“মালিনী”পর্ব ১২+১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে মলি হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছে বিছানার এক কোনে। বিরতি নিয়ে এক ফোটা দু ফোটা করে টুপটাপ চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। সবকিছুই ভাবনার বাইরে ছিলো। কে জানতো মুহূর্তের মধ্যে জীবনটা এভাবে পাল্টে যাবে! সবটাই হয়তো ভাগ্যের খেলা।
যেভাবেই হোক বিয়ে তো হয়েছে। ফরহাদ এখন তার বর বিধায়ই তো অধিকার খাটিয়েছে। তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। এখন তো তাকে বাধা দেওয়ার কোনো সাধ্য নেই!
মনকে বারবার শান্তনা দিচ্ছে মলি। তবুও মন অশান্ত! শত চেষ্টায়ও ভেতরের কষ্টটা যে ঠেলে দূরে সরাতে পারছে না! ফরহাদ কেন তার সাথে এমন করলো! তাকে কি কখনো এ পরিবার গ্রহণ করবে! সে এই পরিবারের আভিজাত্যের উপযুক্ত না। সেদিকে নিজের পরিবারেও পাবে না কোনো মর্যাদা! ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া সে ই বা কেন এসেছিলো কারো বাড়িতে কাজ করতে! না এখানে কাজ করতে আসতো আর না ফরহাদের সাথে দেখা হতো, আর না আজ এখানে অবস্থান করতে হতো!
দরজা ঠেলে ফরহাদ রুমে ঢুকতেই মলির ভাবনার জগতের বিচ্ছেদ ঘটলো। দু’হাতে দ্রুত চোখের পানি মুছে নিলো। ফরহাদ তার আগেই লক্ষ্য করেছে সে যে কাদছিলো। দরজা লাগিয়ে আলমারির দিকে যেতে যেতে বললো,
– প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যান করে এবং অযথা চোখের জলে সমুদ্রের সৃষ্টি করে এমন মানুষ আমার একদম পছন্দ না। আমার সামনে যেনো কখনো এমন পরিস্থিতি না আসে!
– শুধু শুধু আমার এমন সর্বনাশ করে বিয়ে কেন করলেন? আপনার পরিবার কি কখনো মেনে নিবে আমাকে?
– পরিবার দিয়ে কি করবে? দায়িত্ব আমি নিয়েছি সেখানে পরিবারের মেনে নেওয়া আর না মেনে নেওয়ার কি আছে!
– তাহলে আমাকে লুকিয়ে রেখেছেন কেন? সবার কাছে বলে দিন যে বউ নিয়ে বাড়িতে আছেন!
ফরহাদ একবার মলির দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করতে করতে বললো,
– বলবো। কিছুদিন পর। আপাতত লুকিয়েই থাকো। এবং শ্বশুরবাড়ির পরিবর্তে বাবার বাড়িই থাকো।
– বাপের বাড়িতে থাকার মর্যাদাও তো হারিয়ে ফেলেছি!
– যেটুকু আছে সেটুকুতেই থাকবে।
মলি একটু জেদি কন্ঠেই বললো,
– এখন রুম থেকে বের হবো কিভাবে আমি!
ফরহাদ পেছনে ফিরে ব্রু কুচকে তাকাতেই মলি বিড়াল ন্যায় চুপসে গেলো! নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের আঙুলের নখ খোচাতে লাগলো। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে বের হবে! নাকি সারাদিন রুমেই আটকে রাখবে কে জানে! আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো ফরহাদ ফোনের ভেতর কি যেনো খুটিনাটি করছে। তার কাজ শেষ হতেই বাথরুমে চলে গেলো। মলি বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দায় চলে এলো। ফুলগুলো যেন তাকে ডাকছে! আর মলি উপর থেকেই মনে মনে চিৎকার করে বলছে, ” দেখ তোদের মালিক কতো খারাপ! আমাকে আটকে রেখেছে রুমের ভেতর! আসতে পারছি না আমি তোদের কাছে!”
আরও শত আলাপন করছে মনে মনে! ফরহাদ তার এই সেই কাজ করেই যাচ্ছে ভোর থেকে। কতোবার বাইরে বেরিয়েছে আর রুমে এসেছে সেই হিসাব নেই!
ফরহাদ বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে আলমারি খুলে কিছু জামাকাপড় বের করলো। মলি একবার পেছনে ফিরে দেখেছিলো আবার বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফরহাদ কাপড় নিয়ে বাথরুমে গেলো। চার পাচ মিনিট পর সে বেরিয়ে এলো। রুমের বাইরে সিড়ির কাছে এসে উচ্চস্বরে বললো,
– ভাবি, মালিনীকে ডেকে দিও তো একটু। কাপড়চোপড় ময়লা হয়ে আছে। মা তো আর পারবে না। বলে দিও তাকে এক্সট্রা টাকা দিয়ে দিবো।
দরজা খোলা থাকায় মলির কানে স্পষ্ট এলো কথাগুলো। ফরহাদ কি বলছে এসব, কিছুই বুঝতে পারছে না! সে দ্রুত রুমের দরজার কাছে এসে শুনতে পেলো জেরিন বলছে,
– মালিনী এখনো আসেনি তো!
