মালিনী (পর্ব ২১ + ২২ + ২৩ +
নূর নাফিসা)
.
.আজও তার একই কান্ড! ফিরতে দেড়ি হবে তাই সকালেই গোসল করে বেরিয়েছে। ফিরেছে সন্ধ্যার পর। মলি তখন রান্না নিয়ে ব্যস্ত। রান্নাবান্না শেষ করে রুমে এলো ফরহাদকে খাওয়ার জন্য ডাকতে। ফরহাদ সোফায় বসে আছে মোবাইল হাতে নিয়ে। হাতমুখও ধোয়নি, পড়নের পোশাকাশাকও খোলেনি। মলি বললো,
– হাতমুখ ধুয়ে আসুন, খাবার দিচ্ছি।
– হাসব্যান্ড কাজ শেষে বাড়ি ফিরলে ওয়াইফকে তার সেবা যত্ন করতে হয় এটা জানা নেই?
ফরহাদের উক্তিতে মলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো! সেবাযত্নের কমতি রাখছে কোনদিকে সেটাই তো বুঝতে পারছে না! এখন তো খাওয়ার জন্য ডাকলো এটা কি সেবাযত্ন না! মাথায় ধরছে না কিছু! তাই সে প্রশ্ন করেই ফেললো,
– কেমন সেবাযত্ন?
– এদিকে এসো।
ফরহাদ তাকে কাছে ডেকে উঠে দাড়ালো। মলি ইতস্তত বোধ করে তার সামনে দাড়াতেই ফরহাদ বললো,
– শার্ট খুলো। আর সেগুলো আয়রন করে রেখেছো?
– হ্যাঁ।
“নতুন ঢং জেগেছে মনে, হুহ! এতো বড় ছেলের আবার শার্ট খুলে দেওয়ার জন্য বউকে প্রয়োজন!”
মনে মনে বকবক করতে করতে শার্ট খুলে নিলো মলি। ঘামের গন্ধ লেগে আছে তাই বাথরুমে চলে গেলো শার্ট নিয়ে। বালতিতে ভিজিয়ে রেখে আর বের হওয়ার সুযোগ নেই সেখান থেকে! ফরহাদ ঝর্ণার নিচে টেনে নিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে! মলি পুরোই “থ” হয়ে আছে! এই লোকটার কি আক্কেল বলতে কিছুই নেই! এতো রাতে এখন নিজে গোসল করছে আবার তাকেও ভিজিয়ে দিয়েছে! হাসের মতো জ্বালা উঠেছেই যখন নিজে ইচ্ছে মতো ভিজে নিতো! তাকে কেন ভিজিয়ে দিলো সেটাই মলির জেদ!
এভাবে তাকাতে দেখে ফরহাদ নিজের মাথায় শ্যাম্পু নিতে নিতে বললো,
– কি কাজের মানুষ! মাছ কুটতে গেলে মাছের গন্ধ লেগে থাকে, রান্না করতে গেলে হলুদ মরিচের গন্ধ লেগে থাকে! ছি! এসব নিয়ে বসবাস করা যায়!
মলির প্রচুর রাগ হচ্ছে কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে চুপচাপ বেরিয়ে আসতে লাগলে ফরহাদ তাকে টেনে নিয়ে শ্যাম্পুর ফেনা মেখে দিলো। মহাজালায় পড়ে মলি ফরহাদের সাথে সম্পূর্ণ গোসল সেড়ে তারপর বেরিয়েছে। দিনে দুইবার গোসল হচ্ছে তার! মাত্র ক’দিন আগে জ্বর থেকে মুক্তি পেয়েছে তাই ঠান্ডা লাগতে বেশি সময় নেয়নি! খাওয়ার সময় হাচি দিতে লাগলে ফরহাদ বললো,
“এটুকুতেই সর্দি! আমি তো দিনে দু-তিনবার গোসল করি, কই আমার তো কিছু হয়না!”
মলি কোন জবাব দিলো না। নিজে ঠেলে ঠেলে গোসল করায় আবার তার উপর সব দোষ ঢেলে দেয়!
[100%গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি,আমাদের পেজের সবগুলো গল্প আপনার ভালো লাগবে।প্লিজ লাইক & ফলো দিস পেইজ। https://www.facebook.com/SeraGolpo500/]
গতকাল না বুঝতে পারলেও আজ বুঝে গেছে ফরহাদ ইচ্ছে করেই তার শরীরে গন্ধের অজুহাতে তাকে নিয়ে গোসল করে! তাই সে পরবর্তী দিনে তার বিপরীতে পরিকল্পনা করে নিলো। দুপুরের দিকে রাতের রান্না শেষ করে তারপর গোসল সেড়ে নিলো। আজ আর বলতে পারবে না শরীরে মাছের আর হলুদ মরিচের গন্ধ লেগে আছে! মাথায় একটু বুদ্ধির বাতি জ্বালাতে পেরে খুব খুশি লাগছে মলির কাছে। কিন্তু আফসোস, ফরহাদ আজ বাইরে থেকে ফিরে দ্বিতীয়বার গোসল করেনি! কিন্তু ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে এসেছে! দুজন মানুষের জন্য একসাথে এতো বাজার আনার কি প্রয়োজন ছিলো! মলি সেসব গুছিয়ে রাখলো। ফরহাদ হাতমুখ ধুয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে ডাইনিং টেবিলের দিকে এলো।
” ভাইয়া, আমি নিজেই একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। ফারদিন ভাইয়া যেহেতু বলেছে আপনি উনাকে বলুন অন্যকোনো ব্যবস্থা করে দিতে। আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মতো এখন এতো টাকা নেই। না হলে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।”
মলি ধারনা করে নিলো ওই লোকটাই হবে হয়তো, যে কাল কল করে টাকা চেয়েছে। সে খাবার দিতে লাগলো প্লেটে। ফরহাদ কল কেটে খেতে খেতে বললো,
– কাল দুপুরে অফিসের দুতিনজন লোক আসবে বাসায়। রান্নাবান্না করে রেখো। আর না পারলে বলো আন্টিকে বলে দেখি আসবে কিনা।
– না, আমিই পারবো।
সকালে নাস্তা সেড়ে ফরহাদ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। মলি ঘুম থেকে উঠার পর অন্যান্য কাজ ঠিকই করেছে কিন্তু নিজের যত্ন একদমই নেয় না! প্রয়োজনীয় সব এনে দিয়েছে ফরহাদ কিন্তু তার বিন্দুমাত্র ব্যবহার হয়নি এখনো! ঘুম থেকে উঠে মাথাটা পর্যন্ত আঁচড়ে ঠিক করেনি! কোনোমতে খোপা বেধে নিয়েছে সে! তা দেখে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো ফরহাদের। সে নিজেকে তৈরি করে ড্রেসিং টেবিল থেকে একে একে সব জিনিসপত্র নিয়ে রুমের কোনে রাখা ঝুড়িতে ফেলতে লাগলো আর বলতে লাগলো, ” শুধু শুধু কোন পাগলের জন্য করি আমি এসব! মানুষের অভ্যাস যে সহজে পরিবর্তন হয়না সেটা তো আমার বুঝা উচিত ছিলো! কেউ যে বস্তি থেকে উঠে এসেছে সেই খেয়ালই নেই আমার! আমার ঘরে তো পেত্নীর বসবাস, সে বুঝবে কিভাবে মার্জিত ও সৌন্দর্যের মূল্য! এতোকিছু সাজিয়ে রেখে কি হবে যদি ব্যবহারই না হয়! কোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমার ঘরে থাকবে না। সেটার জায়গা হবে ময়লার ঝুড়িতে!”
মলি হতবাক হয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে ফরহাদের কর্মকান্ড! যে কি-না নিজে পাগল হয়ে গেছে সে আবার অন্যকে বলছে পাগল! যদিও এই পাগলটার যুক্তি আছে কিন্তু কে বলেছিলো তাকে এসব এনে দিতে!
“চুলের যত্নটাও নেয় না! পনেরো দিনে একবার শ্যাম্পু করলে করে আর চুল তো সর্বদা উষ্কখুষ্ক! নিজের রূপের কদর যদি নিজে না বুঝতে চায় তাহলে কার সাধ্য আছে তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার!”
কথাটা বলে চিরুনিটাও ঢিল মেরে ঝুড়িতে ফেললো। মলি চুপচাপ দাড়িয়ে আছে, বাধা দিচ্ছে না তার কাজকর্মে। ফরহাদ বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, “দুপুরে লোক আসবে সেটা যেন কেউ ভুলে না যায়! আর এই বেশটা যেন কাউকে না দেখায়! কাজকর্ম সেড়ে রুমেই যেন বন্দী থাকে!”
