দিয়েছো। তোমার কোনো ক্ষমা নাই।”

এবার লাবন্য কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো অপরপ্রান্তে কে। একটু থেমে নানি আবার বলতে শুরু করলেন

“উঁহু, তোমার ওসব দায়সারা সস্তা অযুহাত আমি শুনব কেন? অসম্ভব ওসব আমাকে শুনিও না।
শোনো শোনো শোনো, এটা তোমার ভুল ধারনা। আমি তোমার জন্য কিছু করছি না। আমি যা করছি তা আমার কাছে উচিৎ মনে হচ্ছে বলেই করছি। আমার মেয়েটার এত দিনের পরিশ্রমকে একটা সার্থক রুপ দিতে করছি। মেয়ের রেখে যাওয়া আমানতের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করার চেষ্টা করছি মাত্র । তোমার অত বিনয় হতে হবে না আমার কাছে।”

কথাটা শুনে লাবন্যের গা’টা জ্বলে উঠল। “এমন কাজ যে করতে পারে সে আবার বিনয়ীও হতে চায়, আজব!” মনে মনে ভাবতেই শুনল নানি বলছেন-

“সেকি কথা! এখন? না না না আমরা এখন বের হচ্ছি।এখন তুমি আসবে কেন?”

এতটুকু চুপচাপ শুনতেই ও যা বোঝার বুঝে উঠল, ওর আব্বু কি চায়, কেন কল দিছে। আর তা বুঝতেই চিৎকার করে উঠল
“কে আসবে? কেন আসবে? এখানে তার কি আছে? কার জন্য আসবে? আমরা চাই না সে আসুক। আমাদের আম্মুর মতো আব্বু চলে গেছে না ফেরার দেশে তেমনটাই মনকে বোঝাচ্ছি । আর কাউকে লাগবে না আমাদের । নানি তুমি মানা করে দাও, সে যেনো এখানে কোনদিনও আসার কথা মাথায় না আনে।”

“আহ লাবু! চুপ কর। আমি কথা বলছি না তুই মাঝখানে কেন কথা বলছিস? আমাকে কথা বলতে দে। বলে তিনি আবার বললেন কলে-
“হ্যা বলো কি বলতে চাচ্ছো?” কিছুক্ষণ নানি চুপচাপ শুনলেন তার কথা। এরপর বললেন-
“হুমম বুঝলাম, আচ্ছা তুমি সন্ধ্যার পর আসো। আর কোন কথা বলবা না।রাখলাম”

“নানি তুমি তাকে বাসায় আসার পারমিশন কেন দিলা?”
“কারন তার এখানে আসাটা দরকার। তার সব ডকুমেন্ট, অফিসিয়াল কাগজপত্র, পাসপোর্ট, ব্যাংকের কার্ড সবই আলমারিতে রাখা এগুলো ছাড়া সে মুভ করতে পারছে না। এতদিন অফিস করেছে কিন্তু খুব ঝামেলা হয়েছে। এগুলো ছাড়া সে কীভাবে টাকা তুলবে আর কীভাবে তোদের জন্য টাকা দিবে?”

“কিন্তু সে যদি আলমারি খুলে আম্মুর জিনিসপত্র নিয়ে যায়?”
“তোর আম্মুর জিনিসপত্রের হেফাজত করা তোদের দায়িত্ব। সেটা যদি তোরা সঠিকভাবে না করতে পারিস তবেতো তা খোয়া যাবেই। এই লোক না নিলেও তা অন্য কেউও নিতে পারবে। আসল কাজ হল রেশমার জিনিসপত্রগুলোকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা যাতে তা কখনও নষ্ট না হয়। সেটা যদি না করতে পারিস তবে আর তা নষ্ট হওয়া নিয়ে টেনশন করে কি হবে?”

“আমি চাচ্ছিলাম আম্মু যেভাবে রেখে গেছে সেভাবেই রাখতে। রুমটায় ঢুকলে মনে হয় আম্মু এখনও এখানেই আছে। এখনই রুমে ঢুকবে আর বলবে, কিরে লাভ এখানে কি করিস? কিছু লাগবে?”

“মানুষটাই নাই আর জিনিস? এসব করে কি হবে?ওতো আর ফিরবে না, শুধু শুধু কষ্ট বাড়ানো ছাড়া আর কিছু নারে নানু আপু।”

“আম্মুর গন্ধটা পাই রুমটায়। সবকিছুতে আম্মুর ছোয়া লাগা ওখানে।”
“রেশমার গায়ের গন্ধ তোদের গায়েই আছে। আমিতো পাই।”
“আমি আজ ভার্সিটি যাব না নানি। বাসায় থেকে আগে এগুলো সরাবো, গোছাবো।যাতে সে আম্মুর কোনো কিছুই না নিতে পারে।”
“অসম্ভব, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া যাবে না। পড়া বাদ দিয়ে কিছু না। ক্লাস শেষ করে বাসায় এসে পরে এগুলো গোছানোর অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন চল দেরি হয়ে গেছে।” বলে রুশ কে নিয়ে নানি আগে আগে বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে ।