– এসেছে, আমি দেখেছি গেইট দিয়ে ঢুকতে। কিচেনে দেখো। আর তারাতাড়ি বলো। আমি এসব নিয়ে চিটাগং যাবো।
– বিয়ে করে বউ বাসায় আনলেই তো হয় ফরহাদ। কাজের লোকদেরও ডাকতে হয় না আর টাকাও খরচ হয় না।
– বউ যে কতটা কাজ করবে তা জানা আছে! তুমি বরং এখন মালিনীকে খুজো।
ফরহাদ আবার রুমে চলে এলো। মালিনী তাকে দেখে আবার বারান্দার দিকে চলে গেলো। দরজা লাগিয়ে ফরহাদও বারান্দার দিকে এলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে রইলো। একজনের মনে প্রেম আর অন্যজনের মনে অশান্তি। চার পাচ মিনিটের মতো অতিক্রম হতেই ফরহাদ তাকে টেনে এনে হাতে কাপড়ের বালতি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ছাদে শুকাতে দিয়ে এসো। আর এতোক্ষণ তুমি কাপড় ধুয়ে ছাদে শুকাতে দিয়েছো। ওকে?
মলি বালতি নিয়ে চলে গেলো ছাদে। “ছোট সাহেবের মাথায় শেয়ালের বুদ্ধি! কি সুন্দর, এতোক্ষন ঘরে আটকে রেখে এখন মিথ্যে বলা শিখিয়ে দিচ্ছে!”
বিড়বিড় করতে করতে মলি কাজ সম্পাদন করে বালতি নিয়ে নিচে নেমে এলো। এদিকে জেরিন দোতলায় উঠে এসেছে। মলিকে দেখে বললো,
– কিরে তুই কখন এলি?
– এ..এইতো কিছুক্ষণ আগে।
– কোথায় ছিলি, আমি তো খুজলাম।
এর মাঝেই ফরহাদ রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
– ছদে নাকি ছিলো, ভাবি। মালিনী, বালতি দাও। আর টাকাটা কিছুক্ষণ পর দিচ্ছি।
ফরহাদ মলির হাত থেকে বালতি নিয়ে রুমে চলে গেলো। মলি জেরিনের পিছু পিছু নিচে চলে এলো। ফাহিমার সাথে দেখা করলে গল্প করার জন্য বসতে বললে মলি বললো আগে বাগানে পানি দিয়ে আসবে পরে গল্প করবে।
বাসা থেকে বেরিয়ে বাগানে এলো। শরীরটা একটু খারাপ লাগছে তবুও কাজে অগ্রসর হচ্ছে। পানির পাইপ নিয়ে পানি দেওয়া শুরু করতেই ফরহাদ এসে পাইপ নিয়ে বললো,
– বাসায় চলে যাও তুমি। আমি পানি দিয়ে দিচ্ছি।
মলি চুপচাপ এখানেই দাড়িয়ে আছে। “বাসায় যাবো না ছাই! সব সম্মান নষ্ট করে আসছে, এখন বাড়িতে কি ঠাই হবে!” ফরহাদ তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কানে কথা যায়নি?
মলি নিচের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,
– কাজে এসেছি, কাজ করে পরেই যাবো। পানির পাইপ দিন।
ফরহাদ আর কিছু বললো না। মলির হাতে পাইপ ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো বাগান থেকে। মলি পানি দেওয়া শেষ করে দেখলো ফরহাদ দোলনায় বসে আছে। ফরহাদ বললো,
– এবার কাজ শেষ না! এখন যাও। রিকশা নিয়ে যাবে, আর বিকেলে আসতে হবে না। পানি আমি দিয়ে দিবো। কাল যদি সুস্থ থাকো তাহলে এসো। আর না হলে আসতে হবে না।
মলি যেনো তার কথায় কান দিচ্ছে না! তাই ধমকের সুরে বললো এবার মলি বাড়ির ভেতরে না গিয়ে গেইটের দিকে চলে গেলো। হটছে একা পথে। রিকশা কিভাবে নিবে! সে কি টাকা এনেছে সাথে! কাল তো হুটহাট বাসা থেকে ধরে এনেছে! কিছু নেওয়ার সময় কি দেওয়া হয়েছে তাকে! কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই তার ধারে রিকশা থামলো। রিকশায় ফরহাদ আছে। মলিকে উঠতে বললো আর মলি নিজের মতো চলতে লাগলো। এখানেও ফরহাদের ধমকেই কাজ হলো।
দুজন একসাথে বস্তির গলির ভেতরে এসেছে রিকশা করে। মলি হনহন করে ফরহাদকে রেখেই তার বাড়িতে চলে এসেছে। মলি একটু অবাকই হলো তার মা ভাবিকে নিয়ে। সে তো অনেক ভয়ে ছিলো, না জানি কিসব বলে! কিন্তু তারা কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করলো না তা নিয়ে! যদিও কথা বলছে আগের চেয়ে কম। ফরহাদ কি থ্রেড দিয়ে গেলো নাকি তার পরিবারের সদস্যদের! এটাই সন্দেহ হচ্ছে মলির। সে হৃদয়ের কাছে এলো। দেখলো হৃদয় এক হাতে আপেল আরেক হাতে মিষ্টি নিয়ে বসে বসে খাচ্ছে।
– কি করছো হৃদয় বাবা?