ফরহাদ বাইরে থেকে দরজা লক করে বেরিয়ে গেলো। মলি দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ঝুড়ি থেকে সব উঠিয়ে আবার ড্রেসিং টেবিলে গুছিয়ে রাখলো। বারোটার আগেই রান্নাবান্না শেষ করে গোসল করে নিলো। গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা পড়েছে আজ। অত:পর ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসেছে একটু সাজতে। ক্রিম, পাউডার, লোশনের ব্যবহার। সাথে চোখে কাজল টানা আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছে। হাতে পড়নের ইমিটেশনের চুড়ি জোড়ার সাথেই নীল কাচের চুড়ি পড়েছে৷ ফরহাদ তার নিজের পছন্দেই সব এনে দিয়েছে। গলায় ফরহাদের দেওয়া সেই প্রথম উপহারটা সবসময়ই থাকে। নিজের উপর নিজেই নজর দিচ্ছে মলি। আজ তাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। বারবার আয়নায় চোখ পড়ছে। চুলগুলো বাকা সিতি টেনে উন্মুক্ত করে রেখেছে।
এদিকে ফরহাদ বাসায় ফিরে দরজা খুললো ভয়ে ভয়ে। কেননা তাদের কোম্পানীর সহধর্মি কোম্পানির সিইও আর তার পিএর সাথে ফারদিনও চিটাগং এসেছে এবং তাদের সাথে এখন লাঞ্চের জন্য ফরহাদের বাড়িতে। ফারদিন আসবে সেটা তার জানা ছিলো না। আগে জানলে অন্য ব্যবস্থা নিতো। কিন্তু মেইন দরজা খুলে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ফরহাদ। কেননা মলি এদিকে নেই। হয়তো রুমে আছে। ফরহাদ তাদের ড্রয়িং রুমে বসিয়ে এলো। কিচেনে উঁকি দিয়ে দেখলো মলি সেখানে নেই। খাবারদাবার সব টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। ফরহাদ এবার রুমের দরজা ঠেলে উঁকি দিতেই দেখলো এক নীল পরি জানালার সামনে দাড়িয়ে আছে, আনমনে বাইরে তাকিয়ে! চেহারা দেখেনি তবে পেছন থেকে দেখেই তার মনে তীর বিদ্ধ হয়েছে! সে নিশব্দে আবার দরজাটা চাপিয়ে বাইরে থেকে লক করে দিলো। খাওয়াদাওয়া চললো সবার কিন্তু ফরহাদ খায়নি। সে জানালো পরে খাবে গোসল সেড়ে। তাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে সার্ভ করতে লাগলো খাবার। খাওয়া শেষ করে ফারদিনসহ বাকিরাও খুব প্রশংসা করলো রান্নার। ফরহাদ মনে মনে বললো, “দুনিয়ার কি নীতি ভাইয়া! একদিন যে হাত পুড়িয়ে দিয়েছিলে তোমরা আজ সে হাতের রান্না করা খাবার খেয়ে প্রশংসা করছো।”
অফিসের পিএ জিজ্ঞেস করতেই ফরহাদ জবাব দিয়েছে রান্নার জন্য রাধুনি রেখেছে সে ই রান্না করে গেছে। ফারদিন পকেট থেকে পাচশো টাকার নোট বের করে ফরহাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ফরহাদ, বকশিস স্বরূপ দিয়ে দিও এটা। রান্না খুব ভালো হয়েছে।
ফরহাদ ঠোঁটের কোনায় তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বললো,
– ভাইয়া, বকশিস নিজ হাতে দিতে হয়। অন্যের হাতে নয়।
– হুম, কিন্তু তোমার কুকারকে আবার কোথায় পাবো। সে কি আছে এখানে?
– না। দেখা যেহেতু পাওনি আপাতত তোমার কাছেই রেখে দাও। হয়তো তোমার বকশিস তার পাওনা না, সেজন্য দেখাও পেলে না। ইন ফিউচার দেখা পেলে তখন দিয়ে দিও।
– ওকে।
ফারদিন মুচকি হেসে টাকা আবার ওয়ালেটে রেখে দিলো। ফরহাদের ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখলো তারা। কিচেনটাও বাদ রাখেনি৷ বেডরুমের দরজার সামনে এসে দেখলো লক করা। ফরহাদকে খুলতে বললে ফরহাদ পকেটে হাত দিয়ে এমন ভাব করলো যেন চাবিটা খুজে পাচ্ছে না। অত:পর বললো,
– চাবিটা মনে হয় কিচেনে রেখেছিলাম তখন। এটা আমার বেডরুম, দেখার তেমন কিছু নেই।
– ওহ, ওকে।
তারা আবার ড্রয়িং রুমে এসে কিছুক্ষণ আলোচনা করে পরপর বেরিয়ে গেলো। তাদের বিদায় দিয়ে ফরহাদ ফ্ল্যাটে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো! মেইন দরজা লক করে তার রুমে এলো চুপিচুপি। মলি এখনো সেখানেই দাড়িয়ে আছে। ফরহাদ পেছন থেকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলো। মলি কেপে উঠেছে ঠিক কিন্তু একটুও ভয় পায়নি। কেননা সে জানে ফরহাদই তার উপর আক্রমণ করেছে। এখন রুমে ঢুকছে সেটা না জানলেও কিছুক্ষণ আগে শব্দ পেয়েই বুঝে গিয়েছিলো ফরহাদ বাসায় ফিরেছে। তাই ভয়টা তার মনে অনুপস্থিত ছিলো।
ফরহাদের দুহাত চলে গেছে শাড়ির নিচে আর নাক ডুবে গেছে খোলা চুলে। মাতাল সুবাসে যেন অন্যান্য খেয়াল হারিয়ে ফেলেছে সে। হাত একসময় শাড়ির কুচিতে চলে গেলে মলি বাধা দিলো! এবার হুশ এলো তার।
মলিকে ছেড়ে দিয়ে শার্ট নিজেই খুলে নিয়ে গোসল করতে চলে গেলো। মলি বুঝতে পেরেছে রাগ করেছে তবুও তার এটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে থালাবাটি ধুয়ে নিলো। ফরহাদ নিজেই নিজের জামাকাপড় ধুয়ে শুকাতে দিলো। মলি বসে আছে চেয়ারে। মানুষ কতোজন এসেছে! সে কি তাদের সাথে খেয়েছে নাকি বুঝতে পারছে না! গোসল হয়ে গেছে ভেবে রুমে এসে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করছে। মলি জিজ্ঞেস করলো,
– খাবেন না?
ফরহাদ কোনো জবাব দিলো না। মলি আবার বললো,
– আপনি কি খেয়েছেন তাদের সাথে?
এবারও কোনো জবাব নেই! মলি খাবারের বাটি টেবিল থেকে উঠিয়ে আবার কিচেনে নিয়ে যেতে লাগলো। ফরহাদ রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে এনে রাখা বাটিগুলো আবার টেবিলে নিয়ে এলো। মলি তার কাজ বন্ধ করে দাড়িয়ে দেখছে শুধু। ফরহাদ নিজের জন্য একটা প্লেট আবার ধুয়ে নিজ হাতে খাবার নিয়ে খেতে লাগলো। মলি মুচকি হেসে তার জন্য প্লেট নিয়ে খাবার নিলো। অল্প খেতেই আর গলা দিয়ে নামছে না। গা গুলিয়ে আসছে তার! লেবু চিপে নিলো বেশি করে তবুও যেন সম্ভব হচ্ছে না অথচ পেটে ক্ষুধা! অবশেষে খাবারের প্লেট নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিলো। পরে ইচ্ছে হলে খেয়ে নিবে। ফরহাদ লক্ষ্য করেছে কিন্তু কিছু বললো না। নিজের প্লেটের খাবার শেষ করে উঠে পড়লো। যে বাটিগুলো সে নিয়ে এসেছিলো সেগুলো সে যথাস্থানে রেখে এলো। বাকিগুলো টেবিলেই আছে। মলির খুব হাসি পাচ্ছে তার কান্ড দেখে তবুও সেটা গোপন রাখলো। বাকিগুলো সে নিজেই গুছিয়ে রাখলো। এবার খোপা খুলে রুমে এলো। ফরহাদ কাধে ফোন চেপে কারো সাথে কথা বলছে আর হাতে ওয়ালেটের টাকা গননা করছে। মলি এসে তার কাছে দাড়ালো ফরহাদ তাকালোও না তার দিকে। ফোনে কথা বলছে তাই কিছু বলতেও পারছে না মলি। অত:পর ফরহাদ কথা বলতে বলতেই বেরিয়ে গেলো। মলি একটা ভেঙচি কেটে বিড়বিড় করে বললো,
– হুহ্! ঢং! আমার দিকে দেখলে যেন উনার চোখে সমস্যা দেখা দিবে! লাগবে না কাউকে দেখা! আমাকে আমিই দেখতে পারি।
মলি আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখতে লাগলো। মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ভেতরে অশান্তি! নিজেকে নিজের কাছেই ভালো লাগছে না। আসরের আযান দিলে নামাজ পড়ে নিলো। একা একা সারাদিন ঘরে বসে থাকতে কি ভালো লাগে! অতি সামান্য বিষয় নিয়ে রেগে যায়! এমন কোনো কাজও নেই যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যাবে! মলি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কখন চোখ লেগে এসেছে খেয়ালই নেই! ঘুম ভাঙলো তার ফরহাদের বকবক শুনে!
“নামাজের তো কোনো খবর নেইই! সারাদিন শুধু ঘুম আর ঘুম! একসময় অসুস্থ হয়ে পড়বে তারপর হসপিটাল দৌড়াদৌড়ি! এটাই তো আমার চাকরি!”
মলি দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত ন’টা বাজতে চলেছে! এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে! মাগরিব ও ইশার আজানও শুনতে পায়নি! মলি ইশার নামাজটা আদায় করে নিলো। দুপুরের রান্না করা খাবারই প্রায় অনেকটা আছে। সেগুলোই গরম করে দিলো। দুজনে একসাথেই বসেছে খেতে কিন্তু মলির খাওয়া চলছে না। দুপুরে রেখে দেওয়া খাবার গুলোই জোর জবরদস্তি করে খেয়ে নিলো। কিছুক্ষন রুমের বাইরে হাটাহাটি করে রুমে এসে দেখলো ফরহাদ ফোন নিয়ে শুয়ে আছে খাটের মাঝামাঝি। মলিকে খাটের দিকে আসতে দেখে ফরহাদ বালিশ দুটো একত্রে নিয়ে মাথার নিচে দিলো আর হাত পা ছড়িয়ে পুরো খাট দখল করে নিলো। মলি ব্রু কুচকে তাকালো! এটা কোনো স্টাইল হলো! এভাবে কি কেউ ঘুমাতে পারে! সে শুবে কোথায়!
– এভাবে শুয়েছেন কেন! একপাশে চাপুন।
ফরহাদ কোনো জবাব দিলো না। মলি বিরক্তি নিয়ে সোফার দিকে যেতে নিয়ে আবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে এলো। চোখে আবার কাজল পড়লো আর ঠোঁটে লিপস্টিক। পরক্ষণেই খুলে রাখা চুড়িগুলো আবার পড়ে নিলো। তারপর খাটের পাশে এসে পাতলা কম্বলটা ছড়িয়ে ফরহাদের উপর দিতেই ফরহাদ পায়ের নিচে ফেলে দিলো। মলি বিছানায় একপাশে বসে ফরহাদের এক হাত টেনে আলগা করতে চেষ্টা করলো কিন্তু ফরহাদ ইচ্ছে করে বিছানার সাথে আরও চেপে রেখেছে। জোরাজোরি করে হার মেনে এবার তার হাতের উপর পিঠ আর পায়ের উপর পা রেখেই শুয়ে পড়লো মলি! ভয়ে আছে মলি! না জানি লাথি দিয়ে ফেলে দেয় খাট থেকে। তবে এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় পায়নি তাকে মানিয়ে নেওয়ার! ফরহাদ আস্তে আস্তে তার হাতটা সরিয়ে ফেলছে আর মলির ধুকপুক বেড়েই যাচ্ছে! পায়ের উপর পা দিয়েছে, না জানি মাইর লাগায়! সেদিন যেই থাপ্পড় লাগিয়েছিলো, মনে হলে এখনো মাথা ঘুরায়!
