ছায়া নীল পর্ব-১৭

0
186

ছায়া নীল!

১৭

সৌরভ আমার সামনে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। তারপর বলল
-একটা বাজে কিছু ঘটে গেছে। আমার ইচ্ছে ছিলো বলবো না। তারপর ভাবলাম বলে দেয়াটা ভালো।
– কী ঘটেছে??
– তোমার মা মানুষ টা কেমন তোমার মনে হয়??
– ভালো না।
– আমার মতে, খুব নিচুস্তরের একজন মানুষ। আমি তো খারাপ, আমার চেয়েও উঁচু মানের।
– কী ঘটেছে বলবা?? আর আমার মায়ের বদনাম আমার কাছেই করছো?
– আসলে সত্যিটা বলছি। তোমার মহীয়সী মাতা, তার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। তারপর সেই টাকা নিয়ে ভেগে গেছেন।
– মানে?? বাবার সম্পত্তি মায়ের নামে ছিলো।
– যার নামে তারই তো সম্পত্তি। বসত বাড়ি আর যা যা ছিলো সব বিক্রি করেছেন। আর তোমার বাবা তোমার চিন্তায় ব্যাকুল। তার একমাত্র মেয়েকে কই রাখবে??
তোমার নানী বাড়িতে তোমার যাওয়া নিষেধ। আর অন্য কেউ নিতেও চায়না।
– আমাকে একটা চাকরী দিবে?? তোমার অফিসে??
– ইন্টার পাশে তো পিয়নের চাকরী। করবা??
– পেট চললেই হবে!
– আমার মা আর তোমার বাবা মিলে একটা উপায় খুঁজে বের করেছেন। সেটা হচ্ছে – আমার গলায় তোমাকে ঝোলাবেন। আমার আপত্তি নেই। দোষ আমারি তাই ভুগতেও হবে আমাকে।
– নাহ, তুমি যা করেছো তাতে আমি…
– তুমি কি ভেবেছো?? তোমার ইচ্ছায় সব হবে??
– মানে? কী বলতে চাও তুমি?? তোমার মতো একটা রাবিশকে বিয়ে করবো?
– হ্যা তাই করবে। তুমি আমাকে ছেড়ে যাবার মেয়ে না।
– যদি যাই??
– পারবে না।অফিস আজকে ৪ টায় ছুটি হয়ে গেছে।
হাতের ঘড়ি দেখে বলল
– এখন ৪.৩০ বাজে। ৩০ মিনিটের মধ্যে সবাই এখানে আসবে।
– আমাকে কাফন পড়াতে??
– নাহ বিয়ে পড়াতে আসবে। তারপর তোমার বাবা যেখানে চোখ যাওয়ার সেখানে চলে যাবেন। তারপর থেকে তুমি আমার।
– আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আর ওই ভূতের বাড়িতে থাকবো না।
– কিছুদিন থাকতে হবে, এখানকার বাড়িটা বসবাসযোগ্য হতে আরো ৩ মাস লাগবে।
– আসুক সবাই বিয়ে আমি করছি না।
– আমি ১০০% শিওর তুমি করবে। আমার কাছে ৩ টা লজিক আছে। ৩ টাই শক্তিশালী লজিক। শুনবে?
– নাহ।
– শুনো। ১. তুমি আমাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতেও পারো না।
২. তোমার বাবার চোখের পানি দেখে তুমি আমাকে ১ বার কেনো হাজার বার বিয়ে করতে রাজি হবে।
৩. তোমার উপর একমাত্র আমার অধিকার অন্য কারো না। আর অধিকার তুমিই দিয়েছো।
– উইল করে দিয়েছিলাম নাকি??
– হ্যা, অলিখিত উইল।
আমি কিছু বলতে যাবো তখন দরজায় নক পরলো। ও দরজা খুলে একটা লাগেজ নিয়ে আবার দরজা আটকে দিলো।
লাগেজ টা বিছানার উপর রেখে বলল
– এখানে বিয়ের শাড়ী আর গহনা আছে। পড়ে নাও। তোমার বাবার কাছে তেমন সময় নেই।
– আমি পড়বো না।
– আচ্ছা তোমাকে এই ফকিন্নি মার্কা পোশাকেই বিয়ে করবো। পরে আফসোস করবা এই ভেবে যে, ইশ আমার বিয়ের শাড়ি নেই ।
আরে মেয়ে খারাপ কিছু নেই। সব দামী দামী জিনিষ। তোমার তুহিন লোকটার আনা শাড়ীর থেকে দামী।
তুহিনের আনা শাড়ী আমি আগুনে পুড়িয়েছি।
আমি অবাক হলাম ওর কথা শুনে।
– বুঝতে পারছো না?? হাসপাতালে তো আর তোমাকে বিয়ের শাড়ীতে রাখবে না। আমাকে দিয়েছে। রাগটা বেচারা শাড়ীর উপর উঠিয়েছি।
আমি বাচাল প্রকৃতির মানুষ। প্রচুর কথা বলি।
বাবা চলে এলেন। ৩০ মিনিট হবার আগেই। সাথে আরো দুজন ছেলে আর হুজুর টাইপের একজন লোক। কথাবার্তায় মনে হলো সে সম্মানিত কাজি সাহেব।
বাবা আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