– মিষ্টি খাই।
– বাবা এনেছে মিষ্টি?
– না, আংকেল।
– আংকেল! আংকেল কে?
– ওই যে, পুলিশ আংকেল।
– পুলিশ আংকেল!
মলি তার মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– মা, হৃদয় কার কথা বলছে? কে এসেছে বাড়িতে?
– কই কেডা আইছে?
– মিষ্টি আনছে কে?
– জামাই না মিষ্টি, ফলটল দিয়া গেলো কালকা।
এবার মলি বুঝতে পেরেছে ফরহাদের কথা বলছে তাহলে। বাহ! শ্বশুর বাড়ি এসে মিষ্টি দিয়ে যায়, মিথ্যা অপবাদ দয়ে বিয়ে করে আবার বউকে নিজের পরিবারের কাছে লুকিয়ে রাখে! আর কতো রূপ দেখাবে লোকটা!
একটু পরেই ফরহাদ বাজার করে নিয়ে বাসায় এলো। মলি দেখে মনে মনে বললো, “এখনো বাসায় যায়নি! ” মলির হাতে ব্যাগ দিলে মলি বললো,
– এগুলো এনেছেন কেন? আপনার বাসায় নিয়ে যান এসব। কাজে লাগবে।
– কেন, তোমার বাসার মানুষ কি না খেয়ে থাকে! চুপচাপ রেখে এসো।
– রেখে এলে কি হবে! এগুলো রান্না করা হবে না। থেকে থেকে আরও নষ্ট হবে। আপনিই নিয়ে যান।
ও বাড়িতে চুপচাপ থাকলেও এখন মলির বুলি ফুটেছে! বাড়ির সামনে এলে নাকি পিপড়ারও জোর বাড়ে! এই তার প্রমাণ! ফরহাদ “আন্টি” বলে মলির মাকে ডাকলো এবং বাজারের ব্যাগ উনার হাতে ধরিয়ে দিলো। এদিকে মলির মা ফরহাদকে নাস্তা করে যাওয়ার জন্য বললো। ফরহাদ মলির দিকে তাকালো ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে। মলির অসহ্য লাগছে খুব! ফরহাদ মলিকে জিজ্ঞেস করলো
– বাথরুম কোনদিকে?
– বাথরুম আপনার বাড়িতে।
– কোনদিকে যেন বাড়িটা? চলো দেখিয়ে দিয়ে আসবে।
মলি বিরক্ত হয়ে দেখিয়ে দিলো বাথরুম। ফরহাদ সেখানে হাতমুখ ধুয়ে মলির রুমে চলে এলো। কাঠের পুরাতন আলমারিটা খুলে একে একে জামাকাপড় দেখতে লাগলো ফরহাদ। মলি জিজ্ঞেস করছে কি খুজছে কিন্তু কোনো জবাব দিচ্ছে না। সবচেয়ে নতুন যে পোশাকটা পেয়েছে তার ওড়নাটা নিয়ে হাত মুখ মুছে নিলো ফরহাদ। মলি অবাকের চরম পর্যায়ে! হাতমুখ মুছার জন্য এতোসব করছে! যেহেতু এতো মার্জিত ব্যক্তি, তাহলে বস্তির এ বাড়িতে কেন এলো! আবার নাস্তা করে যাওয়ার জন্য থেকেও গেলো! মলির ইচ্ছে করছে ফরহাদের মাথা ফাটিয়ে দিতে! আর রক্ত দেখিয়ে বলতে সবার রক্তের রঙ এক! জীবন মরণ সবার আছে তাহলে এতো অহংকার কেন তাদের মধ্যে! বাইরে থেকে নীলিমা ডাকলো মলিকে। মলি বেরিয়ে এলে নীলিমা মৃদু স্বরে বললো,
– মলি, করলা ভাজি আছে আর আলু দিয়ে ডিম ভুনা আছে। এগুলো কি জামাই খাবে?
মলি উচ্চস্বরে জবাব দিলো,
– না, তোমাদের জামাই উঁচু শ্রেণির ব্যক্তি। করলা ভাজি আর আলু দিয়ে ডিম ভুনা উনার গলা দিয়ে নামবে না। পোলাও কোরমা করো উনার জন্য। যেসব খেয়ে উনি অভ্যস্ত! প্রয়োজনে রেস্টুরেন্টের কুকার এনে রান্না করো।
মলির এমন ধাচের কথা শুনে ফরহাদের গা ঝিমঝিম করছে! সে বেরিয়ে এসে মলির হাত ধরে টানতে টানতে বাসা থেকে বের হচ্ছে। নীলিমা স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো! মলি বারবার থামতে বলছে কিন্তু ফরহাদ এগিয়েই যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিকশা নিয়ে সে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে চলে এলো। পুরোটা সময়ই ফরহাদ তাকে টানতে টানতেই নিয়ে এসেছে! ধপাস করেই চেয়ারে বসালো মলিকে। ওয়েটার ডেকে নানান খাবার অর্ডার করে মলির মুখোমুখি চেয়ারে বসালো। মলি জবাব পায়নি কোনো প্রশ্নে তবুও থেমে নেই! আবার প্রশ্ন করলো,
– এখানে কেন এনেছেন?