কিন্তু তার ঘটলো অন্যকিছু! ফরহাদ তার পা মলির পায়ের উপর তুলে তাকে আরও চাপিয়ে আনলো নিজের দিকে। মলি চোখ খুলে দেখলো ফরহাদের মুখ এখনো গম্ভীর! গম্ভীর মুখে মলির দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
– এতো সেজেছো কার জন্য?
মলি ব্রু কুচকে তাকালো! কার জন্য সেজেছে সে কি জানে না! তবুও জবাব দিলো,
– সেজেছি কোন একজনের জন্য।
– কোনো একজনটা কে? ওই কোম্পানির সিইও নাকি তার পিএ টা?
মলির খুব বিরক্ত লাগছে তার কথাবার্তা! সে কি চেনে এদের মধ্যে কাউকে! দেখেছে নাকি তাদের কখনো! এমন জিজ্ঞাসা কিভাবে করতে পারলো সে! যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তরে মলি বললো,
– ওই সিএও টা কি ফরসা ছিলো নাকি কালো ছিলো?
প্রতুত্তরে এমন জবাব পেয়ে ফরহাদের ব্রু কুচকে গেলো! মলি কিছুটা মজা পেয়ে আবার বললো,
– আর ওই পিএ টা কি লম্বা ছিলো নাকি খাটো ছিলো? হুম?
এবার ফরহাদ ফিক করে হেসে উঠলো সাথে সাথে মলির মুখেও ফুটে উঠেছে হাসি! ফরহাদ তার গলায় নাক ডুবিয়ে বলতে লাগলো,
– আজ ভাইয়াও এসেছিলো। রাধুনির হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করেছে আর বকশিস দিতে চেয়েছিলো।
– ফারদিন ভাইয়া?
– হুম।
– তারপর?
– তারপর রাখিনি সেটা, ফিরিয়ে দিয়েছি। সাথে বলে দিয়েছি, বকশিস নিজ হাতে দিতে হয়। অন্যের হাতে নয়।
মলি নিশব্দে হেসে উঠলো। ফরহাদ তার মাঝে হারিয়ে যেতে যেতে বললো,
“ভালোবাসি মলি। খুব ভালোবাসি!”
অবশেষে আজ মলি তার অনুভূতি গুলোর নাম জেনে গেছে। এর নাম তাহলে ভালোবাসা! সেই ভালোবাসার অনুভূতি উপভোগ করতে করতে এদিকে মলির মনের উক্তি, “বেশি ভালোবাসা দিতে গিয়ে যে আমাকে ব্যাথা দিচ্ছেন সে খেয়াল কি আছে আপনার! তবুও বাধা দিবো না আমি। আপনার বাধ্য আপনার মালিনী।”
“মালিনী”
পর্ব- ২২
(নূর নাফিসা)
.
.
আবহাওয়াটা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। গত দু’দিন বাদ গেলেও আজকে ফরহাদের হাবভাব ভালো লাগছে না মলির কাছে! যদিও সে আগে থেকেই সাবধান, কেননা আজ সকালে ফরহাদ গোসল করে অফিসে যায়নি। তার মানে ফিরে এসে গোসল করবেই সেটা মলি নিশ্চিত! তাই সকল কাজকর্ম সেড়ে গোসল করে বসে আছে। ফরহাদ ফিরেছে বিকেলে। মলিকে এনে সে সামনে দাড় করালো শার্ট খুলে দেওয়ার জন্য। মলি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
– আমার শরীরে কিন্তু কোনো কিছুর গন্ধ লেগে নেই আজ। আমি সব কাজ সেড়ে গোসল করেছি।
– আচ্ছা! আমার শরীরে ঘামের গন্ধ আছে?
– আমার শরীরে ঘামের গন্ধও নেই।
– আমি আমার শরীরের কথা জিজ্ঞেস করেছি।
– হ্যাঁ, ঘেমে তো শার্টই ভিজে আছে।
মলি শার্ট খুলে নিতেই ফরহাদ তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। এরপর কানের কাছে মুখে এনে বললো,
– এই শরীরটাতেও এখন ঘাম লেগে গন্ধ ছড়িয়েছে। যা দূর করার একমাত্র উপায় গোসল! হয় গোসল করতে যাবে আর না হয় ফ্ল্যাটের বাইরে! গোসল ছাড়া আমার সাথে ঘরে জায়গা হবে না বলে দিলাম।
ফরহাদ তাকে ছেড়ে দিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে লাগলো। মলি অসহায় ভঙ্গিতে বললো,
– আমি কিছুক্ষণ আগে মাত্র গোসল করেছি!
ফরহাদ তার পথে যেতে যেতে বললো,
– এক কথা বারবার বলতে পছন্দ করিনা। জামাকাপড় আর তোয়ালে নিয়ে এসো।
ফরহাদ চলে গেলো বাথরুমে। আর মলি নিজের কপাল চাপড়ে বললো, “মানুষ এতো গোসলের পাগল হয় কিভাবে! ওফ্ফ মলি, কেন করতে গেলি শুধু শুধু গোসল! বিপদ সংকেত তো তোর আগেই জানা ছিলো! নিয়মমাফিক আর কিছু থাকুক আর না থাকুক! প্রতিদিন দু-তিনবার গোসল নির্ধারিত তোর কপালে!”
বাধ্য হয়ে আবারও গোসল করতেই হলো! শুধু গোসলই নয়, দুপুরে খাবার খাওয়া সত্ত্বেও এখন ফরহাদের সাথে আবার খেতেও হলো! সবকিছু গুছিয়ে রুমে এসে দেখলো ফরহাদ কারো সাথে কথা বলছে। আর ওপাশের ব্যক্তিটা যে ফাহিমা আন্টি সেটাও বুঝতে বাকি নেই! কেননা ফরহাদ বলছে,
” মা, আমি নিজেকে মানুষ বলে দাবি করি। আর তোমাদের বাড়িতে কিছু মানুষরূপী জানোয়ার বসবাস করে। যেখানে একটাও জানোয়ার আছে সেখান আমি থাকতে পারবো না। তার চেয়ে ভালো দূরেই পড়ে থাকি। আমার একার জন্য তো কারো কিছু যায় আসে না! তোমাকেও সেখানে রাখতে ভয় হয় আমার। ইচ্ছে করে আমার কাছেই নিয়ে আসি। আজ কাজের লোকের উপর তারা আক্রমণ করেছে, বলা তো যায় না আবার তোমার উপর কখন আক্রমণ করে বসে!”
ওপাশে কি বলছে সেটা মলির অজানা কিন্তু এপাশেরটা ঠিকই শুনতে পারছে।
” না, কাউকে কিছু আর জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না। আর জানিয়ে কি হবে। বাদ দাও, যে যেভাবে চলতে চায় চলুক। আমিও আমার মতোই চলি। শুধু নিজের খেয়ালটা রেখো তুমি। না, আমি আর আসছি না।”
ফরহাদ কথা শেষ করে কল কেটে দিলো। ফাহিমা আন্টি নিশ্চয়ই তাকে ওবাড়িতে যাওয়ার জন্য বলছে আর সে মলির জন্য যাচ্ছে না এটাই মলির বিশ্বাস! সে ধীর গতিতে কদম ফেলে জানালার দিকে এগিয়ে ফরহাদের কাছে এসে দাড়ালো। ফরহাদ তাকে দেখে ডান হাতটা ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো অত:পর হাতে একটু ঠোঁটের ছোয়া দিলো। মলি চোখ বন্ধ করে স্পর্শটা অনুভব করলো। অতপর বললো,
– আন্টি বাসায় যাওয়ার জন্য বলছিলো না? ঘুরে আসুন গিয়ে। ভালো লাগবে।
– পরামর্শ চাইনি কারো কাছে।
– পরামর্শ না, কিন্তু আন্টির দিকটা একটু বুঝে উঠুন। আপনি তো জেদ নিয়ে বসে আছেন কিন্তু আন্টি তো মা। সন্তানের জন্য মায়ের মন সর্বদাই ছটফট করে। সেটা আন্টির কাছে থেকেই জেনেছি। আপনি ওবাড়িতে গেলে আন্টি খুব হাসিখুশি থাকে। আবার যখন চলে আসেন কেমন যেন মনমরা হয়ে যান তিনি। দেখেছি আমি সেটা।
ফরহাদ তার প্রতুত্তর না করে মলিকে বাইরের দিকে ঘুরিয়ে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। মলি আবারও বললো,
– যান, কিছুদিন কাটিয়ে আসুন আন্টির কাছে।
– সব ঢাকা যাওয়ার ফন্দি, বুঝি না আমি! কখনো নিয়ে যাবো না।
– উহুম, যাবো না আমি। আপনাকেই বলছি যেতে।
– একা থাকতে পারবে এখানে?
– হুম, পারবো।
আরও কিছুক্ষণ সময় কাটলো তাদের জানালার ধারে। নিরবে অনুভব করছিলো একে অপরকে। আজ কোনো একপাক্ষিক অনুভূতি কাজ করছে না তাদের মাঝে। আজ দুজনের দুটি মন একত্রিত হয়ে নতুন অনুভূতির জন্ম নিয়েছে। যার না আছে কোনো আকার, বর্ন, স্বাদ! আছে শুধুই অনুভব আর অনুভব!