– মা রে আমাকে মাফ করিস। তোমার বাবা হওয়া সত্ত্বেও তোর কোনো ভরণপোষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। তোর মা যা করলো।
– বাবা তুমি যেখানে যাবে সেখানেই আমি যাবো তুমি আমাকে সাথে নিয়ে চলো।
– নাহ, মা তুই এতো কষ্ট করতে পারবি না। তোর মেজো ফুপুর ছেলে একটা সোনার টুকরা ছেলে। তুই ওকে বিয়ে কর। আমি শান্তি পাবো।
– বাবা না।
– মা, মানা করিস না। এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় আমি খুঁজে পাচ্ছি না। একটা চাকরী যে করবি সেটাও পারবি না।
– কেনো??
– মা আমার কথা মেনে নে। তুই ইনশাআল্লাহ সুখী হবি।
ফকিন্নি মার্কা পোশাক পড়েই কাবিননামায় সিগনেচার করলাম।
বাবা আমাদের দুজনকে দোয়া দিয়ে চলে গেলেন। বাবাকে আজকে নিস্ব লাগছে। আমারও কেমন যেন ফাঁকাফাঁকা লাগছে।
সৌরভ বলল
– নো টেনশন প্লিজ। তোমার বাবা ভালোই থাকবে।
কথাটা বলার সময় আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। অবাক হলাম ওর চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারছি না।
একটা মানুষ আমার সাথে এতো খারাপ কিছু করেছে আর আমি তার প্রত্যেকটা কথা মেনে নিচ্ছি। এমনকি ও যা যা বলছে তার বিরুদ্ধে কথা বললেও তা ঠিকি মেনে নিচ্ছি।
আমি এখন পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত যে, ও আগেও আমার উপর প্রভাব বিস্তার করতো, এখনো করছে এবং ভবিষ্যৎ এ করবেও।
আমি চাইলেও এটা উপেক্ষা করতে পারবো না।
বাবা কোথায় যাচ্ছেন? কী করতে যাচ্ছেন? কিছুই জানি না। ও সবই জানে কিন্তু আমাকে বলবে না। শেষ পর্যন্ত আমাকে এই নোংরা অবস্থায় সাধারণ একটা থ্রিপিচ পড়ে বিয়ে করতে হলো। সৌরভ কে বললাম
– বাসায় কখন যাবে??
সৌরভ মনে হয় অন্যমনস্ক ছিলো। তাই উত্তরে বলল
– কী বললা??
– বাসায় কখন যাবা??
– মা বাসায় নেই, আর আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না।
– তাহলে??
– আমার চেনা এক আবাসিক হোটেল আছে ওখানে আজকের রাতটা থাকবো।
আমার কিছু বলার নাই। ও বাসা থেকে যতো দূরে থাকা যায়। হোটেল দেখে আমি রীতিমতো অবাক হলাম। এতো সুন্দর। আমরা রুম পেলাম তিন তলার ৩০৩ নাম্বার রুমটা।
লিফট দিয়ে উঠার সময় মনে পড়লো, সিরিয়াল কিলাররা এভাবে হোটেলে মেয়েদের এনে মেরে ফেলে। ও আমাকে ফেরে ফেলবে না তো। ওর হাতে সেই লাগেজ টা এখনো আছে। জানি না কী হবে আমার?
রুমে এসে ঢোকার পর ও জিজ্ঞেস করলো
– কিছু খাবে??
রুমটাও সুন্দর, বেশ বড়, জানালার কাছে বেড রাখা। টেলিভিশন আছে, এমনকি একটা ছোট্ট বারান্দাও আছে। খিদে তেমন পায়নি। তারপরও কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল। তাই বললাম
– খাবো, চিকেন ভেজিটেবিল স্যুপ আর চিকেন ফ্রাই।
– বেয়ার না উইস্কি??
– আমি ওসব খাই না।
টেলিফোন একটা ছোট্ট টেবিলের উপর রাখা। ও ফোন করে খাবার অর্ডার দিয়ে দিলো।
আমি বললাম
– এখানে আনার কারণ?? মেরে টেরে ফেলবা নাকি??
– আজকে কি অমাবস্যাতিথি??
– আমি ওসব বুঝি না। মেরে ফেলতে চাইলে মারবা। তবে এমনভাবে মারবা যেন বুঝতে না পারে যে,আমার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
ও সহজ স্বাভাবিক ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল
– কেনো??
– পোস্টমর্টেম ব্যাপার টা ভয় লাগে। কাটাকাটি করবে এই দেহ। অনেক ব্যথা পাবো। কাকে কীসব বলছি, তার তো কোনো ফিলিংসই নেই।
– আচ্ছা, চেষ্টা করবো।