– ওহ, তুমি তো জানো না! শুনো, জানিয়ে দিচ্ছি। এটা হচ্ছে রেস্টুরেন্ট। আর এখানে মানুষজন খেতে আসে। তাই আমিও খেতে এসেছি।
– তো আমাকে নিয়ে এসেছেন কেন?
– কেননা তুমি আমার বউ। আমি যেখানে খেতে পারবো না সেখানে তুমি কেন খাবে! আমি যেখানে খাবো সেখানেই তুমি খাবে। আর যখন কথা বলতে বলবো কথা বলবে, নিষেধ করবো তো চুপ করে থাকবে! এখন চুপ করে থাকো।
– করবো না চুপ! আমার উপর আপনার অধিকার থাকলেও আমারও অধিকার আছে। সুতরাং, আমি আমার ইচ্ছায় চলবো।
– এতো বছর তো নিজের ইচ্ছাতেই চলেছো। এখন আমার ইচ্ছায় চলে অধিকার সমান সমান করো।
ফরহাদ পকেট থেকে একটা বাটন সেট বের করে মলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা রাখো। শুধু ফরহাদ হাসান নামে যে নম্বর আছে সেটাতে কল যাবে আর সেটা থেকেই কল আসবে। নকশিকাঁথা বিক্রির কাজে যেন না ব্যাবহৃত হয়!
– লাগবে না আমার।
– তোমার না লাগুক। আমার লাগবে। রাখো!
মলি মনে মনে বিড়বিড় করছে, “এতো পয়সাওয়ালা, এতো নামি-দামি চালচলন তাহলে বউকে এই বাটন সেট দিলো কেন! নিজে একটা কিপ্টুস, ছোট লোক! আবার অন্যের উপর নাক ছিটকায়! এই মলি তুই এতো ভদ্রলোকের মতো এখানে বসে আছিস কেন! ওঠ!”
নিজের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে মলি উঠতেই ফরহাদ ধমক দিয়ে বসতে বললো। আশেপাশের দু একজন তাকিয়ে আছে তাদের দিকে! মলি আবার বসে পড়লো মুখ গোমড়া করে। ওয়েটার একে একে খাবার নিয়ে আসছে টেবিলে। মলি এসব দেখে বললো,
– জেনিফা ম্যাডামকে নিয়েও কি এসব খেতে যান?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ফরহাদ কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে তাকালো মলির দিকে। মলি উত্তরের আশায় তার দিকে তাকালো। কোনো উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– জেনিফা ম্যাডামকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট আসার কথা ছিলো আপনার। আমাকে কেন আনলেন? আমার গলা দিয়ে এসব আভিজাত্যের খাবার নামবে না। এটা আপনাদের মতো লোকদের খাওয়ার জায়গা। জেনিফা ম্যাডামকে মানাবে আপনার সাথে। আমাকে শুধু শুধু টানবেন না! আমি আপনার এবং আপনার পরিবারের যোগ্য নই।
ফরহাদ রেগে বসা থেকে উঠে গেলো। এবং বললো,
– হ্যাঁ, জেনিফার সাথেই আমাকে মানায়। তোর গলা দিয়ে যেহেতু এসব খাবার নামবে না, তুই খেয়ে খেয়েই অভ্যাস করে নে। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। আজীবন গন্ডমুর্খ না থেকে আশপাশ দেখে কিছু শেখার চেষ্টা কর। না হলে পৃথিবীতে বাচতে পারবি না। আজীবন অন্যের গোলামীই খেটে যাবি!
ফরহাদ খাবারের বিল দিয়ে বেরিয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে! মলি হতবাক হয়ে এখানেই বসে আছে! এটা কি আদও মানুষ নাকি পাগল? মুহুর্তের মধ্যেই কি থেকে কি উলটপালট করে বসে! এতো খাবার অর্ডার করে এখন তাকে রেখেই চলে গেলো!
মলি কি করবে বুঝতে পারছে না! একদিকে ফরহাদের উপর রাগও হচ্ছে আবার মায়াও হচ্ছে। সকাল থেকে তো সেও কিছু খায়নি, শুধু মাত্র এক কাপ কফি ছাড়া! যা-ই তাদের বাড়িতে হাতমুখ ধুয়েছিলো খাওয়ার জন্য সেটাও পারলো না তার জন্য, এখন এখানে এসেও খেতে দিলো না সে!
এবার নিজেকেই পাগল ভাবতে লাগলো মলি! মাথায় রাগ চাপা থাকলে নিজের কথাবার্তারই কোনো ঠিক থাকে না! মলি ফোনটা টেবিল থেকে উঠিয়ে খুজে খুজে কন্টাক্ট নম্বর বের করলো আর ফরহাদের নম্বরে ডায়াল করলো। একটু বাজতেই কল কেটে গেলো! কয়েকবার চেষ্টা করলো বারবার কেটেই দিচ্ছে। মলি ব্যর্থ হয়ে রেখে দিলো। ওয়েটারকে ডেকে বললো খাবারগুলো প্যাকেট করে দিতে। ওয়েটার প্যাকেট করে দিলে সে খাবার নিয়ে হেটে হেটে বাসায় ফিরে এলো।
.
.