পরদিন মলির কাছে তার এক ফোন দিয়ে নতুন সিম এক্টিভ করে দিলো। দুপুরের দিকে বেরিয়ে গেলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। ফরহাদ ট্রেনে সময় নষ্ট না করে বিমানেই চলে গেছে। মন তার পড়ে আছে চিটাগংই। তবুও মায়ের টানে আসতে হয়েছে তাকে। কেননা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আপন মা। জেদ ছিলো বাকিদের উপর কিন্তু মায়ের মমতার টানে তার মনও আকুপাকু করে ছুটে আসার জন্য। যার ফলে কাজের ফাকে ফাকেই চলে আসতো মায়ের সাথে দেখা করতে। কিন্তু গতদিন গুলোতে মন চাইলেও মলিকে একা রেখে আসার সাহস হয়নি। আর আজ মলির সাহস যুগিয়ে দেওয়ায় আসতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু মন যে পড়ে আছে সেদিকে।
দিনটা একা কাটাতে পারলেও রাতে মলির কিছুটা ভয় লাগছে। ফরহাদ সবদিক থেকে সাবধান করে দিয়ে গেছে তাকে। সন্ধ্যায় কল করে বললো তারাতাড়ি খেয়ে নিতে। মলি তাই করলো। তারপর ঘুমিয়ে থাকতে বললো, মলি তাই করলো। শুয়েছে কিন্তু ঘুম আসছে না তার! ফরহাদ আবার তাকে কল করে জাগ্রতই পেলো। এটা সেটা জিজ্ঞেস করে রেখে দিলো। ওদিকে তার ঘুমানোর সময় হয়ে এলে সে ভিডিও কল করলো। কথা তেমন বলেনি, নিরবে সময় কাটলেও মলির চোখে ঘুম নেমে আসা পর্যন্ত কল করে এক্টিভ ছিলো ফরহাদ।
পরদিন সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফরহাদ চিটাগং হাজির! ফ্ল্যাটে প্রবেশের আগে কল করে বলে নিলো, “আমি এসে পড়েছি। ভয় পেও না আবার।” মলি আর কিছু বলার সু্যোগ পেলো না। কল কেটে দেওয়ার দু মিনিট পরই দরজা খোলার শব্দ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো ফরহাদ এসে গেছে। তাহলে সে বাসার নিচ তলায় থেকেই কল করেছে! মলি জিজ্ঞেস করলো,
– এতো তারাতাড়ি ফিরে এলেন যে! আরও দুতিন দিন কাটাতে পারতেন সেখানে।
– আমার কাজকর্ম তো বসে বসে তুমি সম্পাদন করছিলে তাই না? মায়ের সাথে দেখা করার ইচ্ছে ছিলো তাই করে এলাম। তাছাড়া একমুহূর্তও কাটানোর ইচ্ছে নেই ওবাড়িতে।
কথা বলতে বলতে ফরহাদ রুমে এসে ল্যাপটপটা খাটে রেখে নিজেই তোয়ালে আর একটা প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। মলি ল্যাপটপটা ট্রলিতে তুলে রাখলো। অতিরিক্ত জামাকাপড় কিছুই নিয়ে যায়নি ফরহাদ। একদিনের জন্য যাবে বলেই হয়তো! তাছাড়া সেখানে তো আছেই।
মলি রান্না বসিয়েছিলো তাই কিচেনে চলে গেলো। গতকাল দুপুরে যে রান্না করেছে সেটাতেই কালসহ আজ চলে গেছে তার। তাই এখন আবার বসিয়েছিলো। রান্না শেষ হতেই রুমে এসে দেখলো ফরহাদ মাথার উপর বালিশ রেখে বুকে ভর করে শুয়ে আছে। মলি কাছে এসে বললো,
– খাবার এনে দিব?
ফরহাদ বালিশের নিচে মাথা রেখেই জবাব দিলো, “না।” মলি আবার বললো,
– এভাবে শুয়ে আছেন কেন? খারাপ লাগছে?
ফরহাদ কিছু না বলে বালিশটা সরিয়ে হাত বাড়িয়ে মলিকে টেনে বসিয়ে দিলো খাটে। তারপর মলির কোলে মাথা রেখে মলির হাত টেনে তার চুলে এনে রাখলো। মলি মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে চুল টানতে টানতে বললো,
– মাথা কি ব্যথা করছে?
ফরহাদ চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিলো,
– হুম।
মলি আস্তে করে তার মাথাটা সরিয়ে খাটে নামালো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে তেল নিয়ে আবার খাটে এসে মাথা কোলে নিয়ে তেল মালিশ করতে লাগলো। ফরহাদ এতোক্ষণ চুপচাপই ছিলো। তেলের গন্ধ পেয়ে প্রায় আধঘন্টা পর সে মাথায় হাত দিয়ে কেমন আঠা অনুভব করলো। চোখ খুলে এবার মলির দিকে তাকিয়ে বললো,
– এসব কি?
মলি কিছু জবাব দেওয়ার আগেই ফরহাদ দ্রুত উঠে বিছানা ছেড়ে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে এলো। মাথা তার তেলে ডুবুডুবু হয়ে আছে! মলির দিকে ঘুরে কোমড়ে হাত রেখে বললো,
– এগুলো কি করেছো! সকাল হতেই অফিসের কাজে ছুটতে হবে আর তুমি মেয়েদের মাথার তেল এনে আমার মাথায় ঢেলেছো! এ অবস্থায় অফিস যাবো আমি!
মলি ভয়ে ভয়ে বললো,
– আপনার মাথা ব্যথা করছে বলেই তো দিলাম। এতে মাথা ব্যথা কমে যাবে। তাছাড়া সকালে মাথায় শ্যাম্পু করে নিলেই তো হবে।
ফরহাদ বিরক্তির সাথে টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে মাথায় ঘষতে লাগলো তেল কমানোর জন্য। তারপর মলির উদ্দেশ্যে বললো,
– খাবার দাও, আমি আসছি।
মলি চলে গেলো খাবার দিতে। ফরহাদ হাতে নিজের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে টেবিলের কাছে এলো। হাত ধুয়ে খেতে বসে লক্ষ্য করলো মলি প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করছে। তাই সে জিজ্ঞেস করলো,
– সারাদিনে বমি করেছো কতবার?
এমন প্রশ্নের জবাব দিতে মলি একটু ইতস্তত বোধ করলো। তবুও বললো,
– দুইবার।
– কনুই লাল হয়ে আছে কেন?
মলি তার কনুই চেক করে দেখলো সত্যিই লাল হয়ে আছে! এতো কিছু খেয়াল করে কেন লোকটা! মলির উত্তর না পেয়ে ফরহাদ আবার বললো,
– মাথা ঘুরে পড়ে গেছো?
– না। মাথা চক্কর দিয়েছিলো, তখন দেয়ালে ধাক্কা লেগেছে কনুই।
– ডাক্তারের কাছে যাবো কাল দুপুরে। তৈরি হয়ে থেকো।
মলি আর কিছু বললো না। দুজনেই চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো। সকালে কিচেনে যাওয়ার আগে মলিকে বাথরুমে নিয়ে গেলো শ্যাম্পু করে তেল সরানোর জন্য! ফরহাদ টুলে বসে আছে আর মলি তার মনে এক বালতি জেদ রেখে ফরহাদের মাথায় শ্যাম্পু নিয়ে ইচ্ছে মতো ঘষামাজা করে তেল উঠাচ্ছে! এতেই শুধু রক্ষা নেই! তাকেও এই সকাল সকাল গোসল সেড়ে বের হতে হলো। পরে রান্নাবান্না!
দুপুরের শেষ সময়ে ফরহাদ বাসায় ফিরে লাঞ্চ সেড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এলো মলিকে। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করলো। এবং জানালো রিপোর্ট কাল দিবে। পরদিন সকালে হালকা নাস্তা করেই বেরিয়ে গেলো ফরহাদ হসপিটালের উদ্দেশ্যে। মলি গতকাল থেকেই চিন্তায় আছে রিপোর্ট নিয়ে! কি আসে রিপোর্টে কে জানে! সময় অতিবাহিত হচ্ছে আর চিন্তাও বেড়ে যাচ্ছে তার! সকল কাজেই হয়ে আছে অন্যমনস্ক! কিছুক্ষণ পরেই ফরহাদ বাসায় ফিরলো। মলি রুমেই ছিলো। ফরহাদের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছে না মলি! মলিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফরহাদ রিপোর্টটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। মলি বের করে দেখলো প্রেগ্ন্যাসি রিপোর্টটা। একটু আধটু পড়ে বুঝে নিলো পজেটিভ রেজাল্ট! কেন জানি মলির হাত কাপছে আর চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। তার প্রতিক্রিয়া এখন কেমন হওয়া উচিত সে নিজেই জানে না। তাই সে ছলছল চোখে ফরহাদের দিকে তাকালো ফরহাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। ফরহাদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে চিরুনি নিয়ে মাথাটা আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো,
– এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে কি হলো?
মলি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে! অশ্রু ঝরার গতি এবার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে! অতি কষ্টে মুখ থেকেও বিড়বিড় করে বেরিয়ে এলো কিছু শব্দ!
” ছি! কিভাবে কি হলো এটা কি উনার অজানা! কি করে বলতে পারলো এটা! বিয়ের যে তিনমাস হয়ে গেছে এটা কি তিনি জানেন না! বিয়ের দিন থেকে রাতদিনগুলো কিভাবে কেটেছে এসব কি অজানা! চারদেয়ালে বন্দি থাকার পরও কিভাবে দিতে পারলো আমার উপর এতো বড় অপবাদ! এতো অবিশ্বাস নিয়ে কি কারো সাথে সংসার করা যায়! এজন্যইতো বিচ্ছেদ ঘটে পরিবারের! থাকবো না আমি এখানে! একটুও থাকতে পারবো না আর! এতোসব সহ্য হয় না আমার!”
সে কি বুঝিয়েছে আর মলি কি বুঝে নিয়েছে! তার মুখে এসব শুনে ফরহাদ রেগে মেঝেতে চিরুনিটা আছাড় মেরে বললো,
– যা চলে যা। থাকতে হবে না তোর। যেখানে ইচ্ছে চলে যা। তবে আমার সন্তান নিয়ে যেতে পারবি না। আমার সন্তান আমার কাছে রেখে যা। কোনো কথার মর্মার্থ না বুঝে সবসময় অতিরিক্ত দু’লাইন বেশি বুঝে থাকে!
“আমার সন্তান” কথাটা শুনতে ভালো লাগলেও মনটা শান্ত হয়নি মলির। নিজ হাতে মুখ চেপে কান্না করছে সে! সে তো ফরহাদের মনমতোই চলতে চেষ্টা করছে। তবুও এতোটা যন্ত্রণা কেন দেয় তাকে! কখনো প্রেম কখনো কটু কথা, এটা কেমন ভালোবাসা!
ফরহাদ এখন নিজেও বুঝতে পারছে তার কথার ধরনটা হয়তো ঠিক ছিলো না। মলি হয়তো তার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ খুশিটা প্রকাশিত হওয়ার প্রত্যাশায় ছিলো! ফরহাদ নিজেকে শান্ত করে একটা নিশ্বাস ফেলে চিরুনিটা মেঝে থেকে তুলে ড্রেসিং টেবিলে রাখলো। অত:পর মলির কাছে এসে পেটে দুহাত রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো এবং কানে কানে বললো,
– কেউ যেন ভুলে না যায়, এখানে আমার বাচ্চাটা আছে। এতো বেশি কাদলে বাচ্চাটা শুধু কাদতেই শিখবে।
মলি ফরহাদের হাত ছাড়িয়ে পেছনে ঘুরে ফরহাদকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললো,
– এমন কেন আপনি! সবসময় এভাবে কথা বলেন কেন! কষ্ট লাগে না আমার!
