ছায়া নীল পর্ব-১৬

0
178

ছায়া নীল!

১৬

কপাল ঘামে ভিজে আছে। ওকে ডাকা যাবেনা। আমার জন্যে এমনিতেই অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। এখন ঘুমানো যাবে না। টেলিভিশন ছেড়ে খুঁজতে থাকলাম কোনো ভালো মুভি হচ্ছে নাকি। পেয়েও গেলাম। ইংলিশ মুভি টাইটানিক। অসম্ভব ভালো একটা মুভি একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। ভয় টা আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগলো। মুভিতে এতোই মগ্ন হয়ে রইলাম যে সময় সেটাও খেয়াল নেই।
মুভির শেষ মুহূর্তে আমার গাল বেয়ে পানি টপটপ করে পরছে। সৌরভ ঠিক এই সময়ে রুমে ঢুকলো। মনে হলো একটু অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো
– আবার কী হয়েছে??
কথা বলার সাথে সাথে ও টেলিভিশনের দিকে তাকালো তারপর হেসে বলল
– ওহ এই কাণ্ড!
চোখেরজল মুছে বললাম
– কত কষ্টের কাহিনী দেখেছো। রোজ, জ্যাককে ছাড়া কীভাবে থাকবে??
– আচ্ছা বুঝলাম। একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
– হুম, বলো।
– শারলিন, নীল কে ছাড়া কীভাবে থাকবে ?
ওর মুখের দিকে তাকালাম। এই প্রশ্ন কেন করলো ?
– বুঝলাম না?
– খাবার এসে যাবে তুমি গোসল করে নিতে পারো। না না থাক তোমার হাত ভেজানো যাবে না।
– নীল অনেকদিন গোসল করি না। কেমন বিশ্রী লাগছে।
– শারলিন আর মাত্র ২ দিন। তারপর পুকুরে লাফাবা তাতেও কিছু হবেনা।
– পুকুর কই পাবো?
– আমাদের বাসায় আছে। হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি খাবার রেডি করছি।
হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি বিছানার উপর চাদর বিছিয়ে খাবার রাখা হয়েছে।
আমাকে দেখে বলল
– পিওর বাঙালি খাবার। কোনো হোটেল থেকে আনা না।
– তাহলে তুমি রেঁধেছ?
– আমার দ্বারা সম্ভব না। আমাদের পিয়নের বউ হেব্বি রান্না করতে পারে। ওনাকেই ঠিক করা আমার।
– বুঝেছি।
খাবার খাওয়ার সময় ওকে বললাম
– আমার সেই ভয় পাওয়ার কারণ টা জানো?
– আমি একটা কারণ খুঁজে পেয়েছি। অবশ্যই তুমিও পেয়েছো। তোমার টা আগে শুনি।
– তোমাদের বাসায় খারাপ কিছু আছে। ভূত টাইপের।
– তোমার হাতের রক্ত খেতে চেয়েছিলো?
– হুম।
আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো।
– তুমি খাও। আমি বলছি কারণটা কী। তোমার ভেতর এই ধরনের ভয় অনেক আগে ঢুকে গেছে। মানুষের মস্তিষ্কের একটা অংশে এই ভয়টা জমা থাকে। যখন ওই ধরনের অর্থাৎ একটু পুরাতন বাড়ি বা গল্পে, মুভিতে ভূত থাকার আলামত বলে দেয় ওরকম কিছু দেখলেই সেই ভয়টা জেগে উঠে।
তারপর ও চুপ হয়ে গেলো। আমার কথা গুলোতে বিশ্বাস হচ্ছে। ছোটোবেলায় দাদীর কাছ থেকে অনেক ভূতের গল্প শুনেছি। এমনকি আমি প্রচুর হরোর মুভিও দেখি। ও আবার বলল
– আমাদের বাড়িটা অনেক পুরাতন। ভাঙা চোড়া তাই তোমার কাছে ভুতুড়ে মনে হয়েছে। মস্তিষ্কের সেই ভয় তোমার ঘুমের ঘোরে হানা দিয়েছে। তাছাড়া আর কিছুই না।
– সত্যি তো?
– হ্যা অবশ্যই। ভয়টাকে জয় না করতে পারলে তোমাকে সেই ভয় তাড়া করে ফিরবে।
– বুঝলাম না?
– মনে করো আমার রুমে তোমার আর একা ঘুমানো সম্ভব না। ভয়টাকে জয় না করতে পারলে একসময় তুমি কোনো রুমেই একা থাকতে পারবে না।