“মালিনী”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
খাবার তো ঠিকই খাওয়া হয়ে গেছে কিন্তু সেদিকে ফরহাদ কি খেয়েছে! খাটে বসে মলি ভাবছে আর ফোন ঘোরাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে এবার কল দিয়েই ফেললো কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
“দূর! তার জন্য এতো ভাবছি কেন! যেমন ইচ্ছে তেমন থাকুক! আমি আমার মতো থাকতে পারলেই হলো।”
মলি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে শুয়ে পড়লো। এপাশ ওপাশ ছটফট করছে কিন্তু ঘুম আসছে না! না চাইতেও ফরহাদের কথাই মনে হচ্ছে বারবার! নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হয়ে ফোন নিয়ে সাপ গেমস খেলতে লাগলো। যাক! একটা কিছু পেলো যেটা দিয়ে সময় কাটানো যাবে। পরক্ষণেই নকশিকাঁথার কথা মনে হলো। তবুও আজ ছুটি কাটানোর মনোভাব নিয়ে একটু গেমস খেলার পরই ঘুমিয়ে পড়লো।
“মলি বাজারের দিকে যাচ্ছিলো। ফরহাদ এসে পাশে গাড়ি থামালো। খুব দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে মলিকে টেনে গাড়িতে উঠিয়ে দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলো। মলি হতবাক হয়ে আছে! ফরহাদ প্যান্ট ফোল্ড করে বাজারে ঢুকে পড়লো। যেন ফুটবল খেলতে যাচ্ছে! একা একা মলি গাড়িতে বসে আছে। একটু পরেই ব্যাগ ভর্তি শাকসবজি নিয়ে ফরহাদ বাজার থেকে বেরিয়ে এলো। ব্যাগটা মলির কোলের উপরে দিয়ে অন্যপাশে গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভ করতে করতে বললো,
– আর কখনো বাজার করতে আসবে না। মুহিত ভাইয়াকে বলো আর না হয় বলো কোনো ছেলেকে ভাড়া করে দেই বাজার করে দেওয়ার জন্য।
মলি তেজি কণ্ঠে জবাব দিলো,
– কোনো প্রয়োজন নেই! আমার ইচ্ছে মতো আমি চলবো, যেখানে খুশি যাবো, যা খুশি করবো। আপনি বলার কে! অন্যের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবুন। আর কে বলেছে এসব কিনে আনতে! যত্তসব!
পার্স খুলে পাচশো টাকার নোটটা বের করে ফরহাদের দিকে ধরে বললো,
– এবার করেছেন, কিছু বললাম না। পরবর্তীতে আমার উপর জোর খাটাতে এলে বস্তির কালু মাস্তানকে ভাড়া করে ঠ্যাং ভেঙে দিবো একেবারে।
টাকা দেওয়াতে ফরহাদ রেগে তাকালো মলির দিকে। হঠাৎ করেই গাড়ি থামিয়ে মলির হাত থেকে টাকা নিয়ে বললো,
– বের হ! যা বের হ! আমার করা বাজার আমিই খাবো।
বাজারের ব্যাগ নিয়ে সে ধাক্কিয়ে মলিকে বের করে দিলো গাড়ি থেকে। তারপর গাড়ি ছেড়ে দিলো। মলি চিৎকার করে ডাকছে,
– আরে! বাজারের ব্যাগ দিয়ে যান! আর না হয় আমার টাকা দিয়ে যান! সব নিয়ে যাচ্ছেন কেন! ধ্যাৎ!
কিছুটা পথ এগিয়ে গাড়ি থামলো। মলি দেখলো হাত বাড়িয়ে বাজারের ব্যাগটা রাস্তায়ই নামিয়ে দিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যাচ্ছে। মলি দ্রুত পায়ে এগিয়ে ব্যাগটা নিলো। দেখলো ব্যাগে টাকাটাও রেখেছে। গাড়ির দিকে তাকিয়ে মলি মৃদু হাসলো।”
হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখলো সে তার ঘরে আছে! তাহলে কি এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো! মলি শুয়ে শুয়েই হাসতে লাগলো! আহ! যদি সত্যি সত্যিই ফরহাদের প্রতুত্তরে তেজি জবাব দিতে পারতো তাহলে মনটা শান্তি পেতো!
