#ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৪১
লেখকঃ লামইয়া চৌধুরী।
বাড়ি ফিরে নক্ষত্র দেখলো, শায়েরী নায়লাকে ধরে ফোঁপাচ্ছে। নক্ষত্র তখন আর শায়েরীর কাছে গেল না। নিজের ঘরে গিয়ে জামাকাপড় বদলে দরজা আটকে বসে রইল। শায়েরীর নানীকে নিয়ে যেতে শায়েরীর মামারা এলো। শায়েরীর নানার বাড়িতে কবর দেওয়া হবে নানীকে। নিয়ে যাওয়া হলো। সেই প্রথম নায়লা গভীর মমতার পরশে শায়েরীকে বুকে নিয়ে ঘুমালো। শায়েরীর মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আম্মা আছি তো। রাগারাগি করি মানে তো এই না যে তোকে ভালোবাসি না, আদর করি না। আমার তো তোর উপর কোনো রাগ নেই, আমার সব রাগ শুধু তোর আব্বার উপর।”
শায়েরী বিশ্বাস করলো না সে কথা। ধরে নিলো সান্ত্বনার বাণী বুলাচ্ছে। সে নিথর হয়ে পড়ে রইল বিছানায়। সারা রাত নায়লা শায়েরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সকালে উঠে শায়েরীকে নিজ হাতে খাইয়েও দিলো। শায়েরী বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল।নক্ষত্র শায়েরীর সাথে কথা বলতে এলো বিকেলবেলায়। শায়েরী মাথানীচু করে নানীর বিছানায় বসেছিল। হাত বুলাচ্ছিল যেখানটায় নানী শুয়ে থাকতো। নক্ষত্র দরজায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যটা দেখতে লাগলো। আলুথালু, অগোছালো চুলের শায়েরী আচমকা মুখ তুলে তাকালো।ইশারায় নক্ষত্রকে ডেকে পাশে এসে বসতে বলল। নক্ষত্র যন্ত্রের মতন শায়েরীর পাশে গিয়ে বসল। শায়েরীর চোখ টকটকে লাল, কাঁপছিলল চোখজোড়া। নক্ষত্র শায়েরীর অমন মুখখানা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো শায়েরীর জন্য, ভীষণ! অনেকটা সময় পর শায়েরী নিজেই কথা বলল। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “আমি গতকাল দুপুরের দিকে দোকান থেকে বিষ এনেছিলাম।”
নক্ষত্র চমকে তাকালো শায়েরীর দিকে। শায়েরী আশ্বস্ত করে বলল, “ইঁদুর মারবার বিষ।”
নক্ষত্র প্রশ্ন করল, “তো?”
“তোমাকে সেই বিষ খাওয়াতে চেয়েছিলাম।”
বিস্ময়ে নক্ষত্রের চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। ছোটখাটো একটা মুরগীর বাচ্চা ঢুকে যেতে পারবে এমন হা করে তাকিয়ে রইল শায়েরীর দিকে। শায়েরী হঠাৎ ফোঁপাতে শুরু করল। এলোমেলোভাবেই বলল, “নানী কেমন করে যেন টের পেয়ে গেল। তারপর আমাকে বকাবকি করে থাপ্পরও দিলো। রাগ করে আমি দুপুর থেকে বিকাল অবধি বাইরে গিয়ে বসে রইলাম। নানী এই সময়ে ভাতঘুম দিতো। ভেবেছিলাম নানী আছরের নামাজ পড়তে যখন উঠবে তখন আমাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে নিজেই আমাকে খুঁজতে বের হবে। আমি মান দেখিয়ে থাকব, নানী আমাকে অনেক অনেক আদর করবে। আমি তারপরেও গাল ফুলিয়ে থাকব। কিন্তু কই কিছুই তো হলো না। নানী ঘুম থেকে উঠছে না, নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে তাই আব্বা নাকি গেল নানীকে ঘুম থেকে জাগাতে। একসময় বুঝল নানী ঘুম থেকে আর জাগবে না।”