কথা বলার পরপরই মলির কান্নার বেগ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে! ফরহাদ তাকে দু’হাতের বন্ধনে বেধে রেখেছে। বাধা দিচ্ছে না কাদতে। কাদলে মন হালকা হবে। কয়েক মিনিট কেটে গেলো কিন্তু তার কান্না যে আর থামছে না! ফরহাদ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললো,
– হয়েছে আর আজ অফিস যাওয়া!
কথাটা বলার পরপরই কোন ডায়াল ছাড়াই ফোন কানে দিয়ে বলতে লাগলো,
“জ্বি, আমি আজ অফিস আসছি না। কেউ কান্না করতে করতে আমাকে গোসল করিয়ে দিয়েছে। আপাতত অর্ধেক পানিতে নেমে আছি । একটু পর মাথাসহ ডুবে যাবো।”
মলি তার কথা শুনে তাকে ছেড়ে দাড়ালো। ফরহাদের শার্টের পানি হাতে মুছে নিজের চোখের পানি মুছতে গেলে ফরহাদ তাকে টেনে কাছে আনলো। এবং গাল বেয়ে পড়া পানি ঠোঁটে মুছে নিলো। মলি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখের পানি যেন আরও পাল্লা দিয়ে পতিত হচ্ছে! তা দেখে ফরহাদ ব্রু নাচিয়ে বললো,
– এতো লোভ কেন? আমার ওষ্ঠ কি স্পঞ্জ নাকি যে পানি পড়বে আর শুষে নিবে!
মলির মুখে ফুটে উঠলো লজ্জাময়ী হাসি! সে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে হাতে মুছে নিলো চোখের পানি কিন্তু ফরহাদের কাছ থেকে ছাড়া পায়নি এখনো। তাই বললো,
– আপনার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে না! অফিস যান।
– সে আর যাচ্ছি নাকি! এতোক্ষণ আটকে রেখে এখন অফিস যান!
– আমি কাউকে আটকে রাখিনি। আপনি অফিস যান।
– কিসের আচার আনতে হবে?
মলির দৃষ্টি নিচের দিকে আছে। হঠাৎ তার এমন কথায় মুখে লজ্জাময়ী হাসি নিয়ে বললো,
– লাগবে না কিছু।
– তেতুল নাকি আমের আচার?
– বললাম তো, কিছু লাগবে না।
– তাহলে কি জলপাইয়ের? নাকি চালতার?
মলির হাসি আরও বেড়ে গেলো। এবার সে ছাড়া পেতে বলে দিলো,
– তেতুলের।
– সাবধানে থেকো।
ফরহাদ তার ঠোঁটে আলতো স্পর্শ করে বেরিয়ে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে।
“মালিনী”
পর্ব- ২৩
(নূর নাফিসা)
.
.
ফরহাদ চলে যাওয়ার পরেও মলি কেদেছে। কেন কেদেছে সে জানে না। তবে এটা জানে তার মনে তখন কোনো কষ্ট ছিলো না। ভেবেছে শুধু অতি শীঘ্রই সে মায়ের আসনে বসতে চলেছে। মাতৃত্বের পূর্নাঙ্গ স্বাদ তার মনে আজ জাগ্রত হয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে, একটা মানুষের মধ্যে আরেকটা মানুষের বসবাস! স্থায়ী হবে সেটা দীর্ঘদিন। প্রায় নয় থেকে দশ মাস! মহান আল্লাহ তায়ালার অপরূপ চমকপ্রদ! কিভাবে সৃষ্টি করে দিয়েছেন প্রকৃতির নিয়মনীতি! একটা সত্তার ভেতর জন্ম নেয় দ্বিতীয় সত্তা! তাও আবার স্ত্রী-পুরুষ ভেদে সুশৃঙ্খলভাবে! আজ ভিন্ন অনুভূতি সাড়া দিচ্ছে তার মনে! খুব আনন্দিত হয়ে ভিন্নভাবে অনুভব করছে তার মধ্যে অবস্থিত সত্তাকে! ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেলো তার নিজের মায়ের কথা। তার মা ও তো তাকে নিয়ে এ অবস্থায় ছিলো কোনো এক সময়। তিনিও নিশ্চয়ই তখন এমন অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছেন! মলি ফোন নিয়ে ভাবি নীলিমার কাছে কল করলো। বেশ কিছুক্ষণ ভাবি ও মায়ের সাথে কথা বললো। তাদের জানিয়ে দিলো তার অবস্থার কথা। অত:পর বাবার সাথেও একটু কথা বলে কল কেটে দিলো।
দুপুরের পরে ফরহাদ বাসায় ফিরেছে সাথে তেতুল, চালতা আর জলপাইয়ের আচার নিয়ে। মলি রুমেই কাপড়চোপড় গোছাচ্ছিল। ফরহাদ তার হাতে আচারের বক্সের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– বাবু কি করে?
তার এমন জিজ্ঞাসায় মলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো! এমন ভাব নিচ্ছে যেন তার দু/এক বছরের বাচ্চা আছে! ফরহাদ উত্তরের আশায় না থেকে আবার মলির হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খাটে রেখে দিলো। অত:পর মলিকে কাছে টেনে দুহাত মলির পেছনে রেখে ঘড়ি খুলতে লাগলো। প্রত্যক্ষ সিগনাল না দিলেও মলি তার সিগনাল বুঝে গেছে। তাই শার্টের বোতামগুলো একে একে খুলে শার্ট খুলে নিলো। ফরহাদ বললো,
– গোসল করোনি কেন?
– করে কি হবে শুধু শুধু! সেই তো আবার করতেই হবে।
ফরহাদ আর কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলো। দুজনের গোসল শেষ হলে খাওয়াদাওয়াও একসাথে হলো। রাতে ফরহাদ ইউটিউবে প্রেগ্ন্যাসির সময়ের সাবধানতার কিছু নিয়মনীতি বের করে মলির হাতে ফোন দিলো। যাতে মলি শুনে আর মেনে সাবধান থাকে। সে পাশে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছে আর মলি শুনছে। একসময় তাদের কানে ভেসে এলো “পানির কাজে লেগে থেকে মায়ের সর্দি যাতে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এতে বাচ্চার ক্ষতি হবে।”
কথাটা শুনে ফরহাদ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে মলির দিকে তাকালো। মলি ইচ্ছে করে আবার পেছনে টেনে কথাটা আবার শুনলো। সেটা কেবল ফরহাদকে শুনানোর জন্যই। ফরহাদ কিছু বললো না। তার নিজের কাজ করতে লাগলো। মলি অপ্রকাশ্য হাসলো।
পরদিন আর তাকে নিয়ে গোসল করেনি। মলি ভেবে নিলো বাচ্চার জন্য নকশিকাঁথা তৈরি করবে। তার জন্য তো কাপড়, সুচ, সুতা ও ফ্রেম লাগবে! তাই ফরহাদ অফিস যাওয়ার সময় নিচু স্বরে বললো,
– সময় করে একবার আমাকে শপিংমলে নিয়ে যেতে পারবেন?
– কেন?
– কিছু কেনার প্রয়োজন ছিলো।
ফরহাদ তার ল্যাপটপ গুছিয়ে মলির হাতে এনে একটা কলম ও কাগজ ধরিয়ে দিলো। মলি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে! এখানে এনে যে বন্দী করেছে, একদিন তো বেড়াতে নিয়ে যায়ইনি! প্রয়োজন থাকায় আজ প্রথম বললো, তাও এনে কাগজ ধরিয়ে দিলো হাতে!
এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফরহাদ কাগজ কলম নিয়ে বললো,
– ওহ, আমি তো ভুলেই গিয়েছি। পড়ালেখার যে ঘোড়ার ডিম জানে! নামেমাত্র এইচএসসি পাস! পাস করেছে না ফেইল করেছে কে জানে! নাও রেকর্ড করো। বলতে তো পারো নিশ্চয়ই!
ফরহাদ ফোন এগিয়ে দিলো তার দিকে। তা দেখে মলি বিরক্তি নিয়ে আবার কাগজ কলম হাতে নিয়ে লিখতে থাকলো আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
– হুহ্! পড়ালেখা যেন শুধু উনিই জানে! পাস করেছি না ফেইল করেছি রেজাল্ট ঘেটে দেখে আসুক!
– আচ্ছা! কি গ্রেট যেন ছিলো রেজাল্ট?
– বি গ্রেট।
– বাহ! খুব ভালো রেজাল্ট! অন্যের টা দেখে দেখে কপি করেছে আর খাতায় পেস্ট করে দিয়েছে। বি ছাড়া আর হবেই বা কি! এটাই অনেক হয়ে গেছে!
– কারোটা দেখে লিখিনি। টুকটাক সবাই জিজ্ঞেস করে সেটা আপনিও করেছেন পরিক্ষার হলে । আর আমি কোনো কোচিং করিনি আপনাদের মতো। নিজে নিজে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি। যতটুকু হয়েছে সেটাই অনেক। আমার জায়গায় থাকলে আপনি সেটাও পারতেন না। আসছে আবার অহংকার দেখাতে! হুহ্!
ফরহাদ আরও কিছু বলতো কিন্তু মলির হাতের লেখা দেখে চুপসে গেছে। অনেক ভালো না হলেও ভালোর কাতারেই পড়ে। যাকে বলা যায় মধ্যবিত্ত ভালো! কিন্তু সেদিন কাজী অফিসে যে সিগনেচার দিয়েছে! সেটা দেখে যে কেউ বলবে সে প্রাথমিক শিক্ষাও শেষ করেনি! মলি লিখে দিতেই ফরহাদ চুপচাপ সেটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো কিন্তু তাকে সতর্কবার্তা দিতে ভুলেনি। সবদিক থেকে সাবধানে থাকতে বলেছে। আর কাজকর্মে কম এগোতে বলেছে। ফরহাদ বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মলিকে কল করলো।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই তুমি কি নকশিকাঁথা বানাবে?
– এতোক্ষণে বুঝেছেন!
– কাথা বানিয়ে বেচে উপার্জনের প্ল্যান করছো না তো!
মলি মজা পেলো তার কথায়! তাই বললো,
– আপনি যদি নিয়ে বেচে দিতে পারেন তাহলে আমি বানিয়ে দিবো।
– হোয়াট! তাহলে আর আনছি না কিছু।
– আরে! আমি বাচ্চার জন্য তেরি করতে চাচ্ছিলাম। এখন না আনলে আর কি করার!