ফরহাদের কথামতো বিকেলে আর যায়নি ওবাড়িতে। পরেরদিন সকালে গিয়ে শুনলো ফরহাদ চিটাগং চলে গেছে। একদিকে মন খারাপ হলেও অন্যদিকে খুশি! এখন সে নিজের ইচ্ছে মতো কাজ ও চলাফেরা করতে পারছে। দুদিন পর আবার কল করেছিলো। ফরহাদ রিসিভ করেছে কিন্তু কথা বলেনি। বলবে কিভাবে! এমনিতেই রাগ করে বসে আছে তারউপর মলি কল করে চুপচাপ ছিলো। কি বলবে কিছুই মাথায় আসছিলো না আবার কেন যেন তার মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যায় ফরহাদের সামনে! দুজনেই নিরবে এক মিনিট ব্যালেন্স অপচয় করেছে। অত:পর বিরক্ত হয়ে ফরহাদই কল কেটে দিয়েছে।
তার এগারো দিনের মাথায়, জিহানের জন্মদিন আজ। মলিকে দাওয়াত করেছে তাদের বাসায়। জেরিন বেশ কয়েকবার বলে দিয়েছে, কোনো গিফট না নিয়ে যেতে আর ভালো পোশাক যেন পড়ে যায়। খেয়েদেয়ে যেন আবার সাথে সাথে চলে আসে। এমন দাওয়াত দিলে কি কারো বাসায় যাওয়া যায়! তবুও মলি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কেননা, ফাহিমা বারবার বলেছে যেতে। উনার মুখের ভাষা নিখুঁত! সেখানে অমান্য করা যায় কিভাবে! জেরিনের দাওয়াতে নয়, ফাহিমা আন্টির করা দাওয়াতে যাবে মলি। অসময়কেও সময় বানিয়ে জিহানের জন্য একটা মাঝারি আকৃতির নকশিকাঁথা বানিয়েছে। অন্য কিছু দিলে তো সযত্নে রাখবে কিনা সন্দেহ কিন্তু কাথা ব্যবহার করে উশুল তুলে ফেলবে।
আলমারি খুলে আজ সেই জামাটাই পড়ার জন্য নিয়েছে মলি, যেটার ওড়না বের করে ফরহাদ হাতমুখ মুছেছে। মনে হতেই মলির মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। ভাবলে রাগও হয় খুব আবার হাসিও পায়। জিহানের জন্মদিন যেহেতু, তাহলে আজ তো সেও আসবে! কাল বিকেলে তো দেখেনি বাসায় আসতে, এখন এসেছে কিনা কে জানে! মলি যাবে কিনা তার কাছেও তো একবার জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। যেভাবেই হোক, বিয়ে তো হয়েছে! মলি ফোনটা নিয়ে কয়েকবার ভেবে কল করেই ফেললো। ফরহাদ রিসিভ করেছে কিন্তু কিছু বলছে না। মলি অনেক কষ্টে মুখে কথা আনতে পেরেছে।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– আজ কি আসবো জিহানের জন্মদিনের পার্টিতে? জেরিন ম্যাডাম দাওয়াত করেছিলো।
– আমি কি জানি। যার ইচ্ছে সে আসবে আর যার ইচ্ছে নয় সে আসবে না।
মলির মুখটা মলিন হয়ে গেছে। এসব কেমন ধাচের কথা বলে! ভালোমন্দ কিছু একটা তো বলতে পারতো! এতো অধিকার দেখাতে আসছিলো, কোথায় গেছে সেই অধিকার! মলিকে চুপ থাকতে দেখে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে ফরহাদ কল কেটে দিলো। টুট টুট শব্দ হতেই মলি ফোন কান থেকে নামিয়ে ধপাস করে খাটে বসে পড়লো। এদিকে গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলো মলি। জামাকাপড় একদিকে রেখে দ্রুত বাবার রুমে এলো। পেট নাকি জ্বালা করছে খুব! নিলীমা ঠান্ডা শরবতের ব্যবস্থা করছে। মলি পাশে বসে কিছুক্ষণ সেবাযত্ন করলো। গতকাল মুহিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। যত তারাতাড়ি সম্ভব, যেন ব্যবস্থা করে। ভাইবোন দুজনেই প্রচেষ্টা করছে টাকাপয়সা যোগাড় করার। সাথে পরিবারের বাকি দুজন মহিলাও লেগে থাকে কাজে সাহায্য করার জন্য। তবুও যেন অভাবের হ্রাস হয় না! বেশ কিছুক্ষণ সেবাযত্নের পর পেটের জ্বালা কমলো। মলি দ্বিধায় আছে ওবাড়িতে যাবে কি যাবে না! না গেলে আবার ফাহিমা আন্টি রাগ করতে পারে! যাওয়াই যাক, কিছুক্ষণ থেকে না হয় তারাতাড়ি চলে আসবে।
মলি তৈরি হয়ে গেলো নতুন জামা পড়ে। জিহানের জন্য তৈরি করা কাথাটা নিয়ে রওনা হলো। খুব সুন্দরভাবে সজ্জিত করা হয়েছে বাড়িটা। কালকেই দেখে গিয়েছিলো কিন্তু এখন পরিপূর্ণ লাগছে। লোকজনও অনেক জমা হয়েছে। মলি একপাশ দিয়ে বাড়িতে ঢুকে ফাহিমাকে খুজতে লাগলো। ফাহিমা তাকে দেখে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। মলি কাথাটা ফাহিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– আন্টি, এটা আপনার কাছে রাখুন পরে জিহানকে দিয়ে দিবেন।
– আমার কাছে কেন রাখবো! তোর গিফট তুই নিজ হাতে দিবি।
– জেরিন ম্যাডাম যদি কিছু বলে! তার চেয়ে বরং এখন আপনার কাছে রেখে দিন।
– আচ্ছা দিবো। তোর এতো দেড়ি হলো কেন আসতে!
– বাবার শরীরটা বেশি ভালো না। তাই।
– এসেছিস, আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু আবার তোর বাবার জন্যও খারাপ লাগছে। আমার আরেকটা ইচ্ছে পূরণ কর এবার।
ফাহিমা আলমারি থেকে একটা শাড়ি এনে মলির হাতে দিয়ে বললো,
– এটা পড়ে নে এখন।
– শাড়ি!
– হুম।
মলি দেখলো লাল রঙের জর্জেট শাড়ি। ঠিক এমন শাড়িই এখন ফাহিমা পড়ে আছে!