নক্ষত্র আচমকা বলল, “আমার ফুফু অনেক ভালো শায়েরী। এখন আমাকে কতটুকু আদর করে তার সাথে যদি তুমি তুলনা করতে যাও তবে নিজেই ঠকবে। আমার মনে হয় ফুফু নিজের ছেলেমেয়ে থেকেও আমাকে বেশি আদর করবে।”
শায়েরী সেদিন সেকথা একরত্তিও বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস করল তখন যখন শিকু হলো। সত্যি সত্যি নায়লা শিকুকেও তেমন আদর করে না। সারাদিন মারে, বকে, ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান করে শিকুর সাথে। ঠাস ঠাস মারেও। খেলো কিনা, পড়ল কিনা, শিকুর গোসল করা হলো কিনা কিছুই খেয়াল করত না নায়লা। শিকু একপ্রকার অবহেলায়, অনাদরেই বড় হতে লাগল। তাই একসময় শায়েরী নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে শিকুকে আগলে রাখতে লাগলো। শিকুর সবকিছু একপ্রকার সেই দেখতো। শিকুও তার বোন বলতে পাগল। শিকুর সকল শখ আহ্লাদ তার বড় বোন শায়েরীর কাছেই।
শায়েরী অবাক হয়ে নায়লাকে নিয়ে ভাবতো। অনেক অনেক ভাবতো। শায়েরীর সাথে যেমন ব্যবহার করত শিকুর সাথেও তেমন একই ব্যবহার কেন করত নায়লা? শায়েরী নাহয় সৎ মেয়ে, কিন্তু শিকু তো নিজের পেটের ছেলে, নিজের সন্তান। তারপরেও কেন এমন উদাসীনতা শিকুর প্রতি? কেন? সবচেয়ে বেশি বাজে ব্যবহার করত শায়েরীর আব্বার সাথে। অথচ, নক্ষত্র এলেই কেমন বদলে যেত নায়লা। প্রথম প্রথম শায়েরী বিষয়টা ধরতে পারেনি। ধীরে ধীরে যখন বুঝল তখন তার আচমকা নানী মারা যাওয়ার পর নায়লা যে একটা কথা বলেছিলেন সেটা মনে পড়ল। নায়লা বলেছিলেন, “রাগারাগি করি মানে তো এই না যে তোকে ভালোবাসি না, আদর করি না। আমার তো তোর উপর কোনো রাগ নেই, আমার সব রাগ শুধু তোর আব্বার উপর।”
শায়েরী সুতীক্ষ্ণ নজরে কিছুদিন বিষয়টা ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝল নায়লার সমস্যা শায়েরী না। নায়লার মূল সমস্যা শায়েরীর আব্বা। তাই শায়েরীর আব্বাকে জুড়ে সকল কিছুতেই নায়লার সমস্যা এমনকি শিকুতেও। শায়েরী যখন প্রথম বিষয়টা ঠাহর করতে পারল তখন নক্ষত্রের সাথে আলোচনা করল সে বিষয়ে। নক্ষত্রের সাথে ততদিনে তার বিশাল খাতির। এমনকি নক্ষত্রকে সে দাভাইও ডাকতো তখন। প্রহর দাভাই ডাকত তাই সেও ডাকতো। নক্ষত্রের সাথে শায়েরীর তখন নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। একদিন ফোনে নক্ষত্রকে বলে বসল, “দাভাই আম্মা আমার আব্বাকে পছন্দ করে না কেন?”
নক্ষত্র তখন মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। আর শায়েরী নিউ টেন। নক্ষত্র বলল, “কি যা তা বলছ!”
“যা তা বলছি না আমি। আমি টের পাই। শুধু আব্বা না, আম্মা আব্বাকে জুড়ে যা কিছু আছে সবকিছুকেই তীব্রভাবে ঘৃণা করে।”
নক্ষত্র হঠাৎ বলল, “আমি তোমায় বলব তবে একটা শর্তে।”
শায়েরী প্রশ্ন করল, “কি শর্ত?”