– অহ! ওকে।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো কিন্তু ইউটিউবে ডাক্তারের পরামর্শ শুনার পর থেকে সে দ্বিতীয়বার গোসল করলেও মলিকে সাথে নেয় না। শীতকাল এগিয়ে আসছে আর আবহাওয়ায় ঠান্ডাও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে তাই তারও এখন দিনে একবার গোসল। অতি প্রয়োজনে দুবার চলে।
আজ মলি সকালের জন্য হালকা নাস্তা তৈরি করেছে। যার ফলে কিচেনের কাজ তারাতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। রুমে এসে দেখলো ফরহাদ মাত্র বাথরুমে ঢুকেছে। অনেকদিন হলো তার সাথে গোসল চলে না। তাই আজ ভাবলো তার সাথেই করা যাক। বাথরুমের দরজা খোলাই ছিলো। মলি তার কাপড়চোপড় নিয়ে ঢুকে পড়লো। ফরহাদ ঝর্ণার নিচে দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখে বললো,
– এখন কেন?
– ইচ্ছে হলো, তাই এলাম।
মলি কাপড়চোপড় রাখতেই ফরহাদ হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
– হঠাৎ এমন ইচ্ছে কেন হলো! আমি কিন্তু ডাকিনি! বাচ্চার ক্ষতি হলে খবর আছে তোমার।
– দুবার তো আর করবো না। এখনই করবো শুধু।
– তাহলে তো প্রতিদিন এ সময়েই করা যায়। দিনে একবার। রান্না দ্রুত শেষ করে নিবে।
মলি মনে মনে বললো, “এবার হয়েছে মহাজ্বালা! একবার ইচ্ছে হলো তাই এলাম আর এখন না হলেও প্রতিদিনই ইচ্ছে হতে হবে! আগে জানলে আসতাম নাকি!”
অনেকদিন পর একসাথে গোসল হলো কিন্তু সময়টা ফরহাদ কমিয়ে এনেছে। নাস্তাও একসাথেই করলো দুজন। মলির যত্নে কোনো কমতি রাখছে না ফরহাদ। শুধু বাচ্চার জন্য নয়। মলিকে এখানে নিয়ে আসার পর থেকেই তার খাওয়াদাওয়া, পোশাকাশাকসহ যাবতীয় দিক থেকে যত্ন নিচ্ছে। মলির সবকিছু যেন নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসারে চলে। ফরহাদ নাস্তা করে বেরিয়ে গেছে অফিসের জন্য আর এদিকে মলি রাতের টা সহ দুপুরের রান্না বসিয়েছে। ঘন্টাখানেক সময় পাড় হতেই ফরহাদ বাসায় হাজির! দ্রুত পায়ে এসে কিচেনের দরজার সামনে দাড়ালো। এসময় ফরহাদকে বাসায় দেখে মলি অবাক হলো তাও আবার এভাবে এসে থমকে দাড়িয়েছে! তার চেহারা কেমন যেন দেখাচ্ছে। তাই মলি জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে? বাসায় ফিরে এলেন যে!
– না, কিছুনা।
ফরহাদ আবার রুমে ফিরে এলো। মলি তার আচরণ বুঝতে পারছে না। কিছু তো হয়েছে নিশ্চয়ই! মলি চুলার আগুন একটু কমিয়ে রেখে রুমে এসে দেখলো ফরহাদ দুহাত মুঠোয় রেখে খাটে বসে কিছু ভাবছে। মলি বললো,
– আপনার কি শরীর খারাপ?
– না।
– অফিসে যাবেন না?
– না। রান্না শেষ হয়েছে?
– একটু বাকি আছে। ক্ষুধা লেগেছে? রুটি আছে, দিবো?
– না। রান্না শেষ করো, যাও।
মলি আবার চলে এলো কিচেনে।
ফরহাদ রুমে পায়চারি করছে আর কিছু ভাবছে। ভাবনার যেন শেষ হচ্ছে না তার! কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না! পাচ সাত মিনিট অতিবাহিত হতেই আবার এসে দাড়ালো কিচেনের দরজার সামনে। মলির দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
– ঢাকা যাবে?
ঢাকার কথা শুনে মলি একটু বেশিই অবাক হলো! আজ হঠাৎ ঢাকার কথা বলছে কেন!গেলে তো ভালোই হতো কিন্তু সে কি নিয়ে যাবে! আবার মনে ভয়ও হচ্ছে, ফরহাদ কোথায় নিয়ে যাবে! ওবাড়িতে কি সবাই জেনে গেছে তাদের ব্যাপারে! আর সেখানেই নিয়ে যেতে চাইছে নাকি!
কোনো জবাব না পেয়ে মলিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফরহাদ আবার বললো,
– তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো। যাবে?
মলি উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– কবে?
– রান্না শেষ করে এখুনি রেডি হও।
– এখন! তাহলে এসব কি করবো! এতোকিছু যে রান্না করলাম!
– ইচ্ছে হলে খেয়ে নাও। আর না হয় থাকুক এভাবেই। আমি টিকেট বুক করছি, রেডি হও গিয়ে।
মলি ঝটপট রান্না শেষ করে রেডি হতে চলে গেলো। খুব আনন্দ লাগছে তার। ফরহাদ ওদিকে কল করে টিকেট বুক করে ফেলেছে। মলি রেডি হয়ে গেলে ফরহাদ তাকে খেয়ে নিতে বললো। ইচ্ছে না থাকলেও অল্প খেতে হলো কিন্তু ফরহাদ খায়নি। সাথে কিছু নিতে চেয়েছিলো কিন্তু ফরহাদ কিছু নিতে দেয়নি। শুধু দুইটা শাড়ি আর শীতের জামা নিতে বলেছে। তবুও মলি মন খারাপ করলো না। কেননা এতোদিন পর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে এটা ভেবেই সে অনেক খুশি! অতি আনন্দ নিয়ে সে ফরহাদের সাথে রওনা দিলো কিন্তু ভ্রমণ মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট! বিমানে আসার কি প্রয়োজন ছিলো অন্যভাবেও তো আসতে পারতো! পথঘাট একটু ঘুরেও দেখা যেতো! মলির মনে শত ইচ্ছে থাকলেও সে ফরহাদের কাজে বাধা দিলো না। তিন-চারমাস পরে এলো সে ঢাকায়। এর মাঝে ফরহাদ একা এসে দুবার ঘুরে গেছে কিন্তু থেকেছে এক-দু দিন । মলি একা বাসায় ছিলো তখন।
খুশি মনে ভাবতে ভাবতে ফরহাদের সাথে সে তাদের মহল্লায় চলে এলো। লক্ষ্য করলো ফরহাদ শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে তবুও আজ কিছুই নেয়নি সাথে। তাকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে তাই আর সেও কিছু বললো না। বাড়িতে পা রাখতেই দেখলো ভিন্ন কিছু, যা দেখে তার আনন্দ বিলীন হয়ে গেলো! বাড়িতে লোকজনের ভীড়! সাথে কান্নার আওয়াজ! মলি দৌড়ে ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। যা দেখলো তা কখনোই প্রত্যাশিত ছিলো না! মনে হচ্ছে যেন জমিন আসমান এক হয়ে গেছে! সে নিজে জীবিত না মৃত তার জানা নেই! চোখের সামনে পড়ে আছে বাবার মৃত দেহ! এটা কি হলো! দুদিন আগেও তো তার সুস্থ বাবার সাথে কথা বলেছিলো! তাহলে আজ এটা হলো কেন! কিছুদিন আগে তো অপারেশন করানো হয়েছে তার পর থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে। তাহলে আজ এটা কেন হলো! দুনিয়াটা যেন উল্টে গেছে মলির! সবকিছু সুশৃঙ্খল থাকতেও আজ তার সব যেন হারিয়ে গেছে! মাথার ছায়া ই তো চলে গেছে তাহলে বাকি সব দিয়ে কি হবে! সেই ছোট্ট থেকে বাবার সাথে খেলাধুলা, কথাবার্তাসহ, কাটানো মুহূর্ত গুলো সব চোখের সামনে পাল্লা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে আজ! বাবাই তো সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলা শিখিয়েছে। বাবাই তো হাত ধরে এক কদম দু কদম ফেলে হাটতে শিখিয়েছে। মা তো সংসারের কাজকর্ম নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত, মায়ের ব্যস্ত সময়টা তো বাবার সাথেই কাটানো। মা পিটুনি দিলে তো বাবাই কোলে নিয়ে শান্ত করাতো। পড়াশোনার জন্য চাপে রাখতো, সর্বদা ভালো কাজের পরামর্শ দিতো! আজ এতো ঋণি রেখে বাবা কোথায় হারিয়ে গেলো! ছেলেমেয়েদের সুখের মুহুর্তটা দেখতে পারলো না ঠিকমতো ! স্বার্থপরের মতো সর্বদা নিজ সন্তানদের কল্যাণ কামনা করে গেলেন, কিন্তু সন্তানদেরকে বাবার জন্য কিছু করার সুযোগ কেন দিলেন না! সরাসরি তো একবার দেখাও করতে পারলো না! দু’একটা কথাও বলতে পারলো না বাবার সাথে! সুযোগ এভাবে কেড়ে নিলো কেন আল্লাহ!
ভাবতে ভাবতে মলি অচেতন হয়ে পড়ে যেতে নিলে ফরহাদ ধরে ফেললো তাকে! যে ভয়টা সে পেয়ে যাচ্ছিলো সেটাই হলো! এজন্যই তাকে এখানে আনার সাহসটাও পাচ্ছিলো না ফরহাদ! কিন্তু না আনলে যে অপরাধ হয়ে যেতো!
ফরহাদ মলিকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলো। মলির মা তাকে দেখে কাছে এসে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো! কিন্তু মলির মুখে না আছে কোনো শব্দ আর না আছে চোখে অশ্রু! সে স্তব্ধ হয়ে গেছে! দুনিয়ার কোনো খেয়াল নেই তার ফরহাদের হাত ছাড়িয়ে সে হেটে হেটে বেরিয়ে এলো এবং দরজার একপাশে বসেই তাকিয়ে রইলো ছোট্ট উঠুনটায় শুয়ে থাকা বাবার মুখের দিকে। ওদিকে কয়েকজন মহিলা মলির মা কে সামাল দিচ্ছে। এদিকে ফরহাদ মলিকে নিয়ে আরও বেশি টেনশনে পড়ে গেছে! সে মলিকে ঝাকিয়ে বলছে কথা বলতে কিন্তু কোনো সাড়া নেই মলির! এক ফোটা পানিও চোখে দেখা দিচ্ছে না! দৃষ্টি যেন পাথর হয়ে গেছে তার! সারা শরীরও নিস্তেজ! নীলিমাও কাদতে কাদতে তার কাছে এসে তাকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ! আশেপাশের দু একজনও এসে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না কোনো প্রতিক্রিয়া আনতে তার মাঝে!