– একটু আগেও চোখ বুজেছিলাম কিন্তু আবার সেই হাত…
– বলেছি না তোমাকে।
– এখন কী করতে হবে বলো?
– কোনো সাইক্রাটিসই বলতে পারবে। আমি তো এটুকু জানতাম তাই বললাম।
– নীল আমাকে সাহায্য করো। আমি আর পারছি না, আমি ক্লান্ত।
– এতেই তুমি হেরে গেলে? তুমি তো এতো সহজে হার মানার মেয়ে না।
– আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো ঠিক উত্তর দিবে?
– হ্যা করো।
– স্বপ্নের ব্যাখ্যা টা আমাকে দিলা না। আমি জানতে চাই কীভাবে?
– বলবো। আগে খেয়ে নাও। শান্তি মতো বসে বলা যাবে।
খাওয়া শেষ হবার পর ও বলল
– আমি এসব নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তুমি একটু বিশ্রাম নাও।
– আর কতো বিশ্রাম নিবো??
আমি তো মোটা হয়ে ফেটে যাবো।
– তুমি কখনওই মোটা হবে না।
– কেনো?
– তবে বাবুর মা হলে হতে পারো।
ও চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে এঠো বাসনকোসন নিয়ে গেলো। আবার বসে থাকা। ঘুমের ঝিমুনি তে চোখ বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। ও দুমগ কফি হাতে নিয়ে আবার রুমে ফিরে এলো।
আমার দিকে একটি মগ দিয়ে বলল
– নাও ঘুম কাটবে।
কফির মগে চুমুক দিলাম, তেমন ভালো কফি না।
– আচ্ছা তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলা না কিন্তু!
– শুনো তাহলে… ওহ কফি ভালো হয়নি তাই না?
– নাহ ভালো না। এরে কফি বলে কেউ?
– আমি বানালাম ভাবলাম তোমার ভালো লাগবে ।
– ভালবাসি বলেই কি সবকিছুই ভালো লাগতে হবে? তুমি তো আমাকে সহ্যই করতে পারাও না। কিছু হলেই…..
– শুধু বাহির টুকু দেখে বিচার করতে নেই। ভেতর টুকুও জানতে হয়।
– আমি তো আর এক্সরে মেশিন না।
– এক্সরে মেশিন হতেও হয়না।
– আমার উত্তর টা পাবো?
– তোমার ছবিটা যখন পেলাম তখন আমি টোটালি ডিপ্রেশন এ ভুগছিলাম। জীবনের অনেক বড় ধরনের স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল। একটা উপায় খুজছিলাম কীভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখা যায়। মা আমাকে তোমার ছবি দেখিয়ে বলল ” দেখেছিস কতো সুন্দর?? ” ছবিটা দেখে আমি অবাক হলাম। কিশোরী এক মেয়ের চোখে কতো চঞ্চলতা খেলা করছে। সেই চোখেই হাসির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসির ছোঁয়া।
নামটা তখনও আমার জানা ছিলো না। যখনি সময় হতো তখনি আমি ছবিটা দেখতাম। কিন্তু সামনাসামনি আসার সাহস ছিলো না। জানোই তো একটা প্রবাদ আছে – ঘর পোড়া গরু সিঁদুররাঙা মেঘ দেখে ভয় পায়।
তারপর ও কফিতে চুমুক দিলো। ওর চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে ওর চোখের ভাষা পড়ি। কিন্তু ও আমার দিকে পিছন ফিরে আছে।
ও আবার বলতে শুরু করলো
– তীব্র ভালোলাগা কাজ করছিলো। আমাকে এক কাছের লোক বুদ্ধি দিলো। স্বপ্নের মাধ্যমে দেখা কর, কথা বল, মোহের জালে আটকে ফেল। তরুণী বয়সের মেয়ে এই বয়সে মেয়েরা আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেয় , বাস্তবতাকে তারা তুচ্ছ মনে করে।
– স্বপ্নে কীভাবে সম্ভব?
– আমি পারি, অবশ্য তুমি পারবা না।
– কীভাবে পারো? আমি তো কোনো সমাধানই পাচ্ছি না।
– ব্ল্যাক ম্যাজিক বুঝো?
– তুমি ব্ল্যাক ম্যাজিকের মাধ্যমে!