– আন্টি এটা তো হুবহু আপনার শাড়ির মতো!
– চার সেট এনেছি জিহানের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে। একটা আমার, একটা তোর, একটা জেরিনের আর একটা জেনিফার। এবার পড়ে নে তো।
– আন্টি, আমি তো এখানে বেশিক্ষণ থাকবো না। শুধু শুধু শাড়ি পড়ে কি হবে!
– এক মিনিটের জন্য হলেও পড়বি। আমি দেখবো। শাড়িতে নারীকে খুব সুন্দর লাগে। জেনিফা, জেরিন উভয়েই পড়েছে। তুইও পড়ে নে। এটা আমার পক্ষ থেকে তোদের সবার জন্য গিফট।
মলি বাধ্য হয়ে পড়ে নিলো। বাইরে বেরিয়ে আসতেই জেরিন সামনে! একই রকম শাড়িতে মলিকে দেখে চোখ জোড়া বড় বড় ছানার মতো হয়ে গেছে তার! মলির হাত ধরে একপাশে এনে বললো,
– মালিনী! এই শাড়ি কোথায় পেলি তুই!
– আন্টি দিয়েছে ম্যাডাম। আমি নিতে চাইনি। আন্টি জোর করেই দিয়েছে পড়তে।
জেরিনের নাকমুখ ফুলে যাচ্ছে! কি করে পারলো একজন কাজের মেয়েকে তাদের পরিবারের সদস্যদের মতো সাজাতে! খুব রাগ হচ্ছে জেরিনের ফাহিমার উপর। আগে জানলে কখনোই পড়তো না জেরিন! খুব কড়া কণ্ঠে মলিকে বললো।
– বাইরে মেহমানের সামনে যাবি না তুই। ঘরেই থাক। এখানেই খাওয়া দাওয়া করে বিদায় হবি।
জেরিন হনহন করে চলে গেলো। ফাহিমার রুমের দিকেই আসছিলো হয়তো কোন কাজে, কিন্তু তা আর হলো না! মলি সেখানেই দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখলো ফরহাদ দোতলা থেকে নামছে। মলি এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। কেননা ফরহাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে! মলি একপলক দেখা চিত্রটাকেই বারবার মনে করছে। এমনিতেই এ বাড়ির মানুষগুলো কিউটের ডিব্বা! তার উপর যদি এমন স্যুট কোট পড়ে পরিপাটি সাজে চোখের সামনে পড়ে তাহলে তো পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়! পরক্ষণেই মনে হলো বাড়িতে মেহমান অথচ তার মাথায় কাপড় নেই। দ্রুত আচল টেনে ঘোমটা দিলো। হঠাৎ করেই কানে বেজে উঠলো অন্যরকম শব্দ! জেনিফা চৌদ্দ ফুট দূরে থেকেই বলতে বলতে এলো,
– ওয়াও! ফরহাদ! হাউ সো সুইট! অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোমাকে!
দিক বিক দেখা নেই, হুট করেই এসে জড়িয়ে ধরলো ফরহাদকে! যেটা সহ্য হচ্ছে না এ প্রান্তে থাকা মালিনীর! মলির মুখে অসহ্য ছাপ দেখতে পেয়ে ফরহাদ ইচ্ছে করেই জেনিফাকে ধরলো এক হাতে। অন্যহাতে জেনিফার ব্লাউজের ফিতা ধরলো মলিকে আরেকটু জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। যেটা শুধু মলির চোখেই পড়লো আর ফরহাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মলি দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তাদের থেকে। কেন জানি খুব খুব অসহ্য লাগছে নিজের বরের কাছে অন্য মেয়েকে দেখতে! ফরহাদ বললো,
– তোমাকে কম লাগছে কিসে! তাছাড়া আমার পাশে তোমাকেই মানায় এটা সবাই জানে।
– হুম।
ফরহাদের কথায় জেনিফা হেসে উঠলো আর মলি জ্বলে! বুঝতে বাকি নেই ফরহাদ তার বলা কথাটাই বললো এখন। ফরহাদ মলিকে শুনিয়ে জেনিফাকে বললো,
– পাবলিক প্লেসে কেউ আক্রমণ করে, রুমে চলো।
– কেন, কি দিবে?
– দেওয়ার তো কত কিছুই আছে। বলে দিলে কিভাবে!
– ওকে, চলো।
জেনিফা খুশি মনে ফরহাদের হাত ধরে দোতলায় চলে গেলো। মলি এখানেই দাড়িয়ে আছে। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে তার! ফরহাদ নিজের ইচ্ছাতে তাকে বিয়ে করেছে তাহলে জেনিফার সাথে এতো মেলামেশা কেন! জেনিফা কেন তাকে টাচ করবে! সে-ই বা জেনিফার এতোটা নিকটে কেন ছিলো! বউ যদি মেনেই থাকে তাহলে বউয়ের সামনে অন্য মেয়ের…! ছি!
খুব কান্না পাচ্ছে মলির কিন্তু একটু মনমতো কাদার জন্য কোনো জায়গাও পাচ্ছে না খুঁজে! বাইরে মেহমান, তাই বেরও হতে পারবে না। দোতলায় তো তারা গেলো, না হয় সে ছাদে চলে যেতো! এখানেই দাড়িয়ে আছে সে। একটু পর হাসাহাসি করতে করতে দুজন নেমে এলো নিচ তলায়। মলি অন্যদিকে ঘুরে দাড়িয়ে আছে। পেছন থেকেই জেনিফা বললো,
– ছি! খুব দুষ্টু তুমি! আরে, মালিনী না! তুই এমন শাড়ি কোথায় পেলি!