একে একে মৃত দেহ দাফনের সম্পূর্ণ কার্যাদি সম্পন্ন হলো। মুহিত কান্না করেছে ফরহাদকে ঝাপটে ধরে! তার বাবা হারিয়ে গেছে। পৃথিবীর বুকে থাকা তাদের শক্তির উৎসটা হারিয়ে ফেলেছে আজ! শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা যে ফরহাদের নিজের মাঝেই নেই আজ! তার চোখেও এসে গেছে অতি কষ্টের অশ্রু।
https://www.facebook.com/profile.php?id=100058759920318
“মালিনী”
পর্ব- ২৩
(নূর নাফিসা)
.
.
ফরহাদ চলে যাওয়ার পরেও মলি কেদেছে। কেন কেদেছে সে জানে না। তবে এটা জানে তার মনে তখন কোনো কষ্ট ছিলো না। ভেবেছে শুধু অতি শীঘ্রই সে মায়ের আসনে বসতে চলেছে। মাতৃত্বের পূর্নাঙ্গ স্বাদ তার মনে আজ জাগ্রত হয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে, একটা মানুষের মধ্যে আরেকটা মানুষের বসবাস! স্থায়ী হবে সেটা দীর্ঘদিন। প্রায় নয় থেকে দশ মাস! মহান আল্লাহ তায়ালার অপরূপ চমকপ্রদ! কিভাবে সৃষ্টি করে দিয়েছেন প্রকৃতির নিয়মনীতি! একটা সত্তার ভেতর জন্ম নেয় দ্বিতীয় সত্তা! তাও আবার স্ত্রী-পুরুষ ভেদে সুশৃঙ্খলভাবে! আজ ভিন্ন অনুভূতি সাড়া দিচ্ছে তার মনে! খুব আনন্দিত হয়ে ভিন্নভাবে অনুভব করছে তার মধ্যে অবস্থিত সত্তাকে! ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেলো তার নিজের মায়ের কথা। তার মা ও তো তাকে নিয়ে এ অবস্থায় ছিলো কোনো এক সময়। তিনিও নিশ্চয়ই তখন এমন অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছেন! মলি ফোন নিয়ে ভাবি নীলিমার কাছে কল করলো। বেশ কিছুক্ষণ ভাবি ও মায়ের সাথে কথা বললো। তাদের জানিয়ে দিলো তার অবস্থার কথা। অত:পর বাবার সাথেও একটু কথা বলে কল কেটে দিলো।
দুপুরের পরে ফরহাদ বাসায় ফিরেছে সাথে তেতুল, চালতা আর জলপাইয়ের আচার নিয়ে। মলি রুমেই কাপড়চোপড় গোছাচ্ছিল। ফরহাদ তার হাতে আচারের বক্সের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– বাবু কি করে?
তার এমন জিজ্ঞাসায় মলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো! এমন ভাব নিচ্ছে যেন তার দু/এক বছরের বাচ্চা আছে! ফরহাদ উত্তরের আশায় না থেকে আবার মলির হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খাটে রেখে দিলো। অত:পর মলিকে কাছে টেনে দুহাত মলির পেছনে রেখে ঘড়ি খুলতে লাগলো। প্রত্যক্ষ সিগনাল না দিলেও মলি তার সিগনাল বুঝে গেছে। তাই শার্টের বোতামগুলো একে একে খুলে শার্ট খুলে নিলো। ফরহাদ বললো,
– গোসল করোনি কেন?
– করে কি হবে শুধু শুধু! সেই তো আবার করতেই হবে।
ফরহাদ আর কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলো। দুজনের গোসল শেষ হলে খাওয়াদাওয়াও একসাথে হলো। রাতে ফরহাদ ইউটিউবে প্রেগ্ন্যাসির সময়ের সাবধানতার কিছু নিয়মনীতি বের করে মলির হাতে ফোন দিলো। যাতে মলি শুনে আর মেনে সাবধান থাকে। সে পাশে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছে আর মলি শুনছে। একসময় তাদের কানে ভেসে এলো “পানির কাজে লেগে থেকে মায়ের সর্দি যাতে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এতে বাচ্চার ক্ষতি হবে।”
কথাটা শুনে ফরহাদ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে মলির দিকে তাকালো। মলি ইচ্ছে করে আবার পেছনে টেনে কথাটা আবার শুনলো। সেটা কেবল ফরহাদকে শুনানোর জন্যই। ফরহাদ কিছু বললো না। তার নিজের কাজ করতে লাগলো। মলি অপ্রকাশ্য হাসলো।
পরদিন আর তাকে নিয়ে গোসল করেনি। মলি ভেবে নিলো বাচ্চার জন্য নকশিকাঁথা তৈরি করবে। তার জন্য তো কাপড়, সুচ, সুতা ও ফ্রেম লাগবে! তাই ফরহাদ অফিস যাওয়ার সময় নিচু স্বরে বললো,
– সময় করে একবার আমাকে শপিংমলে নিয়ে যেতে পারবেন?
– কেন?
– কিছু কেনার প্রয়োজন ছিলো।
ফরহাদ তার ল্যাপটপ গুছিয়ে মলির হাতে এনে একটা কলম ও কাগজ ধরিয়ে দিলো। মলি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে! এখানে এনে যে বন্দী করেছে, একদিন তো বেড়াতে নিয়ে যায়ইনি! প্রয়োজন থাকায় আজ প্রথম বললো, তাও এনে কাগজ ধরিয়ে দিলো হাতে!
এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফরহাদ কাগজ কলম নিয়ে বললো,
– ওহ, আমি তো ভুলেই গিয়েছি। পড়ালেখার যে ঘোড়ার ডিম জানে! নামেমাত্র এইচএসসি পাস! পাস করেছে না ফেইল করেছে কে জানে! নাও রেকর্ড করো। বলতে তো পারো নিশ্চয়ই!
ফরহাদ ফোন এগিয়ে দিলো তার দিকে। তা দেখে মলি বিরক্তি নিয়ে আবার কাগজ কলম হাতে নিয়ে লিখতে থাকলো আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
– হুহ্! পড়ালেখা যেন শুধু উনিই জানে! পাস করেছি না ফেইল করেছি রেজাল্ট ঘেটে দেখে আসুক!
– আচ্ছা! কি গ্রেট যেন ছিলো রেজাল্ট?
– বি গ্রেট।
– বাহ! খুব ভালো রেজাল্ট! অন্যের টা দেখে দেখে কপি করেছে আর খাতায় পেস্ট করে দিয়েছে। বি ছাড়া আর হবেই বা কি! এটাই অনেক হয়ে গেছে!
– কারোটা দেখে লিখিনি। টুকটাক সবাই জিজ্ঞেস করে সেটা আপনিও করেছেন পরিক্ষার হলে । আর আমি কোনো কোচিং করিনি আপনাদের মতো। নিজে নিজে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি। যতটুকু হয়েছে সেটাই অনেক। আমার জায়গায় থাকলে আপনি সেটাও পারতেন না। আসছে আবার অহংকার দেখাতে! হুহ্!
ফরহাদ আরও কিছু বলতো কিন্তু মলির হাতের লেখা দেখে চুপসে গেছে। অনেক ভালো না হলেও ভালোর কাতারেই পড়ে। যাকে বলা যায় মধ্যবিত্ত ভালো! কিন্তু সেদিন কাজী অফিসে যে সিগনেচার দিয়েছে! সেটা দেখে যে কেউ বলবে সে প্রাথমিক শিক্ষাও শেষ করেনি! মলি লিখে দিতেই ফরহাদ চুপচাপ সেটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো কিন্তু তাকে সতর্কবার্তা দিতে ভুলেনি। সবদিক থেকে সাবধানে থাকতে বলেছে। আর কাজকর্মে কম এগোতে বলেছে। ফরহাদ বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মলিকে কল করলো।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই তুমি কি নকশিকাঁথা বানাবে?
– এতোক্ষণে বুঝেছেন!
– কাথা বানিয়ে বেচে উপার্জনের প্ল্যান করছো না তো!
মলি মজা পেলো তার কথায়! তাই বললো,
– আপনি যদি নিয়ে বেচে দিতে পারেন তাহলে আমি বানিয়ে দিবো।
– হোয়াট! তাহলে আর আনছি না কিছু।
– আরে! আমি বাচ্চার জন্য তেরি করতে চাচ্ছিলাম। এখন না আনলে আর কি করার!
– অহ! ওকে।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো কিন্তু ইউটিউবে ডাক্তারের পরামর্শ শুনার পর থেকে সে দ্বিতীয়বার গোসল করলেও মলিকে সাথে নেয় না। শীতকাল এগিয়ে আসছে আর আবহাওয়ায় ঠান্ডাও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে তাই তারও এখন দিনে একবার গোসল। অতি প্রয়োজনে দুবার চলে।
আজ মলি সকালের জন্য হালকা নাস্তা তৈরি করেছে। যার ফলে কিচেনের কাজ তারাতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। রুমে এসে দেখলো ফরহাদ মাত্র বাথরুমে ঢুকেছে। অনেকদিন হলো তার সাথে গোসল চলে না। তাই আজ ভাবলো তার সাথেই করা যাক। বাথরুমের দরজা খোলাই ছিলো। মলি তার কাপড়চোপড় নিয়ে ঢুকে পড়লো। ফরহাদ ঝর্ণার নিচে দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখে বললো,
– এখন কেন?
– ইচ্ছে হলো, তাই এলাম।
মলি কাপড়চোপড় রাখতেই ফরহাদ হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
– হঠাৎ এমন ইচ্ছে কেন হলো! আমি কিন্তু ডাকিনি! বাচ্চার ক্ষতি হলে খবর আছে তোমার।
– দুবার তো আর করবো না। এখনই করবো শুধু।
– তাহলে তো প্রতিদিন এ সময়েই করা যায়। দিনে একবার। রান্না দ্রুত শেষ করে নিবে।
মলি মনে মনে বললো, “এবার হয়েছে মহাজ্বালা! একবার ইচ্ছে হলো তাই এলাম আর এখন না হলেও প্রতিদিনই ইচ্ছে হতে হবে! আগে জানলে আসতাম নাকি!”