– হ্যা, প্রকৃতির নিয়মে তো আর হয়নি তাই ব্ল্যাক ম্যাজিক ব্যবহার করেছি। আসলে ওই সময়টা আমি ভালো থাকতে চাচ্ছিলাম কোনো একটা উপায়ে। কেউ বলেও দেয়নি যে এটা পাপ। ইভেন আমি জানতামও না যে এটা ব্ল্যাক ম্যাজিকের মধ্যে পড়ে।
যখন প্রথম একজন কিশোরী কে দেখলাম আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। এতো সুন্দর কোনো মানুষ হতে পারে?
– আচ্ছা যখন জানলে যে এটা খারাপ তখন কী করলে?
– তখন আমি বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু ততোদিনে তুমি আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছো। কীভাবে স্বভাব ত্যাগ করি? ভাবলাম সামনে আসবো কিন্তু…
– কী?
– আমি সত্যটা জানানোর সাহস পাই নেই তখন। কিন্তু আস্তে আস্তে তুমিও জেদ ধরতে শুরু করলে। আমি অনেক চেষ্টা করতাম স্বপ্নের ব্যাপার টা ভুলে থাকার। এমন অনেক রাত ঘুমের মেডিসিন খেয়েও কাটিয়েছি।
– সমস্যা কী ছিলো? তুমি তো ভালবাসো আমাকে তাহলে?
– আমি অনেক বড় পাপ করেছি। তোমাকে নিয়ে খেলেছি। তোমার প্রতি ভালোলাগা ছিলো কিন্তু ভালবাসা ছিলো না। তাহলে সেটা কি খেলা না?
তুমি কষ্ট পেলে আমার আনন্দ হতো। মনে হতো আমি আমার প্রাক্তন কে কষ্ট দিচ্ছি। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই আনন্দ টা আর থাকলো না। খারাপ লাগা শুরু হলো যখন বুঝতে বাকি থাকলো না, মেয়েটা আমায় পাগলের মতো ভালবাসে।
কথা গুলো শুনতে আমার খারাপ লাগছিলো না। আসলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। আমার অনুভূতি আর আগের মতো প্রখর নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
– তাহলে যে বললে, ভালবাস আমায়?
– তোমাকে বিয়ের সাজে দেখে হিংসা হচ্ছিলো। অন্য কারো হবে? ওকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে। ওর সেই চোখের চঞ্চলতা আমার হবেনা? তারপর তো তুমি ভয়ংকর কিছু করে বসলা। কিছু হয়ে গেলে কী হতো?
তোমার সাথে মাঝেমধ্যে খারাপ ব্যবহার করি সেটা আসলে আমার নিজের উপরের রাগটা তোমার উপর প্রয়োগ করে বসি। চেষ্টা করি নিজেকে থামানোর। আসলে আমি মানুষ টা পুরোপুরিভাবে ভালো না।
– আমি এখন কী করবো? আমাকে একটা পথ দেখিয়ে দাও।
– বুঝলাম না ঠিক?
– তুমি তো আমাকে গ্রহণ করবে না। আমাকে অন্য কেউ বিয়েও করবে না। বাসায় যাওয়া নিষেধ। আমার যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। তুমি যে খেলা খেলেছো তাতে আমি পুরোটা ধ্বংস হয়ে গেছি। একজনের প্রতিশোধ আমার উপর তুলে খুব ভালো কাজ করেছো। তার উপর তো তুলতে পারতে? আমাকে কেনো নীল?
– আমি নিতে চাইনি কিন্তু কীভাবে যে করলাম আমি নিজেও জানি না। ভেতরের শয়তানটা জেগে উঠতো। বিশ্বাস করো শারলিন আমি প্রতিশোধ ব্যাপার টা ইচ্ছে করে করিনি।
– তুমি কী বলছো নিজে বুঝতে পারছো?একবার এটা বলছো আরেকবার তার উল্টো টা বলছো।
– জানি না মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। একটা কথা আমি স্পষ্ট ভাবে বলতে পারি সেটা হচ্ছে, এখন আমি আর তোমার কোনো ক্ষতি হোক চাই না।
– ক্ষতি হবার মতো আর কিছুই নাই।

চলবে……!

© Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here