বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ৩

0
600

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩

হন্তদন্ত করে ছাদের দিকে ছুটছে শ্রাবণ। ছাদের দরজা ঠেলে উঠতেই আঁতকে উঠলো সে। এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে অস্থির কণ্ঠে বলল
–রক্ত কিসের ভাইয়া? কি হয়েছে তোমার?

শ্রাবণের হাত থেকে টি শার্টটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের গায়ের রক্ত মাখা শার্টটা খুলে ফেললো হিমেল। সেটা গায়ে দিতে দিতেই বলল
–আমার কিছু হয়নি। রাস্তায় একটা বাচ্চা এক্সিডেন্ট করেছিল। ওকেই হাসপাতালে নিতে গিয়ে আমার শার্টে রক্ত লেগে যায়। এই অবস্থায় বাসায় যেতে পারবো না। মা দেখলে বাজে অবস্থা হয়ে যাবে।

শ্রাবণ রক্ত মাখা শার্টটা হাতে নিয়ে বলল
–তাই বল। আমি তো ভয় পেয়েছিলাম। যেভাবে ফোন করে কাপড় নিয়ে চুপিচুপি ছাদে আসতে বললে। আমি তো অন্যকিছু ভেবে বসে আছি।

শ্রাবণের কণ্ঠস্বর অন্যরকম শোনাল হিমেলের কাছে। সরু চোখে তাকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–কি ভেবেছিলি?

শ্রাবণ ভীষণ লাজুক ভঙ্গীতে হাসল। বিষয়টা এমন যে তার ধারনা সত্যি হলে সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা হতো। ঐ অবস্থাতেই বলল
–কিছু না। আমি শার্টটা ধোঁয়ার ব্যাবস্থা করছি তুমি বাসায় আসো।

————
চোখের সামনে সেই ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতেই গাড় ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো নিমেষেই। কিছুটা চেচিয়েই বসে পড়লো বিছানায়। পাশেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মৌ আপার গলার আওয়াজ শুনেই উঠে বসলো। বিচলিত হয়ে বলল
–আপা তোমার কি হইছে?

দৃষ্টি ফিরিয়ে মৌকে দেখে নিলো। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। মাঝরাতে এমনভাবে তার বড় আপা চিৎকার করলে ছোট্ট মৌয়ের ভয় পাওয়া তো স্বাভাবিক। মুখে জমে থাকা ঘাম আলতো করে মুছে নিয়ে মৌয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরল। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–কিছু হয়নি। তুমি উঠলে কেন?

মৌ মাথা তুলে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–তাহলে চেচালে কেন?

কুমু একটু বিরক্ত হল। ভাই বোন দুজনেরই স্বভাব একরকম। একটা বিষয় পেলেই সেটার শেষ অব্দি না পৌছা পর্যন্ত শান্তি পায় না। এখন ওর সব প্রশ্নের উত্তর মন মতো দিতে না পারলে না ঘুমিয়ে প্রশ্ন করতেই থাকবে। কুমু ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
–স্বপ্ন দেখছি। তাই ভয় পাইছিলাম।

মৌ শান্ত হল না। আবারো প্রশ্ন করলো
–ভুতের স্বপ্ন আপা?

কুমু এবার হেসে ফেললো। বলল
–হ্যা। এখন গল্প শুনলে তুমিও ভয় পাবে। এখন ঘুমাও। আমি সকালে শোনাবো।