তারপর ও লাগেজ খুলে একটা বড় গামছা বের করলো। তারপর বাথরুম থেকে একটা ছোট্ট বালতি এনে আমার সামনে রাখলো। পানির ভিতরে গামছা রাখা। আমি বুঝতে পারছিলাম না ও কী করতে চাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম
– এটা দিয়ে কী করবা??
ও পানি থেকে গামছা তুলল তারপর গামছাকে চিপড়ায়ে বলল
– তোমার হাত পা মুছে দিবো। অনেকদিন গোসল করো না। মুছে দিলে আরাম পাবা রাতে ঘুমও ভালো হবে।
কথাটা বলে আমার অনুমতির অপেক্ষা না করে হাত টেনে ধরে মুছতে শুরু করলো। আমি অবাক হয়ে বললাম
– একি করছো? আমি করি।
কোনো কথা শুনলো না। সত্যি হাত পা মুছার পর আমার বেশ আরাম লাগছে। খাবার চলে আসার পর খেয়ে নিলাম।
বিয়ের পর মেয়েদের মনে মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টো।আমাকে ও মেরে ফেলবে এমন মনে হচ্ছে। কিন্তু ওর দৃষ্টি তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
ও বলল
– তুমি খুব চিন্তিত। কারণ টা জানতে পারি??
– নাহ।
– আমি জানি শুনবে?
– নাহ।
– শুনো, তুমি ভাবছো আমি তোমাকে মেরে ফেলার জন্য এখানে এনেছি। বাসায় কেনো নিয়ে গেলাম না, এই প্রশ্নের উত্তর একটাই খুঁজে পেয়েছো। যেটা বললাম একটু আগেই। তবে উত্তর টা ভুল।
– সত্যটা বললেই হয়।
– বাসায় মা নেই।মা মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। ধরো ১/২ দিন পর ফিরে আসেন। খোঁজার অনেক চেষ্টা করেও লাভ হয়না। প্রথম প্রথম ব্যাপার টা মেনে নিতে পারিনি। এভাবে বাসার বাইরে থাকা খুবই ভয়ের। পুলিশ এ জিডিও করেছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
– তাকে জিজ্ঞেস করোনি?
– কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। সাইক্রাটিস দেখানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কোনো লাভ হয়নি।
– সাইক্রাটিস কেনো??
– মানসিক সমস্যা হলে তো এরাই সেটা সমাধান করেন। আমার মায়ের মানসিক সমস্যাটা তীব্র রকমের খারাপ।
– দেখে তো মনে হলো না। খুবই স্বাভাবিক একজন মানুষ।
– তাকে দেখে কখনওই মনে হয়না। তুমি যেদিন আমাদের বাসায় এলে সেদিন কিন্তু সে একটাবারের জন্যও রুম থেকে বের হননি। আরেকটা কথা সে অনেক উদ্ভট কথা বলবে। বিশ্বাস করার ভান ধরবে কিন্তু ভুলেও বিশ্বাস করবে না। তার মন মানসিকতা খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়।
– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
– কয়েকদিন থাকলেই বুঝতে পারবা। আর রান্নাটা নিজে করার চেষ্টা করো। আমাকে অন্তত বাঁচাও।
– তোমাকে তো আমার স্বাভাবিক মনে হয়না।
– দীর্ঘ সময় একজন মানসিক রোগী নিয়ে আছি বলে কথা। বাড়িতে সে কোনো কাজের লোক রাখতে দেয়না। এমনকি কোনো মিস্ত্রী আনতে পর্যন্ত দেয়না। পানি বা স্যানিটারি ঘটিত ঝামেলা হলে সারাক্ষণ সেই লোকের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তার ধারনা তাকে কেউ মেরে ফেলবে। আরো যতো প্রকার অজুহাত আছে সব দেখাবে। যাই হোক, এগুলো বলার জন্যেই এখানে আনা।
– তুমি যে বললে, মা বাড়ি নেই।
– মা ফোন করে বলল নেই, আবার থাকতেও পারে। মূল কথাটা কি জানো??
– বলো।
– তোমার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে মন চাচ্ছিল।
– তোমার বাবার কী হয়েছিলো?
– পরে বলবো
ও আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল তারপর বলল
– ঘুমিয়ে পড়ো। যতো পারো ঘুমিয়ে নাও। আমাদের বাসায় গেলে তো ঘুম থাকবে না।
– ভূত কি আছে??
– আরে না, তোমার ভুল।

চলবে….!

~ Maria_kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here