নক্ষত্র খানিক ইতঃস্তত করে বলল, “ওয়াদা করো আমাকে তুমি কখনও দাভাই ডাকবে না।”
শায়েরী ফোনের ওপাশ থেকে চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করল, “কেন?”
নক্ষত্র কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। সে খট করে ফোন রেখে দিলো। শায়েরী সারারাত ভাবল কেন দাভাই ডাকতে নিষেধ করল! কেন? শায়েরী ভেবে ভেবে যা বের করল তার মানেটা অন্যরকম। শায়েরী কখনও তেমন করে ভেবে দেখেনি। সেকথা ভেবে শায়েরী শিউরে উঠল। মনে মনে বলল, “এরকম কিছু হলে আম্মা আর মামী মিলে তোকে কুপিয়ে মেরে ফেলবে শায়েরী। এরকম স্বস্তাধারার চিন্তাভাবনা তোর মনে আসে কি করে? দাভাই শুধু তোর ভাই।”
পরদিন শায়েরী আবার ফোন দিলো। কর্কশভাবে বলল, “দাভাই ডাকলে সমস্যা কি?”
নক্ষত্র ভয়ে মিথ্যে বলল, “তুমি আমাকে প্রহরের মতন দাভাই ডাকো সেটা মা পছন্দ করে না। তোমাকে কখন কি বলে বসে তাই ভাবলাম আমিই তোমাকে আগে থেকে না করে দিই। পরে মা সরাসরি তোমায় কিছু বলে ধমকালে তোমার খারাপ লাগবে তাই না করেছি।”
শায়েরী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। বলল, “ঠিক আছে দাভাই নাহয় নাই ডাকলাম।”
এরপর থেকে শুরু হলো নক্ষত্র ভাই ডাকা। নক্ষত্র বেচারা দাভাই থেকে শুধু নক্ষত্র হতে চেয়েছিল কিন্তু তার মনোবাঞ্ছা নক্ষত্র ভাই ডাকের নীচে ভয়ানকভাবে চাপা পড়ল। শায়েরী জিজ্ঞাসা করল, “এবার বলো তোমার ফুফু কেন আমার আব্বাকে এত জ্বালাতন করে, অশান্তি দেয়।”
নক্ষত্র চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি পুরোটা জানি আজু। কিন্তু তোমায় সবটা বলতে পারব না। শুধু এটুকু বলব তুমি যদি ফুফুর জায়গায় থাকতে হয়তোবা তুমিও অপছন্দ করতে।”
“কেন?”
“তা বলব না তোমায়। ফুফু কষ্টে আছে বলেই ফুফাকে কষ্টে রাখে।”
শায়েরী হয়তোবা খানিক জোরাজুরি করে নক্ষত্র থেকে সবটা জেনে নিতে পারত। কিন্তু সে আর জানতে চাইলো না। কারণ পৃথিবীতে সুখে থাকতে হলে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো কম জানা। যে যত বেশি জানে তার যন্ত্রণা তত বেশি। শায়েরীর যেটুকু জানার ছিল সে শুধু সেটুকু জেনে নিয়েছে। এর বেশি সে জানতে চায় না।
.