মৌ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে শুয়ে পড়লো। কুমুও শুয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মৌ ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চিত হতেই নিজের ক্লান্ত চোখটা বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু আবারো সেই রক্তে মাখা বাচ্চাটার চেহারা ভেসে উঠতেই চোখ খুলে বিচলিত শ্বাস ফেললো। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর শুভ্রা আর দোকানের লোকজন মিলে তার জ্ঞান ফেরায়। একটা রিক্সা নিয়ে শুভ্রা তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। বাসায় এসে ঘটনার কিছুই কুমু বলেনি। খুব স্বাভাবিক আচরণ করেছে। অযথা তার মা আর বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়বে। দুই তিনিদিন বাইরে যেতে দেবে না। কিন্তু এটা তো আর এমন কিছু নয়। চোখের সামনে অমন বীভৎস দৃশ্য দেখে তার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। ঐ দৃশ্য না দেখলে তো এমন কিছুই হতোনা। দৈনন্দিন জীবনে অনেক বিপদ ঘটে থাকে। কিন্তু বিপদে খুব ভয় পায় কুমু। অল্প বিপদেই কাতর হয়ে ওঠে। আজ আর ঘুম হবে না। মস্তিস্ক সেই ভয়ংকর দৃশ্য কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে পানি খেলো কুমু। মাথাটা ভার ভার লাগছে। বড় করে একটা হাই তুলল। একেবারেই না ঘুমিয়ে থাকা যায়। কিন্তু কিছুক্ষন ঘুমালে তারপর সেই গাড় ঘুম ভেঙ্গে গেলে খারাপ লাগে। এখন যেমন অস্থির আর দুর্বল লাগছে। কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করলে হয়তো শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়বে আর তখন ঘুম আসবে। তাই এপাশ ওপাশ পায়চারী করতে লাগলো। সেই সময় কানে ভেসে এলো প্রতিদিনের মতো সেই সম্মোহনী সুর। কান খাড়া করে ছাদের দিকে তাকাল। ছাদে যাবে না বলেই আজ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু লাভ তো কিছুই হল না। সেই সময়েই তো জেগে গেলো। চোখ বন্ধ করে নিজের মন কে বলল আজ কিছুতেই ছাদে যাবে না। বলেই আবার সেই পায়চারী করতে শুরু করলো। কিন্তু লাভ হল না। প্রতিদিনের মতো নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বের হয়েই গেলো ছাদে। ছাদে উঠতেই সুরটা স্পষ্ট শুনতে পেলো। আজ তার মাথায় সেই সুরের রহস্য উৎঘাটনের চিন্তা এলো। কোথা থেকে আসে এই সুর। ছাদের চারিদিকে এদিক সেদিক দেখেও কুল কিনারা পেলো না। একদম কিনারায় গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পেলো ভয়ংকর সেই মূর্ছনা। এক কোণে মাথা বাড়াতেই পাচিলে লাগোয়া পাশের দোতলা বাড়ির ছাদের দৃশ্যটা চোখে পড়লো। কুমুদের বাড়ির তিন তলার জানালার ছায়া তাদের ছাদে। কেউ একজন জানালার পাশে বসেই কোন একটা বিশেষ বস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করছে আর সেখান থেকেই তৈরি হচ্ছে সেই ভুবন ভুলানো সুর। শ্রবনেন্দ্রিয়তে ঝঙ্কার তুলছে। বুক কাঁপছে কুমুর। কিছুটা সময় পরেই থেমে গেলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশ। জানালার পর্দা টেনে দিতেই নিকশ কৃষ্ণ ছায়াটা কালো অন্ধকারে ডুবে গেলো। মন খারাপ গ্রাস করে নিলো অভিমানী কিশোরীর মন। অচেনা মানুষটার উপরে তীব্র অভিমান জমে গেলো। আর কিছু সময় থাকলে কি হতো? সারারাত এপাশ ওপাশ করে কেটে দিলো। ফজরের আজান কানে আসতেই বিছানা ছাড়ল কুমু। অজু করে এসে নামাজ পড়লো। কাঠের জানালা খুলে দিতেই বসন্তের সুমধুর হাওয়ায় শুরু হল দিনের। পর্দাটা টেনে দিয়ে ছোট্ট মৌয়ের পাশে শুয়ে পড়লো। মৌ দুই হাত উঁচিয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। কুমু আলতো করে জড়িয়ে ধরতেই আদুরে ভঙ্গীতে গুটিসুটি মেরে বুকের ভেতরে ঢুকে গেলো। তুলতুলে দেহটা আরও আবেশে জড়িয়ে ধরে চোখটা বন্ধ করে ফেললো কুমু। এবারো স্বপ্ন দেখল সে। আবছা স্বপ্নে সেই অচেনা পুরুষের মুখটা ভেসে উঠলো। ঘুমটা ছুটে গেলো মুহূর্তেই। চোখ মেলে কিছুক্ষন ভাবল। ভাবতে বাধ্য হল। অস্পস্ট স্বরে বলল
–সুদর্শন পুরুষ!

এমন আখ্যা দেয়ার কারণ বুঝে নিজেই থমকে গেলো। অচেনা মানুষকে প্রথমবার দেখেই কি সুদর্শন বলা চলে? সেই সাধারন বেশ ভুসার পুরুষের মাঝে কিছু তো একটা বিশেষ দিক ছিল যা সহজেই আকর্ষণ করার মতো। বাচ্চা ছেলেটিকে যখন কোলে তুলেছিল তখন তার সাদা দামী শার্টটা রক্তে মেখে গিয়েছিল। কিন্তু সেটার দিকে কোন খেয়াল ছিল না। বাচ্চার জীবন বাচানোই গুরুত্বপূর্ণ তখন। একজন অপরিচিত মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যার এতো মায়া তার ভালোবাসার গভীরতা না জানি কতটুকু। এমন সুন্দর চেহারার মানুষের প্রেমে তো যে কেউ পড়বে। কিন্তু সেই হবে ভাগ্যবতী যে তার মন জয় করে নিতে পারবে।