অনেকদিন পর একসাথে গোসল হলো কিন্তু সময়টা ফরহাদ কমিয়ে এনেছে। নাস্তাও একসাথেই করলো দুজন। মলির যত্নে কোনো কমতি রাখছে না ফরহাদ। শুধু বাচ্চার জন্য নয়। মলিকে এখানে নিয়ে আসার পর থেকেই তার খাওয়াদাওয়া, পোশাকাশাকসহ যাবতীয় দিক থেকে যত্ন নিচ্ছে। মলির সবকিছু যেন নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসারে চলে। ফরহাদ নাস্তা করে বেরিয়ে গেছে অফিসের জন্য আর এদিকে মলি রাতের টা সহ দুপুরের রান্না বসিয়েছে। ঘন্টাখানেক সময় পাড় হতেই ফরহাদ বাসায় হাজির! দ্রুত পায়ে এসে কিচেনের দরজার সামনে দাড়ালো। এসময় ফরহাদকে বাসায় দেখে মলি অবাক হলো তাও আবার এভাবে এসে থমকে দাড়িয়েছে! তার চেহারা কেমন যেন দেখাচ্ছে। তাই মলি জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে? বাসায় ফিরে এলেন যে!
– না, কিছুনা।
ফরহাদ আবার রুমে ফিরে এলো। মলি তার আচরণ বুঝতে পারছে না। কিছু তো হয়েছে নিশ্চয়ই! মলি চুলার আগুন একটু কমিয়ে রেখে রুমে এসে দেখলো ফরহাদ দুহাত মুঠোয় রেখে খাটে বসে কিছু ভাবছে। মলি বললো,
– আপনার কি শরীর খারাপ?
– না।
– অফিসে যাবেন না?
– না। রান্না শেষ হয়েছে?
– একটু বাকি আছে। ক্ষুধা লেগেছে? রুটি আছে, দিবো?
– না। রান্না শেষ করো, যাও।
মলি আবার চলে এলো কিচেনে।
ফরহাদ রুমে পায়চারি করছে আর কিছু ভাবছে। ভাবনার যেন শেষ হচ্ছে না তার! কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না! পাচ সাত মিনিট অতিবাহিত হতেই আবার এসে দাড়ালো কিচেনের দরজার সামনে। মলির দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
– ঢাকা যাবে?
ঢাকার কথা শুনে মলি একটু বেশিই অবাক হলো! আজ হঠাৎ ঢাকার কথা বলছে কেন!গেলে তো ভালোই হতো কিন্তু সে কি নিয়ে যাবে! আবার মনে ভয়ও হচ্ছে, ফরহাদ কোথায় নিয়ে যাবে! ওবাড়িতে কি সবাই জেনে গেছে তাদের ব্যাপারে! আর সেখানেই নিয়ে যেতে চাইছে নাকি!
কোনো জবাব না পেয়ে মলিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফরহাদ আবার বললো,
– তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো। যাবে?
মলি উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– কবে?
– রান্না শেষ করে এখুনি রেডি হও।
– এখন! তাহলে এসব কি করবো! এতোকিছু যে রান্না করলাম!
– ইচ্ছে হলে খেয়ে নাও। আর না হয় থাকুক এভাবেই। আমি টিকেট বুক করছি, রেডি হও গিয়ে।
মলি ঝটপট রান্না শেষ করে রেডি হতে চলে গেলো। খুব আনন্দ লাগছে তার। ফরহাদ ওদিকে কল করে টিকেট বুক করে ফেলেছে। মলি রেডি হয়ে গেলে ফরহাদ তাকে খেয়ে নিতে বললো। ইচ্ছে না থাকলেও অল্প খেতে হলো কিন্তু ফরহাদ খায়নি। সাথে কিছু নিতে চেয়েছিলো কিন্তু ফরহাদ কিছু নিতে দেয়নি। শুধু দুইটা শাড়ি আর শীতের জামা নিতে বলেছে। তবুও মলি মন খারাপ করলো না। কেননা এতোদিন পর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে এটা ভেবেই সে অনেক খুশি! অতি আনন্দ নিয়ে সে ফরহাদের সাথে রওনা দিলো কিন্তু ভ্রমণ মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট! বিমানে আসার কি প্রয়োজন ছিলো অন্যভাবেও তো আসতে পারতো! পথঘাট একটু ঘুরেও দেখা যেতো! মলির মনে শত ইচ্ছে থাকলেও সে ফরহাদের কাজে বাধা দিলো না। তিন-চারমাস পরে এলো সে ঢাকায়। এর মাঝে ফরহাদ একা এসে দুবার ঘুরে গেছে কিন্তু থেকেছে এক-দু দিন । মলি একা বাসায় ছিলো তখন।
[আমাদের এই পেজে সব ভালো ভালো গল্পের লিংকই পোস্টই করা হয়। Pls Like, follow and share our page to get links to all the best stories. →↓
https://www.facebook.com/AllBestStoryLinkRiazUddinShakil/]
খুশি মনে ভাবতে ভাবতে ফরহাদের সাথে সে তাদের মহল্লায় চলে এলো। লক্ষ্য করলো ফরহাদ শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে তবুও আজ কিছুই নেয়নি সাথে। তাকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে তাই আর সেও কিছু বললো না। বাড়িতে পা রাখতেই দেখলো ভিন্ন কিছু, যা দেখে তার আনন্দ বিলীন হয়ে গেলো! বাড়িতে লোকজনের ভীড়! সাথে কান্নার আওয়াজ! মলি দৌড়ে ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। যা দেখলো তা কখনোই প্রত্যাশিত ছিলো না! মনে হচ্ছে যেন জমিন আসমান এক হয়ে গেছে! সে নিজে জীবিত না মৃত তার জানা নেই! চোখের সামনে পড়ে আছে বাবার মৃত দেহ! এটা কি হলো! দুদিন আগেও তো তার সুস্থ বাবার সাথে কথা বলেছিলো! তাহলে আজ এটা হলো কেন! কিছুদিন আগে তো অপারেশন করানো হয়েছে তার পর থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে। তাহলে আজ এটা কেন হলো! দুনিয়াটা যেন উল্টে গেছে মলির! সবকিছু সুশৃঙ্খল থাকতেও আজ তার সব যেন হারিয়ে গেছে! মাথার ছায়া ই তো চলে গেছে তাহলে বাকি সব দিয়ে কি হবে! সেই ছোট্ট থেকে বাবার সাথে খেলাধুলা, কথাবার্তাসহ, কাটানো মুহূর্ত গুলো সব চোখের সামনে পাল্লা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে আজ! বাবাই তো সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলা শিখিয়েছে। বাবাই তো হাত ধরে এক কদম দু কদম ফেলে হাটতে শিখিয়েছে। মা তো সংসারের কাজকর্ম নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত, মায়ের ব্যস্ত সময়টা তো বাবার সাথেই কাটানো। মা পিটুনি দিলে তো বাবাই কোলে নিয়ে শান্ত করাতো। পড়াশোনার জন্য চাপে রাখতো, সর্বদা ভালো কাজের পরামর্শ দিতো! আজ এতো ঋণি রেখে বাবা কোথায় হারিয়ে গেলো! ছেলেমেয়েদের সুখের মুহুর্তটা দেখতে পারলো না ঠিকমতো ! স্বার্থপরের মতো সর্বদা নিজ সন্তানদের কল্যাণ কামনা করে গেলেন, কিন্তু সন্তানদেরকে বাবার জন্য কিছু করার সুযোগ কেন দিলেন না! সরাসরি তো একবার দেখাও করতে পারলো না! দু’একটা কথাও বলতে পারলো না বাবার সাথে! সুযোগ এভাবে কেড়ে নিলো কেন আল্লাহ!
ভাবতে ভাবতে মলি অচেতন হয়ে পড়ে যেতে নিলে ফরহাদ ধরে ফেললো তাকে! যে ভয়টা সে পেয়ে যাচ্ছিলো সেটাই হলো! এজন্যই তাকে এখানে আনার সাহসটাও পাচ্ছিলো না ফরহাদ! কিন্তু না আনলে যে অপরাধ হয়ে যেতো!
ফরহাদ মলিকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলো। মলির মা তাকে দেখে কাছে এসে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো! কিন্তু মলির মুখে না আছে কোনো শব্দ আর না আছে চোখে অশ্রু! সে স্তব্ধ হয়ে গেছে! দুনিয়ার কোনো খেয়াল নেই তার ফরহাদের হাত ছাড়িয়ে সে হেটে হেটে বেরিয়ে এলো এবং দরজার একপাশে বসেই তাকিয়ে রইলো ছোট্ট উঠুনটায় শুয়ে থাকা বাবার মুখের দিকে। ওদিকে কয়েকজন মহিলা মলির মা কে সামাল দিচ্ছে। এদিকে ফরহাদ মলিকে নিয়ে আরও বেশি টেনশনে পড়ে গেছে! সে মলিকে ঝাকিয়ে বলছে কথা বলতে কিন্তু কোনো সাড়া নেই মলির! এক ফোটা পানিও চোখে দেখা দিচ্ছে না! দৃষ্টি যেন পাথর হয়ে গেছে তার! সারা শরীরও নিস্তেজ! নীলিমাও কাদতে কাদতে তার কাছে এসে তাকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ! আশেপাশের দু একজনও এসে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না কোনো প্রতিক্রিয়া আনতে তার মাঝে!
একে একে মৃত দেহ দাফনের সম্পূর্ণ কার্যাদি সম্পন্ন হলো। মুহিত কান্না করেছে ফরহাদকে ঝাপটে ধরে! তার বাবা হারিয়ে গেছে। পৃথিবীর বুকে থাকা তাদের শক্তির উৎসটা হারিয়ে ফেলেছে আজ! শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা যে ফরহাদের নিজের মাঝেই নেই আজ! তার চোখেও এসে গেছে অতি কষ্টের অশ্রু!
.
.
একেকজনের একেক ধারণা। আসল কথা হলো গতকাল ব্যস্ত ছিলাম বিধায় পার্টটা লিখতে পারিনি। আজ লিখে তারপর পোস্ট করলাম। 🙂
https://www.facebook.com/profile.php?id=100058759920318