লাবন্য দরজায় লক লাগিয়ে নিচে নেমে এল। আজ আর একরাম সাহেব নাই আর গার্ডও পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা সালাম দিয়ে গেইট খুলে দিল। এরপর নিজেই একটা সিএনজি ডেকে আনল। লাবন্য বিষয়টা খুব উপভোগ করল। এই মানুষটার উপস্থিতিতে এতটা স্বস্তি ফিরবে ওদের জীবনে তা কখনও ভাবেনি আগে।

আজ ক্লাস শেষ হতেই লাবন্য তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল। মায়ের রুমে ঢুকে সব কিছু ভালো করে লকড করল। ওর নানি চুপচাপ লাবন্যের অস্থিরতা দেখতে লাগল। মেয়েটাকে আগে যখন দেখতো তখন এমন ছিলো না। মায়ের মৃত্যুর পর যেদিন দেখেছিলো তখনও এমনটা মনে হয়নি অথচ এখন একেবারেই অন্য একজন লাবন্য বলে মনে হল। মেয়েটা বারবার চেক করছে ওর মায়ের ব্যবহার্য কোন কিছু এদিক সেদিক পড়ে রইল কি না।

রৌশন যখন শুনলো ওর আব্বু আসবে আজকে বাসায় তখন থেকেই কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেল। নানি আসার পর যাও একটু নরমাল আচরণ করছিল আজ হঠাৎ করেই চেঞ্জ হয়ে গেল। দুপুরে খেয়ে নিজের রুমেই ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল সকাল উঠে যায় বলে দুপুরে এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। মাগরিবের আগেই উঠে গেলো। নানুর সাথে নামাজ পড়ে দুধ খেয়ে নিজের রুমে চুপচাপ পড়তে বসে গেল। ওর এমন আচরনটা ওর নানুর মনটাকে আরও বেশি নাড়া দিল। ওদের আব্বু আসবে বাসায় আজ কয়টা দিন পর অথচ ওদের কারউ মনেই কোন আনন্দের লেস মাত্র দেখতে পেলেন না।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঠিকই লিখন আসল এই বাসায়।বুয়া খালা দরজা খুলে দিল। লিখন ভিতরে ঢুকে দেখল কেউ নাই আশেপাশে।জিজ্ঞেস করতেই জানল যে যার রুমে পড়ছে। একটা সময় রেশমার মা বের হয়ে এলেন।

“আসসালামু আলাইকুম আম্মা ”
“ওয়ালাইকুম আস সালাম, যে কাজে এসেছো তাই করে যাও।”
“জি আম্মা ” বলে নিজের রুমে ঢুকে গেল। নিজের বাসা নিজের রুম কিন্তু চিরচেনা সেই জায়গায় আজ ঢুকতে কেমন চোর চোর অনুভূতি অনুভব করল। নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠল। বিছানায় বসতেও যেনো কেউ মানা করছে এমনটাই মনে হল লিখনের। আলমারিটা খুলে নিজের দরকারি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে নিল সাথে কিছু কাপড় চোপড়ও গুছিয়ে নিল। রুমটাতে থাকতে পারছে না। কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো ওর। পুরো রুমটার সৌন্দর্যই মনে হল গায়েব। রেশমার এত সুন্দর করে সাজানো ড্রেসিং টেবিলটা পুরো খালি। মনে হল শুধু আসবাবপত্রগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেশমার জন্য কাঁদছে। একটা সময় নিজেকে কেমন জানি অসহায় বলে মনে হল। সাজানো গোছানো জীবনটা হঠাৎ করেই এলোমেলো হয়ে গেল। যাও চাইল নতুন করে গোঁছাতে তাতে আরও বেশি ঝামেলা পাকিয়ে গেল।এখন একেবারে ছন্ন ছাড়া হয়েগেল সবটা। রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসল। বারবার মুখ তুলে চারপাশ দেখতে লাগল কিন্তু ছেলেমেয়ে কাউকেই দেখতে পেলো না। চুপচাপ বসে আছে দেখে রেশমার মা আবার লিখনের সামনে এসে দাঁড়ালো ।

“কিছু বলবে? বসে আছো যে?”
“আমাকে সবাই বলল, বিয়ে করলেই সংসারটা আবার আগের মতে হয়ে যাবে। বিয়ের কথা আগে বললে লাবু অমত করবে তাই আগে কিছুই বলা হল না। দিন দিন লাবু যেনো ওর মায়ের অভাবে কেমন হয়ে যাচ্ছিল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যদি কোন বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যায় ওর! তাই চাচ্ছিলাম যত দ্রুত সম্ভব সব যেনো আবার আগের মতো হয়ে উঠে। লাবু আবার নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দিবে, রুশ আগের মতো খেলবে আনন্দ করবে। আমার মা’ও নিজের ঘরে আগেরমতো শান্তিতে থাকবে। কিন্তু আমার ভাগ্যটাই খারাপ। সব ঠিক হওয়ার জায়গায় সবকিছু যা ছিল তার চেয়ে আরও খারাপ হয়ে গেল। আমার মেয়ের এমন রুপ আমি কোনো দিনও আশা করিনি যা আমি এখন দেখছি। এই এক জীবন আমার এমনভাবেই নষ্ট হয়ে গেল। আমার রুশ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি আসছি অথচ ও আমার সাথে দেখাটা পর্যন্ত করতে আসলো না। এ জীবনের আর কি দাম আছে আম্মা বলতে পারেন? ”