শায়েরী শিকুর চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙলো দরজায় কড়াঘাতের শব্দে। শায়েরী উঠে বসল। দরজার ওপাশে বিপাশার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। একনাগাড়ে শায়েরীকে ডেকে যাচ্ছে সে। শায়েরী ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে গিয়ে দরজা খুলল। বিপাশা সলজ্জিতভাবে বলল, “আসলে আমি না অনেক রাত করে ডিনার করি। ছোটবেলা থেকেই পড়া শেষ করে একেবারে বারোটায় টেবিল ছেড়ে উঠে তারপর খেতে বসি। তুমি যে কিছু খাওনি একদমই মনে ছিল না আপু। আমি অভ্যাস অনুযায়ী পড়া শেষ করে, ঘুরাঘুরি করে সোয়া বারোটায় এলাম তোমায় ডাকতে। একদম স্যরি। ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাইনা? সারারাত না খেয়ে কাটাবে বলে ভাবলাম ডেকে তুলি। কাল থেকে আর এমন হবে না।”
শায়েরী আশ্বাসের সুরে বলল, “সমস্যা নেই আপু। এমনিতেও ক্ষিধে ছিল না।”
বিপাশা তাড়া দিয়ে বলল, “খেতে এসো এখন। আমি ওভেনে সব গরম করে রেখেছি।”
শায়েরী ঘুমে কাতর হয়ে বলল, “আমি খাব না আপু। ঘুমে দাঁড়াতে পারছি না। এক্সামের কারণে গতরাতেও জেগেছিলাম।”
বিপাশা কড়া গলায় বলল, “উহু একদম এসব চলবে না। খেতে এসো তো। মুখে পানির ঝাপটা দাও ঘুম কেটে যাবে।”
শায়েরী খানিক না না করল। কিন্তু বিপাশা শায়েরীকে টেনে নিয়ে এসে নিজেই চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে মুখ ধুয়ে দিলো। তারপর জোর করে খেতে বসালো। মনে মনে শায়েরী বিপাশার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, “আপু তোমার মতন এত জোস একটা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড আমার খেচর ভাই কি করে যে হলো! খেচর ভাইয়ের কপাল সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতন একটা কপাল। ইশ্ তুমি কী ভীষণ ভালো আপু। তোমাকে আমার এখনই ভাবি বলে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। উহু ভাবি না আমি তোমায় বৌমণি ডাকব।”
বিপাশা শায়েরীকে বিড়বিড় করতে দেখে প্রশ্ন করল, “কি বলছ তুমি? ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি? কি বললে কিছুই তো বুঝলাম না।”
শায়েরী ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আরে তেমন কিছু না।আন্টি কোথায়? আন্টি খাবেন না?”
বিপাশা বার্গারে কামড় বসাতে বসাতে বলল, “মা তো খেয়েদেয়ে কবেই ঘুম দিয়েছে। আমাকে অবশ্য বলেছিল তুমি কি আমার সাথে খাবে নাকি মায়ের সাথে। আমি বলেছিলাম আমি আর শায়েরী একসাথে ডিনার করব। এরপর দিব্যি ভুলে গেলাম। কি যে লজ্জা লাগছে শায়েরী। আমি না সত্যিই স্যরি। মা যদি কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার কাণ্ডখানা জানতে পারে তবে বিশাল বকুনি দিবে আমায়।”
“আরে ধুর আন্টিকে বলতে যাবে কে? বলার দরকার নেই।”
বিপাশা খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে বলল, “থেঙ্ক ইউ থেঙ্ক ইউ বাঁচালে আমায়। চিরকৃতজ্ঞ রহিব তোমারো তরে।”
বিপাশা এমন ভাবে থেঙ্ক ইউ বলল যে শায়েরী হেসে ফেলল। বিপাশা বলল, “মিষ্টি মেয়ে হেসো না তো। আমার ভাইটাই থাকলে তোমাকে ভাইয়ের বউ বানিয়ে ফেলতাম। তুমি হাসলেই আমাদের বাসায় তখন মুক্তোদানা ঝরে ঝরে পড়ত!”
শায়েরী শব্দ করে হেসে বলল, “আমার ভাই আছে তো। আমি নাহয় এখন উল্টো কাজটা করে ফেলি।”
বিপাশা পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “ইয়াহ্ শিকুকে বিয়ে করা যায়। শুনেছি জোস ক্রিকেট খেলে। শিকুটা বড় হয়ে বিরাট কোহলি হবে আর আমি হব আনুশকা শার্মা। দারুন না?”
শায়েরী মুখ টিপ হাসলো। মনে মনে বলল, “অ্যাহ্ এমন ঢং করো তোমরা দুজন যেন আমি কচি খুকি। খুব ভালো করেই তোমার আর নক্ষত্র ভাইয়ের ইটিশ পিটিশ সম্পর্কে জানা হয়ে গেছে আমার। পিচ্চিকাল থেকেই তো ইটিশপিটিশ শুরু করলে। সাধে কি আর নক্ষত্র ভাই দশ বছর ধরে ভালোবাসে এই কথা বলে!”
চলবে…