————
সেই ফটোকপির দোকানের পাশের চায়ের দোকানে বিস্তর আড্ডা। হাতে জ্বলন্ত নিকোটিনের সাথে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ। কয়েকজন ছেলে একবার নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ে তো আরেকবার গরম কাপে চুমুক দেয়। তাদের কথা বার্তা আর গানের সুরে সরব হয়ে উঠেছে এলাকা। ক্লাস শেষে শুভ্রা তনু আর কুমু সেদিক দিয়েই যাচ্ছিল। সেই চায়ের দোকানের কাছাকাছি আসতেই কেউ একজন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বাক্য ছুড়ে দিলো। যা যে কোন মেয়ের জন্য সহজেই বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। বাক্যটা কর্ণপাত হতেই থেমে গেলো কুমুর পা। সবাই সেটা শুনেছিল। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখায় নি কেউ। সবাই চুপ থাকলেও কুমু এসব কোনভাবেই সহ্য করে না। তাই না চাইতেও থেমে ঘাড় বেকিয়ে তাকাল। দু পাশের পাতান বেঞ্চে কয়েকজন ছেলে সারিবদ্ধ ভাবে বসে আছে। তার মধ্যে একজন ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা দেখা না গেলেও কুমু ধারনা করেই নিলো যে এই ছেলেই কিছুক্ষন আগে তাদের উদ্দেশ্যে সেই বাক্য বলেছে। তাই আর দেরি না করেই সেদিকে পা বাড়াতেই শুভ্রা ধরে ফেললো। অসহায়ের মতো বলল
–জাস না কুমু। বাদ দে। সিন ক্রিয়েট করিস না প্লিজ।

কুমু রাগটা শুভ্রার উপরে ঝেড়ে দিলো। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতেই শুভ্রা চুপ মেরে গেলো। কারণ এর পরে আর কোন কথা বলা চলে না। কুমু এগিয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল
–রাস্তায় মেয়েদেরকে এভাবে বিরক্ত করে কি মজা পান বলেন তো। আপনাদের মতো বখাটে ছেলেদের কারণে আমাদের মতো সাধারন ঘরের মেয়েরা রাস্তা ঘাটে বের হতে পারে না।

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল হিমেল। আপাদ মস্তক ভালভাবে দেখে নিয়ে ভীষণ ভদ্রভাবে বলল
–আমাকে বলছেন?

কুমু থমকাল। এটা তো সেই ছেলেটা যাকে সেদিন রাস্তায় দেখেছিলো। একেই তো সুদর্শন বলে আখ্যা দিয়েছিলো সে। এই ছেলে এমন কাজ করতে পারে সেটা ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। নিস্পলক সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই তনু এগিয়ে এসে তার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল
–তুই ভুল করছিস। ইনি কোন কথা বলেন নি।

আঙ্গুলের ইশারায় সামনের জন কে দেখিয়ে বলল
–উনি বলেছেন।

কুমু পলক ফেলে আঙ্গুল তাক করে সেদিকে তাকাল। ছেলেটি অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কুমু ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আবারো দৃষ্টি ফেরাল হিমেলের দিকে। সে ভ্রু জোড়ায় গভীর ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে কুমুর দিকে। কুমু একটা ঢোক গিলতেই হিমেল ভীষণ কঠিন গলায় বলল
–আপনার কেন মনে হল আমিই এমন করতে পারি? মানে এতজনের মাঝে থেকে আমাকেই বেছে নিলেন কেন? আমার চেহারা দেখে কি বখাটে মনে হয়?

কুমু লজ্জা পেলো। এর উত্তরে কি বলা উচিৎ ভেবে পেলো না। ভীষণ রকম অপরাধবধ নিয়ে বলল
–সরি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি কে বলেছিল। শুধু শুনতে পেয়েছিলাম। রাস্তায় চলার সময় পাশে থেকে এরকম অশোভন কথা বার্তা মোটেই ভালো লাগে না। একজন মেয়ে হিসেবে ভাবলে হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন আমার কথা। মেজাজটা তখনই খারাপ হয়ে গিয়েছিল আর হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।

হিমেল কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। কুমু দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। ভাবল এবার হয়তো হিমেল রাগ করবে। না জেনে কাউকে এভাবে অপবাদ দেয়া একদম উচিৎ না। সবাই এমন আচরন মেনে নিতে পারে না। চূড়ান্ত অপমান হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে হিমেল বলল
–ইটস ওকে। আপনার কোন ভুল নেই। রাস্তায় এরকম কোন কথা শুনতে কোন মেয়েরি ভালো লাগার কথা নয়। মেয়ে নাহলেও আমি বুঝি। এই ধররনের পরিস্থিতি মানসিক ভাবে কতোটা প্রভাব ফেলে। আমি কথা দিচ্ছি দ্বিতীয়বার আর এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। অন্তত এখানে উপস্থিত আমাদের কারো কাছ থেকেই না। আর রাজিবের হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

কুমু বিস্মিত হল। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। এই মানুষটার আবার নতুন একটা রুপ দেখার সৌভাগ্য হল তার। মানুষটা সত্যিই অনেক ভালো। এমন ভাবে তাকিয়ে থাকায় হিমেল একটু অসস্তিতে পড়ে গেলো। বলল
–আর কিছু বলবেন?

চমকে গেলো কুমু। হুশ ফিরতেই লজ্জায় জমে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–বলবো না।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here