“না আমি কিছুই বলতে পারি না। আমি শুধু জানি তুমি চাইলে আমার মেয়েটা আরও একটু আরাম পেতে পারতো। আরও একটু শান্তিতে থাকতে পারতো। তুমি ওর ভালোবাসাকে পুঁজি করে ওকে শুধু তোমার প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছো।”

“আম্মা আমি বারবার বলছি আমার অপারগতার কথা। আমি আমার মায়ের কাছে বন্দি। আমার পায়ের পাতায় এক্সিমা ছিল ছোটবেলায়, ভয়ংকর কষ্ট হত আমার। আমি দেখেছি আমার মা কি কষ্ট করেছে আমাকে নিয়ে। দিন নাই রাত নাই, শীত গরম সব সময়ই আমার জন্য কষ্ট করেছেন। আমি কি করে তাকে কষ্ট দেই। তার সব কথা রেশমা মেনে নিত, আমিও তাই আর কিছু বলতাম না।”

“বাদ দাও এসব বলে এখন আর কোন লাভ নেই, আমার মেয়েটাই নেই ও তো আর ফিরবে না। তোমরা এখন যে যার কর্মফল ভোগ করবে এটাই নিয়ম।”

“আম্মা একবার একটু রুশকে ডাকবেন, লাবন্য বড় শক্ত ও আসবে না। একবার একটু রুশকে ডাকেন, ওকে দেখি না অনেক দিন হল। ওকে না দেখে ঘুমোতে যেতে পারতাম না। সকালে ওর রুমে গিয়ে ওর বিছানায় প্রায় সময় ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম রেশমার চিৎকারে দুজন লাফিয়ে উঠে রেডি হতে যেতাম। আম্মা প্লিজ একবার ডাকেন না ওকে।”

“তুমিই ডাকো।”

“রুশ, রুশ, এই রুশ। আব্বু আয় না একবার, রুশ-” আর ডাকতে হলো না। রৌশন বের হয়ে এল রুম থেকে । চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সামনে এসে। লিখন এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু ওর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। টেনে এনে পাশে বসিয়ে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল লিখন।

“এই নে তোর ফেবারিট চকলেট আছে এতে। এমন গোমড়া মুখে আছিস কেন? আব্বুর উপর অনেক রাগ তোর? তুই জানিস তোর জন্য তোর আব্বুরও মন খারাপ হয়। কতদিন হল আমরা একসাথে ক্রিকেট খেলতে যাই না সকাল বেলা। যাবি খেলতে? তোর স্ট্যাম্পগুলো ঠিক করা হয়নি। এবার ঠিক করে দিব। তুই যতক্ষণ বল করতে বলবি আমি ততক্ষণ বল করব একটুও টায়ার্ড হব না বাপ। ছুটিরদিন বিকেলে ডমিনেন্স পিজ্জা খাব। হট চকলেট……..”
আর বলতে পারলো না, রুশ উঠে দৌড়ে ওর নানুর কাছে গিয়ে নানুকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল

“নানু আমি আর জীবনেও ক্রিকেট খেলবো না। আই হেট ক্রিকেট। আমি জীবনও কোন চকলেট খাব না পিজ্জাও না। হট কেক না। আই হেট দেম। আমি এসব কিছু চাই না। আমার এগুলোর কোন দরকার নাই। আমার কিছু লাগবে না।”

রৌশনের কান্নাতে ওর নানুরও চোখ ভিজে গেল। তিনি বেশ শক্ত করে রুশকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা চুমুও খেলেন। এরপর বেশ শক্ত গলায় বললেন
“আমার মনে হয় তোমার কাজ শেষ। তুমি এখন আসতে পারো।”
রৌশনের এমন আচরনে লিখন হতভম্ব হয়ে গেল। ছেলের কান্নার জোয়ারে নিজের চেপে রাখা কষ্টটা মনে হল ও গিলে ফেলল। ঢোক গিলে বলল
“আম্মা আমি প্রতি মাসে টাকাটা কি আপনার একাউন্টে দিব নাকি লাবন্যের একাউন্টে দিব। ওতো এখন বাচ্চা মেয়ে…….”

“সে বিষয়ে না হয় পরেই কথা বলি। এখন তুমি আসো। ”

“জি আচ্ছা”। বলে আর দাঁড়ালো না লিখন, বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। বুয়া খালা এসে দরজাটা আটকিয়ে দিল সাথে সাথে। তারও চোখ ভিজা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here