ফাহিমা এদিকেই আসছিলো, তিনিই জবাব দিলেন,
– আমিই দিয়েছি মলিকে।
– ওহ্!https://www.facebook.com/profile.php?id=100058759920318
জেনিফা মুখটা মলিন করে ফেললো। ফাহিমা তার কাজে চলে গেলো। এই ফাকে মলি ছাদে যাওয়ার জন্য সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। জেনিফা ফরহাদের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে নিলে ফরহাদ বললো সে একটু পর আসছে। জেনিফা বেরিয়ে গেলো। আর এদিকে ফরহাদ এক প্রকার দৌড়ে দোতলায় চলে এলো। মলি মাত্র ছাদে যাওয়ার সিড়িতে পা ফেলেছে। ফরহাদ আর এগিয়ে যেতে দিলো না। সেখান থেকে টেনে তার রুমে এনে দরজা লাগিয়ে দিলো। মলির চোখ আর বাধা মানছে না! টুপটাপ পানি পড়া শুরু করে দিয়েছে। সে ফরহাদকে টপকিয়ে দরজার কাছে আসছিলো দরজা খোলার জন্য। ফরহাদ তাকে টেনে একদম নিজের কাছাকাছি এনে মাথার আচল ফেলে দিলো। মলি ছোটাছুটির বৃথা চেষ্টা না করে দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে দাড়িয়ে আছে। ফরহাদ তার খোপা করা চুলগুলো মুক্ত করে দিলো। মুখটা উঁচু করে দেখলো সাজ বলতে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে ঠোঁটে আর চোখে চিকন কাজল টানা। গাল গড়িয়ে পড়ছে চক্ষু বিন্দু কণা! ফরহাদের মুখে ফুটে উঠলো মৃদু হাসির রেখা। বুঝতেই পারছে তার মনে লেগেছে তাহলে ব্যাথা। তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
– বুক ফাটে তবুও মুখ ফুটে না! কাছে থাকলে পাত্তা দেয় না, দূরে গেলে মর্ম বুঝে!
ফরহাদ তাকে ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা স্বর্ণের চেইন বের করলো। মলির পেছনে দাড়িয়ে এক আঙুল দিয়ে ঘাড়ে হালকা আঁচড় ফেলে চুল সরিয়ে একপাশে আনলো। এমন স্পর্শে মলির দেহে শিহরণ বয়ে গেলো কিন্তু শিহরণটা মনে বেদনা হয়ে আছে। ফরহাদ চেইনটা পড়িয়ে দিয়ে হটাৎ করেই একটানে তার ব্লাউজের ফিতা খুলে দিলো! মলি ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে আছে। অশ্রুপাত যেন আরও গতি বাড়িয়ে দিয়েছে! ঘাড়ে ফরহাদের ঠোঁটের ছোয়া পড়তেই মলির মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
– জেনিফা ম্যাডামের কাছে কি তৃপ্তি মেটেনি?
এমন উক্তিতে ফরহাদের প্রচুর রাগ হলেও ততটা প্রকাশ করেনি। ড্রেসিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে দাতে দাত চেপে বলতে লাগলো,
– জানতাম! জানতাম আমি এমম কিছুই ঘটবে! সন্দেহ করা তো মেয়ে লোকের স্বভাব!
টেবিলে রাখা ফোনটা এনে একটা ভিডিও বের করে মলির হাতে ধরিয়ে দিলো। মাত্র পড়িয়ে দেওয়া চেইনটা গলা থেকে খুলে পকেটে রেখে সে দ্রুত পায়ে বাথরুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো যেন সব অপরাধ দরজা ই করেছে! মলি ফোনে তাকিয়ে ভিডিওটা দেখলো। জেনিফা ফরহাদের সাথে রুমে এসেছে। একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো জেনিফার হাতে। জেনিফা প্যাকেট খুলে বের করে আনলো একটা প্লাস্টিকের সাপ! জেনিফা চিৎকার দিয়ে সেটা মেঝেতে ফেলে দিলো। আর তা দেখে ফরহাদ হাসতে হাসতে বললো, “দারুন না জিনিসটা! কাল আসার সময় পথে দেখতে পেয়েছি তাই নিয়ে এলাম। সকালে জিহানকে ভয় দেখাতে গেলাম কিন্তু ভয় পেলো না। সে উল্টো সবাইকে ভয় দেখিয়ে এসেছে। ”
“ফরহাদ! আমার জানই বেরিয়ে আসছিলো! এসব কেউ করে! তোমাদের মাথায় এতো দুষ্টুমি চেপে থাকে কেন! আমি খুব ভয় পেয়েছি!” অত:পর দুজনেই বেরিয়ে গেলো হাসতে হাসতে। ভিডিও দেখে মলির চোখে পানি আর ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠেছে একটু হাসি। সেটা এই ভেবে যে, প্রমাণ দেওয়ার জন্য আবার ভিডিও করে রেখেছে।